তথাকথিত ‘সমাজতান্ত্রিক’ দেশসমূহ

The so-called ‘Socialist’ Countries

 

রাষ্ট্রের হাতে পুঁজিকে কেন্দ্রীভূত ক'রে , উৎপাদনের উপকরণের ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান এবং বুজোর্য়া শ্রেণীর উচ্ছেদের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ । ‘এক দেশে সমাজতন্ত্রের' স্তালিনীয় তত্ত্ব দিয়ে কিছু রাষ্ট্রকে ‘সোসালিষ্ট' অথবা ‘কমিউনিষ্ট' নামে চিহ্নিত করা বা ‘সমাজতন্ত্রের পথে অগ্রসরমান' ব'লে প্রচার করার মত ডাঁহা মিথ্যার উৎস হলএই বিভ্রান্তিই।     

শুধু সম্পত্তি মালিকানার আইনগত বিচার বিভাগীয় (Juridical) রূপের মধ্যেই রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের প্রবণতার ফলে সংঘটিত পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করা যায়, উৎপাদনের বুনিয়াদী সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার কোন প্রভাবই চোখে পড়ে না । এই সব পরিবর্তন উৎপাদনের উপকরণের ব্যক্তিগত মালিকানার (উৎপাদন সম্পর্কগত দিকটার) নয়,তার আইনগত বিচারবিভাগীয় (juridical) দিকটারই কেবল অবসান ঘটায় । শ্রমিকদের অবস্থান থেকে বিচার করলে দেখা যাবে উৎপাদনের উপকরণগুলো ব্যক্তিগত সম্পত্তিই থেকে গেছে। আমলাতন্ত্রের(bureaucracy) জন্য উৎপাদনের উপকরণগুলো ‘যৌথ মালিকানায়' আনা হয় মাত্র ।আমলাতন্ত্রই যৌথভাবে এগুলোর পরিচালনা করে এবং মালিকানা ভোগ করে ।

শ্রমিকশ্রেণীর  উদ্বৃত্ত শ্রমশোষণ ও জাতীয় পুঁজি সঞ্চয়ের নিদির্ষ্ট অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালনকারী রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রই হয়ে ওঠে একটি শ্রেণী । কিন্তু এটা কোন নতুন শ্রেণী নয় । রাষ্ট্রীয়কৃত (Statified ) রূপে সেই একই পুরনো পুঁজিপতি ছাড়া যে এটা অন্য কিছুই নয় , এই ভূমিকা থেকেই সেটা স্পষ্ট । শ্রেণী হিসেবে বিশেষাধিকারের প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের ক্ষেত্রে বৈশিয্ট্যসূচক দিকটি হল এই যে , পুঁজির ব্যক্তিগত মালিকানার আয় তার উৎস নয় । চালু রাখা ও পরিচালনার জন্য খরচা (running cost), বোনাস এবং কাজের গুণাগুণের বিচারে  নিদির্ষ্ট পদ্ধতিতে প্রদত্ত এর পারিশ্রমিকই হচ্ছে এর উৎস। এই পারিশ্রমিক দেখতেই শুধু ‘মজুরির' মত, আসলে মজদুরদের যে মজুরি দেওয়া হয় ,তার থেকে এটা প্রায়ই কয়েক দশক বা শতক গুণ বেশি হয়ে থাকে।

রাষ্ট্র ও আমলাতন্ত্র কতৃর্ক পুঁজিবাদী উৎপাদনের কেন্দ্রীকরণ (centralization) ও পরিকল্পনা শোষনের অবসানের পথে কোন পদক্ষেপ তো নয়ই বরং দক্ষতার সঙ্গে শোষনকে তীব্রতর করারই উপায় মাত্র ।

অর্থনৈতিক স্তরে রাশিয়া কখনোই, এমন কি শ্রমিকশ্রেণীর দখলে রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকার সংক্ষিপ্ত সময়কালেও , পুঁজিবাদকে অবলুপ্ত করতে সমর্থ হয় নি । প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয় এবং পরে গৃহযুদ্ধের বিশৃংখল পরিস্থিতির দরুণ অথর্নৈতিক ক্ষেত্রের লন্ডভন্ড অবস্থা (economic disorganization) ,পতনশীল বিশ্বপুঁজিবাদী ব্যবস্থায় জাতীয় পুঁজি হিসাবে রাশিয়ার অস্তিত্বকে অনেক বেশি কঠিন করে তুলেছিল বলেই , রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ সেখানে অত্যন্ত বিকশিত রূপে , এত দ্রুত শেকড় গেড়ে বসল ।

প্রতিবিপ্লবের বিজয় সূচিত হল রাশিয়ার জাতীয় অথর্নীতিকে পুনরায় সংগঠিত রূপদানের কর্মসূচিরূপে আর এতে কাজে লাগানো হল রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের সবথেকে  বিকশিত রূপ গুলোকে আর এ গুলোকে নির্লজ্জভাবে উপস্থাপিত করা হল ‘অক্টোবরের ধারাবাহিকতা' এবং ‘সমাজতন্ত্রের নিমার্ণ' হিসাবে । এই দৃষ্টান্তই অনুসরন করা হল চীন, পূর্ব ইউরোপ , কিউবা , উত্তর কোরিয়া , ভিয়েতনাম  ইত্যাদি  দেশে। যাইহোক না কেন , প্রলেতারিয় বা কমিউনিষ্ট বলে কোনো কিছুই এ সব দেশের কোনোটাতেই নেই । আসলে এসব দেশে চূড়ান্ত অবক্ষয়ী পুঁজির ধরণে পুঁজিবাদী একনায়কত্বেরই শাসন শোষন চলে সমাজতন্ত্রের নামে। ইতিহাসের চরম মিথ্যাগুলোর অন্যতম এই মিথ্যাচার। তাই যতই সমালোচনামূলক (critical)বা শতার্ধীন(conditional) হোক না কেন এই সব দেশের কোনরকম সমর্থন বা পক্ষাবলম্বন ,সম্পূর্ণরূপে প্রতিবিপ্লবী ক্রিয়াকলাপ ছাড়া আর কিছুই নয় ।