Communist Internationalist - 2010

ইন্টারন্যাশানাল কমিউনিস্ট কারেন্টের প্যান এশিয়ান কনফারেন্স ফেব্রুয়ারি ২০১০ (Pan Asian Conference of the ICC February 2010)

২০১০-র ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে আইসিসি তার এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অবস্থিত সেকসনগুলোকে নিয়ে একটি সম্মেলন করে। সম্মেলনে ফিলিপাইন্স, তুর্কি এবং ভারতের সেকসনগুলোর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আইসিসির প্রতি সহমর্মী ছাত্র, যুব এবং শ্রমিকেরা উপস্থিত ছিলেন; ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার একটি আন্তর্জাতিকতাবাদী গ্রুপের প্রতিনিধিও। কোরিয়ার দুটি ইন্টারন্যাশানালিস্ট গ্রুপ যাঁরা আইসিসির কংগ্রেসে উপস্থিত ছিলেন তাঁরাও আমন্ত্রিত ছিলেন কিন্তু তাঁরা শেষপর্যন্ত উপস্থিত হতে পারেননি, তবে সম্মেলনের প্রতি তাঁদের সংহতি ও শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন তাঁরা। পাঠিয়েছেন কোরিয়ার শ্রেণিসংগ্রামের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে একটি বিবৃতি।

এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য আইসিসির অষ্টাদশ কংগ্রেসে নির্ধারিতকর্তব্যগুলো সমাধা করার কাজটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী যে আন্তর্জাতিকতাবাহিনীর উদ্ভব ঘটছে তার ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যুক্ত হওয়া এবং সেই ক্রিয়াকলাপের আরো বিকাশ ঘটানোও এই সম্মেলনের একটি লক্ষ্য। আইসিসির ১৮তম কংগ্রেসে আন্তর্জাতিকতাবাদী গ্রুপ এবং মিল্যুর(milieu) মধ্যে সহযোগিতার বিকাশ ঘটানো বর্তমানে আমাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে স্থির হয়েছিল। এই সম্মেলনেও তাই এটা একটা মুখ্য ফোকাস হিসাবে কাজ করেছে।
একটা গভীর দুঃখের খবর দিয়ে সম্মেলন শুরু হয়। আমরা জানতে পারি মাত্র দুদিন আগে আমাদের ইউএস(USA) সেকসনের কমরেড জেরি মারা গেছেন। তিনি ছিলেন আমেরিকান সেকসনের একটি স্তম্ভস্বরূপ, বহু বছর ধরে তিনি আইসিসির কাজ করে গেছেন। সম্মেলন তাঁর পরিবার এবং সেকসনের প্রতি সৌভ্রাতৃত্ব জ্ঞাপন করে।
কনফারেন্সে প্রদত্ত রিপোর্ট (Reports to the Pan Asian Conference):
কনফারেন্সে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নানা বিষয়ে রিপোর্ট পেশ করা হয়। যেমন, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট,এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী বিরোধ, আইসিসির কর্মকান্ড। এছাড়া প্রলেতারীয় বিতর্কের অনুশীলন ও অভ্যাস এবং তত্ত্বের প্রতি আগ্রহ, ভারত এবং ফিলিপাইন্সের জাতীয় অবস্থা এবং শ্রেণি সংগ্রাম, এশিয়ার বিভিন্ন সেকশনের কাজকর্ম ইত্যাদি  বিষয়ে রিপোর্ট পেশ করা হয়।
তিনদিন ধরে এই সমস্ত রিপোর্ট এবং সেসব থেকে উ্ঠে আসা প্রশ্নগুলো নিয়ে গভীর আগ্রহ ও আন্তরিকতাসহ আলোচনা ও ডিবেট চলে। তবুও আলোচ্য সমস্ত প্রশ্নে যথেষ্ট গভীরতায় ও স্বচ্ছতায় পৌঁছনো যায়নি। এখানে সমস্ত আলোচনার বিশদে যাওয়া যাবে না তবে তুলনামূলকভাবে গুরুত্ত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে আমরা আমাদের রিপোর্ট পেশ করবো।
এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী বিরোধ(Imperialist Rivalries in Asia)
বিশদ রিপোর্ট আমাদের ইংরাজী সাইট (en.internationalism.org)-এ পাওয়া যাবে। এবিষয়ে পেশ করা রিপোর্ট আমাদের ১৮তম কংগ্রেসে সাম্রাজ্যবাদী টেনসন বিষয়ে প্রদত্ত রিপোর্টের মূল দৃষ্টিভঙ্গীর ওপরে ভিত্তি করেই রচিত এবং আলোচিত।
ইউএসের(USA) ক্ষমতা ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়ছে অন্যদিকে চীন আন্তর্জাতিকস্তরে একটা গুরুত্ত্বপূর্ণ পাওয়ার হয়ে উঠছে। এই বিষয়টা আলোচনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। পাশাপাশি এশিয়াতে সাম্রাজ্যবাদী আঁতাত এবং দ্বন্দ্ব-বিরোধে এর প্রভাব কী হতে পারে তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করা হয় এই আলোচনায়। 
সম্মেলনে এবিষয়ে কারো কোন সন্দেহই ছিল না যে আমেরিকা ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়া সত্ত্বেও এখনও সেটা বিশ্বে এক নম্বর মহাশক্তিধর দেশ এবং চীনের এই মুহূর্তে আমেরিকাকে সম্মুখসমরে মোকাবিলা করার সামর্থ বা ইচ্ছা কোনটাই নেই। চীন কতটা দ্রুতগতিতে মহাশক্তি হিসাবে উথ্থানের পথে এগিয়ে চলেছে এবং এখনই বা অদূর ভবিষ্যতে সে আমেরিকাকে চ্যালেন্জ করতে পারবে কিনা এই বিষয়টার ওপর কয়েকজন দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
 কনফারেন্সে এ্শিয়ায় ক্রমবর্দ্ধমান সমরসজ্জা ও সামরিকীকরণের ওপর গুরুত্ত্বপূর্ণ বিতর্ক হয়। পৃথিবীর মধ্যে এশিয়া এখন অস্ত্র-শস্ত্রের অন্যতম প্রধান বাজার হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীন যুদ্ধাস্ত্রে বিনিয়োগের ব্যাপারে এক নম্বরে এটা ঠিকই, তবে, ভারত, সৌদি আরব, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশগুলোও এব্যাপারে পিছিয়ে নেই। চীন এবং ভারতের বর্তমান অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও গুরুত্ব এবং ক্রমবর্ধিত সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্খাই তাদের এই বেশি বেশি সমরাস্ত্রসজ্জিত হওয়ার মূল কারণ। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার ক্রমবর্ধমান মিলিটারাইজেসনের পিছনে আমেরিকার পতনোন্মুখ অবস্থা এবং চীন দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা একটা বড় কারণ।
বর্তমানে ইউএসএ আফগান-পাক যুদ্ধের প্রতিই বেশি নজর দিচ্ছে। এটা ঠিকই যে আমেরিকা আফগানিস্তানের পরিস্থিতিকে অস্থিরতামুক্ত ও সুনিয়ন্ত্রিত করতে চাইছে কিন্তু আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানই এখন আমেরিকার বেশি দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কনফারেন্সের কাছে এটাও পরিষ্কার যে আমেরিকা এখনই আফগানিস্তান পাকিস্তানের রণাঙ্গণ ছেড়ে যাচ্ছে না এবং ভবিষ্যতে সেনা সংখ্যা কমালেও আফগানিস্তানে তাদের নিয়ন্ত্রণকারী ভূমিকা বজায় রেখেই চলবে।
আলোচনায় দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদীজোটের ভাঙা গড়ার প্রক্রিয়াটির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। ভারত ও পাকিস্তানের পারস্পরিক তিক্ত ও মারাত্মক রেষারেষি শুধু আজকের নয়, সবসময়ের। এটা এখন আফগানিস্তানে দুজনের মধ্যেকার পরোক্ষযুদ্ধে প্রসারলাভ করেছে।এই্ দুই দেশ পরস্পরের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হতে না চাইলেও তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের(volatile) চরিত্রটা মাথায় রেখে বলা যায় যেকোন সময় হঠাতই সামরিক সংঘাত বেধে যাওয়ার বিপদ সম্পর্কে আমাদের সতর্ক থাকা দরকার যেমন ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে আক্রমণের পর দুদেশের মধ্যে সামরিক সংঘাতের সম্ভাবনা এক লাফে অনেকখানি বেড়ে গিয়েছিল।
গত কয়েক বছর ধরে চীন ও ভারতের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ সংঘাত বেড়ে চলেছে। ফলে ভারত, আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কটা আরো গভীর ও বিস্তৃত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বর্তমান ঐতিহাসিক যুগে চাচা আপন প্রাণ বাঁচার প্রবণতা দারুণভাবে জোরদার হওয়ার ফলে এই সম্পর্কেও ভাটার টান দেখা দিয়েছে। ভারত এখন রাশিয়ার মত পুরোণো মিত্রদের দিকে ঝুঁকতে চাইছে।
আলোচনায় অন্যান্য যেসব বিষয় উঠে আসে তার মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোও আছে:
-জাতীয়তাবাদ এবং জাতীয় দ্বন্দ্ব কে শ্রমিকশ্রেণির বিরুদ্ধে ব্যবহার করা
-সংকট এবং সাম্রাজ্যবাদী টানাপোড়েনের মধ্যে সম্পর্ক।
-পুঁজিবাদের পচন এবং(Post war imperialist block)ব্লক ভেঙে যাওয়ার পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা এবং চাচা আপন প্রাণ বাঁচা এই প্রবণতাবৃদ্ধি।
শ্রেণি-সংগ্রাম (Class Struggle )
 কনফারেন্সের অংশগ্রহণকারীরা এই বিষয় নিয়ে অত্যন্ত উজ্জীবিত ছিলেন। উপস্থাপনায় আন্তর্জাতিকভাবে আজকের শ্রেণি সংগ্রামের পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়।
২০০৩ সালে শ্রমিকশ্রেণি শ্রেণি-সংগ্রামের একটি নতুন বাঁকে(turning point) উপস্থিত হয়েছে। এসময় শ্রেণি নতুন করে বুরজোয়ার বিরুদ্ধে তার প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করে। কিন্তু ২০০৮-এ আকস্মিক প্লাবনের মত সংকট আছড়ে পড়ল। এর ফলে এক লহমায় শ্রমিকশ্রেণির ওপর নেমে আসা তীব্র আক্রমণগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে শ্রমিকশ্রেণি কিছুটা যেন হতচকিত, আতঙ্কিত, দ্বিধাগ্রস্ত বা কিছুটা যেন অবশ(paralized) হয়ে পড়ল। এখন প্রশ্ন শ্রেণি কি এই অবস্থাটা অতিক্রম করতে পেরেছে? ইউএস এবং ইউরোপে যে নেতিবাচক প্রভাব শ্রমিকশ্রেণির ওপর পড়েছে, এশিয়ার শ্রমিকশ্রেণির ওপর কি তার প্রভাব একইরকম? বর্তমান পরিস্থিতি কি ভয় এবং থমকে থাকা অবস্থা থেকে বাইরে আসার ইঙ্গিত দিচ্ছে? এসবের সুনির্দিষ্ট উত্তর যদিও আসে নি তবে সাধারণভাবে আলোচনায় একথা উঠে এসেছে যে বর্তমান সংগ্রাম তার সাময়িক ছত্রভঙ্গ অবস্থা থেকে মুক্ত হবার প্রয়াসকেই সূচিত করছে। তাছাড়া আজকের সংগ্রামগুলো আন্তর্জাতিকস্তরে বিকশিত হবার দিকেই প্রসারিত এবং এই সংগ্রাম একটা বা দুটো দেশের ব্যাপার নয় সারা পৃথিবীতেই তা গড়ে উঠছে।
পাশাপাশি আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে সংগ্রামের ধীরগতি বিকাশের প্রশ্নটা। ১৯৬৮ এবং তার পরবর্তী সময়ের তুলনায় আজকের সংগ্রামে শ্রেণির আত্মবিশ্বাসের ধীরগতি বিকাশের দিকটাও আলোচনায় উঠে আসে। ২০০৩ এ শ্রেণির পুনরায় (historical)মঞ্চে আসার সময় থেকেই ধীরে ধীরে পরিণত হয়ে ওঠার ব্যাপারটা একটা বৈশিষ্ট হিসাবেই পরিলক্ষ্যিত হচ্ছে।আজ অব্দি এইধারা বজায় আছে। এর কারণ আজকের দিনে সংগ্রামের বর্শামুখের প্রকৃতি: সাধারণভাবে এই সঠিক বিশ্বাস আছে যে এই অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির কোন সম্ভাবনা আর নেই; আর তাই এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শ্রেণিকে এই সংকটের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে এবং তার থেকে উঠে আসা শিক্ষাগুলো সারসংকলন করতে হচ্ছে।
আলোচনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে সংকটের গভীরতার সঙ্গে শ্রেণির প্রতিক্রিয়ার কোন যান্ত্রিক সম্পর্ক নেই; তাই এটা ভাবা ঠিক নয় যে সংকট গভীর হলেই শ্রমিকশ্রেণির প্রতিক্রিয়াও তৎক্ষণাৎ বিশাল বিস্ফোরণের আকারে ফেটে পড়বে। তাসত্ত্বেও ইউরোপসহ বিশ্বের অন্যান্য অংশের সাথে সাথে ভারতেও কিছুকিছু সংগ্রামে শ্রেণি-সংহতির সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটছে। পরপর ঘটতে থাকা সংগ্রামগুলো থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্র (sector)-র মধ্যে সংগ্রাম বিস্তারের সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে।
তুরকি, ফিলিপাইন্স এবং ভারতের শ্রেণিসংগ্রাম বিষয়েও কিছু বিশেষ আলোচনা হয়। ভারতে বিশেষতঃ গুরগাঁও-এ অটো কোম্পানীর শ্রমিকের আন্দোলন, গুজরাটের হীরা শ্রমিকদের আন্দোলন আলোচিত হয়। তবে সবার মধ্যে একটা অনুভূতি ছিল যে আলোচনাটা আরো গভীরে যাওয়ার দরকার ছিল। বিশেষতঃ শ্রেণির মধ্যে সচেতনতা বিকাশের ব্যাপক প্রয়াস কিভাবে সম্ভব হয় এবং কিভাবেই বা শ্রেণি মাস-স্ট্রাইকের স্তরে পৌঁছবে এইদিকগুলো আলোচিত হওয়া এবং বোঝা দরকার। এইদিকটাকে সামনে রেখে রিজলিউসন(resolution) নেওয়া হয় যে কনফারেন্সের পরে এনিয়ে আলোচনা এবং বিতর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।
ভারত এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর বিশেষত্ব নিয়েও আলোচনা হয়:
ভারত, চীন এবং অন্যান্য এশিয়ান দেশগুলোয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি (boom ) নিয়ে বুর্জোয়া প্রচারের প্রভাব;
জাতীয়তাবাদ এবং জাতিগত বিভাজন এবং তার দরুন লেগে থাকা দ্বন্দ্ব;
নানবিধ ধর্ম, জাতপাত এবং বহুবিধ ভাষার প্রভাব;
বিশাল সংখ্যক জনগন কৃষক;
কিভাবে শ্রেণির কাছে আমাদের বক্তব্য নি্য়ে যাওয়া হবে এই প্রশ্ন গুরুত্ব পায়; আইসিসির এবং এশিয়ার অন্তর্গত তার বিভিন্ন সেকশনের কাজকর্ম সংক্রান্ত আলোচনায় এই প্রশ্ন আরো বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়।
আইসিসির জীবনধারা (Life of the ICC)
ল্যাটিন আমেরিকায় আন্তর্জাতিকতাবাদী কিছু গ্রুপ এবং ব্যক্তির সঙ্গে চলা কাজের উল্লেখসহ প্রসঙ্গটি উপস্থাপিত হয়। এ প্রসঙ্গে কালচার অফ ডিবেট, টেস্ট ফর থিয়োরি, ট্রান্সমিসন অফ এক্সপেরিয়েন্স, মানবিক দৃষ্টিকোণ এবং বস্তুগত পরিস্থিতির ভিত্তিতে একজন সদস্যের কার্যকলাপের মূল্যায়ন ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হয়।
আন্তর্জাতিক বিপ্লবী সংগঠনের ধারার মধ্যে শুধু আইসিসি নেই; এর মধ্যে নানাবিধ ধারাবাহিকতার ভেতর দিয়ে উঠে আসা অন্যান্য আন্তর্জাতিকতাবাদী গ্রুপ আছে। আইসিসি সামগ্রিকভাবে এই শক্তিটাকে আরো শক্তিশালী করে তোলার চেষ্টা করছে, এর ভেতরে থাকা বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করতে চাইছে । ভবিষ্যতেও এই একসাথে কাজ করার ব্যাপারটাকে বাড়িয়ে তোলার জন্য সক্রিয় হওয়া অবশ্যই দরকার। সামগ্রিকভাবে আন্তর্জাতিকতাবাদী এই শক্তিটার আরো শক্তিশালী হওয়া মানে আমাদেরও শক্তিশালী হয়ে ওঠা।
বিতর্কের অনুশীলন ও অভ্যাস, তত্ত্বের প্রতি আগ্রহ এবং অভিজ্ঞতার সঞ্চালন ও আদান প্রদান(Culture of Debate, Taste for Theory and Transmission of Experience)
এই আলোচনায় একথা মনে করা হয় যে শ্রমিক শ্রেণি সচেতনতা অর্জনে সক্ষম শ্রেণি। শ্রেণি সচেতনতার ক্রমাগত বিকাশ না ঘটিয়ে এবং দুনিয়াজোড়া ঐতিহাসিক শ্রেণি-সংগ্রামের অভিজ্ঞতার সারসংকলন না করে শ্রমিক শ্রেণি তার সংগ্রামকে পূর্ণ বিকশিত করতে এবং পুঁজিবাদ উচ্ছেদের কাজ সফল করতে পারে না।
ঐতিহাসিক এই অভিজ্ঞতার প্রাসঙ্গিকতাকে সামনে রেখে এবং বর্তমানে বিপ্লবী দিশার খোঁজে থাকা মানুষজনের সংখ্যা বাড়তে থাকার বাস্তবতাকে লক্ষ্য করে শ্রমিক-শ্রেণির সংগ্রাম,সংগঠন এবং সচেতনতার অভিজ্ঞতা এই নতুন প্রজন্মে সঞ্চালিত করার কাজে আইসিসির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে বলে আইসিসি মনে করে। সর্বত্রই এই ট্রান্সমিসনের কাজ গুরুত্বপূর্ণ; এশিয়ায় যেখানে কোনদিনই কোন কম্যুনিস্ট সংগঠন ছিল না, যেখানে বামপন্থী এবং জাতীয়তাবাদী শক্তি সর্বদাই নিজেদেরকে কম্যুনিস্ট হিসাবে উপস্থিত করেছে সেখানে এই কাজ আরো বিশেষভাবে জরুরী।
কিন্তু এই কাজটা ইস্‌কুল-মাস্টারী করার মত একমুখী বিষয় নয় যে শিক্ষক শুধু শিক্ষা দিয়ে যাবেন আর স্টুডেন্টরা তা গ্রহণ করবে। বিপরীতে এ হল একটা বিপ্লবী কাজ। এই প্রক্রিয়া সর্বদাই দ্বিমুখী। একাজ করতে গেলে নতুন প্রজন্ম কী বলতে চাইছে তা গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করতে হবে এবং গুরুত্ব দিতে হবে। যেসব নতুন প্রশ্ন উঠে আসছে সেগুলোর প্রতি চিন্তার জগৎ খোলা রাখতে হবে, খোলা মনে ভাবতে হবে এবং তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে,যেসব নতুন সমস্যা দেখা দিচ্ছে সেগুলো নতুনভাবে খোলামনে বোঝার চেষ্টা করতে হবে, ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার সঞ্চালনের উদ্দেশ্যে আইসিসির অভ্যন্তরে এবং চারপাশের অনিসন্ধিৎসু মানুষজনের মধ্যে বিতর্কের পরিমন্ডল গড়ে তুলতে হবে। তত্ত্বের প্রতি আগ্রহ সৃজনও এই প্রক্রিয়ার একটা অংশ। উপস্থিতদের একটা বড় অংশই এর প্রাসঙ্গিকতাকে তুলে ধরেন।
এক্ষেত্রে উনবিংশ শতকের শেষভাগের এবং বিংশ শতকের শুরুর দিককার বিপ্লবী সংগ্রামের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করা হয়। এই সময়ে বিপ্লবীরা শুধু শ্রেণির ও শ্রেণি সংগ্রামের বস্তুগত অবস্থাই স্টাডি করেছেন তা নয়, সমসাময়িক বিজ্ঞানের বিকাশ সম্পর্কেও যথেষ্ট অধ্যয়ন করেছেন, বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গীতে সেসব পর্যালোচনা করেছেন, সার সংকলন করেছেন, শ্রেণির তাত্ত্বিক সচেতনতা বিকাশে কাজে লাগিয়েছেন। এই সময়টায় গভীর তাত্ত্বিক আগ্রহ এবং অনুশীলন হয়ে উঠেছিল বিপ্লবী কর্মকান্ডের গুরুত্ত্বপূর্ণ অংশ।
আজ, দীর্ঘ প্রতিবিপ্লবী পর্যায় পার করার পর এই কাজ কঠিন বলেই মনে হয়। তবে শ্রমিকশ্রেণিকে যদি তার ঐতিহাসিক লক্ষ্যে পৌঁছোতে হয় তাহলে তাকে অবশ্যই এই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতেই হবে।
বিতর্কের পরিমন্ডল গড়ে তোলা বা তত্ত্বের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে তোলার পথে বাধাগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। কতকগুলো ইম্‌পর্ট্যান্ট বাধা হল:
·       বুরজোয়া মতাদর্শের প্রভাব;
·       পুঁজির পচনশীলতার পর্যায়ের প্রভাব যা সুসংহত চিন্তাধারা গড়ে তোলাকে অবদমিত করে।
·       ভারতের মত দেশে সামন্ততান্ত্রিক এবং জাতপাতগত ঐতিহ্য গুরুজনদের মেনে চলা, গুরুকে অনুসরণ করা ইত্যাদি ধ্যান-ধারণাকে জোরদার করে, বিপরীতে নিজের স্বাধীনভাবে চিন্তাকরা ও সবকিছুকে প্রশ্ন করার প্রবণতাকে অবদমিত করে।
·       মাওবাদের প্রভাব: একটি বুরজোয়া ধারা হিসাবে এটি নেতাকে মান্য করে চল এই নীতিকেই প্রতিষ্ঠা করে, শ্রমিক শ্রেণির ইতিহাস ও তত্ত্বের প্রতি আগ্রহটাকে খুবই সন্দেহজনক চোখে দেখে।
মাওবাদী অভিজ্ঞতা যাদের আছে সেইসব কমরেডরা মনে করিয়ে দেন মাওবাদী থিসিসটার কথা যাতে বলা হয়েছে: যত পড়বে তত বোকা বনবে
সচেতনভাবে ডিবেটের কালচার গড়ে তোলা এবং তত্ত্বের প্রতি আগ্রহ বিকশিত করার প্রয়োজনীয়তার প্রতি আলোকপাত করা হয়। বলা হয় নতুন প্রজন্মে অভিজ্ঞতার সঞ্চালন এবং তাদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন করার কাজে উপরোক্ত কাজের গুরুত্ত্ব অনস্বীকার্য।
বিপ্লবীদের কাজের গভীর মানবিক চরিত্র (The profoundly human character of militant activity)
আইসিসির জীবনছন্দের অন্তর্গত অপর একটি প্রশ্ন আলোচনায় জায়গা করে নেয়: এটা হল একটা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তার বাহিনীর কাজকে দেখার প্রশ্ন। আমাদের রাজনৈতিক অনুশীলন এবং সামাজিক জীবনযাপন এই দুয়ের মধ্যে যেকোন রকম বিভেদ রেখা টানার প্রয়াসকে আলোচনায় বেঠিক বলে চিহ্নিত  করা হয়। একইসঙ্গে পুঁজিবাদের অভ্যন্তরে কম্যুনিজমের কোন  বিচ্ছিন্ন দ্বীপ বানানোর আইডিয়াকেও যৌক্তিকভাবে পরিত্যাগ করা হয়। পাশাপাশি এটাও বলা হয় যে আমাদের জীবনযাপন প্রণালী কম্যুনিজমের মূলদিকগুলোর একদম বিপরীতও হতে পারে না।
নারীদের প্রসঙ্গও একট বিশেষ জায়গা করে নেয়। এক্ষেত্রে সাধারণভাবে সকল নারীর এবং বিশেষভাবে যাঁরা বিপ্লবী কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত মানুষজনের অংশ সেইসব নারীদের প্রতি কম্যুনিস্টদের দৃষ্টিভঙ্গী কী হওয়া উচিত সেবিষয়ে আলোকপাত করা হয়। বিপ্লবীদের এই কনফারেন্সে এই বিষয়টা অনেক সুদূর ভবিষ্যতের ব্যাপারে বিতর্কের বিষয় বলে মনে হলেও এটা ঠিক যে ভারত, তুর্কি এবং ফিলিপাইন্সে মেয়েদের প্রতি সামন্ততান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর একটা বিষময় প্রভাব আছে এবং সেদিক থেকেই বিষয়টার প্রাসঙ্গিকতা আছে। প্রকৃতপক্ষে আইসিসির প্রতি সহমর্মী একজন মহিলা সাথী  প্রশ্নটাকে সজোরে সামনে আনেন। তিনি দেখান পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব ভারতে আইসিসির সহমর্মী  মানুষজনের মধ্যেও বিদ্যমান।
সময়াভাবে এই্ আলোচনা বেশিদূর এগোয়নি তবে সেকসনগুলোকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয় যাতে তারা এ বিষয়ে সেকসনে আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যায়।
ইন্টারভেনসন (Intervention):
ফিলিপাইন্সে সদ্যজাত সেকসন দ্বারা যে বিপুল কাজ ইতোমধ্যেই করা হয়েছে তাকে কনফারেন্স স্যালুট জানায়। বিশেষত, যে পরিস্থিতির মধ্যে সেকসনকে এই কাজ করতে হয়: আধা বে-আইনি অবস্থার মধ্যে, রাষ্ট্রীয় এবং বাম ডান নানা দলের নিজস্ব সেনাবাহিনীর দ্বারা নিপীড়ণের থ্রেটকে মাথায় রেখে এবং খুবই কষ্টকর অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে সংগ্রাম করেই এইসব কাজ করে চলতে হয়।
ইন্টারভেনসনের প্রশ্নে দীর্ঘ, প্রাণবন্ত বিতর্ক চলে। এই আলোচনা অনেকগুলো প্রশ্নে স্বচ্ছতা এনে দেয়:
ইন্টারভেনসনের নানা হাতিয়ার এবং রূপ যথা পামফ্লেট(pamphlet), পত্র-পত্রিকা, লিফলেট, আলোচনা চক্র, কনট্যাক্ট মিটিং, পাবলিক মিটিং ইত্যাদি।
তাত্ত্বিক দিক থেকে স্বচ্ছতা এবং গভীরতা অর্জন ইন্টারভেনসনের অপরিহার্য অঙ্গ এবং রূপ।
থিয়োরি এবং প্র্যাকটিসের মধ্যে ঐক্য।
এই আলোচনার একটি সুনির্দিষ্ট প্রসঙ্গ ছিল ভারতে থাকা সেকসনের কাজকর্মের একটি ব্যালান্স সীট উপস্থাপন। এই মূল্যায়ণে উল্লেখ করা হয় যে:
গত কয়েকটা বছর সেকসন সংখ্যার দিক থেকে বেড়ে ওঠা এবং ভারতের বিভিন্ন জায়গায় সংগঠন গড়ে তোলার ওপরই বিশেষ জোর দেয়।
ভারতের বিভিন্ন জায়গায় উদীয়মান নতুন অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিদের সঙ্গে ফলপ্রসূ এবং গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা আলাপ আলোচনা চালানো গেছে। এতে করে ভারতে কম্যুনিস্ট চিন্তাভাবনার প্রভাব ছড়ানোর কাজই করা হয়েছে এবং তা আইসিসির আন্তর্জাতিক কর্মকান্ডকেই প্রসারিত করেছে।
পাশাপাশি মূল্যায়নের খাতায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ দুর্বলতা চিহ্নিত হয়েছে, যেমন:
এখনও অব্দি ভারতে রেগুলার প্রকাশনার কাজ শুরু করতে না পারা।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহে আমাদের ইন্টারভেনসন অনিয়মিতই থেকে গেছে। ভারতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু শ্রমিক আন্দোলনে আমাদের কোন ইন্টারভেনসনই হয়নি।
শেষোক্ত ব্যাপারটা নিয়ে আইসিসিরই কিছু সহমর্মীও প্রশ্ন তোলেন; এতে আলোচনাটা আরো গভীরতা পায়।
এই ডিসকাসন্‌টা আমাদের সহমর্মী এবং সেকসন উভয়ের পক্ষেই খুবই উৎসাহব্যঞ্জক হয়ে ওঠে। সহমর্মী কমরেডরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আইসিসির জন্য লিখতে, আইসিসির নানা টেক্সট অনুবাদ করতে, পত্রিকা বিলানোর কাজে সাহায্য করতে এবং শ্রেণি-সংগ্রামে ইন্টারভেইন করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
উপসংহার (Conclusion)
সংগঠনের জীবনে প্যান এশিয়ান কনফারেন্স একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত এবং এশিয়ায় কম্যুনিস্ট ভাবধারা এবং সংগঠন বিস্তারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পথপ্রদর্শক হয়ে রইল। যদিও সংখ্যাগতভাবে বিশাল কিছু নয়, তবুও সম্ভবত এশিয়ায় এখনও অব্দি এটাই কমিউনিস্ট এবং আন্তর্জাতিকতাবাদীদের সবচেয়ে বড় জমায়েত। আইসিসির অনেক সহযোদ্ধা ও সহমর্মীদের কাছে আইসিসির আন্তর্জাতিক সভায় থাকার এটাই প্রথম অভিজ্ঞতা। কমরেডদের মনে হয়েছে এটা যেন আইসিসির কংগ্রেসের ছোট সংস্করণ।
অস্ট্রেলিয়া থেকে আগত প্রতিনিধি এবং অন্যান্য সহমর্মীদের কাছে এই সম্মেলন এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। তাদের মতে এই সম্মেলন তাদের কাছে এমন একটা সংগঠন সম্বন্ধে বাস্তব অভিজ্ঞতা যেটা শুধু আন্তর্জাতকতাবাদীই নয়, তাদের কর্মক্ষেত্রে তারা সত্যিসত্যিই আন্তর্জাতিক। অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা তরুণ কমরেডের ভাষায় এই কনফারেন্সের অভিজ্ঞতা তার জীবনের দিশাটাকেই বদলে দিয়েছে এবং কমিউনিস্ট হিসাবে কাজ করার প্রশ্নটা নতুনভাবে হাজির করেছে।
সম্মেলনের শেষে ভারতের একজন সহমর্মী সাথী সম্মেলন সম্বন্ধে তার মনোভাব ব্যক্ত করেছেন এইভাবে: সম্মেলন চলাকালীন আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমি আমার দেশে আছি। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বিপ্লবী সাথীদের সঙ্গে কাজ ও আলোচনা করতে করতে অনুভব করছিলাম আমি আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণির জীবন এবং সংগ্রামেরই অংশ”
এই অনুভবটা আসলে সকলের মধ্যেই ব্যপ্ত ছিল। এই প্যান এশিয়ান কনফারেন্স সকলের মধ্যে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সংগ্রাম গড়ে তোলার লক্ষ্যে স্বচ্ছতা এবং উদ্দীপনা জুগিয়েছে।

সাকি, ৪ই এপ্রিল, ২০১o

কলকাতার চটকল শ্রমিকের সংগ্রামে ইউনিয়নগুলোর অন্তর্ঘাত (স্যাবোটাজ)

 কলকাতার নিকটবর্তী ৫২ টি জুটমিলের প্রায় আড়াইলক্ষ শ্রমিক ২০০৯-র ডিসেম্বরের শুরুতেই ধর্মঘটে নামে। মজুরী বাড়ানো, অস্থায়ী ভিত্তিতে নিযুক্ত বহুসংখ্যক শ্রমিকের স্থায়ীকরণ, অবসরকালীন সুযোগ সুবিধা প্রদান এবং জীবনযাপনের মান উন্নয়ন ও কারখানায় নানান অসুবিধাজনক পরিস্থিতির বদল ইত্যাদি নানা দাবীতে এই ধর্মঘট। সর্বোপরি, বকেয়া বেতন আদায়, স্বাস্থ্য বীমা, প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং অন্যান্য খাতে কেটে নেওয়া টাকা শ্রমিকদের নামে যথাযথভাবে জমা দিতে বাধ্য করা ছিল এই আন্দোলনের অন্যতম দাবী। দুমাস ধরে চলার পর ১২ই ফেব্রুয়ারী ২০১০ ইউনিয়নগুলো ধর্মঘট প্রত্যাহার করে এবং শ্রমিকদের কাজে যেতে নির্দেশ দেয়, যদিও ম্যানেজমেন্টের কাছ থেকে কোন দাবী আদায়ে তারা সমর্থ হয়নি। বরং এই পরাজয় শ্রমিকশ্রেণির ওপর আর একটা আক্রমণের মঞ্চ তৈরি করল।

চটকল শ্রমিকদের এই ধর্মঘট প্রতিবছরেই
চটকল শ্রমিকদের এই সাম্প্রতিক স্ট্রাইক প্রথম নয়। প্রায় প্রতি বছর তাঁরা ধর্মঘট করেন। ২০০২, ২০০৪, ২০০৭-এ ৬৩ দিনের টানা ধর্মঘট এবং ২০০৮-এর ১৮দিন ধর্মঘটের কথা আমরা মনে করতে পারি। প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই শ্রমিকসাধারণের কর্তপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার প্রয়াস বা সামান্য দাবী আদায়ের প্রচেষ্টা ইউনিয়ন এবং চটকল কর্তপক্ষের মিলিত ষড়যন্ত্রের ফলে ব্যর্থ হয়েছে।
চটকল মজুরদের বারংবার বিক্ষোভে ফেটে পড়ার কারণ নিহিত আছে তাদের কর্মক্ষেত্রের অমানবিক পরিস্থিতির মধ্যে, নিহিত আছে স্ট্যালিনিস্ট এবং অন্যান্য ইউনিয়ন ও পার্টির দমন পীড়ণের মধ্যে যাদিয়ে তারা শ্রমিকদের বিক্ষোভকে নিজেদের মুঠির মধ্যে রাখতে চায়। অনেক চটকল চালানোর ক্ষেত্রে স্থায়ী কিছু সমস্যা থেকে যাওয়াও শ্রমিকদের আন্দোলনে যেতে বাধ্য করে।
চটকল মজুরদের বেতন অত্যন্ত কম। এমনকি স্থায়ী শ্রমিকদের বেতন মাসে ৭০০০ টাকা মানে কিনা মোটামুটি ১৫০ ইউএস ডলার বা বর্তমান হিসাবে ১০০ ইউরোর কাছাকাছি। প্রতিটা মিলে একতৃতীয়াংশের বেশি মজুর অস্থায়ী বা চুক্তির ভিত্তিতে নিযুক্ত যাদের বেতন স্থায়ী শ্রমিকদের অর্ধেকের কম, মানে ডেলি ১০০ টাকা। পরন্তু, যেদিন কাজ করানো হবে শুধু সেইদিনের বেতনই দেওয়া হবে! এইসব অস্থায়ী কর্মীরা জীবনের অধিকাংশ সময় একটা মিলে কাজ করেই জীবন কাটিয়ে দেন; তা সত্ত্বেও তাঁদের স্থায়ী করা হয় না কেননা মালিক তা চায় না। এমনকি শ্রমিকেরা তাদের মাসিক বেতন নিয়মিত এবং পুরোপুরি  পান না; আন্যান্য দেয় বেনিফিটের টাকাও মেলে না।এইসব টাকা বছরের পর বছর জমতে থাকা সত্ত্বেও মেটানো হয় না। এমনকি আইনসঙ্গতভাবে স্বাস্থ্যবীমা ও প্রভিডেন্ট ফান্ডে জমা দেওয়ার জন্য টাকা কেটে নিলেও অনেকসময় ম্যানেজমেন্ট সেটাকা শ্রমিকদের নামে সংশ্লিষ্ট সরকারী দপ্তরে জমা করেনা। এ বিষয়ে সংঘবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেও মালিকেরা সেই সিদ্ধান্তকে বুড়ো আঙুল দেখায়। শ্রমিকদের ওপর আরো বেশিমাত্রায় উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্য চাপিয়ে দেবার জন্য মালিকেরা লক-আউট ঘোষণা করে, বেতন দেওয়া বন্ধ করে দেয়। আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বসেরা একাজ চালিয়ে যেতে পারে কারণ চলতি বামফ্রন্ট সরকার সহ যত স্ট্যালিনিস্ট ও্ অন্যান্য ইউনিয়নগুলো তাদেরই দোসর। প্রতিটা চুক্তির ক্ষেত্রে সরকার নিজেই একটা পার্টি, তবুও কোন চুক্তিলাগু করার জন্য সরকার কোন প্রয়াসই নেয় না। সোজা কথায় সরকার নিজস্ব শ্রম আইন নিজেই ভাঙে।
এইসবের ফলে শ্রমিদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দানা বাঁধে, যার ফল হল তাদের এই বারবার করে সংগ্রামে নামা। 1990-র প্রথমদিকে ভিক্টোরিয়া এবং কানোরিয়া জুটমিলের শ্রমিকদের মধ্যে এই তীব্র ক্ষোভের প্রকাশই আমরা দেখি; এখানে তারা প্রচলিত সমস্ত ইউনিয়নকে বয়কটই শুধু করেনি, এমনকি ভিক্টোরিয়ার শ্রমিকরা সমস্তধরণের ইউনিয়নের অফিস আক্রমণ করে, অফিস ভাংচুড় করে, মারধর করে ইউনিয়ন বসেদের। কানোরিয়ার শ্রমিকেরা সমস্ত প্রচলিত ইউনিয়ন বয়কট করে এবং বহুদিন ধরে মিল দখল করে।
কিন্তু বহু বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ বামপন্থীদের মৃগয়াক্ষেত্র হয়ে আছে; গত ৩২ বছর ধরে রাজত্ব করা স্ট্যালিনিস্ট হায়নারাই শুধু আছে তা নয়, এদের পাশাপাশি আছে বিরোধী বামপন্থী দলবল, আছে এনজিও, বামপন্থী বুদ্ধিজীবির দল। ফলে, কানোরিয়া বা ভিক্টোরিয়ার শ্রমিকদের প্রচলিত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীনভাবে আন্দোলন সংগঠিত করার প্রয়াসকে সরকার বিরোধী বামপন্থীরা খুব দ্রূত ক্যাপচার করে নেয়; আন্দোলন বেপথু হয়ে পড়ে। প্রচলিত ইউনিয়নগুলোর বিরুদ্ধে শ্রমিকের স্বতঃস্ফূর্ত্ত ঘৃণাকে ব্যবহার করে এরা  নতুন মোড়কে সেই একই ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতির খপ্পরেই তাদের এনে ফেলে। এখনও অব্দি এই হল পশ্চিমবাংলার চটকল শ্রমিক সংগ্রামের করুণ পরিণতি।এই বাস্তবতা থেকে এটা বোঝা যায় শ্রমিক সংগ্রামে সত্যিকারের শ্রমিক শ্রেণির চিন্তাধারা গড়ে তোলা কী ভীষণভাবে প্রয়োজনীয়।
বর্তমান ধর্মঘট
পাঁচ পাঁচটা ত্রিপাক্ষিক বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার পর শ্রমিকদের বিক্ষোভ এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে ২০টা ইউনিয়ন সম্মিলিতভাবে ১৪ই ডিসেম্বর থেকে ধর্মঘটের ডাক দিতে বাধ্য হয়। বকেয়া বেতন মেটানো, স্বাস্থ্য বীমা ও প্রভিডেন্ট ফান্ডে দেয় টাকা সংশ্লিষ্ট সরকারী দপ্তরে জমা করা এবং বেতন বৃদ্ধি ইত্যাদি দাবীতে এই ধর্মঘট ডাকা হয়। খবর অনুযায়ী গড় পরতায় শ্রমিক পিছু ৩৭০০০ টাকা পর্যন্ত বকেয়া আছে যা প্রায় তাদের ছ মাসের বেতনের সমান। এগুলো না দেওয়া মানে শ্রমিকের পয়সা স্রেফ চুরি করা। পরন্তু স্বাস্থ্য বীমা এবং পিএফে টাকা না দেওয়ার অর্থ চিকিৎসা পরিসেবা না পাওয়া, রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট আটকে যাওয়া।
ধমর্ঘটের ফলে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকার চাপের মুখে পড়ে, তাদের হস্তক্ষেপ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। বীজনেস স্যান্ডার্ড পত্রিকা অনুযায়ী চলতি অর্থনৈতিক সংকটের ফলে অন্যান্য সেক্টরে যে অসন্তোষ দানা বাঁধছে তারাও ধর্মঘটীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে দিতে পারে এমন একটা আশঙ্কা বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান উড়িয়ে দিচ্ছে না। তাছাড়া এর ফলে মালক পক্ষ লোকসান করছে। বীজনেস স্যান্ডার্ড অনুযায়ী (১৬ ০২ ২০১০) ৬১ দিনের স্ট্রাইকে মোট ২২ বিলিয়ন টাকা (৪৭৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার) ক্ষতি হয়েছে।
কেন্দ্র ও বাম ফ্রন্ট পরিচালিত রাজ্য সরকার সহ আন্যান্য পার্টি এবং ইউনিয়ন মিলিতভাবে ধর্মঘট দমনের কাজে হাত লাগায়।
রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা
 দেখানোর জন্য সব রাজনৈতিক দলই ধর্মঘট সাপোর্ট করেছে(তৃণমূল কংগ্রেস পার্টি বাদে); আর বাস্তবে তাদের নিজ নিজ ছাতার তলায় থাকা ইউনিয়নগুলোকে পরামর্শ দিয়েছে যেমন করেই হোক শ্রমিকদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে একটা সুবিধাজনক অবস্থানে আনতে। পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী তাদের দল সিপিএমের অধীন বেঙ্গল চটকল মজদুর সঙ্ঘের নেতা গোবিন্দ গুহকে পরামর্শ দিয়েছেন শ্রমিকদের সব দাবী দাওয়া মেনে নিতে বাধ্য করার চেষ্টা না করতে। মিস্টার গুহ সংবাদ মাধ্যমকে নিজেই জানিয়েছেন,
আমি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি; তিনি সব দাবী শুনেছেন; তিনি বলেছেন এইসব দাবী মেনে নিতে চুক্তিবদ্ধ হওয়াটা খুব শক্ত হবে। উল্লেখ্য, সবচেয়ে বেশি সংখ্যার শ্রমিক সিপিএমের এই ইউনিয়নের সদস্য।
 শুধু পশ্চিমবাংলার প্রধান বিরোধী দল তৃণমূল কংগ্রেস তার অধীন ট্রেড ইউনিয়নকে নির্দেশ দিয়েছে ধর্মঘটে যোগ না দিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে। তৃণমূলের মতে কারখানা অচল করে দেয় এমন কোন কিছুতেই থাকা চলবে নাবড় বড় বীজনেস হাউজের পক্ষে এই অবস্থান যথেষ্ট সন্তোষজনক এবং এজন্য তৃণমূলের কর্মকান্ডে ওদের অর্থসাহায্য করার কথাও শোনা যাচ্ছে।
শ্রমিকদের এই লড়াকু মনোভাবকে বেপথু করছে ট্রেড ইউনিয়ন
অন্যান্য মিলগুলোর  শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলার রাস্তাতেই হাঁটতে দেয় না ইউনিয়নগুলো; কলকাতার অন্যান্য নানা সেক্টরের শ্রমিকদের সঙ্গে ঐক্য গড়ে তোলার পথে তারা প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শ্রমিকদের প্যাসিভ, পরস্পর বিচ্ছিন্ন করে রেখে ইউনিয়ন নেতারা শুধু আশ্বস্ত করে যে কিছু করার দরকার নাই, অপেক্ষা কর, নেগোসিয়েসন হবে, মালিককে দাবী মানাতে বাধ্য করব। বাস্তবে, বকেয়া বেতন মেলে না, মজুরি বৃদ্ধির প্রতিশ্রুত পরিমানটাও নেহাতই সামান্য থেকে যায়। বলা হয়, বকেয়া বেতন কিস্তিতে বেশ কিছু মাস ধরে মেটানো হবে। ডিয়ারনেস আলাউয়েন্স টাও মাসিক মাইনের সঙ্গে দেওয়া হবে না, সেটাও হবে তিনমাস অন্তর। পরিবর্তে ইউনিয়ন কী প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে? পরবর্তী তিন বছর শ্রমিকেরা কোন ধর্মঘট করবে না!! সিপিএমের ইউনিয়ন নেতা মিস্টার গুহ বলছেন পরবর্তী তিন বছর চটকলে কোন ধর্মঘট হবে না। এথেকে মালিকেরা চটকল মজুরদের নিশ্চিন্ত মনে আক্রমন চালিয়ে যেতে পারবে: চাকরি ছাঁটাই, মজুরি সংকোচন হবে, প্রাপ্য মজুরি দিচ্ছে না, দেবেও না, লিভিং কনডিশন, ওয়ার্কিং কনডিশন আরো খারাপ হবে কিন্তু কিছু বলা যাবে না! এই হল ইউনিয়নের শ্রমিক দরদী ভূমিকা।
এই ভয়ংকর বেইমানি শ্রমিকদের সাথে করা হল: এই দীর্ঘ ধর্মঘটের সময় ধরে বেতন না পেয়েও ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার ফল শ্রমিকেরা পেলেন। এক নিদারুণ হতাশা, যন্ত্রণা এবং ঘৃণা ও রাগের আগুন জ্বলতে থাকল শ্রমিকদের মনে।
এই তীব্র রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটল আকস্মিক হিংসাত্মক ঘটনা ঘটানোর ভেতর দিয়ে
ধর্মঘট শেষ হয়ে যাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই মজুরদের ক্ষোভ ফেটে পড়ল ইউনিয়ন অফিসগুলো আর তার নেতাদের আক্রমণের ভেতর দিয়ে।
চৌঠা মার্চ ২০১০, উত্তর চব্বিশ পরগনার জগদ্দল জুট মিলের মজুরদের বিরুদ্ধে মালিকপক্ষ নতুন আক্রমণ নামিয়ে আনল। স্থায়ী মজুরদের করণীয় স্থানান্তরণের কাজটা চুক্তিভিত্তিক মজুরদের হাতে তুলে দিতে চেষ্টা করা হল। লোকাল ইউনিয়ন লিডারদের তোয়াক্কা না করেই, মজুরেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এই আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং এই্ পদক্ষেপ প্রতিহত করে। শ্রমিকদের এই প্রতিরোধ ভাঙতে এবং তাদের ভয় দেখাতে পরদিন মালিকেরা আকস্মিকভাবেই গেটে তালা ঝুলিয়ে দেয় এবং সাসপেনসন নোটিশ দেয়। শ্রমিকেরা সকালের শিফটে কাজ করতে এসে দেখে এই অবস্থা।
দীর্ঘদিন ধর্মঘট করারর ফলে বেতন না পাওয়া, সবদিকথেকে অন্যায়ের শিকার হওয়া বিক্ষুব্ধ হাজার হাজার শ্রমিক তৎক্ষণাৎ এই আক্রমণের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে: তারা শ্লোগান তোলে এখনি মিল খুলতে হবে এবং শ্রমিকদের কাজ করতে দিতে হবে।এই সময়েই ৫৬ বছর বয়েসী এক পুরোণো শ্রমিক আক্রমণের আকস্মিকতায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং হার্ট আ্যাটাক হয়ে প্রায় তৎক্ষণাৎ মারা যান। এই ঘটনা শ্রমিকদের ভেতর রাগ ও ঘৃণার আগুন শতগুন বাড়িয়ে তোলে। তাঁরা বোঝেন যে এই সাসপেনশনের পেছনে অতি আবশ্যই ইউনিয়নগুলোর হাত আছে। ক্রুদ্ধ মজুরেরা সংগে সংগে (সরকারী বামপন্থী সিপিএম পরিচালিত) সিটু এবং (কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন কংগ্রেস পরিচালিত) আইএনটিইউসির অফিসে যান এবং অফিস ভেঙে তছনছ করেন।সিটুর লিডার ওমপ্রকাশ রাজবর মজুরদের হাতে মার খায়। পরে বিশাল পুলিশ বাহিনী এসে ম্যানেজার এবং নেতাদের উদ্ধার করে। অবশ্যই পুলিশ শ্রমিকদের প্রতি ভায়োলেন্ট আচরণ করে, নির্মমভাবে লাঠিপেটা করে সাধারণ মজুর ও তাদের ফ্যামিলির লোকজনদের।
এরকম হিংসাত্মক কার্যকলাপ অবশ্যই শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে না, তবু এই ঘটনা দেখায় যে মালিক এবং ইউনিয়নের বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে শ্রমিকদের মধ্যে কি তীব্র রাগ এবং ধিক্কার জমা হয়ে আছে!
কিভাবে এগোনো যায়
জুট শিল্প বরাবরই সমস্যাদীর্ণ আর বর্তমানে তীব্রতর হতে থাকা বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব থেকে অন্যান্য সেক্টরগুলোর মতই জুট শিল্পও মুক্ত থাকতে পারে না। লাভ বজায় রাখা শুধু নয়, মিল মালিকদের লক্ষ্য আরো বেশি বেশি লাভ করা। এর একমাত্র উপায় শ্রমিকদের আরো আরো বেশি শোষণ করা, আর এজন্যই, তাদের কাজের পরিস্থিতি, জীবনযাপনের মানের ওপর আরো ভয়াবহ আক্রমণ নামিয়ে আনা ছাড়া আর কোন উপায় আজ নেই। জুট ওয়ার্কারদের আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। তাঁরা প্রায়শই জঙ্গী আন্দোলন করেছেন, বীরের মত রুখে দাঁড়িয়েছেন অন্যায় ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে তত পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে তাঁদের স্বার্থে লড়াই এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে অন্যান্য সেক্টরে, কলে কারখানায় শ্রমিকদের সংগ্রামগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলে চলবে না, বরং আন্দোলনে পরস্পরের সাথী হিসাবে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। অন্যান্য সেক্টরের শ্রমিকদের সাহায্য সহযোগিতা সমর্থন ছাড়া আজকের দিনে বিচ্ছিন্নভাবে একটা সেক্টরের মজুরের লড়াই জয়যুক্ত হতে পারেনা। পরন্তু, ইউনিয়নের বিরোধীতা করতে গিয়ে হয় নিষ্ক্রিয় থাকা নয়তো এধরণের নৈরাজ্যমূলক ভায়োলেন্ট ঘটনা ঘটানো কোন ইতিবাচক পদক্ষেপ নয়। ইউনিয়ন  মালিক ও রাষ্ট্রের পক্ষেই থাকতে বাধ্য, এথেকে শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থরক্ষার কোন সম্ভাবনাই নেই, এই ব্যাপারটা শ্রমিককে বুঝতে হবে এবং সমস্ত ধরণের ইউনিয়নসংগঠনের খপ্পর থেকে বাইরে এসে নিজেদের আন্দোলন নিজেদের হাতেই নিতে হবে। স্বসংগঠন গড়ে তোলা,আন্দোলনের পন্থা পদ্ধতি সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য শ্রমিকদের সাধারণ সভা আয়োজন করা, স্থায়ী নেতৃত্বের বদলে যেকোন সময়ে প্রত্যাহারযোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচন করে আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, অন্যান্য কলে কারখানায় অফিসে আন্দোলনের সমর্থনে শ্রমিকভাইবোনেদের আহ্বান করা ইত্যাদির মধ্যে দিয়েই আজকের আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব, এছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই।
নিরো,২রা মে ২০১০

‘ব্যয়সংকোচের দাওয়াই’-এর বিরুদ্ধে: শ্রেনিসংগ্রাম!

এই মুহূর্তে ভীষণ অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে গ্রীসের পরিস্থিতি। যেকোন মুহূর্তে তীব্র ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে শ্রমিক শ্রেণি। গ্রীক রাষ্ট্র শ্রমিক শ্রেণির ওপর অবিরাম আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেসমস্ত প্রজন্মের, সমস্ত সেক্টরের ওয়ার্কার আজ সেই আক্রমণের শিকার। প্রাইভেট সেক্টর, পাবলিক সেক্টর, বেকার, পেনসনজীবি, আংশিক সময়ের চুক্তিতে কর্মরত ছাত্র-ছাত্রী কেউ বাদ যায়নি। সমগ্র শ্রমিক শ্রেণি নিদারুণ দারিদ্রের মুখোমুখি।রাষ্ট্রের আক্রমণের সামনে দাঁড়িয়ে শ্রমিকশ্রেণি তার পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করেছে। অন্যান্য কান্ট্রিগুলোর মতই গ্রীসেও শ্রমিকশ্রেণি নেমেছে রাস্তায়, করছে ধর্মঘট,জানিয়ে দিচ্ছে:

পুঁজিবাদের সংকটে তারা আর বলির পাঁঠা হতে চায় না; পুঁজিবাদকে টিকিয়ে রাখার জন্য নিদারুণ আত্মত্যাগের আহ্বানে  সাড়া দিতে শ্রমিকশ্রেণি বিন্দুমাত্র দায়বদ্ধ নয়।

তবে গ্রীসে এই আন্দোলন এখনও বিশাল আকার ধারণ করেনি। গ্রীসের শ্রমিকেরা এই মুহূর্তে অত্যন্ত কঠিন পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সমস্ত মিডিয়া এবং সমস্ত রাজনীতিকরা শ্রমিকশ্রেণিকে জ্ঞান দিচ্ছে : বাছা করার আর কিছু নেই কোমরে গামছা বাঁধ কষে আর দেউলে অবস্থা থেকে দেশটাকে বাঁচাও; তো তখন শ্রমিকেরা কী করবে? শ্রমিক ভাইয়েরা ভীষণ দানবাকৃতি এই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিভাবে দাঁড়াবে? কিভাবে কোন্‌ পদ্ধতিতে লড়াই করা দরকার যাতে শক্তিসাম্যটা শোষিত মানুষের পক্ষে আসে?

এই সব প্রশ্ন শুধু গ্রীসের শ্রমিকেরা ফেস করছেন তা নয়, এ প্রশ্ন আজ সমগ্র বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণির। প্রকৃতপক্ষে গ্রীসের এই ট্র্যাজেডিসারা বিশ্বে কী ঘটতে চলেছে তার আভাস মাত্র। ইতোমধ্যে গ্রীক স্টাইলে ব্যয়সংকোচের প্যাকেজ ঘোষিত হয়েছে পর্তুগাল, রুমানিয়া, জাপান এবং স্পেন (যেখানে সরকার পাবলিক সেক্টরের ওয়ার্কারদের বেতনের শতকরা ৫ ভাগ কেটে নিচ্ছে)। বৃটেনে এই কাটাউতি কিরকম হতে চলেছে তার ছবি নতুন কোয়ালিসন সরকার সবেমাত্র প্রকাশ করতে শুরু করেছে। এইসব আক্রমণ পরপর ঘটে চলেছে। এ থেকে আবারো বোঝা যাচ্ছে শ্রমিকশ্রেণির কোন জাতীয়তা নেই, পৃথিবীজুড়ে তাদের একটাই শ্রেণি পরিচয়, তাদের স্বার্থও একটাই, এই ধরণীতে তাদের শত্রুও একটাই। পুঁজিবাদ প্রলেতারিয়েতকে মজুরি-শ্রমের এই ভারী শেকলটা পরে থাকতে বাধ্য করে, তবে একইসঙ্গে এই শেকলই বিশ্বজুড়ে তাদের যুক্তও করে, একত্র করে সারা বিশ্বের শেকলপরা প্রলেতারিয়েতকে।

গ্রীসে আমাদেরই শ্রেণিভাইবোনেরা আক্রমণের শিকার আর তারাই এই আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়তে নেমেছে তাই তাদের সংগ্রাম আমাদেরই সংগ্রাম।

গ্রীসের শ্রমিকশ্রেণির প্রতি আমাদের সংহতি জানাই! একটাই শ্রেণি আমাদের, লড়াইও আমাদের একটাই!

বুরজোয়ারা আমাদের মধ্যে হাজারোরকমের বিভেদ সৃষ্টির চক্রান্ত অনবরত চালিয়ে যাচ্ছে--এই সমস্ত চক্রান্ত আমাদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। সেই আদ্যিকাল হতে চলে আসা শাসকশ্রেণির নীতি: ভাগ কর শাসন কর’—এর বিরুদ্ধে আমাদের শ্লোগান আজ একটাই: দুনিয়ার মজদুর এক হও।

ইউরোপে, বিভিন্ন দেশীয় বুরজোয়ারা বলছে আমাদেরকে যদি পেটে গামছা বেঁধে পড়ে থাকতে হয় তো তার দায় গ্রীসের। সেখানে দেশ পরিচালনার দায় যাদের কাঁধে তারা অসততা করেছেদশকের পর দশক তারা দেশটাকে ঋণের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে দিয়েছে, সরকারী অর্থের অপব্যয়, তছরুপ এবং লুটপাট করেছে আর এরাই ইউরোর প্রতি বিশ্বজোড়া আস্থার যে সংকট তার জন্য দায়ী। একটার পর একটা, এইসব ফালতু অজুহাত দেখিয়ে সরকারগুলো কেন ডেফিসিট কমাতে হবে তার ব্যাখ্যা দিচ্ছে আর আমাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে ব্যয় সংকোচেরর কঠোর পদক্ষেপগুলো।

গ্রীসে সমস্ত সরকারী পার্টিগুলো জাতীয়তাবাদের পালে হাওয়া দিচ্ছে; এদের পুরোভাগে আছে গ্রীসের কম্যুনিস্ট পার্টি; এরা দোষ চাপাচ্ছে বিদেশী শক্তির ওপর। বাম আর অতিবামদের মিছিলে কান পাতুন, শুনতে পাবেন: আই.এম.এফ. আর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন নিপাত যাককানে আসবে জার্মান নিপাত যাকএই শ্লোগান। গ্রীসের জাতীয় পুঁজিবাদকে টিকিয়ে রাখার জন্য এরা যথাসাধ্যই করছে।

 বুরজোয়াদের কোন কোন গোষ্ঠী বলছে ইউএস-এতে স্টক মার্কেটে ধস নামার কারণ হল ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অস্থির অবস্থা। কোম্পানীগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ ইউরো কারেন্সির দুর্বল অবস্থা কেননা, ডলার এবং ইউএসের রপ্তানীর ক্ষেত্রে ইউরো একটা প্রতিবন্ধক।....

সংক্ষেপে, প্রতিটা জাতীয় বুরজোয়া তাদের প্রতিবেশী বুরোজোয়া দেশগুলোকে অভিযুক্ত করছে আর শ্রমিকশ্রেণিকে ব্ল্যাকমেল করছে। এরা বলছে: ব্যয়সংকোচ মেনে নাও নয়তো দেশ দুর্বল হয়ে পড়বে আর এর সুফল ভোগ করবে আমাদের প্রতিযোগী অন্য দেশগুলো। এভাবে জাতীয়তাবাদের বিষাক্ত ইনজেকসন দিয়ে এরা আমাদের শ্রেণি সংগ্রামের রাস্তা থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছে।

কতকগুলো প্রতিযোগী পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসাবে বিভাজিত ধরণী আমাদের ধরণী নয়। যে বিশেষ রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে বাস করছি সেই রাষ্ট্রীয় পুঁজির স্বার্থে শৃঙ্খলিত থেকে শ্রমিকশ্রেণির কিচ্ছু পাবার নেই। আজ জাতীয় অর্থনীতিকে বাঁচাবার স্বার্থে ওদের চাপিয়ে দেওয়া ব্যয়সংকোচের কালা কানুন মেনে নেওয়ার মানে আগামীকাল আরও কঠোরতর আত্মত্যাগ মেনে নিতে প্রস্তুত থাকা।

গ্রীস আজ গভীর খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে। আজ স্পেন, ইতালি এবং পর্তুগাল ঠিক তার পিছনের সারিতে; বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানী, আমেরিকা আজ ভীষণ এক সংকটের মুখোমুখি--- এসবের কারণ পুঁজিবাদ এখন আক্ষরিক অর্থেই মুমূর্ষ ব্যবস্থা। পুঁজিবাদের নৈরাজ্যের অতল তলে ক্রমাগত আরো তলিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত দেশ। গত চল্লিশটা বছর ধরে পুঁজিবাদী বিশ্ব অর্থনীতি সংকটাপন্ন। এক মন্দা থেকে আরেক মন্দার ভেতর দিয়ে চলেছে সে।  এ্যাদ্দিন শুধুমাত্র বাঁচার চেষ্টায় মরীয়া পুঁজিবাদ লাগামছাড়াভাবে ঋণের আশ্রয় নিয়েই যেটুকু সম্ভব বিকাশটুকুকে জিইয়ে রাখতে পেরেছে; কিন্তু তার ফলাফল আজ কী? প্রতিটি ব্যক্তি, প্রতিটি পরিবার, কোম্পানী, ব্যাঙ্ক আর রাষ্ট্র সমস্তটাই ঋণভারে জর্জরিত। গ্রীস রাষ্ট্রের দেউলিয়া হয়ে যাওয়াটা এই শোষণভিত্তিক ব্যবস্থাটার সাধারণ এবং ঐতিহাসিকভাবে দেউলে অবস্থারই একটা বিশেষ বিকৃত প্রকাশমাত্র।

শাসকশ্রেণির দরকার আমাদের ঐক্য ভাঙা: আমাদের দরকার শ্রেণি-সংহতি!

শ্রমিকশ্রেণির শক্তি তার ঐক্য!

শাসকশ্রেণি ব্যয়সংকোচের যে প্ল্যান ঘোষণা করেছে তা আসলে আমাদের জীবনযাপনের অবস্থার ওপর সামগ্রিক একটা আক্রমণ। সুতরাং এর বিরুদ্ধে একমাত্র দাওয়াই শ্রমিকশ্রেণির ব্যাপক শ্রেণি-সংগ্রাম। নিজের ছোট্ট চৌহদ্দির ভেতর লড়াই করে একে ঠেকানো অসম্ভব: তা সে নিজ নিজ ফ্যাক্টরি, স্কুল, অফিস যাই হোক; একাএকা এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন থেকে কোন আন্দোলনই আজ আর এই বিপুল আক্রমণকে প্রতিহত করতে পারবে না। সুতরাং সমস্ত ক্ষেত্রের সমস্ত শ্রমিকের ব্যাপক আন্দোলন আজ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।  শাসকেরা সেক্টরভিত্তিক লড়াই চূর্ণ করে দেবেই, আর বাধ্য করবে গভীরতর দারিদ্রে নিমজ্জিত হতে। এর বিপরীতে একমাত্র উপায় সমস্ত বিভাজনরেখার ভেঙে চূড়মার করে সমস্ত সেক্টরের শ্রমিকের ঐক্যবদ্ধ এবং সুসংহত লড়াই। 

লক্ষ্য করুন অফিসিয়াল সংগ্রাম-বিশেষজ্ঞদের মানে ট্রেডইউনিয়নওয়ালাদেরকী করছে তারা? অসংখ্য কর্মক্ষেত্রে তারা ধর্মঘট সংগঠিত করছে:কিন্তু একটিবারের জন্যও তাদের চেষ্টা নেই এই সমস্ত পৃথক পৃথক আন্দোলনগুলোকে একসূত্রে গাঁথার। বরং সেকসনগত, বিশেতঃ সরকারী এবং বেসরকারী ক্ষেত্রগুলোর শ্রমিকদের মধ্যে বিভাজনটাকে এরা সক্রিয়ভাবে উৎসাহিতই করছে। তারা শ্রমিকদের নিষ্ফল, নিষ্ক্রিয় প্রতিবাদ-কর্মসূচীতে সামিল করছে; সোজা কথায় তারা ওয়ার্কারদের ঐক্য বিনাশ করারই বিশেষজ্ঞ। ইউনিয়নগুলোও একইরকমভাবে জাতীয়তাবাদী মনোভাবকে আরো চাঙ্গা করতে চাইছে। একটা উদাহরণ দিই: মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে ইউনিয়নগুলোর একটা গালভরা কমন্‌ শ্লোগান হল: স্বদেশী জিনিস কেনো!

ইউনিয়নের রাস্তায় হাঁটা মানে ঐক্যের বিপরীতে হাঁটা, পরাজয়ের পথে হাঁটা। শ্রমিকদের নিজেদের সংগ্রাম নিজেদের হাতেই নিতে হবে; সব শ্রমিকদের সম্মিলিত সাধারণ সভায় নিজেদের সংগঠিত করার মধ্য দিয়ে, সাধারণ সভায় সংগ্রামের দিশামুখ, পদ্ধতি ইত্যাদি সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভেতর দিয়ে, নিজেদের দাবী আর শ্লোগান সম্মিলিতভাবে ঠিক করার মধ্যে দিয়ে, সংগ্রাম পরিচালনার জন্য, যেকোন সময়ে প্রত্যাহারযোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচন করে, সংগ্রাম কমিটি গঠন করে, কাছাকাছি থাকা ফ্যাক্টরি, স্কুল. কলেজ. হাসপাতালইত্যাদি সম্ভাব্য সব জায়গায়কর্মরত শ্রমিকদের সঙ্গে (যাতে তারাও আন্দোলনে সামিল হয় সেই্ লক্ষ্যে) আলোচনা করার জন্য প্রতিনিধি পাঠানোর কাজ সংগঠিত করার মধ্যে দিয়ে শ্রমিকশ্রেণিকে একাজ করতে হবে।

ট্রেডইউনিয়ন চৌহদ্দির বাইরে বেরিয়ে, শ্রেণি তার নিজের সংগ্রামের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবে নিজেই, অন্যান্য সেক্টরের শ্রমিকের কাছে যাবে—এগুলো বেশ কঠিন কাজ মনে হতে পারে। আসলে শ্রমিকশ্রেণির নিজ শ্রেণির প্রতি গভীর আস্থার অভাব আজকের দিনে শ্রেণিসংগ্রাম বিকাশের ক্ষেত্রে একটা বিরাট বাধা। নিজের শ্রেণিটা যে কি বিপুল শক্তি ধরে সেটা সম্বন্ধে তারা নিজেরা পুরোপুরি সচেতন নয়। এই মুহূর্তে একদিকে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট, পুঁজিবাদের হিংস্র আক্রমণ, অন্যদিকে প্রলেতারিয়েতের স্ব-শ্রেণির প্রতি দৃঢ় আস্থার অভাব সব মিলে একটা অচল, অবশ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি যেমনটা দাবী করে এমনকি গ্রীসেও, শ্রমিকের সাড়া, তার তুলনায় অনেকটাই ক্ষীণ। তাসত্বেও ভবিষ্যৎ শ্রেণিসংগ্রামেরই হাতে। পুঁজিবাদের আক্রমণের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণির ক্রমবর্ধমান এবং ব্যাপক আন্দোলনই সামনে এগোনোর একমাত্র রাস্তা।

কিছু মানুষ জিগ্যেস করছেন, “ কেন আন্দোলন করব? এ আন্দোলনের পরিণতিটাই বা কী? পুঁজিবাদ তো দেউলে হয়ে গেছে, কোন সংস্কারই যখন সম্ভব নয়, তখন আর কিইবা রাস্তা থাকে?” সত্যি বলতে কি, এই শোষণভিত্তিক ব্যবস্থার ভেতর আর কোন সমাধান নেই। কিন্তু কুত্তার মত বাঁচতে অস্বীকার ক’রে সম্মিলিতভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর মানে আপন মর্যাদা রাখার দাঁড়ানো। এর মানে এই উপলব্ধি যে এই প্রতিযোগিতা আর শোষণ ভিত্তিক বিশ্বেও সংহতি নিশ্চিতভাবেই আছে আর এই অমূল্যবান মানবিক অনুভবটিকে বিশ্বজুড়ে বাস্তবায়িত করতে শ্রমিকশ্রেণি সক্ষম। আর এখান থেকেই আরেক নতুন ধরণীর অভ্যুদয়ের শুরু: একটা বিশ্ব যেখানে কোন শোষণ নেই, রাষ্ট্রীয় সীমানা নেই, নেই কোন সেনাবাহিনী; সে বিশ্ব লাভের জন্য নয়, মানুষের জন্য। শ্রমিকশ্রেণি নিজের শক্তির ওপর গভীর আস্থা গড়ে তুলতে পারে এবং তা তাকে করতেই হবে। একমাত্র এই আস্থাই সেই মানবিক বিশ্ব গড়ে তুলতে সক্ষম; এই আস্থাই   মার্কসের ভাষায় “পরিস্থিতির দাসত্ব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে স্বাধীনতার পরিমন্ডলে উত্তরণের” মধ্যে দিয়ে মানুষের প্রজাতিগত সত্তার প্রকৃত বিকাশ ঘটাতে পারে।

পুঁজিবাদ দেউলিয়া কিন্তু আরেক বিশ্ব সম্ভব, সে হল কমিউনিজ্‌ম্‌!

ইন্টারন্যাশানাল কমিউনিস্ট কারেন্ট, ২৪শে মে ২০১০