Communist Internationalist - 2008

 

ইন্টারন্যাশানাল কম্যুনিস্ট কারেন্ট আয়োজিত আলোচনা সভা

বামপন্থা, অতিবামপন্থা এবং কম্যুনিজম্‌ তারিখ: ২৭শে এপ্রিল, ২০০৮   বিষয় উপস্থাপনা

প্রিয় সাথী,

সকলকে আইসিসি'র পক্ষ থেকে স্বাগত জানাই। আপনাদের মধ্যে অনেকেই জানেন আইসিসি, মানে ইন্টারন্যাশানাল কম্যুনিস্ট কারেন্ট ধারাবাহিকভাবে সারা পৃথিবী জুড়েই শ্রমিকশ্রেণির সচেতনতা বিকাশে সাহায্য করতে সচেষ্ট।  বর্তমান সময়কালে শ্রমিকশ্রেণির সচেতনতার অর্থ কী হবে, তার বর্তমান সংগ্রামের গতিপ্রকৃতি কী হবে, কম্যুনিজমের পথে এগোনোর জন্য শ্রেণির আজকের কর্তব্য কী ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন, খোলামেলা আলোচনা এবং স্বচ্ছতা অর্জনের নিরলস প্রয়াস আজকের দিনে আমাদের কর্তব্য ব'লে আইসিসি মনে করে এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে তা পালন করার চেষ্টা করে। ভারতে আজকের এই আলোচনা সভা সেই স্বচ্ছতা অর্জনেরই একটা প্রয়াস হিসেবে দেখতে হবে এবং আইসিসি তার রাজনৈতিক কর্তব্য হিসেবেই এই আলোচনা সভা আয়োজন করেছে।  

প্রথমতঃ এই বিষয়টা কেন আমরা রেখেছি তা নিয়ে অবশ্যই দুকথা বলার দরকার আছে। ভারতীয় প্রেক্ষাপটেই শুধু নয়,সারা পৃথিবীতেই বামপন্থা এবং অতিবামপন্থার নানান ভ্যারাইটি আমরা দেখতে পাই এবং চলতি ধারণা মোতাবেক এদের কমর্কান্ডের সঙ্গে কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রামকে এক ক'রে দেখানো হয়। যখন মেলে না তখন এক বিরাট শূণ্যতার বোধ আমাদেরকে গ্রাস করে। সত্যিকারের কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রাম আর এদের সংগ্রামের মঝে এক বিরাট ফাঁক আজ যেকোন মানুষের চোখে পড়ে। কিন্তু বোঝা যায় না কিভাবে এটা ব্যাখ্যা করা যায় এবং কিভাবেই বা শ্রমিক শ্রেণির কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রাম সম্ভব বা আদৌ তার আর কোন তাৎপর্য আছে কিনা। এর ফলে অনেক মানুষ যাঁরা তাঁদের জীবনের অনেকটা সময় শ্রমিকশ্রেণির মুক্তির জন্য ব্যয় করতে চেয়ে অত্যন্ত সততার সংগে হয় কোন না কোন গ্রূপ বা দলের হয়ে কাজ করেছেন বা করছেন, অর্ন্তদন্দ্বে ভুগছেন অথবা সঠিক বিকল্প অনুসন্ধান করছেন অথচ কোন পথের দিশা বা আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে সঠিক এবং সুসংহত একটা ফ্রেমওয়ার্ক পাচ্ছেন না তাঁদের কাছে আজকের দিনে এই বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব'লে মনে হয়েছে।

দ্বিতীয়তঃ, শ্রমিকশ্রেণির প্রধান হাতিয়ার তার সচেতনতা এবং তার সংগঠন। সত্যিকারের শ্রেণিসংগঠনের রূপরেখা কী হতে পারে, আদৌ এইসমস্ত ধরণের বামপন্থার সাথে তার বিন্দুমাত্র কোন যোগ আছে কিনা, তা বুঝতে না পারলে শ্রেণি তার আজকের সংগ্রামের দিকদিশা ঠিক করতে পারেনা। এক্ষেত্রে তার সামনে সবচেয়ে বড় বাধা তার সনাতনভাবে লালিত এই ধারণা যে বামপন্থা তা সে যেমনই হৌক, পারলিয়ামেনটারি অথবা বিপরীত তা শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থের সংগে সংস্লিষ্ট।

তৃতীয়তঃ, সারা বিশ্বজুড়ে শ্রমিকশ্রেণি আবার সংগ্রামের মন্চে হাজির হচ্ছে। সারা পৃথিবী জুড়েই সচেতনতা অর্জনের প্রয়াসে নতুন জোয়ার এসেছে। আজ পুঁজিবাদী বর্বরতার পর্যায়ে মানব অস্তিত্ব বিপন্ন। এঅবস্থায় সচেতনতার মূর্ত নির্দিষ্ট অর্থ হ'ল কম্যুনিজমের অপরিহার্যতার উপলব্ধি, কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রামকে বিকশিত করা; আর এই লক্ষ্যেই আমাদের প্রথম দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় সংগ্রামের সামনে বাধাগুলো সম্বন্ধে স্বচ্ছতা অর্জন। যে রাজনীতি কম্যুনিজমের নামে   কম্যুনিজমের ঠিক বিপরীত ধারাকে শ্রমিকশ্রেণির ওপর চাপিয়ে দিয়েছে এবং আজো তাইই ক'রে চলেছে, তার স্বরূপ উন্মোচন করা আমাদের দায়িত্ব।

বিষয়ে আসা যাক।

আমরা জানি পুঁজিবাদী সমাজের বিবর্তনের পথে তার বস্তুগত পরিস্থিতির বদলের সঙ্গে শ্রেণিসংগ্রামের গতিপ্রকৃতি ও দিকদিশা বদলায়। প্রকৃতপক্ষে এই দুইয়ের একটিকে অন্যটির সাথে বিচ্ছিন্ন ক'রে দেখা  যায় না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা সামন্ততন্ত্রের গর্ভ থেকে জন্মলাভ ক'রে দীর্ঘ বুরজোয়া বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে গেছে এবং নিজেকে সমৃদ্ধতর করতে থেকেছে। তারপর নিজ নিয়মেই সেটা বিকাশের চূড়ান্ত পর্যায় অতিক্রম ক'রে ক্ষয়ের পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। আর এই দীর্ঘ কাল পর্বে শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রামেরও বিবর্তন ঘটেছে। বিকাশের পর্ব থেকে ক্ষয়ের পর্বে যেমন পুঁজিবাদ পৌঁছেছে তেমনই শ্রেণিসংগ্রামও   সংস্কারমূলক কর্মসূচির কালপর্ব থেকে প্রলেতারীয় বিশ্ব বিপ্লবের কর্মসূচির কাল পর্বে পৌঁছেছে। ফলতঃ বিপ্লবী লক্ষ্যের সাপেক্ষেই তার সংগ্রামের প্রকৃতি, উপায় ইত্যাদিরও বদল ঘটেছে।

পুঁজিবাদের বিকাশের দশা বা Ascendant phase-র   প্রধান বৈশিষ্ট হ'ল এই পর্যায়ে পুঁজির সম্প্রারণের পথে কোন মৌলিক বাধা নেই, সমগ্র উৎপাদন সম্পর্ক উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যে একটা তালমেল আছে, শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রামগুলোর প্রধান লক্ষ্য আশু দাবীদাওয়া ভিত্তিক যা মূলতঃ তার জীবনযাপনের মানকে আরো উন্নত করবে, সুনিশ্চিত করবে, রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্রীয় কাজে আর প্রত্যক্ষ যোগ থাকবে(পার্লামেনটে অংশ নেওয়া)। এককথায় এই পর্যায়ের রাজনীতি চালিত হয়েছে সংগ্রাম এবং সহাবস্থান এই ভিত্তিতে। অবশ্য এই পর্যায়েই শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রামের ঐতিহাসিক লক্ষ্য স্থিরীকৃত হয়ে গেছে: কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টোয় মার্কস তারই ঘোষণা করেছেন সুস্পষ্ট ভাষায়। বোঝা গেছে কম্যুনিজম কোন ইউটোপিয়া নয়, কোন ভাবাদর্শ নয়, এ হ'ল বাস্তবে অর্জনযোগ্য  শ্রেণিহীন শোষনহীন রাষ্ট্রীয় সীমানাহীন একটা বিশ্বব্যবস্থা, সমাজ গতির মধ্যেকার ক্রিয়াশীল দন্দ্বগুলোর পরিণতিতে এটা হয়ে ওঠে সম্ভবপর এবং অপরিহার্য। আর এর জন্য সংগ্রাম করতে, তাকে সফল ক'রে তুলতে পারে একমাত্র শ্রমিকশ্রেণি। তবে পুঁজির বিকাশের সেই পর্বে কম্যুনিজম   আশু কর্মসূচি হয়ে ওঠে নি।

পুঁজিবাদের ক্ষয়ের পর্যায়ের (decadence) প্রধান বৈশিষ্ট হ'ল বাধাহীনভাবে পুঁজির সম্প্রসারণে স্থায়ী সংকট। বিশ্বজুড়ে বৃহৎ পুঁজির মধ্যে বিশ্ববাজারটা একবার দখল হয়ে যাবার পর তার বাজারের সংকট স্থায়ী রূপ লাভ করতে থাকে।। এর ফলে অনিবার্য হয়ে ওঠে বাজার পুণর্দখলের লড়াই: দুদুটো বিশ্বযুদ্ধ তারই সুস্পষ্ট প্রতিফলন। বিংশশতাব্দীর প্রারম্ভ থেকেই মোটামুটিভাবে সুস্পষ্ট হতে থাকা এই পর্যায়কে সাম্রাজ্যবাদের যুগ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন লেনিন এবং বলেছেন এ হ'ল "মূমূর্ষ পুঁজিবাদ" (সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়"-লেনিন, ১৯১৬)। শ্রমিকশ্রেণির দিক থেকে তাই এই যুগ আর কোন দাবী দাওয়া আদায়ের সংগ্রামের যুগ নয়: এ হ'ল প্রলেতারীয় বিশ্ববিপ্লবের যুগ। এই পর্যায়ে তাই তার কাছে কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রামটা নিছক শ্লোগান থাকতে পারেনা, বরং তার সংগ্রামের গতিপ্রকৃতি হয়ে ওঠে কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রামের অভিমুখী। বর্তমান পর্যায় সেই কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রামের পর্যায়।   সহাবস্থান বজায় রেখে সংগ্রাম   নয়,এ হ'ল পুঁজিবাদের উচ্ছেদের জন্য সংগ্রামের পর্যায়।

দুই পর্যায়ের রাজনীতি তাই শ্রমিকশ্রেণির কাছে একইরকম হতে পারেনা।

 আমরা দেখি পুঁজির বিকাশের দশায় সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিগুলোর প্রধান কাজ ছিল দাবীদাওয়াভিত্তিক সংগ্রামগুলো সংগঠিত করা, তাকে নেতৃত্ব দেওয়া। তখনও অব্দি বুর্জোয়াদের মধ্যে থেকে প্রগতিশীল বুর্জোয়া অংশ খুঁজে পাওয়া যেত যাদের কে প্রলেতারিয়েত কোন কোন প্রশ্ন সমর্থন করত পারত এবং তা শ্রমিকশ্রেণির তৎকালীন স্বার্থের পক্ষে সহায়কই হত।   দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মধ্যে বহুরকম "গণসংগঠন" গড়ে তোলার প্রোগ্রাম ছিল, ছিল পার্লামেন্টে অংশগ্রহনের কর্মসূচি। কম্যুনিজম ছিল সর্বদাই একটা দূরের বস্তু, শেষ লক্ষ্য। এরই অধীনে যেসব পার্টিগুলো  কাজ করত তাদেরকেই বলা হত বামপন্থী দল এবং তারা ছিল মূলতঃ সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি হিসেবে পরিচিত।   কম্যুনিজম তাদের কাছে আশু লক্ষ্য ছিল না আর তাই সংস্কারমূলক কাজ কর্মের মধ্যে নিয়োজিত থাকাটা ছিল শ্রমিকশ্রেণির রাজনীতিরই অংগ।  

কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ইতিহাসের সেই পর্যায়কে চিহ্নিত করল এই ব'লে যে পৃথিবী এক নূতন যুগে প্রবেশ করেছে-  সাম্রাজ্যবাদী বর্বরতা অথবা সমাজতন্ত্র এ‌ই হ'ল এযুগের দুই বিকল্প। সুতরাং শ্রমিকশ্রেণির রাজনীতিতে এক মৌলিক পরিবর্তন ঘটল: তার আশু এবং চূড়ান্ত সংগ্রাম সমার্থক হয়ে দাঁড়াল, বিপ্লবই হয়ে দাঁড়াল তার একমাত্র কর্মসূচি। সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিকযুগের সংস্কারমূলক সংগ্রাম সেকেলে হয়ে পড়ল, শ্রমিকশ্রেণি ট্রেডইউনিয়নের সংগ্রাম ছেড়ে "মাস-স্ট্রাইক"-র রাস্তা দেখাল। লেনিনসহ রোজা লুক্সেমবার্গ, কার্ল লিবনেখ্‌ট, পানেকোয়েক ইত্যাদি অগ্রণী কমরেডরা নতুন যুগের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি অনুযায়ী শ্রেণির সংগ্রামের পথ নির্দেশিকা হাজির করলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে এরই পরিণত প্রতিফলন ঘটল এই বিখ্যাত অবস্থানের মধ্য দিয়ে: সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের সবকটা পক্ষই সমান প্রতিক্রিয়াশীল এবং সাম্রাজ্যবাদী; এর মধ্যে কোন পক্ষই শ্রমিকশ্রেণি গ্রহণ করতে পারেনা। তার কাজ সাম্রাজ্যবাদী এই  যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধে পরিণত করা। সোজা বাংলায় যার মানে হ'ল বিশ্বজুড়ে প্রলেতারীয় বিপ্লব সংগঠিত করা। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মধ্যে বেশিরভাগ অংশই এই লাইনকে মেনে নেয়নি। 

 প্রথম বিশ্বযুদ্ধে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক  শ্রমিকশ্রেণিকে এক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অপর সাম্রাজ্যবাদী পক্ষ অবলম্বন করতে আহ্বান জানাল।     জাতীয়তাবাদের ধারণাকে উস্কে দিয়ে এভাবেই এক অংশের শ্রমিকশ্রেণিকে অন্য অংশের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিল; ফলে শ্রমিকশ্রেণির আন্তর্জাতিকতার কোন প্রশ্নই দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মধ্যে রইল না। স্পষ্টতই লেনিনসহ মাইনরিটি অংশ দ্বিতীব আন্তর্জাতিকের রাজনীতি পরিত্যাগ করলেন। ঘোষণা করলেন দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক মৃত। এভাবে ইতিহাসের বিপ্লবী যুগের সূচনাতেই আমরা দেখলাম শ্রমিকশ্রেণির রাজনীতিতে দুটি সুষ্পষ্ট ধারা: একটি অধঃপতিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের, অন্যটি লেনিন, রোজা ইত্যাদিদের মাইনরিটি ধারা। ইতিহাস দেখিয়ে দিয়েছে কোন্ ধারাটি প্রকৃত বিপ্লবী লাইনের প্রতিনিধিত্ব করেছে। লেনিনেরা সংখ্যায় অল্প ছিলেন কিন্তু প্রলেতারীয় অবস্থান নেওয়ার প্রশ্নে তাঁরাই প্রকৃত বিপ্লবী ধারার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। বিপরীতে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের রাজনীতি শ্রমিকশ্রেনীর প্রতি বেইমানিই করেছে, কারণ শ্রমিকশ্রেণি সারা পৃথিবী জুড়ে সাম্রাজ্যবাদী নিধনযজ্ঞের শিকারই হয়েছে। মুখে-আন্তর্জাতিকতার বিপরীতে লেনিনেরা বাস্তবে আন্তর্জাতিক শ্রেণিলাইনটি আঁকড়ে ছিলেন যারই ধারাবাহিকতায় পৃথিবীতে প্রথম সফল প্রলেতারীয় বিপ্লব সংঘটিত হ'ল রাশিয়ায়। তার ঢেউ আছড়ে পড়ল সারা ইউরোপে- জার্মানি হয়ে উঠল বিশ্ব প্রলেতারীব বিপ্লবের সাফল্যের নির্ধারক শক্তি। আর সেই জার্মানেই আমরা বিপ্লবকে পরাজিত হতে দেখলাম দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের অন্তর্গত সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিগুলোর বেইমানির কারণেই।   সেই সময় থেকেই বাস্তবতঃ বামপন্থী সোস্যাল ডেমোক্র্যাসির সঙ্গে কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রামের সম্পর্ক রইল না। যদিও তারা টিকে রইল কিন্তু তাদের অস্তিত্ব শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রামকে বেপথু করা ছাড়া শেষ বিচারে কিছুই করে নি। জার্মানিতে প্রতিবিপ্লবের বিজয় তারই সুনিশ্চিত প্রমাণ।  

১৯১৭-র রুশ বিপ্লব দিয়ে শুরু হল শ্রমিক শ্রেণির প্রথম বিশ্বজোড়া বিপ্লবের ঢেউ। সেই ঢেউ শেষঅব্দি পরাজিত হ'ল। শ্রমিকশ্রেণির এই পরাজয়  তার শ্রেণি সচেতনতার ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব বিস্তার করল। তার হেরে যাওয়ার ওপর ভিত্তি করেই ক্রমাগত সেই ধারার বিকাশ এবং বিস্তার ঘটতে থাকল যা লেনিনেরা পরিত্যাগ করেছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালেই।  বিজয়ী রুশ বিপ্লবের ওপর ভিত্তি করেই যে বিপ্লবী শিক্ষা দুনিয়ার শ্রমিক শ্রেণি অর্জন করছিল, তারই ওপর ভিত্তি ক'রে তৃতীয় আন্তর্জাতিক গঠিত হয়েছিল। তার মূল লক্ষ্যই ছিল বিশ্ব বিপ্লবকে জয়ী করা। কিন্তু সেই বিপ্লবী তরংগে যখন ভাটা এল, তখন সেই ভাটার হাত ধরেই তার মধ্যে ফিরে আসতে থাকল সেই রাজনৈতিক অবস্থানের কথা যা লেনিনেরা পরিত্যাগ করেছিলেন দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সময়কালেই। এল বুরজোয়াদের সংগে ইউনাইটেড ফ্রন্ট গঠনের রাজনীতি, ফিরে এল সংস্কারমূলক কর্মসূচির জন্য লড়াই, ট্রেডইউনিয়নিজম, ফিরে এল পার্লামেন্টে অংশ গ্রহণের রাজনীতি, ফিরে এল বাণর্স্টাইনের শান্তিপূর্ণ সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব, ফিরে এল সেকেলে হয়ে যাওয়া এবং বাস্তবতই ভিত্তিহীন হয়ে পড়া বুরজোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তত্ত্ব অর্থাৎ এককথায় সেইসবকিছু যা পুঁজির বিকাশের যুগের শ্রমিকশ্রেণির রাজনীতির সঙ্গে খাপ খায়। আন্তর্জাতিকতার প্রশ্নটি একটি বাগাড়ম্বরে পরিণত হল।  রাশিয়ার সফল বিপ্লব শেষ অবধি অধঃপতিত হতে হতে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদে রূপলাভ করল।    আর এরই ধারাবাহিকতায় এল ইতিহাসের ভয়ংকরতম শ্রমিকশ্রেণি বিরোধী লাইন যা এর আগে কোন কম্যুনিস্ট কোনদিন কল্পনাও করতে পারেননি: ঘোষিত হ'ল: একদেশে সমাজতন্ত্র সম্ভব! যদি একদেশে সমাজতন্ত্র সম্ভব হয় তাহলে আন্তর্জাতিকের  দরকার থাকে না।  সেটা আর দুনিয়ার শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী সংগ্রামকে নেতৃত্ব দিতে পারেনা।

ইতিহাসের সেই পর্বে তৃতীয় আন্তর্জাতিকের মধ্যে কি তবে কোন ডিবেট ছিল না? কোন অংশই কি সেদিন ছিল না যারা দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মধ্যে লেনিনেরা যা ভূমিকা পালন করেছিলেন সেই একই ভূমিকায় কমিনর্টানের মধ্যে প্রলেতারীয় লাইনকে তুলে ধরেছেন, আন্তর্জাতিক শ্রেণি লাইনকে প্রাণপণে রক্ষা করার লড়াই করেছেন? আমরা কি কখনও তাদের ইতিহাস ঘেঁটে দেখেছি? আসলে আবারো আমরা দেখব দুটি ধারার বিভাজন: একটি ধারা যা শ্রমিক শ্রেণির নামে বুরজোয়াদেরই স্বার্থরক্ষাকারী ধারা যাদেরকে আজ আমরা বামপন্থী হিসেবে চিনি এবং এদের সাথে কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রামের কোন সম্পর্ক নেই। অপর ধারা যেটা কমিনটার্ণের মূল মার্কসীয় ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে, প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাকে একমূহুর্তের জন্যও পরিত্যাগ করেনি। বরং যাদেরকে   ইন্টারন্যাসনাল থেকে বের ক'রে দেওয়া হয়েছিল বা যারা অধঃপতিত হতে থাকা ইন্টান্যাশনাল থেকে নিজেরাই বেরিয়ে এসেছিল শ্রমিকশ্রেণির অবস্থানকে রক্ষা করতে।এদের মধ্যে ইটালিয়ান লেফ্‌ট্, জার্মান লেফ্‌ট্ ইত্যাদি অংশের ঐতিহাসিক ভূমিকা অপরিসীম। ইতিহাসে এরা কম্যুনিস্ট লেফ্‌ট্ নামে পরিচিত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই দুই ধারার মৌলিক অবস্থানই আমাদের নিশ্চিতভাবে চিনতে সাহায্য করে কোন্ ধারাটি প্রলেতারিয়েতের বিপ্লবী অংশের প্রতিনিধিত্ব করেছে। আমরা জানি তৃতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেসে সকলেই " সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে কোন পক্ষ নেওয়া নয়, আসল কাজ তাকে গৃহযুদ্ধে পরিণত করা" এই অবস্থান গ্রহণ করেছিল কারণ মার্কসের ভাষায় প্রলেতারিয়েতের কোন ‘পিতৃভূমি" নেই, থাকতে পারেনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই অবস্থানকে আঁকড়ে ধরার আহ্বান রেখেছিল কারা? সেই মাইনরিটি অংশ যারা লেনিন রোজা ইত্যাদিদের যোগ্য উত্তরসূরি। এই মাইনরিটি ধারার নাম কী? ইতিহাসে এদের নামকরণ হয়েছে কম্যুনিস্ট লেফ্‌ট্।  বিপরীতে স্ট্যালিনের আহ্বান কী ছিল? পিতৃভূমি রক্ষার লড়াই। এ পিতৃভূমি কার? নিশ্চয়ই বুরজোয়ার রাশিয়া যার একটি অংশ।, নিশ্চয়ই সারা পৃথিবী জুড়ে শ্রমিকশ্রেণির মানুষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়ার চক্রান্ত বুরজোয়া রাজনীতিরই অঙ্গ। এই রাজনীতিই কম্যুনিস্ট লেফ্‌টদের সংগ্রামের ইতিহাস মুছে দেওয়ার চেষ্টা করেছৈ। মার্কসবাদের নামে একটি ধারা সারা পৃথিবীতে লালন করেছে বামপন্থী দলগুলো, যাদের ভিত্তি হল অধঃপতিত হতে থাকা কম্যুনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের রাজনৈতিক অবস্থানগুলো।  

   একদিন দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক থেকে লেনিনদের একটি ছোট্ট অংশ বেরিয়ে এসেছিলেন শ্রমিকশ্রেণির প্রকৃত অবস্থানকে আঁকড়ে ধ'রে, ঠিক তেমনই সেই বিপ্লবীদের প্রকৃত মার্কসীয় ধারাকে অব্যাহত রাখার জন্য অধঃপতিত তৃতীয় আন্তর্জাতিকের রাজনীতিকে পরিত্যাগ ক'রে শ্রমিকশ্রেণির  প্রকৃত আন্তর্জাতিকতার অবস্থানকে গ্রহণ ক'রে এবং তাকে বিকশিত ক'রে তোলার কাজে যাঁরা হাত লাগিয়েছিলেন তাঁরাই ‘কম্যুনিস্ট লেফ্‌ট্ কারেন্ট"। এঁরা বামপন্থী নন, এঁদের গ্রূপ বা কারেন্ট কোন শ্ট্যালিনীয় বা মাওবাদী বা ট্রটস্কিবাদী অফিসিয়াল ধারাকে প্রতিনিধিত্ব করে না, এরা হ'ল কম্যুনিস্ট লীগ থেকে শুরু ক'রে, তিনটি আন্তর্জাতিকের যা কিছু বিপ্লবী ঐতিহ্য তারই ধারাবাহিকতার ফসল, তারই প্রকৃত উত্তরাধিকারী: এখানেই বামপন্থার সঙ্গে কম্যুনিস্ট লেফ্‌টের মৌলিক তফাৎ। বিপ্লববিরোধী রাজনীতির বিপুল ঢেউয়ের তলায় চাপা দিয়ে দেওয়া হয়েছে এদের সমস্ত প্রয়াসকে। ইন্টারন্যাশানাল কম্যুনিস্ট কারেন্ট সেই কম্যুনিস্ট লেফ্‌টের অংশ, তাদেরই আরধ্য কাজেরই ধারাবাহিকতায় আইসিসি তার আজকের কর্মকান্ড পরিচালনা করছে। লেনিন যে কম্যুনিস্ট লেফ্‌টদের ছেলেমানুষ বলেছিলেন ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে তাদের অবস্থানই আজ আরো সুসংহত এবং সত্যরূপে প্রকাশিত হয়েছে। স্পষ্টতই, বামপন্থার হাজার ভ্যারাইটির মধ্যে এবং তাদের থেকে ভেঙে বেরিয়ে আসা হাজারটা দল উপদল থেকে বা আপাত রা‌ডিক্যাল অতিবামপন্থা, তৃতীয় ধারা, চতুর্থ ধারা ইত্যাদির মধ্যে আমাদের কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রামের একটি কণাও খুঁজে পাওয়া যাবে না, কেননা তাদের প্রতিটি অবস্থানই আজকের যুগে সেকেলে হয়ে পড়েছে  তা সে যতই মার্কসবাদের নাম দিয়ে বিশুদ্ধ করে তোলার চেষ্টা হোক। বিপরীতে কম্যুনিস্ট লেফ্‌টরাই প্রকৃতঅর্থে কম্যুনিজমের সংগ্রাম বিকাশের ধারার প্রতিনিধিত্ব করেছে এবং করছে। এইসব বামপন্থী দলের অস্তিত্ব আজ কোন না কোনভাবে বুরজোয়াদেরই স্বার্থ সুরক্ষিত করতে বাধ্য। যদিও এইসব বামপন্থী দলে যুক্ত মানুষের মধ্যে অনেক মানুষ আছেন যাঁরা অকৃত্রিম সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গেই কমিউনজিমের জন্য সংগ্রাম করতে চান।       

সুতরাং আজ কমিউনিজমের জন্য সংগ্রামে রত মানুষের কাছে ইতিহাসের একটি সত্য উপলব্ধি করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে যে বামপন্থার সঙ্গে কমিউনিজমের জন্য সংগ্রামের কোন সম্পর্ক নেই। যাঁরা দীর্ঘ সময় ধ'রে কোন না কোনভাবে এই কাজে রত আছেন বা থাকতে চান তাঁদের প্রয়াসের সততায় কোন সন্দেহই থাকতে পারেনা। তাই তাঁদের যুক্তিবোধ, মার্কসীয় আলোকে সবকিছুকে বারাবার ফিরে দেখার যে প্রয়াস তাকে স্বাগত জানিয়ে আশা করব আসুন আমরা খোলামেলা আলোচনার ভেতর দিয়ে স্বচ্ছতর হবার চেষ্টা করি। আমরা কেউই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর নিয়ে বসে নেই, কিন্তু প্রলেতারিয়েতের কাছে যৌথ আলোচনার ভেতর দিয়ে সঠিকতায় পৌঁছোনোর প্রয়াস সর্বদাই ছিল, আছে, থাকবে।

উপস্থাপনার পর্ব শেষ। আমরা আশা করব সকলের সম্মিলিত আলোচনায় আজকের সভা প্রাণবন্ত, ফলপ্রসূ হয়ে উঠবে এবং ভারতবর্ষে প্রলেতারীয় রাজনৈতিক চর্চার ক্ষেত্রে তা একটি সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে। এখানে আপনাদের মতামত, প্রশ্ন, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, বিরোধ যা আছে তা নির্দ্বিধায় রাখার অনুরোধ করছি।

অভিনন্দনসহ,

ইন্টারন্যাশনাল কম্যুনিস্ট কারেন্ট

২৭ ০৪ ০৮

১৯২৯-২০০৮ – পুঁজিবাদ হয়ে উঠেছে একটা দেউলিয়া ব্যবস্থা সম্ভব হয়ে উঠেছে অন্য এক বিশ্বব্যবস্থা: কমিউনিজম

বিশ্ব ব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের গভীরতা বোঝাতে তাবড় অর্থনীতিবিদ এবং রাজনীতিবিদেরা আজ হতবাক। কেউ বলেছেন "অতল খাদের কিনারে", কেউবা বলছেন "অর্থনৈতিক সুনামি", কারোর মতে "অর্থনৈতিক পার্ল হারবার" কারোর বা "অথর্নীতির ৯/১১"[1] তবে "টাইটানিক"-র সঙ্গে তুলনাটাই কেবল বাদ গেছে। আসলে ঠিক কী ঘটছে? এক নগ্ন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু উদ্বেগজনক প্রশ্ন উঠে আসছে: আমরা কি ১৯২৯-র মতই এক নতুন বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি? কিভাবে এই অবস্থার সৃষ্টি হল আর কিভাবেই বা আমরা এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে পারি? আচ্ছা,কিরকম পৃথিবীতেই বা আমরা বাস করছি?

আমাদের জীবনযাত্রার মান নির্মম অবনমনের দিকে

এব্যাপারে সত্যিই কোন সন্দেহ নেই। সমগ্র বিশ্বজুড়ে মানবতা তার অস্তিস্ত্বের ভয়াবহতম অবক্ষয়কে প্রত্যক্ষ করতে চলেছে। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ভান্ডার (আই এম এফ) তার সাম্প্রতিক রিপোর্টে ঘোষণা করেছে যে ২০০৯ সালের প্রথমার্ধের মধ্যেই দুর্ভিক্ষ কবলিত দেশগুলোর তালিকায় আরো ৫০টি নতুন নাম অন্তর্ভূক্ত হতে চলেছে যাদের মধ্যে আফ্রিকা, লাটিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান এমনকি এশিয়ার বেশকিছু দেশ রয়েছে।  শুধু সরকারী মতেই ইতিমধ্যেই ইথিওপিয়ার বারো মিলিয়ন মানুষ শুধু অনাহারজনিত কারণে মরণাপন্ন। ভারত ও চীনের মত তথাকথিত  পুঁজির নতুন "সোনার হরিণ"-র ভুখন্ডেও  লক্ষ লক্ষ শ্রমিক নিদারুণ দারিদ্রে পীড়িত হচ্ছে এবং হবে। একইরকমভাবে আমেরিকা এবং ইউরোপের জনগনের একটা বিরাট অংশ এক অসহ্য বঞ্চনার শিকার। সব সেক্টরের শ্রমিকেরাই আক্রান্ত: অফিস, ব্যাঙ্ক, ফ্যাক্টরি, হাসপাতাল, তথ্য-প্রযুক্তিক্ষেত্র, গাড়িশিল্প, গৃহনির্মাণ সবক্ষেত্রেই লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের ছাঁটাই হওয়া শুধুমাত্র কিছুসময়ের অপেক্ষা। বেকারী গগনচুম্বী। ২০০৮-র শুরু থেকে, শুধুমাত্র আমেরিকাতেই প্রায় ১০লক্ষ শ্রমিককে ইতোমধ্যেই আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করা হয়েছে। আর এই সবে শুরু। উদ্বৃত্ত ঘোষনার এই উন্মাদ তরঙ্গের অভিঘাত এসে পড়বে সোজা শ্রমিক-পরিবারগুলোর ওপর: নেহাত ভাত কাপড়ের যোগাড় কিংবা মিনিমাম স্বাস্থ্য রক্ষার ব্যবস্থাটুকু জোটানোও হয়ে পড়বে দুঃসাধ্য। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আর কোন উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তুলে ধরতে পারেনা।

ওরা গতকালও ছিল মিথ্যেবাদী আর আজও মিথ্যেকথাই বলে চলেছে

শাসকদলের স্বার্থরক্ষাকারী সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ এবং পুঁজিবাদী বিশ্বের দন্ডমুন্ডের কর্তারা এই ধ্বংসোন্মুখ অবস্থাটাকে আর কোনভাবেই গোপন রাখতে পারছে না। আর পারবেই বা কিভাবে? পৃথিবীর বৃহৎ ব্যাঙ্কগুলোর কয়েকটা ইতোমধ্যেই দেউলে হয়ে গেছে: ধন্যবাদ রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপকে: সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক থেকে শতশত বিলিয়ন ডলার, পাউন্ড, ইউরোর ইন্‌জেকসন দিয়ে কোনরকমে তাদের প্রাণভ্রমরা টিকিয়ে রাখা হয়েছে। আমেরিকা, এশিয়া এবং ইউরোপের শেয়ার বাজার অতলান্ত সংকটে নিমগ্ন: ২০০৮-র জানুয়ারি থেকে আজ অব্দি ২৫ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে যা আমেরিকার দুবছরের সামগ্রিক উৎপাদনের সমান।  এথেকেই বোঝা যায় গোটা বিশ্বের শাসকশ্রেণির আসল আতঙ্কের উৎসটা কোথায়। স্টক মার্কেটের বিপর্যয়ের কারণ শুধুমাত্র ব্যাঙ্কগুলোর বিপর্যস্ত অবস্থা নয়; আমরা দেখব অথনৈতিক ক্ষেত্রে বিপুল অধোগতি, ব্যবসায়িক কর্মোদ্যোগগুলোর ক্রমবর্ধমান দেউলিয়াপনা, সর্বোপরি গত চল্লিশ বছরে দেখা যায়নি এমন অর্থনৈতিক মন্দা, যার  ফলে পুঁজিপতিরা বুঝতে পারছে যে তাদের লাভের অঙ্ক এত কমে যাবে যে তাদের   মাথা ঘুরে যাবে। বস্তুতঃ লাভের এই পতনের অঙ্কটাও স্টক-মার্কেটের পতনের  অন্যতম একটা কারণ। 

বুশ, মারকেল, ব্রাউন, সারকোজি ও হু জিন তাওদের মত পৃথিবীর দন্ডমুন্ডের কর্তারা একের পর এক শীর্ষ সম্মেলন ক'রে চলেছেন (যেমন কিনা জি-ফোর, জি-এইট, জি-সিক্সটিন, জি-ফর্টি সম্মেলন)-উদ্দেশ্য একটাই:   এই ভয়াবহ ক্ষতিটাকে সীমিত ক'রে রাখা এবং আরো ভয়ংকর পরিস্থিতি এড়ানোর চেষ্টা করা।   নভেম্বরের মাঝামাঝি আবার একটা শীর্ষ-সম্মেলন হচ্ছে যেটাকে কেউ কেউ "পুঁজিবাদের পুর্নস্থাপনা" করার উপায় ব'লে ভাবছেন। আর  রাজনীতিকদের বিচলিত অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যাবে আজকের টিভি, রেডিও আর খবরকাগজগুলোর  বিশেষজ্ঞদের দিশাহীন অবস্থার; একটাই বিষয়: ‘সংকট'।

কেন এই ভ্রমজাল পাতা?

এরা অর্থনৈতিক মহা বিপর্যয়টাকে লুকোতে যখন পারছে না তখন যে করেই হোক চেষ্টা করছে সত্যটাকে আড়াল করার; সোজা কথায়, যে করেই হোক বোঝাও পুঁজিবাদের অস্তিত্ব নাকচ হয়নি, হবেও না---আসল কথা হ'ল সাময়িক কিছু "অপব্যবহার" আর "বাড়াবাড়ির" বিরুদ্ধে লড়াই করা। দেখানো হচ্ছে দোষটা আসলে ফাটকাবাজদের, অতিলোভী মুনাফাবাজদের, দোষ ‘সরকারী কর-নীতি"র, দোষ ‘নিও-লিব্যারালিজম"-র!

এই রূপকথার গল্পটা গেলানোর জন্য পেশাদার ধাপ্পাবাজদের মাঠে নামানো হয়েছে। সেই একই বিশেষজ্ঞ যারা দুদিন আগে বলেছিল অর্থনীতি বেশ স্বাস্থ্যকর অবস্থায় আছে, ব্যাঙ্কগুলো ফার্স্টক্লাস রান করছে, তারাই আজ টিভি মিডিয়াতে হামলে পড়ছে নতুন মিথ্যে শোনানোর জন্য। সেই লোকেরাই যারা গতকাল ‘নিও-লিবারালিজম" কে বলেছিল "একমাত্র" সমাধানের রাস্তা, বলেছিল অর্থনৈতিক ব্যাপারে রাষ্ট্রের নাক গলানো কমিয়ে ফেলা দরকার, তারাই আজ রাষ্ট্রকে আরো আরো বেশি বেশি ক'রে হস্তক্ষেপ করতে বলছে।

আরো রাষ্ট্র----আরো ‘নৈতিকতা', ব্যাস, তাহলেই পুঁজিবাদ চাঙ্গা! এই মিথ্যেটাই তারা আজ আমাদের খাওয়াতে চাইছে।

পুঁজিবাদ কি তার সংকট কাটিয়ে উঠতে পারে?

আসল কথা হল যে-সংকট আজ বিশ্বপুঁজিবাদকে ছাড়খার ক'রে দিচ্ছে তার সূচনা ইউএসেতে ২০০৭-র গ্রীষ্মকালে আবাসনশিল্পের ফানুসটা ফাটতে শুরু করার মধ্যে দিয়ে হয়নি। ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধ'রে একটার পর একটা মন্দা এসেছে যথা ১৯৬৭. ১৯৭৪, ১৯৮১, ২০০১-র মন্দা। দশকের পর দশক ধ'রে বেকারি একটা স্থায়ী এবং মহামারীর মত সংক্রমনে পরিণত হয়েছে, শোষিত মানুষের জীবনযাত্রার মানের ওপর নেমে এসেছে পাহাড় প্রমান আক্রমণ। কিন্তু কেন?

কারণ পুঁজিবাদ এমনই এক ব্যবস্থা যেখানে উৎপাদন করা হয় মানুষের প্রয়োজনের জন্য নয়, তা হয় বাজারে বিক্রির এবং লাভের জন্য। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের হাজারো চাহিদা পূরণ হয় না কারণ তাদের সাধ্য নেই বা সোজা ক'রে বললে তাদের ক্রয় ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। যদি পুঁজিবাদ সংকটে পড়ে থাকে, যদি কোটি কোটি মানুষকে অসহনীয় ক্ষুধা আর দুর্দশার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হতে হয়, তবে তার কারণ এই নয় যে পুঁজিবাদ যথেষ্ট উৎপাদন করতে পারছে না, বরং বিপরীত, এ ব্যবস্থায় যতটা বিক্রি হতে পারে তার চেয়ে অনেক বেশি উৎপাদিত হচ্ছে । যতবার বুরজোয়ারা সংকটে পড়ছে ততবার তারা বিপুল পরিমাণ ঋণ দেওয়া-নেওয়া  আর কৃত্রিম বাজার তৈরির আশ্রয় নিচ্ছে। এভাবে সাময়িকভাবে বেঁচে উঠতে গিয়ে পুঁজিবাদ তার ভবিষ্যতকে আরো বিপদগ্রস্ত ক'রে তুলছে, কেননা শেষ পর্যন্ত এই বিপুল ঋণ শোধ করতে হবে! বর্তমানে ঠিক এটাই ঘটে চলেছে। গত কয়েকবছরের ‘অভাবনীয় সমৃদ্ধি'-র ভিত্তিই হ'ল এই ঋণ। বিশ্ব অর্থনীতি "ঋণ"-র ওপর ভর করেই বেঁচে ছিল আর এখন যখন সেই ধার শোধ করার পালা তখন তা তাসের ঘরের মতই ভেঙে পড়ল। ব্যাঙ্কারদের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ, ব্যবসায়ীদের ফাটকাবাজি বা রাজনীতিকদের পরিচালনার ত্রুটির জন্যই পুঁজিবাদী অর্থনীতির এই বিপর্যয় তা কিন্তু নয়;এরা পুঁজিবাদের নিয়মগুলোই প্রয়োগ করেছে কিন্তু সমস্যাটা এই যে পুঁজিবাদের এই নিয়মগুলো নিজগুনেই এমন যে তা এই ব্যবস্থাটাকে ধ্বংসের দিকেই নিয়ে যায়। আর এই কারণেই রাষ্ট্র আর তার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলো যতই কোটি কোটি টাকা বাজারে ঢালার চেষ্টা করুক না কেন তাতে কোন ইতিবাচক বদল আসবে না। বরং আরো ভয়াবহভাবে ঋণের ওপর ঋণের স্তুপ জমতে থাকবে। ব্যাপারটা তেল ঢেলে আগুন নেভানোর সামিল। এরকম বেপরোয়া এবং নিষ্ফলা পদক্ষেপ নেওয়ার মধ্যে দিয়ে বুরজোয়াদের অক্ষমতাটাই প্রকট হয়ে উঠছে। আজই হোক বা দুদিন পর, এভাবে টাকা ঢেলে সংকট কাটানোর প্রচেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হতে বাধ্য। এতে ক'রে পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রকৃত পুনরুদ্ধার কোনমতেই সম্ভব নয়। বামপন্থী বা দক্ষিণ পন্থী কারো কোন পলিসিই আর এই মারণ ব্যাধিতে র্জজরিত ব্যবস্থাটাকে রক্ষা করতে পারেনা।

পাহাড়প্রমাণ দারিদ্রের বিরুদ্ধে শ্রেণি-সংহতি আর শ্রেণি-সংগ্রাম!

সর্বত্রই ১৯২৯-র অর্থনৈতিক মহাপতন এবং ১৯৩০-র মহা-মন্দার সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতির তুলনা করা হচ্ছে। সেই সময়ের ছবি আমাদের স্মৃতিতে এখনো উজ্জ্বল: বেকার শ্রমিকের অন্তহীন মিছিল, গরীব মানুষের জন্য লঙ্গরখানা, চারিদিকে বন্ধ হয়ে যাওয়া কল কারখানা। কিন্তু আজকের সংকটটা কি সেদিনের মত? না। হয়তো পুঁজিবাদ অতীতের থেকে শিক্ষা নিয়ে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ এবং তুলনামূলকভাবে উন্নত আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের সাহায্যে চূড়ান্ত পতনটা এখনও এড়াতে পারছে, তবুও আজকের সংকট আরো ভয়াবহ, আরো গভীর।

সেদিনের সঙ্গে আজকের একটি মৌলিক তফাৎ আছে। ১৯৩০-র গ্রেট-ডিপ্রেসন্‌ পুঁজিবাদকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে ঠেলেছিল; আর আজকের এই মন্দা কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে?   এটা ঠিকই যে,  যুদ্ধই সংকট থেকে বেরোবার একমাত্র পুঁজিবাদী-সমাধান আর আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণিই একমাত্র এই পুঁজিবাদী সমাধানকে প্রতিহত করতে পারে। ১৯৩০-এ শ্রমিকশ্রেণি সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে প্রতিহত করতে পারেনি বরং তার শিকার হয়েছিল, কারণ, ১৯১৭-য় রাশিয়ায় শুরু হওয়া বিশ্ব-বিপ্লবের ঢেউয়ের ব্যর্থতার ধারাবাহিকতায় সেসময় শ্রমিকশ্রেণি সেই গভীর পরাজয়ের পর্যায়ের মধ্যে দিয়েই চলেছিল। কিন্তু ১৯৬৮ থেকে তাদের বিশাল সংগ্রামের ভেতর দিয়ে শুরু ক'রে শ্রমিকশ্রেণি দেখিয়েছে যে সে পরাজয়ের পর্যায় পার ক'রে আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। যার ফলে এখন আর  সে  শোষক-শ্রেণির জন্য রক্ত ঝরাতে মোটেই রাজী নয়। গত চল্লিশ বছর ধ'রে অনেক বেদনাদায়ক পরাজয় হয়েছে, তবু শ্রেণি দাঁড়িয়ে আছে; আর বিশেষতঃ ২০০৩ থেকে সে আরো বেশি বেশি ক'রে সংগ্রামের পথে চলেছে। সংকট চলতে থাকার অর্থই হল কোটি কোটি শ্রমিকের ভয়ংকর দুর্ভোগ, এটা শুধু পিছিয়ে পড়া দেশেই নয়, উন্নত দেশেও। বেকারি, দারিদ্র এমনকি দুর্ভিক্ষেরও শিকার হতে হবে। কিন্তু এটা শোষিত শ্রেণির প্রতিরোধ সংগ্রামেরও জন্ম দেবে।

বুরজোয়াদের অথর্নৈতিক আক্রমণগুলো ঠেকানোর জন্য এইসব সংগ্রামগুলো চূড়ান্তভাবে দরকার যাতে ক'রে তারা শ্রমিকশ্রেণিকে নিরঙ্কুশ দারিদ্রের মধ্যে ঠেলে দিতে না পারে। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে শ্রমিকশ্রেণি তাদের সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে পুঁজিবাদের এই গভীর থেকে গভীরতর সংকটে ডুবতে থাকাটাকে থামাতে পারেনা। একারণেই এইসব প্রতিরোধ-সংগ্রাম আরো গুরুত্বপূর্ণ এক সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তাকে স্পষ্ট ক'রে তোলে। এইসব সংগ্রাম শোষিত শ্রেণিকে আরো ঐক্যবদ্ধ, সুসংহত হতে এবং সমষ্টিগত শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে, তাদের মধ্যে এই চেতনার সঞ্চার করে যে এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটাকে উৎখাত করাটাই বর্তমানে একমাত্র বিকল্প যার ভেতর দিয়ে মানব প্রজাতি রক্ষা পেতে পারে। এই সমাজকে উৎখাত ক'রে তার জায়গায় এমন এক সমাজ গঠন করা যার ভিত্তিটাই হবে পুঁজিবাদী  সমাজের থেকে গুনগতভাবে আলাদা। এহবে এমন এক সমাজ যা শোষন এবং লাভের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়,সে সমাজে বাজারের জন্য  উৎপাদন না হয়ে তা হবে মানুষের প্রয়োজনের জন্য উৎপাদন; তাহবে এমন এক সমাজ যা সংগঠিত হবে খোদ উৎপাদকদের নিজেদের দ্বারাই, বিশেষসুবিধাভোগী সংখ্যালঘিষ্ঠ কিছু মানুষের দ্বারা নয়। এককথায় তা হবে কমিউনিস্ট সমাজ।

আটটা দশক ধ'রে বুরজোয়াদের ডান বাম সব অংশই হাতে হাত মিলিয়ে পূর্ব ইউরোপ এবং চীনকে  ‘কমিউনিস্ট ব্যবস্থা' ব'লে প্রচার করেছে, যদিও সেগুলো রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের বর্বরোচিত প্রকাশরূপ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। বুরজোয়াদের মতলব হল এটা বোঝানো যে অন্য কোন সমাজ ব্যবস্থার কথা ভাবা নেহাতই নিষ্ফল, পুঁজিবাদই শেষ কথা। কিন্তু এখন পুঁজিবাদের  ঐতিহাসিক দেউলিয়াপনা জলের মত পরিষ্কার, আর তাই বিপরীতে কমিউনিস্ট সমাজ গঠনের লক্ষ্য ও সচেতনতায় শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রামকে উদ্বুদ্ধ হতে হবে।

পুঁজিবাদের লাগামছাড়া আক্রমণের সামনে দাঁড়িয়ে, সমস্ত শোষণ, দারিদ্র আর যুদ্ধের ববর্রতার অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে----

দুনিয়ার শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রাম দীর্ঘজীবি হোক!

দুনিয়ার মজদুর এক হও!

ইন্টারন্যাশানাল কমিউনিস্ট কারেন্ট, ২৫ ১০ ২০০৮



[1]   Respectively: Paul Krugman (the last Nobel Prize winner in economics); Warren Buffet (an American investor, nicknamed the ‘oracle of Omaha', so much is the opinion of this billionaire from small town Nebraska respected in the world of high finance); Jacques Attali (economic adviser to French president Nicolas Sarkozy) and Laurence Parisot (president of the French bosses' association)