Communist Internationalist - 2000s

Communist Internationalist - 2003

  

ICC anti-war leaflet

সংযুক্তিসাইজ
PDF icon antiwarleaflet.pdf88.31 কিলোবাইট

Communist Internationalist - 2006

 

কোরিয়ায় যুদ্ধের হুমকির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকতা

অক্টোবার ২০০৬র শেষ দিকে, সোস্যালিষ্ট পোলিটিকাল এ্যালায়েন্স(SPA) র ডাকে আন্তর্জাতিকতাবাদী  কিছু সংগঠন, গ্রুপ এবং সদস্যদের নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সিওল এবং উলসান্ শহরে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উপস্থিতির হার যত অল্পই হোক না কেন, আমরা যতদূর জানি, এসপিএ-ই হল দূর প্রাচ্যে কম্যুনিষ্ট লেফ্টের নীতির   প্রথম সংগঠিত প্রকাশ আর এই ধরণের সম্মেলন অবশ্যই প্রথম।এর একটা ঐতিহাসিক তাৎপরয আছে বলে আমরা মনে করি আর তাই এই সম্মেলনের প্রতি আইসিসি(International Communist Current )  সম্পূর্ণ সমথর্ন

 জানিয়ে সম্মেলনে তার একজন প্রতিনিধি  পাঠিয়েছে। [১] 

যাইহোক, সম্মেলন চলাকালীন সম্মেলনের লক্ষ্যের সুদূর প্রসারী রাজনৈতিক গুরুত্বের দিকটা কিছুটা চাপা পড়েছে ; কারণ,  উত্তর কোরিয়ার প্রথম পরীক্ষামূলক পরমানু বোমা বিস্ফোরণের পরিপ্রেক্ষিতে এখানকার আন্ত-সাম্রাজ্যবাদী টানাপোড়েন নাটকীয়ভাবে তীব্রতা লাভ করেছে এবং তাকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলে উপস্থিত সাম্রাজ্যবাদী-শক্তিগুলো (USA, China, Japan, Russia, South Korea) নানাবিধ জঘন্য কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিচছে/অবস্থান গ্রহণ করছে। ফলতঃ, এই প্রশ্নটা সম্মেলনে একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে এবং প্রধান আলোচ্য হয়ে ওঠে। আলোচনায় তীব্র বিতর্ক চলে এবং অবশেষে যেসব সিদ্ধান্ত উঠে আসে তার ভিত্তিতে সম্মেলনে উপস্থিত(যাদের নাম নিচে উল্লিখিত হল) সকলের সম্মতিতে নিম্নলিখিত ঘোষণাপত্র গৃহিত হয়:

 কোরিয়ায় যুদ্ধের হুমকির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকতাবাদী ঘোষণা:

উত্তর কোরিয়ায় পরীক্ষামূলক পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সিওল এবং উলসানে অনুষ্ঠিত কম্ম্যুনিষ্ট আন্তর্জাতিকতাবাদীদের সম্মেলনে এই ঘোষণা করছি যে  ---------------

আমরা.............

.                      আর অন্য কোন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের নতুন করে  পারমানবিক হাতিয়ার তৈরির ক্ষমতা লাভের তীব্র নিন্দা করছি:  আন্ত-সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে সব্বোর্চ্চ হাতিয়ার নিউক্লিয়ার বোমা, এর কাজ হল সাধারণভাবে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষকে হত্যা করা এবং বিশেষ ভাবে শ্রমিকশ্রেণিকে হত্যা করা।

.                       পুঁজিবাদী রাষ্ট্র উত্তর কোরিয়া কতৃর্ক যুদ্ধের পথে এই নয়া পদক্ষেপকে নিঃশর্ত্তে ধিক্কার জানাচ্ছি। উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্র কতৃর্ক গৃহিত এই পদক্ষেপ আবারো একবার সুনিশ্চিতভাবে প্রমান করছে(অবশ্য যদি এই প্রমান করার কোন আবশ্যকতা থেকে থাকে) যে এই রাষ্ট্রের সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণি বা কম্যুনিজমের কোন সংস্রব নেই বরং এ হল চূড়ান্ত অবক্ষয়ী পুঁজিবাদের মিলিটারি বারবারিজমের সাধারণ প্রবণতার একটা চূড়ান্ত প্রকাশ।

.                       ইউএসএ এবং তার জুটিরা উত্তর কোরিয়ান শত্রুর বিরুদ্ধে যে ভন্ড প্রচার চালাচ্ছে তাকে নিঃশর্ত্তে নিন্দা করছি। তাদের এই বড় বড় বুলি আসলে  উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে আগে থেকে আঘাত হানার (যখনই তারা একাজ করতে সমর্থ হবে) মতাদর্শগত প্রস্তুতি ছাড়া কিছুই নয়। আর এই আঘাতের প্রধান বলী হবে শ্রমজীবি মানুষ যেমনটা আমরা ইরাকের বেলায় দেখছি। আমরা একথা ভুলিনি যে পৃথিবীতে ইউনাইটেড স্টেটই একমাত্র রাষ্ট্র যে যুদ্ধে পরমাণু বোমা ব্যবহার করেছিল, হত্যা করেছিল হিরোসিমা ও নাগাসাকির হাজার হাজার সাধারণ নাগরিকদের।

.                      তথাকথিত শান্তি উদ্যোগকে খোলাখুলি নিন্দা করছি। এই উদ্যোগ স্বভাবতই অন্য সাম্রাজ্যবাদী মস্তান বাহিনী যথা চীন-র পক্ষ থেকে আসবেই। এ উদ্যোগ শান্তির দিকে তাকিয়ে নয়,  সংশ্লিষ্ট সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর নিজ নিজ অঞ্চলের সাম্রাজ্যবাদী/পুঁজিবাদী স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার জন্যই এই উদ্যোগ। শ্রমিকেরা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের যেকোন শান্তিকামী উদ্যোগ-র প্রতি কোনো আস্থা রাখতে পারে না।

.                      জাতীয় স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র রক্ষার অজুহাতে শ্রমিকশ্রেণি বা আন্তর্জাতিকতাবাদী আদর্শে যারা সক্রিয় তাদের বিরুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়ার বুরজোয়াদের দমন-পীড়ণমুলক সমস্ত পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা করছি।  

 সেনা আক্রমণ ঘটলে যারা সবথেকে আগে আর বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেই উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপান এবং রাশিয়ার শ্রমিকদের প্রতি,  আমাদের সম্পূর্ণ সংহতি ঘোষণা করছি।

.                      ঘোষণা করছি যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়   বরবরতা, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ, পারমানবিক হাতিয়ার প্রয়োগের যে বিপদসংকেত সবর্দাই আমাদের মাথার  ওপর ঘনিয়ে আছে, তার চিরকালীন অবসান ঘটাতে পারে শুধুমাত্র বিশ্বব্যাপী ঐক্যবদ্ধ  শ্রমীক সংগ্রাম।

শ্রমিকের কোন দেশ নেই, কোনো দেশের পক্ষে সে দাঁড়াতে পারে না।

সমস্ত দেশের শ্রমিকেরা--- ঐক্যবদ্ধ হও!

এই ঘোষণাপত্রে যেসব সংগঠন এবং গ্রূপ সই করেছেন :

ইন্টারন্যাশনাল কম্যুনিষ্ট কারেন্ট

সোস্যালিস্ট পোলিটিক্যাল এ্যালায়েন্স(কোরিয়া), সিওল গ্রূপ মিটিং অফ টোয়েনটি সিক্স্থ অক্টোবার, ২০০৬

ইন্টারন্যাশনাল পার্সপেকটিভস

…………………………………………

সম্মেলনে উপস্থিত কিছু কমরেড ব্যক্তি হিসেবে ্ই ঘোষণায় সাক্ষর করেছেন; তাঁরা হলেন:

SJ (Seoul Group for Workers’ Councils)
MS (Seoul Group for Workers’ Councils)
LG
JT
JW(Ulsan)
SC(Ulsan)
BM

[১] সম্মেলন প্রসঙ্গে আমরা পরে আরো ডিটেলসে লিখব(আইসিসি)

ফ্রান্সে পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলন

বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, ভবিষ্যতের বেকার, হবু অস্থায়ী ও আংশিক-সময়ের  শ্রমিক এবং বতর্মান শ্রমিক

পুঁজিবাদ বিরোধী সংগ্রামে সামিল হলেসকলেই

ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম থেকে বিদ্যালয়গুলিতে ছুটি থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ফ্রান্সের অধিকাংশ বড় শহরগুলিতে সরকার ও মালিকের অথনৈতিক আক্রমনের বিরুদ্ধে এবং CPE1 আইনের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়েছে এবং তাদের ক্ষোভ উগরে দিয়েছে, যদিও গণমাধ্যমগুলি (বিশেষত, টিভি) এ বিষয়ে সম্পূণ নীরব। বরং বারবারিয়ান গ্যাং2 এর জঘন্য ক্রিয়াকলাপগুলি প্রচারের আলোতে নিয়ে আসার প্রতিই তাদের মনোযোগ বেশি। 

বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিক্ষোভ কতটা সঠিক?

স্কুল,কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা সস্তা শ্রমের ভান্ডার পূরণ করার জন্য প্রয়োজনীয় বেকার উৎপাদনের কারখানায় পরিণত হয়েছে। এটা ছাত্রসমাজ উপলব্ধি করেছে এবং সেই জন্যই পাশ্ববর্তী কারখানার শ্রমিক ও বিভিন্ন অঞ্চলের বেকার যুবকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য এবং তাদেরকে সংগ্রামে সামিল করার জন্য তারা বিভিন্ন ছাত্র-সমাবেশ থেকে(যেমন Caen এ হয়েছে) প্রতিনিধি পাঠিয়েছে । আসলে CPE শ্রমিক শ্রেণীর কাছে একটি পরিকল্পিত অনিশ্চয়তা ছাড়া কিছুই নয়। এই অনিশ্চয়তা শুধু যুব সমাজের উপরই প্রভাব ফেলেনি, শ্রমিক শ্রেণীর প্রত্যেক প্রজন্মই এই অনিশ্চয়তা, বেকারত্ব ও দারিদ্রের শিকার। এই জন্যই কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের(যেমন Paris III Censier) অধ্যাপক,শিক্ষাকমী বন্ধুরাও এই ছাত্রছাত্রীদের প্রতি একাত্ম হয়ে ধমর্ঘটে সামিল হয়েছে।

CPE আসলে পুঁজিবাদের দেউলিয়াপনারই নগ্ন প্রকাশ ।

গত নভেম্বরে প্রবাসী যুবকেরা তাদের প্রতি অন্যায়, অপমান ও লাঞ্ছনার প্রতিবাদে  নতুন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শহরতলিগুলিতে দাঙ্গায় মেতে ওঠে ; শাসকশ্রেণী এবং তাদের সরকার পাল্টা কার্ফু জারি করে এবং প্রবাসী যুবকদের দেশে থাকার অধিকার নেই বলে বিতাড়িত করে তাদের শৃঙ্খলা বজায় রাখে। বতর্মানে সেই শাসক শ্রেণী শ্রমিকদের সন্তানসন্ততিদের উপর বলপ্রয়োগ করে ঠান্ডা করার(power cleanse)এর নীতি চালিয়ে যেতে চায়। কোন শ্লোগানই এর চেয়ে বেশি অমানবিক নয়। তারা সুযোগের সাম্যের নামে CPE  আইনের মধ্য দিয়ে অনিশ্চয়তা ও স্বল্প মজুরির বিষয়টি আরোপ করতে চায়। এই আইনে যে সব সৌভাগ্যবান একটি চাকরি জোগাড় করতে পারবে তারা নিজেদেরকে মালিকের করুণার পাত্র হিসেবে দেখবে, যদিও তারা ঘরবাঁধা ও সন্তান প্রতিপালনের মতো বাঁচার আশাটুকুও  দেখতে পাবে না। তারা রোজই কাজে যাওয়ার সময় এই ভয়ে থাকবে যে এই বুঝি তাদের হাতে সেই মুদ্রিত চিঠিটি ধরিয়ে দেওয়া হবে যাতে এই অশুভ বাক্য লেখা থাকবে

  তোমাকে আর প্রয়োজন নেই এই হলো মজুরি দাসত্ব! এই হলো পুঁজিবাদ !

CPE শুধুমাত্র সেই সাম্যই দিতে পারে যা দারিদ্রের সাম্য।  CPE  পারে শহর শেষের ঘিঞ্জি, নিচু জলা এলাকায় শ্রমিক শ্রেণীকে ঠেসে গুঁজে দিতে,কোন রকমে গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য একটি অস্থায়ী কাজ থেকে অন্য একটি অস্থায়ী কাজে দৌড় করাতে অথবা বেকার ভাতা বা RMI3 দিয়ে  তিলে তিলে মারতে  ----  এই হলো সেই উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ যা শাসক শ্রেণী এবং তাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র শ্রমিক শ্রেণীর সন্তানসন্ততিদের জন্য CPE র মধ্য দিয়ে উপহার হিসেবে নিয়ে এসেছে।

এই সব শিশুদের পিতামাতারাই ২০০৩ সালে পেনশন সংস্কার আইনের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছিল, এবং তখন প্রধানমন্ত্রী ভিলপাঁর পূবর্সূরী  র্যাফরিন এই বলে রাস্তায় নেমে পড়া সংগ্রামীদের উদ্দেশে তিক্ততা প্রকাশ করেছিলেন যে রাস্তা দেশ শাসন করে না (It’s not the street that rules)

বয়স্ক শ্রমিক তথা ভবিষ্যত পেনশনভোগীদের উপর আক্রমনের পর পুঁজিবাদ এখন যুব-সম্প্রদায় তথা ভবিষ্যত বেকারদেরকে আক্রমনের লক্ষ্যবস্তু হিসাবে স্থির করেছে। CPE  আইনের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদের আসল চেহারা  অনাবৃত হয়ে গেছে যে , একটি অবক্ষয়িত ব্যবস্থা নতুন প্রজন্মকে কিছুই দিতে পারেনা।বর্তমানে এটি এমন একটি ব্যবস্থা যা অনতিক্রমনীয় অর্থনৈতিক সংকটের দ্বারা পচনশীল হয়ে পড়েছে। এটি সেই ব্যবস্থা যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে শুধু অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র তৈরী করতে বিপুল পরিমান অর্থ ব্যয় করে চলেছে ।১৯৯১ -এর উপসাগরীয় যুদ্ধের পর থেকে রক্তস্রোত একবারও থামেনি । বতর্মানে পুঁজিবাদ হল সেই দেউলিয়া ব্যবস্থা যা লক্ষ লক্ষ মানুষকে শুধু বেকারত্ব ও দারিদ্র দিয়েছে এবং নিবির্চারে হত্যা চালিয়েছে ইরাকে, মধ্যপ্রাচ্যে ও আইভরি উপকূলে4

দিনের পর দিন যে অবক্ষয়িত পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পৃথিবীর উপর তার শাসন কায়েম করে রেখেছে তাকে যে কোন মূল্যে উৎখাত করতেই হবে।এই কতব্য র্অনুধাবন করেই প্যারিস টোলবিয়াক(Paris Tolbiac) এর ছাত্র সমাবেশ থেকে ঘোষিত হয়েছিল সেই শ্লোগান এটাই পুঁজিবাদকে উৎখাত করার মোক্ষম সময় (It’s time to put an end to capitalism)আর সেই কারণেই গত ৩রা মার্চ Paris Censier  এর ছাত্ররা বিপ্লবী গান গাওয়ার জন্য একটি থিয়েটার সংস্থাকে আমন্ত্রণ জানায়; উত্তোলিত হয় লাল নিশান এবং শতশত ছাত্র শিক্ষক ও কর্মচারী বন্ধুরা আন্তর্জাতিক সংগীত(Internationale) এর সঙ্গে গলা মেলায়।বিশ্ববিদ্যালয়চত্বরে মার্কসের কমিউনিস্ট ইস্তাহারের কপি বিতরণ করা হয়,বারংবার ধ্বনিত হতে থাকে বিপ্লব(REVOLUTION) শব্দটি।  ছাত্ররা শুরু করে শ্রেণী সংগ্রামের উপর আলোচনা, যেখানে উঠে আসে ১৯১৭র রাশিয়ার বিপ্লবের প্রসঙ্গ, আলোচনায় রোজা লুক্সেমবার্গ,কার্ল লিবনেটের মতো শ্রমিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্বদের নাম উঠে আসে যাদেরকে ক্ষমতাসীন সোশালিস্ট পার্টির নির্দেশে হত্যা করা হয়েছিল।  শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হলে তাদের অবশ্যই অগ্রজদের সংগ্রামের অভিজ্ঞতা স্মরণ করতে হবে।  বিশেষ করে মনে রাখতে হবে ১৯৬৮র মে মাসের ঐতিহাসিক আন্দোলনের কথা।   

১৯৬৮র মে মাসের আন্দোলন আমাদের সমুখ পানের পথ-নির্দেশ দিয়েছে

সেই উত্তাল সময়ে অধিকাংশ উন্নত দেশের বিশেষভাবে আমেরিকা ও জামার্ন  বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও ছাত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল।ফ্রান্সের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৯৬৮-র মে-তে দারুনভাবে সংঘবদ্ধ হয়েছিল। তাদের এই সংঘবদ্ধতা তখনই সম্পূরণো নতুনমাত্রা পেয়েছিল, যখন ধর্মঘটী ৯ লক্ষ শ্রমিকের সঙ্গে সমগ্র শ্রমিকশ্রেণী এই আন্দোলনে সামিল হয়েছিল। তখন বেশীরভাগ সচেতন ছাত্ররা তাদের বিশেষ দাবী-দাওয়া থেকে সরে গিয়ে শ্রমিকশ্রণীর সাধারণ দাবীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে শ্রমিকশ্রেণীর অংশ হিসেবেই নিজেদেরকে যুক্ত করেছিল।  তারা শ্রমিকদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে আন্দোলনের পরিস্থিতি ও পরিপ্রেক্ষিত আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।প্রত্যেক জায়গায় বিপ্লব তথা পুঁজিবাদকে উৎখাত করার প্রয়োজনীয়তা __এই ছিল বির্তকের বিষয় ।

মে ১৯৬৮-র আন্দোলন বিপ্লবের পরিণতি পায়নি । পায়নি কারণ তখনও পযন্ত পুঁজিবাদী সংকট ছিল সূচনাপরবে। কিন্তু তাতেই  বুর্জোয়ারা তাদের অস্তিত্ব সর্ম্পকে ভীত হয়ে পড়েছিল । সরকার যেভাবে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হয়েছিল তাতে ইউনিয়নগুলিকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ ,কারণ তাদের যথাসাধ্য চেষ্টার দ্বারা  ধমঘর্টীদের কাজে ফেরৎ পাঠানো সম্ভব হয়েছিল । ধন্যবাদ প্রাপ্য বামপন্থী সংগঠনগুলির এবং বিশেষকরে সেই সব সংগঠনগুলোর যারা শ্রমিকশ্রেণীর স্বাথরর্ক্ষার নামে De Gaulle5-র ডাকা নিবাচর্নে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিল।

মে-র ১৯৬৮ দেখিয়েছে বিপ্লবযাদুঘরের ধুলোয় ঢাকা পড়া নিছক প্রদশর্নীর সামগ্রী নয়। বিপ্লব কোন সুদূর  অতীতের ধারনা মাত্র নয় ,বরং সমাজের অপরিহারয ভবিষ্যৎ হল বিপ্লব। সেদিনের সংঘবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলন দেখিয়েছে যে,শাসকশ্রেণী সমাজের শোষিত মানুষকে আর জাতীয়তাবাদের পতাকাতলে ধরে রাখতে পারবে না, দেখিয়েছে  ১৯১৪ ও ১৯৩৯ সালের মতো একটি ৩য় বিশ্বযুদ্ধ  সংগঠিত করার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে শ্রমিকশ্রেণী স্বয়ং। গভীরতম অর্থনৈতিক মন্দা থাকা সত্ত্বেও শ্রমিকশ্রণীর সংঘবদ্ধ আন্দোলনের জন্যই বুরজোয়ারা ১৯৩০-এর মতো নিবির্চার মানবহত্যার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি।

ভবিষ্যৎ নয়া প্রজন্মের হাতে

CPEর বিরুদ্ধে যুব সম্প্রদায়ের আন্দোলন দেখাল যে, ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদের গর্ভে নতুন সমাজের বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছে। ভবিষ্যৎ এই নয়া প্রজন্মের হাতেই। বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ অনুধাবন করতে শুরু করেছে যে, বেকার অথবা অনিশ্চিত শ্রমিকহিসেবে তাদের বেশিরভাগ অংশটাই ভবিষ্যতের শ্রমিক শ্রেণীর অন্তর্গত।তারা সেই শোষিত শ্রেণী, পুঁজিবাদ যাদের উৎপাদন-পদ্ধতি থেকে ক্রমাগত বেশী পরিমানে ছাঁটাই করে চলেছে।এরা সেই শ্রেণী যাদের সামনে নিজেদের ও সন্তানদের ভবিষ্যত রক্ষা করা এবং লড়াইকে জোরদার করা ছাড়া আর কোন কিছু বেছে নেবার নেই। এরা সেই শ্রেণী যাদের সামনে শোষণ, দারিদ্র, বেকারত্ব ও ববরর্তার অবসান ঘটানোর উপায় হিসাবে পুঁজিবাদকে উৎখাত করা ছাড়া আর কিছু বেছে নেবার নেই ।এরাই সেই একমাত্র শ্রেণী যারা গড়ে তুলতে পারে নতুন বিশ্ব, যে বিশ্ব শোষণ,প্রতিযোগিতা ও মুনাফার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে না বরং তা সমগ্র মানবসমাজের চাহিদার সন্তুষ্টিবিধান করবে । ১৯১৪ সালের যুদ্ধক্ষেত্রে কামানের খাদ্য হিসাবে যাদের পাঠানো হয়েছিল তারা বেশীরভাগই ছিল শ্রমিকশ্রেণীর অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান। রোজা লুক্সেমবার্গ যাদের বলেছিলেন সবর্হারার সুন্দর কুসুম,সেই নতুন প্রজন্মকেই পুঁজিবাদ ছিঁড়ে-খুড়ে রক্তলাঞ্ছিত করেছিল। 

 একবিংশ শতাব্দীতে এইসবহারার সুন্দর কুসুমদের দায়িত্ব নিতে হবে সেই অবক্ষয়িত পুঁজিবাদকে ধ্বংস করার, যে পুঁজিবাদ ১৯১৪ও ১৯৩৯ সালের বিশ্বযুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর প্রজন্মকে বিনষ্ট করেছে । সমগ্র শ্রমিকশ্রণীর সমস্ত প্রজন্মের সম্মিলিত সংগ্রামের বিকাশের মধ্যে দিয়েই পুঁজিবাদকে ধ্বংস করা  সম্ভব। সম্প্রতি ব্রাজিলের Vitoria da conquista বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস সংক্রান্ত বিতর্কে অংশগ্রহনের আগ্রহ প্রকাশ করেছে6। তারা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে যে, অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েই তারা তাদের পিতা-পিতামহ-প্রপিতামহদের বাহিত সংগ্রামের মশালকে প্রজ্জ্বলিত রাখতে  পারে। এই ছাত্ররা তাদের বক্তব্যই শুনতে চাইছিল যারা অতীত ইতিহাসকে তাদের মধ্যে সঞ্চালিত করতে পারবে। এ হল সেই অতীত যার উপর ভিত্তি করে নয়াপ্রজন্ম তাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবে। তারা উপলব্ধি করেছে যে, শ্রেণীসংগ্রামের জীবন্ত ইতিহাস শুধু বই পড়ে শেখা যায়না  সংগ্রামের বাস্তবভূমি থেকেও একে জানতে হয়।তারা কথা বলার,প্রশ্ন করার,ভিন্নমত পোষন করার এবং তাদের (বক্তাদের) যুক্তিকে বিরোধ করার দুঃসাহস দেখাতে পেরেছিল।যে সমস্ত শ্রমিক ,বেকার ও বিপ্লবীরা পুঁজিবাদকে উৎখাত করতে চায় তাদের জন্য এখন ফ্রান্সের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বক্তৃতামঞ্চগুলোর দরজা খুলে রাখা উচিৎ ।

সামনে এখন একটিই পথ : সমগ্র শোষিত শ্রেণীর ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলা।    

 বেশ কিছু সময় ধরে পৃথিবী জুড়ে শ্রমের দুনিয়া জামার্নী,স্পেন, আমেরিকা,ভারত ও লাতিন আমেরিকার রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ক্ষেত্রগুলি ধমর্ঘটের দ্বারা আলোড়িত হয়ে চলেছে। বেকারী ও ছাঁটাইর বিরুদ্ধে প্রতিটি জায়গাতেই ধমর্ঘটীরা সমস্ত প্রজন্মের মধ্যে এবং বেকার ও চাকুরীজীবিদের মধ্যে সংহতির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে।

ছাত্রসমাজ! যদি তোমরা বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চবিদ্যালয়ের চার দেওয়ালের গন্ডীর মধ্যে নিজেদেরকে আবদ্ধ রাখো তাহলে CPEর বিরুদ্ধে তোমাদের বিক্ষোভ মাত্র ৯ দিনের বিস্ময় হয়ে থেকে যাবে।   তোমাদেরকে উৎপাদন-প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হচ্ছে, ফলে তোমাদের হাত থেকে পুঁজিবাদী-অর্থনীতিকে অসাড় করে দিয়ে শাসকশ্রণীর উপর চাপ সৃষ্টির  হাতিয়ারটাই কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।

শ্রমিক, বেকার ও পেনশনভোগীগন! এখন সংঘবদ্ধ হওয়ার সময়,কারণ আপনাদের সন্তান-সন্ততিরা এখন আক্রান্ত। আপনারাই সমাজের সম্পদ উৎপাদন করে এসেছেন এবং এখনো করে চলেছেন। পুঁজিবাদ-বিরোধী সংগ্রামের প্রধান চালিকাশক্তি আপনারাই।

শহরতলির বেকার যুবকগন !  শুধু তোমরাই বঞ্চিত হবে তা নয়! বতর্মানে পুঁজিপতিরা  তোমাদের বলছেইতর-উছৃঙ্খল-জনতা আর ১৯৬৮ সালে  যারা পুঁজিবাদের শোষনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল তোমাদের সেই পূবর্সূরীদের  তারা বলত: জঘন্য সমাজবিরোধী !       

ভবিষ্যতের একমাত্র স্বপ্ন (বিপ্লব ) অন্ধ হিংসাত্মক ক্রিয়াকলাপের মধ্যে নিহিত নেই , আছে সমগ্র শ্রমিকশ্রেণীর প্রত্যেক প্রজন্মের সংঘবদ্ধ লড়ায়ের মধ্যে ,আছে ধমর্ঘটের মধ্যে, আন্দোলনের মধ্যে,স্কুল-কলেজ-কর্মস্থলের সেইসব আলোচনাসভার মধ্যে,পথসভার মধ্যে ____যেখানে আমরা বেকারত্ব,অনিশ্চয়তা এবং দারিদ্রের বিরুদ্ধে আমাদের সম্মিলিত বিক্ষোভের প্রকাশ ঘটাতে পারি।

CPE নিপাত যাক! পুঁজিবাদ নিপাত যাক ! শ্রমিকশ্রেণীর শৃঙ্খল ছাড়া হারাবার কিছু নেই,  কিন্তু জয় করবার জন্য আছে সারা দুনিয়া

ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিষ্ট কারেন্ট(ICC) , ০৬.০৩.০৬

যদি দায়িত্ব অনুভব করেন তবে এই লিফলেটটি কপি করে প্রচার করুন।


1. CPE: Contrat Premiere Embauche: ২৬ বছরের নিচে থাকা তরুন শ্রমিকদের জন্য ভিলপাঁ সরকারের নতুন শ্রম-আইন যার অন্যতম নিয়মটি হল ২ বছরের trial period (ট্রায়াল পিরিয়ড), যে সময়ের মধ্যে, চাকরিতে নিয়োগকারী চাইলেই নিযুক্ত শ্রমিকটিকে কোন কারণ না দশির্য়েই ছাঁটাই করতে পারবে!  ইতোমধ্যেই Contrat Nouvelle Embauche (CNE) মধ্যে দিয়ে ২৫ জনের কম শ্রমিক বিশিষ্ট কোম্পানীগুলোর ক্ষেত্রে একই কালাকানুন প্রয়োগ  শুরু হয়ে গেছে। এভাবে CPE,CNE এবং CDD Seniors(বৃদ্ধ শ্রমিকদের জন্য স্বল্প সময়ের চুক্তি)র মাধ্যমে  ফরাসী শ্রম আইনকে কে এক ঝটকায় বদলে ফেলতে চাইছে  সরকার আর তার ভেতর দিয়ে বতর্মানে শ্রমিকেরা যেটুকু অধিকার ভোগ করে সেটুকুও কেড়ে নিতে চাইছে।

2.  একদল দুষ্কৃতিকারী যারা  একটি দোকানের কর্মীকে টাকা আদায়ের আশায় কিডন্যাপ করে এবং নৃসংশভাবে খুন করে।

3. Revenue Minimum d’Insertion : একজন কমর্হীন ব্যক্তির জন্য ন্যূনতম রোজগার বতর্মানে যা মাসিক মোট ৪৩৩ ইউরো--- প্রতিমাসের ঘরভাড়ার থেকেও যা কম!

4. যেখানে এখন ফরাসী সেনা শৃঙ্খলা রক্ষা(!) করছে।

5.  তৎকালিন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট

6. মাদের নোড১৭১১ তে প্রকাশিত[ ইংরাজী সাইট en.internationalism.org] দেখুন।

 

ফ্রান্সে শ্রেণি-সংগ্রাম

অভিবাদন জানাই শ্রমিক শ্রেণির নতুন প্রজন্মকে!

ফ্রান্সের চিরাক/ভেলপাঁ/সারকোজি সরকার গায়ের জোরে চাকরি সংক্রান্ত  এক জঘন্য কালাকানুন চালু করেছে যার নাম হল সি.পি.ই.(প্রথম নিয়োগ চুক্তি বা First Employment / job Contract)। এর বিরুদ্ধে সেদেশের ছাত্রসমাজ  যে  বিশাল বিক্ষোভ-আন্দোলন গড়ে তুলেছে তা বতর্মান সময়ে আন্তজার্তিক ভাবে শ্রমিকশ্রেণির   পুনরায় জেগে উঠতে থাকা  সংগ্রামগুলোর অংশ হিসেবেই দেখতে হবে।   বিভিন্ন শ্রেণির মিলিজুলি করে চলা আগেকার যেসব ছাত্র  আন্দোলন তার সাথে এর কোন মিল নেই। এ সংগ্রাম সমগ্র শ্রমিক শ্রেণির শ্রেণি-সংগ্রামের অংশ। পুঁজিবাদের অথর্নৈতিক আক্রমনের বিরুদ্ধে, নতুন প্রজন্মের সামনে নিশ্চিত দিশাহীন ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে এ আন্দোলন প্রথম থেকেই দৃঢ়ভাবে শ্রমিক শ্রেণির লাইনকেই আঁকড়ে ধরেছে। ছাত্র-ছাত্রীদের নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক          দাবি-দাওয়া

( যেমন, এল. এম. ডি. ডিপ্লোমা[1] প্রত্যাহারের দাবি)কে  পাশে সরিয়ে রেখে তারা এমন এক দাবিকে সামনে এনেছে যা প্রকৃত পক্ষে সমগ্র শ্রমিক শ্রেণির সাধারণ দাবি: সি.পি ই. বাতিল কর! কমর্ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা, বেকারি, ছাঁটাই বন্ধ কর!

এই আন্দোলনের প্রধান শক্তি হল সংগ্রামের মধ্যে ক্রমবধর্মান সক্রিয় সংহতি। উচ্চ বিদ্যালয় এবং অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীরা এটা বুঝতে পেরেছে যে: একতাই শক্তি; তারা শ্রমিক সংগ্রামের সেই পুরোনো শ্লোগানকেই  বাস্তবায়িত করছে: তোমার তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা সবার তরে। এই উপলব্ধিই তাদের সংগ্রামের পিছনে সমস্ত শিক্ষক এবং শিক্ষাকমীর্দের সামিল করতে সক্ষম করেছে, সকলকে টেনে নিয়ে গেছে ছাত্র-ছাত্রীদের স্ব-সংগঠন জেনারেল এ্যাসেমব্লি(এ.জি.)তে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা এই জেনারেল এ্যাসেমব্লিকে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে,  তাদের পিতামাতা, অন্যান্য শ্রমিক, এমনকি পেনশনভোগিদেরজন্যও (বিশেষতঃ প্যারিস III Censier-এ)  উন্মুক্ত করে রেখেছে।   সংগ্রামকে কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তা তারা শিখতে চাইছে। এক প্রকার সাজেশন বক্স নিয়ে তারা ঘুরছে রাস্তায়, সুপারমাকের্টে, বিভিন্ন কমর্ক্ষেত্রে,ইন্টারনেটে: সবর্ত্রই তাদের বক্তব্য : বলুন কিভাবে আমাদের এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, আসুন আমাদের পাশে দাঁড়ান! এভাবেই সংগ্রামের সবাপের্ক্ষা সচেতন এবং দৃঢ়চিত্ত বাহিনী সমগ্র শ্রমিক শ্রেণির সংহতিকে বিকশিত ও নিশ্চিত করা এবং সংগ্রামকে ব্যাপকতর করে তোলার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।

  সংগ্রামের প্রাণকেন্দ্র গণ সাধারণ সভা   (mass general Assemblies)

 

৭ই মারচ্-২০০৬র মিছিলের পরেপরেই ছাত্রদের গন সাধারণ সভার বিস্তার ঘটতে থাকে সারা প্যারিস তথা অন্যান্য জায়গার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। লৌহ-মানব ভিলপাঁ(ফ্রান্সের বতর্মান প্রধানমন্ত্রী) নিজের অবস্থানে অনড় থাকেন কেননা সি.পি.ই. পালির্য়ামেন্টে পাশ হয়েছে--- আর এটা তো ঠিক যে রাস্তা দেশ শাসন করবে এটা হয় না! হ্যাঁ, ২০০৩-এ তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী রাফ্যারিন একথাই বলেছিলেন যখন পেনশন-প্রথার সংস্কারের নামে   জীবনের ৪০টা বছর ধরে শোষিত হওয়ার পর অবসর-প্রাপ্ত শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনাটুকুকেও কেড়ে নেওয়ার কালাকানুন চালু করতে গিয়ে বিপুল শ্রমিকের প্রতিরোধের মুখে পড়েছিল ফ্রান্সের শাসক শ্রেণি। ছাত্রসমাজ বশ্যতা স্বীকার করেনি।বিশেষতঃ রাজধানীতে, লেকচার হলগুলো ,যেখানে এ.জি.র সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সেখানে উপচে পড়ছে ভীড়, মিছিলের সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে। ছাত্রৱা গণমাধ্যমগুলোকে তাদের নীরবতা ভাঙতে এবং মিথ্যাচারণ বন্ধ করতে বাধ্য করছে।

৮ই মারচ্ থেকে ১৮ই মারচ্,২০০৬ এই দশটা দিন ফ্রান্সের শাসক-শ্রেণির দুনিয়া কাঁপিয়ে দিয়েছে! ছাত্রসমাজের ক্রমাগত বেশিবেশি করে সংগঠিত হয়ে ওঠার এক এবং একমাত্র অভিমুখ হল: সমগ্র শ্রমিকশ্রেণির সাথে সংহতি এবং ঐক্য গড়ে তোলা। 

প্রলেতারিয়েতের প্রতিরোধ আন্দোলনের এই  দিকদিশা রাজধানীতে ছড়িয়ে পড়েছে Censier  বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা এই সংগ্রামের বিস্তার এবং কেন্দ্রীকরণের (centralisation) ক্ষেত্রে সবার্পেক্ষা অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।

জেনারেল এ্যাসেমব্লীতে সমস্ত, এমনকি পথচলতি শ্রমিকদের দুহাত বাড়িয়ে স্বাগত জানানো হয়েছে; আলোচনায় অংশ নিতে , তাদের অভিজ্ঞতার কথা বলার জন্য আহ্বান করা হয়েছে। যাঁরাই এই সাধারণ গণ সভায় ছিলেন তাঁরাই অবাক হয়েছেন শ্রেণি সংগ্রামের ক্ষেত্রে এই নতুন প্রজন্মের সৃজনশীল ক্ষমতার  প্রয়োগ দেখে! বিশেষতঃ Censier-এ অলোচনার গভীরতা, স্ট্রাইক কমিটি দ্বারা নিবার্চিত সদস্যদের দায়িত্ববোধ, তাদের আন্দোলন সংগঠিত করার সক্ষমতা, এ্যাসেমব্লী পরিচালনার দক্ষতা, যারা বলতে চায় তাদের সকলকে বলবার সুযোগ করে দেওয়া,  যুক্তি প্রতিযুক্তির মাধ্যমে,  যারা আন্দোলনকে ভেস্তে দিতে চায় তাদের মুখোশ খুলে ফেলার এবং এ ব্যাপারে অন্যদের সচেতন করার প্রয়াস ইত্যাদি সব কিছুই নিশ্চিতভাবে শ্রমিকশ্রেণির নতুন প্রজন্মের প্রাণবন্ততা এবং সক্ষমতাকে নিশ্চিতরূপে প্রমান করে।

খোলা ভোটের ভিত্তিতে নিবার্চিত এবং এ.জি. কতৃর্ক ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করতে পারা না পারার ভিত্তিতে যেকোন সময় প্রত্যাহারযোগ্য প্রতিনিধিদের নিরলস প্রয়াসের সাহায্যে ছাত্ররা সবর্দাই এ.জি.-র সাবর্ভৌম চরিত্র বজায় রাখার পক্ষে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। । ইউনিয়নস্থ এবং ইউনিয়নের বাইরে থাকা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে থেকে  সভাপতিত্ব করবার জন্য প্রতিদিন সম্পূরণো নতুন   টিম নিবার্চন করা হচ্ছে।

দায়িত্বের যথাযথ বন্টন, সংগ্রাম পরিচালনার কেন্দ্রীকরণ, বিভিন্ন অংশের কাজ ও দায়িত্বকে একসূত্রে গাঁথা এবং সমগ্র আন্দোলনের ওপর সচেতন নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য প্যারিস III-Censier-এ স্ট্রাইক কমিটি   এ.জি.-তে নিবার্চনের মাধ্যমে  কতকগুলো কমিশন তৈরি করেছে, যথা: প্রেস,  (বৃহত্তর বিষয় সমূহ নিয়ে চিন্তা করার জন্য) এ্যানিমেশন এ্যান্ড রিফ্লেক্সন্, ওয়েলকাম এ্যান্ড ইনফরমেশন কমিশন ইত্যাদি।

এ.জি.-র এই সত্যিকারের গণতন্ত্র এবং সংগ্রামের কেন্দ্রীকরণের এই প্রক্রিয়াই ছাত্রদের সবর্দাই কখন কী সিদ্ধান্ত নিতে হবে তা ঠিক করতে সাহায্য করেছে এবং এইসব ক্ষেত্রে তাদের  প্রধান লক্ষ্য থেকেছে কিভাবে শ্রমিকদের কমর্ক্ষেত্র অব্দি এই আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেওয়া যায়।

 এই পন্থা-পদ্ধতি এবং লক্ষ্যই তাদের এই সংগ্রামের আগুনকে সমগ্র শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে

ছাত্র-ছাত্রীরা স্পষ্টই বুঝতে পেরেছে যে তাদের আন্দোলনের সাফল্যের চাবিকাঠি আছে শ্রমিকদের হাতে, (যেমনটি Île de France Coordination-র ৮ই মারচ্র মীটিঙে একজন ছাত্র বলেছেন: যদি আমরা বিচ্ছিন্ন থাকি, তাহলে ওরা আমাদেরকে ওদের খাদ্য বানিয়ে ছাড়বে। ভিলপাঁ সরকার যত অনমনীয় থাকছে ছাত্ররাও তত বেশি করে দৃঢ়প্রত্যয়ী হয়ে উঠছে, বাড়ছে তাদের নাছোড়বান্দা মনোভাব!  সারকোজির কঠোর পদক্ষেপ শ্রমিকদের ক্ষোভ এবং ভোটারদের অনাস্থাই শুধু বাড়িয়ে তুলছে। শ্রেণি-সংগ্রামে অভ্যস্ত শ্রমিকেরা (এবং বুজোর্য়াদের সবথেকে কম বোকা অংশটা) ভালোভাবেই জানে যে যদি ইতর-উশৃঙ্খল শাসকশ্রেণি তাদের এই অযৌক্তিক যুক্তি আঁকড়ে থাকে  তাহলে এই আন্দোলন  (সাধারণ ধমর্ঘট নয় যেমনটি কিছু ইউনিয়ন এবং এ্যানাকির্স্টরা করার কথা বলছেন) মাস-স্ট্রাইক(mass strike)এর রূপ নেবে।

সারা দেশজুড়ে শ্রমিকদের সঙ্গে সংহতি স্থাপনের প্রয়াস, সাধারণ সভায় বিপুল সংখ্যায় শ্রমিক-প্রতিনিধিদের উপস্থিতি[2] এবং আন্দোলনে তাদের সামিল করার ও শ্রমিকদের স্বতঃস্ফূত্তর্ভাবে তাতে যোগদান ইত্যাদি দেখায় যে আন্দোলনের শুরু থেকেই এর গতি প্রকৃতিগতভাবেই  মাস স্ট্রাইকের রূপ নেওয়ার দিকেই। ছাত্ররা ইউনিয়নগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্লকেজ[3]-এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে এবং শ্রমিকেরা ছাত্র-প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা না করে  কোন কথা বলতে অস্বীকার করেছে। প্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ের Little Sioux’[4]রা   আশ্চরয উদ্ভাবনী ক্ষমতার সাহায্যে এই ব্লকেজকে অতিক্রম করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

শ্রমিকদের সক্রিয় যোগদান সুনিশ্চিত করার জন্য ছাত্র-ছাত্রীরা যথেষ্ট সৃজনী ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে: Censier একধরণের কারডবোরড্ বক্স তৈরি করেছে, যার নাম   চিন্তা-বাক্স; কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন প্যারিসে Jussieu এ ছাত্র-ছাত্রীরা এই বাক্স নিয়ে রাস্তায় নামছেপথচারী মানুষের কাছে জানতে কেন তারা বিক্ষুব্ধ, আন্দোলনের ব্যাপারে  তাদের মতামত লিখে বাক্সের মধ্যে ফেলতে বলা হচ্ছে কেননা তাদের মতে সব মতামতই লক্ষ্য করা প্রয়োজন। বিশেষতঃ, শ্রমিকদের , যারা পথচলতি বা যারা তাদের আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করতে আসছে তাদের মতামত বা চিন্তা ভাবনাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে সংগ্রহ করা হচ্ছে যাতে তারা সেগুলো সংগ্রাম বিকাশের কাজে ব্যবহার করতে পারে। তাদের অভিজ্ঞতাকে ধন্যবাদ, তারা বাছাই করছে সেই সব ভালো আইডিয়া যেগুলো সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে! আর বাতিল করছে বাজে আইডিয়াগুলো যেগুলো তারা মনে করছে সংগ্রামকে দুবর্ল করবে এবং অন্তঘার্ত করবে আর ছাত্রদের রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ণের শিকারে পরিণত করবে; যেমন, Sorbonne   বিশ্ববিদ্যালয় দখল করার ভাবনা।

 অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিশেষতঃ আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লেকচার হলগুলো শ্রমিক, বেকার এমনকি পেনশন-জীবিদের জন্যও উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে; সেখানে তাদের কমর্জীবনের অভিজ্ঞতা বলতে বলা হয়েছে; পুরোনো প্রজন্ম নতুনদের  আর নতুন প্রজন্ম পুরোনোদের কাছে শিখবার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে! পরিণত হয়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের মধ্যে পুরোনো প্রজন্ম আবিষ্কার করছে তাদের ফেলে আসা যৌবনের দিনগুলি! বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে দেওয়া-নেওয়া, শেখা-শেখানোর এ যেন এক অভিস্রবণ প্রক্রিয়া যা সমগ্র আন্দোলনে এক নতুন গতি দান করেছে।। সংগ্রামের বিশালতম শক্তি, অসাধারণ বিজয় যেন সংগ্রাম নিজেই!

এই বিজয় হল  সমস্ত সেক্টরের, সমস্ত প্রজন্মের, সমগ্র   শ্রমিক-শ্রেণির সংহতি এবং ঐক্য।

এ বিজয় অজির্ত হয়েছে পালার্মেন্টে নয়, হয়েছে ফ্রান্সের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লেকচার হলগুলোতে; দুভার্গ্যজনকভাবে এ. জি.-তে সরকার নিযুক্ত গুপ্তচরেরা এই বিজয় বুঝতে পারেনি, তারা কিস্যু বোঝেনি! তারা মিস্টার ভিলপাঁকে কোন আইডিয়া দিতে অপারগ।ভিলপাঁ/সারকোজি/শিরাক সব আইডিয়ার বাইরে চলে গেছে! আর তাই  বুজোর্য়া গনতন্ত্রের আসল স্বরূপ প্রকাশ করতে তারা বাধ্য হচ্ছে, হাতে তুলে নিতে হচ্ছে গনতান্ত্রিক হাতিয়ার: দমন, নিপীড়ণ।

পুলিশের হিংসাত্মক আচরণ পরিষ্কার প্রমান করে দিচ্ছে বুজোর্য়াদের ভবিষ্যৎলে আর কিছু নেই।  

এই ছাত্র আন্দোলন নেহাতই সিপিইর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নয়; ৭ই মারচের জমায়েতে  Paris-Tolbiac Universityর এক শিক্ষক  বলেছিলেন: সিপিই একটা বাস্তব এবং বিশেষ অথর্নৈতিক আক্রমণ শুধু নয়, এটা একটা প্রতীকও বটে। সত্যিই, এটা পুঁজিবাদী অথর্নীতির দেওলিয়াপনারই প্রতীক।

  পুলিশের  ভুল আচরণের,যা ২০০৫-এর শরতে দুটি নিরপরাধ যুবকের মৃত্যুর কারণ হয় (  একজন নাগরিক তাদের চোরলে অভিযুক্ত করে এবং পুলিশ তাদের হত্যা করে), পরোক্ষ প্রতিক্রিয়া এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হয়। এক মানসিক বিকারগ্রস্ত (সারকোজি)কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী করে বুজোর্য়ারা বুঝিয়ে দিয়েছে যে তারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে অক্ষম; এরা ভুলে গেছে অন্যান্য ঘটনার পাশপাশি, ১৯৮৬[5] তে  Malik Oussékine র মৃত্যু শ্রমিকদের সংগ্রামকে আরো বেশি সক্রিয়  এবং উত্তপ্ত করে তোলে। আজ Sorbonne য়ুনিভাসির্টির ছাত্র-ছাত্রীরা, যারা মিথ্যাবাদী Mr de Robienর দাবীমত বই পোড়াতে যায়নি গিয়েছিল শুধুমাত্র এ.জি.র সভা করতে , তাদের ওপর পুলিশি নিপীড়ণ ছাত্রসমাজের নাছোড়বান্দা মনোভাবকেই আরো শক্তিশালী করেছে। সমস্ত বুজোর্য়া আর তাদের মিডিয়া সকলে মিলে  ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা বলে চলেছে---- ছাত্ররা নাকি গুন্ডামো করছে অথবা ভদ্দরলোক সারকোজির ভাষায় এরা নাকি উচ্ছৃঙ্খল ছোটোলোক!

কিন্তু এরা এতটাই ডাহা মিথ্যা বলছে যে শ্রমিকেরা তা মোটেই বিশ্বাস করে নি। উল্টে বুজোর্য়ার গুন্ডাবাহিনী যে নিপীড়ণ চালিয়েছে তাই দিয়েই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আর তার মহান গণতন্ত্রের হিংসাত্মক রূপটি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। এ এক এমন ব্যবস্থা যেখানে লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে ছুঁড়ে ফেলা হয় রাস্তায়, ৪০ বছর ধরে শোষন করার পর যেখানে পেনশনজীবি শ্রমিকদের দারিদ্রের অন্ধকারে নিক্ষেপ করে সরকার, যেখানে পুলিশের লাঠি আর গুলি দিয়ে আইন-শৃংখলা চাপিয়ে দেওয়া হয় আমাদের ওপর। অন্যদিকে ভিলপাঁরা কালাবোবা সেজে থাকে, এদের আচরণ সেই পুরোনো রসিকতাটাকেই মনে করিয়ে দেয় ---- একনায়কতন্ত্র মানে বোবা হয়ে থাক, গনতন্ত্র মানে যা বলবি বল, কান করেছি ঢোল। তবে ভিলপাঁ/সারকোজি/সিরাক ত্রয়ী এক নতুন শ্লোগান আমদানী করেছে---তোমার যা খুশি বল এবং মুখ বন্ধ কর

  ক্ষমতায় থাকার দৌলতে মিডিয়া এইসব ভদ্দরলোকদেরই তাঁবেদারি করছে বিশেষত মতাদশর্গত বিষ ছড়ানোর সেরা মাধ্যম টিভি নিউজ চ্যানেলগুলো তাদের কেনা গোলাম! এরা মানুষকে ভুল বোঝানোর জন্য পুরো আন্দোলনটাকে  শুধুমাত্র   লক্ষ্যহীন কতকগুলো হিংসাত্মক ঘটনা হিসাবে তুলে ধরছে যাতে শ্রমিকদের কে এর থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়, তাদের সচেতনতাকে নষ্ট করা যায় । কিন্তু যতই তারা এই চেষ্টা করছে ততই তারা আমাদের ঘৃণাকে তীব্রতর করে তুলছে। 

ভবিষ্যত নিমার্ণের চাবিকাঠি যাদের হাতে সেই শ্রমিকশ্রেণির নতুন প্রজন্ম আর তার সবথেকে সচেতন অগ্রণী বাহিনী  পুলিশ-রাষ্ট্রের উসকানি এবং ইউনিয়নবালাদের নিজেদের খপ্পরে রাখার  কৌশলের ফাঁদে পা দেয় নি। নিবির্চার এবং মরীয়া হিংসাত্মক ক্রিয়াকলাপে লিপ্ত হবার  বুজোর্য়া পন্থা তারা প্রত্যাখ্যান করেছে , তারা মফস্বলের যুবকদের  অথবা দুচারটে এ্যানারকিস্ট ও লেফ্টিস্টদের মত জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবার পন্থাকে  কখনোই গ্রহণ করেনি।

 ছাত্র-আন্দোলনের পুরোধা এইসব শ্রমিক-শ্রেণির সন্তানরাই একমাত্র গোটা সমাজের সামনে এক নতুন ভবিষ্যতের দিশা তুলে ধরতে পারে। তার নিজ শ্রেণি-শক্তির প্রতি আত্মবিশ্বাস, তার ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গী, তার ধৈরযো এবং যেমন লেনিন বলেছিলেন তার রসবোধ শ্রমিকশ্রেণির এই ভবিষ্যত দিশাকে বিকশিত করে তুলতে পারে।   শ্রমিকশ্রেণির এক সুনিদির্ষ্ট ইতিহাস-সম্মত ভবিষ্যত আছে কিন্তু বুজোর্য়াদের কোন ভবিষ্যত নেই--- তারা তাই কেবল আতঙ্কগ্রস্তই হতে পারে, লক্ষ্যহীন নিবির্চার হিংসার পথ ছাড়া তাদের আর কোন পথই খোলা নেই।

 ছাত্রদের সিপিই প্রত্যাহারের দাবির প্রতি মিস্টার ভিলপাঁর অনমনীয় মনোভাব আরো একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে দেয় যে বুজোর্য়ারা কখনই ব্যালোট বক্সের          

চাপে তাদের  ক্ষমতা ছেড়ে দেবে না। যদি বিশ্বকে পুঁজিবাদের হাত  থেকে মুক্ত  করতে  হয়, গড়তে হয় এক প্রকৃত বিশ্ব-মানব-সমুদায় তাহলে ভবিষ্যতে শ্রমিকশ্রেণি বাধ্য হবে তার নিজ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের স্বারথে রাষ্ট্রের হাতের ক্রীড়ণক দমন-পীড়ণের ব্যবস্থা ও তাদের ভয়ংকর আক্রমণ  ও নিপীড়ণের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ করতে। তবে প্রলেতারিয় শ্রেণিহিংসার সঙ্গে  দাঙ্গাকারী মফস্বলের যুবকদের কিংবা সন্ত্রাসবাদের কোন সম্পরকোই নেই(যদিও বুজোর্য়ারা উল্টোটাই বলে কেননা এর ফলে তারা শ্রমিক,ছাত্র এবং অবশ্যই প্রকৃত কম্যুনিস্টদের অত্যাচার করাটাকে যুক্তিসিদ্ধ হিসাবে দেখাতে পারে)।

আন্দোলনকে ভেতর থেকে ধ্বংস করা এবং এর প্রলেতারিয়- চরিত্রকে নষ্ট করার লক্ষ্যে শাসক শ্রেণির পাল্টা আক্রমণ     

 অথর্নৈতিক তথা পুলিশি আক্রমণ নামিয়ে আনার জন্য তাদের প্রথম ফিকির হল এমন একটা সময় বাছা যেসময় ছাত্র-ছাত্রীদের ছুটি থাকবে ফলে তাদের বিক্ষোভ দানা বাঁধতে পারবে না; কিন্তু উল্টো হল : আমরা দেখলাম তাদের সক্রিয়তা অব্যাহত এবং ছুটির সময় তা অনেক বেড়ে গেল। স্বাভাবিকভাবেই, আন্দোলনের শুরু থেকেই ইউনিয়নবালারা ছিল এবং যথাসাধ্য চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছিল কিভাবে মুভমেন্টের বারোটা বাজানো যায়। কিন্তু তারা ধরতেই পারে নি  শেষ পযর্ন্ত বেশিরভাগ শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের কোন নিয়ন্ত্রণই তারা রাখতে পারবে না।

উদাহরণস্বরূপ, প্যারিসে প্যারিস III Censierর বাইরে কয়েকহাজার স্টুডেন্ট সবাইমিলে একসঙ্গে  জমায়েতে যাবে বলে জড়ো হয়েছিল; যখন তারা আবিষ্কার করল যে CGT মিছিলে নেতৃত্ব দেবে বলে  আগেভাগেই তাদের  ব্যনার ট্যনার খুলে রেডি হয়ে মিছিলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে তখন  যারা যেভাবে পেরেছে হেঁটে, মেট্রোয়, সাইকেলে মানে যার যা ছিল সে তাই কাজে লাগিয়ে জমায়েতের সামনে গিয়ে পৌঁছেছে, তারপর মেলে ধরেছে তাদের নিজস্ব ঐক্যতান-খচিত  পতাকা; তাতে লেখা আছে:

ইউনিভাসির্টি এবং স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী, বেকার শ্রমিক, সরকারি,বেসরকারি ও আংশিক সময়ের শ্রমিক---- সকলের লড়াই আজ একটাই: বেকারি এবং অনিশ্চিত-কাজের বিরুদ্ধে লড়াই!

CGT র অবস্থাটা হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়। স্টুডেন্টদের বিপুল উচ্ছসিত কলরোলের পিছনে তাদের নানা বিভাগীয় পতাকা যথা: “CGT Engineers”, “CGT RAPT”[6] ইত্যাদি আর প্রতিটি পতাকার পিছনে হাতেগোনা কয়েকজন, তারা সম্পূর্ণ ছত্রভঙ্গ। তাদের বাহিনীকে চাঙ্গা করার জন্য Maurice Thorez[7]  -এর স্ট্যালিনিস্ট পারটির কর্মীরা কিছু গরম-গরম শ্লোগান দেবার চেষ্টা করল, লাউডস্পীকারের মাধ্যমে ছাত্রদের শ্লোগান আর বক্তব্যকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করল শেষপযর্ন্ত সিজিটি এবং ফ্রেঞ্চ কম্যুনিষ্ট পারটির ক্যাডাররা ইন্টারন্যাশানাল গেয়ে সকলকে তাদের সাথে যুক্ত করার চেষ্টাও করল--- কিন্তু বুড়ো স্টালিনিস্ট ডাইনোসোরগুলোর এই ক্যারিকেচার তাদের আরো বেশি হাস্যাস্পদ করে তুলল; সত্যি বলতে কি, জমায়েতের এবং পথ-চলতি অনেক লোক  হেসে গড়িয়ে পড়ছিল! এমনকি এই মন্তব্যও শোনা গেল যে  ওদের আচরণ নাকি  Spitting Image[8] -র মতোই দেখাচ্ছে।

ওই একই রাতে সিজিটি ইউনিয়নের নেতা Bernard Thibault টিভি সাক্ষাতকারে বলেছে: এটা সত্য যে আজকের জমায়েতে এমন  একটা  ব্যাপার ছিল যা আমরা আগে থেকে আন্দাজ করতে পারিনি।

ইউনিয়নগুলো যতই আন্দোলনকে তাদের হাতের মুঠোয় আনবার জন্য জঘন্য সব কলা-কৌশল নিয়েছে ততই তাদের মুখোস খুলে পড়েছে। Mr de Robien ঘৃণার বশে এই সত্যটা বুঝতে পারছেন না: তিনি দেখাতে চাইছেন Sorbonne বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টরা হঠকারিতা করেছে (এটা প্রমানের জন্য বুজোর্য়া ম্যানিপুলেসনে স্পেশ্যালিস্টদের ছিঁড়ে রাখা কয়েকটা বই তিনি দেখাচ্ছেন যেন বা এইসব ছাত্রদেরই কীরতি!) , তিনি বলেছেন: এই আন্দোলন মুষ্টিমেয় কিছু জনের দ্বারা পরিচালিত। একজন ইউনিয়ন নেতা হিসাবে তার পক্ষে  এভাবে দেখাই স্বাভাবিক, কেননা এই বিপুল মানবসমাজকে গতিশীল রাখে যে বিশাল উৎপাদক শ্রেণি সেটা তার চোখে পড়ে না, চোখে পড়ে শুধু সেই মুষ্টিমেয় শাসক শ্রেণির প্রতিনিধি, যাদের দ্বারাই দুনিয়াটা পরিচালিত হচ্ছে বলে মি. রবীন মনে করেন!

শুধু ৭ইমার্চেই নয়, সিজিটি এবং এফ.ও.[9], ১৪ই মারচের ছাত্র-ছাত্রীদের স্বতঃস্ফূর্ত্ত মিছিলেও তাচ্ছিল্যের পাত্র হয়েছে: এজন্যই কিছু বুদ্ধিমান টিভি সাংবাদিক মন্তব্য করেছে: ইউনিয়নগুলো তাচ্ছিল্যের পাত্রে পরিণত হয়েছে। যে সংগ্রামী যুব-ছাত্ররা তাদের উপহাসের পাত্র করে তুলেছে তাদের এবং ১৬ই মারচের জমায়েতে ছাত্রদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া শ্রমিকদের প্রতি   ঘৃণা তারা গোপন রাখতে পারেনি; ফলতঃ  সমগ্র জনসমক্ষে,  ক্যামেরার সামনে মিস্টার সারকোজি এ্যান্ড কোঙের সাথে ওদের আঁতাত দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে গেছে। 

ওইদিন প্যারিসে সিজিটি (Stalinist party র সাথে সংশ্লিষ্ট)  এবং এফ.ও. ( ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর সিআইএর টাকায় তৈরি ইউনিয়ন)র প্রতিনিধিরা মিছিলের পুরোভাগে থেকে সি.আর.এস.-এর[10]সামনা করছিল। হঠাৎ দেখা গেল ওদের ইউনিয়ন কডর্ন ম্যাজিকের মতন হাওয়া আর পরিকল্পিতভাবে  আন্দোলনকে বেপথু করতে  সেখানে ছেড়ে রাখা হল  কিছু পেটি বুজোর্য়া দাঙ্গাবাজকে  যারা Sorbonne-মুখি মিছিলে  ঢুকে পড়ে পুলিশের সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলায় মেতে উঠল।   যাঁরা এই নতুন হিংসাত্মক  দৃশ্য দেখলেন তাঁদের প্রত্যেকেই বলেছেন যে ভিলপাঁ/সারকোজিরা যে তাদের দমন-পীড়ণের যন্ত্রটা কাজে লাগাতে পারল আর ভরতি করতে পারল তাদের জেলখানা (Black Marias) তার কৃতিত্বটা পুরোপুরি ইউনিয়ন প্রতিনিধিদেরই প্রাপ্য।

সবোর্পরি, টিভি নিউজ ২৪ ঘন্টা এদিনের হিংসাত্মক ঘটনার ছবি দেখিয়ে দেখিয়ে  মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টা চালিয়েছে যাতে ১৮ই মারচের মিছিলে যেতে লোকে ভয় পায়। অনেক শ্রমিক এবং যুবক যারা এই মিছিলে যোগ দেবে ভেবেছিল তারা হয়তো ভয় পেয়ে যোগ নাও দিয়ে থাকতে পারে।

টিভি চ্যানেলগুলো এই সুখবর প্রচার করেছে (১৬ই মারচে প্রচারিত নিউজ অনুযায়ী) যে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসছে

যারা এই আন্দোলনের মৃত্যু চায়, তারা  সারকোজির সাগরেদ, এরা তারা যারা  চায় আন্দোলনকে ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণে আনতে। আর শ্রমিকশ্রেণি একথা বুঝতে শুরু করেছে। বড় বড় বুলির আড়ালে, ইউনিয়ন আসলে সরকারের চামড়া  বাঁচাতেই আগ্রহী। UMP[11]র ব্রন্টোসোরগুলোর[12] পাশাপাশি স্ট্যালিনিস্ট পারটি আর তার সিজিটি ইউনিয়নের ঠাঁই হওয়া উচিত জুরাসিক পার্কেসামাজিক আন্দোলনের আগুন নেবানোর কাজে নিযুক্ত সামাজিক দমকলবাহিনীইউনিয়নের পতাকাগুলো ১৬ই মারচ্ মানসিক-বিকারগ্রস্ত ভিলপাঁ/সারকোজিরা নিজেরাই পুড়িয়ে দিয়েছে ---সবার কাছে ধরা পড়ে গেছে তাদের আসল রূপ; আর তাই এরা এখনো অব্দি সামাজিক আন্দোলনের এই আগুন নেবানোর ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে।

  শ্রমিকেরা সংগ্রামী স্টুডেন্টদের সমথর্ন করেছে কারণ তারা দেখেছে ইউনিয়নগুলো কিভাবে গণ সাধারণ সভার(মাস জেনারেল এ্যাসেমব্লীজ) বিষয়ে গণমাধ্যমগুলোকে চুপ থাকতে সাহায্য করেছে।

৭ই মারচের মিছিল-জমায়েতের পর থেকে ইউনিয়নগুলো উঠে পড়ে লেগেছে যাতে যেন তেন প্রকারেণ শ্রমিকদেরকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা যায়, কোনমতেই শ্রমিকেরা যেন ছাত্রদের সঙ্গে যোগ না দিতে পারে। তারা চেষ্টা করেছে যে করেই হোক যেন এই আন্দোলনকে ভেতর থেকেই নষ্ট করে দেওয়া যায়। তারা তাদের বুলিকে ঝাঁঝাঁলো করেছে; তারা দাবি তুলেছে আপোষরফার বৈঠকে যাওয়ার আগেই যেন সিপিই প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়(এর মানে এই নয় যে  শ্রমিকদের অগোচরে তারা তলায় তলায় আপোষরফার চেষ্টা চালাচ্ছে না)।   সরকারকে বাধ্য করার জন্য  তারা এমনকি সাধারণ ধমর্ঘট’ –এর ডাক দেবার হুমকিও দিয়েছে। তারা প্রকাশ্যে  ঘোষণা করেছে যে ছাত্রদের  সঙ্গে  শ্রমিকদের সংহতি হোক , শ্রমিকরা সক্রিয়ভাবে এই আন্দোলনে সামিল হোক তারা তা চায় না।  তাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে, আর তাই উপায়ান্তর না দেখে কিছু অতি-মাথাগরম ছেলেপুলেকে উসকে দিচ্ছে যাতে হিংসাত্মক ঘটনাগুলো অব্যাহত থাকে।

এই রাজনৈতিক সংকটের কবল থেকে ফরাসী বুজোর্য়ার বেরোবার একমাত্র উপায় হল যে কোন উপায়ে ফরাসী প্রজাতন্ত্রের এই বিভ্রান্তিকর অবস্থাটাকে আড়াল করা, এর   গনতান্ত্রিক ভাবমূর্তিটাকে  বজায় রাখা। আর, এজন্য প্রয়োজনীয় মতলবটি মিস্টার ভিলপাঁকে রূপোর থালায় পরিবেশন করেছেন  PS/PCF/Greens[13]-রা;   সিপিইর বিরুদ্ধে তাদের বক্তব্যটি কন্সটিটিউসন্যাল কাউন্সিলের[14] বিচারের অধীন করার দাবীতে এরা সকলেই ঐক্যবদ্ধ।  সোস্যালিস্ট পারটির এই সাহায্যের হাত কাজে লাগিয়ে ১২জন বিজ্ঞ ব্যক্তি[15]-র কাছে সরকার বিষয়টি বিচারের আবেদন রাখতে পারে এবং এতে বিষয়টি আপাতত ঝুলে থাকবে; সেই সুযোগে রাফারিনের নীতিতে অবিচল থাকা যাবে যে রাস্তা দেশ শাসন করে না; এর সঙ্গে যোগ করে বলা যায়: দেশ শাসন করে কন্স্টিটিউসন্যাল কাউন্সিলের   মাত্র ১২ জন পেনশনভোগী।

 এই সংগ্রামের সবথেকে বড় বিজয় সংগ্রাম নিজেই

সরবোন ইউনিভাসির্টির ছাত্রদের এবং তাদের কমরেডদের (যারা তাদের জন্য খাদ্য নিয়ে এসেছিল তাদের)  ঠেঙিয়ে ঠান্ডা করতে গিয়ে সারকোজি প্যানডোরার বাক্সটি খুলে ফেলেছে, আর  তার ভেতর থেকে ভিলপাঁ/সারকোজি সরকার বের করে এনেছে শ্রমিকদের প্রতারক-বন্ধুটিকে: এ হল ইউনিয়ন।

সুতরাং দুনিয়ার শ্রমিক এজন্য ফরাসী সরকারকে ধন্যবাদ জানাতে পারে।  চ‌রম দক্ষিণ-পন্থি Le Pen[16]  -র অভ্যুথ্থানের ভয় দেখিয়ে লাল-সাদা-নীল শাসকশ্রেণি দুনিয়ার সবথেকে অপরিণতবুদ্ধি দক্ষিণ-পন্থীদেরকে ক্ষমতায় নিয়ে আসতে পেরেছিল: এমন এক দক্ষিণ-পন্থী যারা এমনসব নীতি নিয়েছে যা কেবল   কোন ব্যানানা রিপাবলিক’ –এই শোভা পায় ।

এই সংগ্রাম এখনও অব্দি যতটুকু এগিয়েছে তাতে বলা যায় যে বিশ্ব শ্রমিক শ্রেণির কাছে এ আন্দোলন অলরেডি বিজয় লাভ করেছে। নতুন প্রজন্মকে ধন্যবাদ যে শ্রমিকশ্রেণি ইউনিয়নের বাধা ভেঙে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। প্রলেতেরিয়েতের প্রতিটি সেক্টর, বিশেষত তাদের তরুন অংশটি এমন এক মুল্যবান অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে যা তাদের চেতনায় এক গভীর ছাপ রেখে যাবে।

এই অভিজ্ঞতা সমগ্র বিশ্ব প্রলেতারিয়েতের। গণমাধ্যমগুলোর বয়কট সত্বেও তাদের সমান্তরালে কাজ করে চলা প্রচার মাধ্যম, সরকারের বশীভূত নয়,অপেশাদার এমন সব লোকজনের ক্যমেরা এবং অন্যান্য সরকারী লাগামের বাইরে থাকা রেডিও , আর অবশ্যই বিপ্লবীদের নিজস্ব প্রেস দুনিয়াজুড়ে প্রলেতারিয়েতের কাছে এই খবর পৌঁছে দেবেই যাতে করে শ্রমিকশ্রেণি এই অভিজ্ঞতাকে তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতারই অংশ করে তুলতে পারে,বুঝতে পারে প্রলেতারিয়েতের বিশ্বব্যাপী সংগ্রামের এটা মাত্র একটা দৃশ্য।  2003 থেকে ধারাবাহিকভাবে সারা পৃথিবীতেই যে সংগ্রাম চলছে এই আন্দোলন তারই অংশ; আর এইসব আন্দোলন পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে  শিল্পপ্রধান দেশগুলোতে শ্রমিকশ্রেণি আবার এগিয়ে আসছে, ১৯৮৯র ইস্টার্ণ ব্লক এবং তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক ও শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্রগুলোর পতনের পর বুজোর্য়াদের ছড়ানো বিভ্রান্তি  তারা কাটিয়ে উঠছে। এইসব সংগ্রামের অন্যতম বৈশিষ্ট হল শ্রমিকদের মধ্যে সংহতিবোধের পুনজার্গরণ। বিশ্ব-পুঁজিবাদের দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশইউ.এস এবং ইউনাইটেড কিংডম-এ শ্রমিক সংগ্রামের মর্মবস্তু  হয়ে উঠেছে:সংহতি। যেমন ক্রিসমাস২০০৫র ঠিক আগে নিউ ইয়র্কের ট্রান্সিট শ্রমিকেরা নিজেদের জন্য নয়, স্ট্রাইক করেছিল ভবিষ্যতে যারা ওই চাকরিতে যুক্ত হবে তারা যেন বতর্মান শ্রমিকদের মত একই অবসরকালীন সুযোগ সুবিধা পায় এই দাবিতে। একইভাবে, ২০০৫-এর শরতে, লন্ডনের হিথরো এয়ারপোরটে Gate Gourmet কোম্পানী তাদের অধীনস্থ ক্যাটারিং বিভাগের শ্রমিকদের ওপর   ঘৃণ্য আক্রমণ  নামিয়ে আনলে শ্রমিকেরা তার বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত্ত ধমর্ঘটে সামিল হয়; আর ওই এয়ারপোরটের যাত্রীদের মালপত্র তোলা-নামানো ইত্যাদি কাজের সাথে যুক্ত শ্রমিকেরা ওই স্ট্রাইকে সামিল হয়, তাদের পাশে দাঁড়ায়।

 ফ্রান্স এবং অস্ট্রিয়ায়   পেনশন সংক্রান্ত সুযোগ সুবিধা কেড়ে নেওয়ার সরকারী কালা-কানুনের বিরুদ্ধে ২০০৩-এর আন্দোলন (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত মানুষের জমায়েত আর হয়নি) থেকে শুরু, যারপর থেকে অবিরাম একটার পর একটা আন্দোলন, কোন না কোন দেশে হয়েই চলেছে আর সে আন্দোলনের  ক্রমাগত বিকশিত হয়ে ওঠার এক প্রবণতা যেন শুরু হয়ে গেছে। ২০০৪-এ  জামার্নিতে গাড়ি কারখানার শ্রমিকদের(বিশেষত ডেইমলার-ক্রাইসলার এবং ওপেলে) ছাঁটাই বিরোধী আন্দোলনে শ্রমিকদের সংহতি, ২০০৫-এর ডিসেম্বরে স্পেনের বারসিলোনায় সিয়েট (SEAT) কারখানায় ইউনিয়নের বাইরে এবং তার বিরুদ্ধে   শ্রমিকদের আন্দোলন[17] ইত্যাদি এই প্রবণতারই দৃষ্টান্ত।

সুতরাং ফ্রান্সের ছাত্র আন্দোলন এই ঐতিহাসিক বাঁকের পযার্য়ে চলতে থাকা আন্দোলনগুলোর অংশ হিসাবেই দেখতে হবে, যে-আন্দোলনগুলোর ফলশ্রুতিতেই মানব প্রজাতি  পুঁজিবাদী বরবরতার গোলকধাঁধা থেকে অব্যাহতি পেতে পারে। নতুন প্রজন্ম, যারা শ্রমিকশ্রেণির দিশায় আজ তাদের সংগ্রাম পরিচালনা করছে, তারাই এই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের  দ্বার উন্মুক্ত করছে। আমরা তাদের ওপর এই  গভীর আস্থা রাখতে পারি যে এই গ্রহের সবর্ত্র, তারা এক নতুন পৃথিবী গড়বার  প্রস্তুতি চালিয়ে যাবে ----- এমন এক পৃথিবী যেখানে কোন প্রতিযোগিতা নেই, লাভ-লোকসান নেই, নেই শোষন, দারিদ্র আর নিমর্ম সন্ত্রাস, আতঙ্ক, হিংসা, যুদ্ধ, নেই এই ভয়ংকর নৈরাজ্য!

স্বাভাবিক ভাবেই পুঁজিবাদ উচ্ছেদের এই রাস্তা দীর্ঘ, সমস্ত রকমের প্রতিকূলতায় ভরা তবু  এই বাধার পাহাড় সরানোর কাজ শুরু হয়ে গেছে, শুরু হয়ে গেছে সে পথে আমাদের সুমহান যাত্রা।     

ইন্টারন্যাশানাল কম্ম্যুনিস্ট কারেন্ট


 


[1] অধুনা এই  ডিপ্লোমা প্রথাটি ইউরোপিয়ান সিস্টেম হিসেবে ফ্রান্সে জোড় করে চাপানো হয়েছে যার ফলে অনেক ছাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

[2] উদাহরণস্বরূপ, Tours- এ, ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ১০,০০০ লিফলেট ছাপিয়ে শ্রমিক-এলাকায় বিলি করেছে, যার প্রধান লক্ষ্য হল শ্রমিকদের এই আন্দোলনে সামিল করা ।

[3] এটা কথার খেলা; আসলে ইউনিয়নগুলো চায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পিকেটিং করতে এবং ছাত্ররা এর বিরোধী।

[4] এটি বাংলায় অনুবাদের  অসাধ্য ; তবে মোটামুটি রেড ইন্ডিয়ানদের এক বিশেষ হস্তশিল্প ধারার উল্লেখ করে এখানে যা বোঝাতে চাওয়া হয়েছে তা হল ছাত্রদের সাংঘাতিক উরবর মস্তিষ্ক যার সাহায্যেই তারা এমন কৌশল উদ্ভাবন করছে যাতে এই ইউনিয়নের ব্লকেজ পন্থাকে ভেস্তে দেওয়া যায়--- এটা উক্ত শিল্প নৈপুন্যের সাথেই তুলনীয় ! 

[5] বিশ্ববিদ্যালয়-সংস্কার’-এর বিরুদ্ধে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিবাদ আন্দোলন চলাকালীন পুলিশের গুলিতে একজন ছাত্র নিহত হয়।

[6] Confédération Générale du Travail সংক্ষেপে সিজিটি: এটি অনেক পুরোণো ইউনিয়ন এবং এখনও স্ট্যালিনবাদী ফরাসী কম্যুনিষ্ট পারটি দ্বারা পরিচালিত।

[7]  এই সেই লোক যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ধমর্ঘটী খনি শ্রমিকদের এবং Renault শ্রমিকদের বলেছিল  যেহেতু ধমর্ঘট হল মনোপলি ট্রাস্টগুলোর হাতিয়ার সুতরাং শ্রমিকগণ, তোমরা যে যার কাজে ফিরে যাও। 

[8] ফ্রান্সে রাতের দিকে টিভি নিউজে একটি ব্যাঙ্গাত্মক অনুষ্ঠান দেখানো হয় যার ফরাসী নাম“Les Guignols de l’Info". ইউনিয়নবালা ও স্ট্যালিনবাদী দলগুলোর এদিনের কান্ডকারখানা সেই স্যাটায়ারের মতোই হাস্যকর হয়ে দাঁড়িয়েছিল!

[9] Force Ouvrière.

[10] ফ্রান্সের রায়ট পুলিশ ।  পুরো নাম Compagnies Républicaines de Sécurité

[11] Jacques Chirac-র অধীন বর্ত্তমান শাসক দল। পুরো নাম: Union pour un Mouvement Populaire (নামের বাহারখানা দেখুন!)

[12] বিশাল চতুষ্পদী তৃণভোজী  ডাইনোসোর যাদের জুরাসিক পরবর্তি যুগে উত্তর আমেরিকায় দেখা যেত।

[13] সোস্যালিস্ট পারটি, ফ্রেঞ্চ কম্যুনিস্ট পারটি এবং গ্রীণ পারটি।

[14] এদের মতলবটা হল কন্স্টিটিউসন্যাল কাউন্সিল যদি ঘোষণা করে যে সিপিই অসাংবিধানিক তাহলে  সরকারের মুখরক্ষা হয়, সেক্ষেত্রে কাউন্সিলের দোহাই দিয়ে সিপিই  প্রশ্নটা মুলতুবি রাখতে  সরকারের অসুবিধা হয় না!

[15] এই বারোজন হল উক্ত কন্স্টিটিউসন্যাল কাউন্সিলের সদস্য।

[16] ফ্যাসিবাদি ন্যাশনাল ফ্রন্ট  দলের নেতা  যে গত রাষ্ট্রপতি নিবার্ছনে প্রথম দফায় সিরাকের ঠিক পরের স্থানে ছিল।

[17] যেখানে ইউনিয়ন শ্রমিকদের পিছন থেকে ছুরি মারার চক্রান্ত করে মালিকের সাথে লজ্জাজনক চুক্তি করে ৬০০ শ্রমিককে ছাঁটাই করার ব্যবস্থা করে।     

বিশ্ব নেতা, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী

গত ৭ ই জুলাই’০৫ তারিখলন্ডনসন্ত্রাসবাদীদের আক্রমনের প্রথম শিকার কারা?

২০০১ নিউইয়ক এব ২০০৪ মাদ্রিদের মতই লন্ডনেও বিস্ফোরণের সুপরিকল্পিত লক্ষ্য ছিল শ্রমিকেরা। তার কারণ সেসময় টিউব আর বাস তাদেরই কমর্স্থল যাবার ভীড় উপচ পড়েছিল এই গণহত্য ঘটানোর দায় স্বীকার করেছ আল-কায়দ, এর বলছইরাক  ব্রিটিশ সেনার যে হত্যালীল চালিয়েছ তারবদল নিতেই  তার কাজ করেছে।কিন্ত ভেব দেখুন, ইরাকি জনগণের উপর যে সীমাহীন নিধন চলছ তার জন্য নিশ্চয় ব্রিটেনের শ্রমজীব মানুষের দায় নয়।এর জন্য দায় ব্রিটেনের এব আমেরিকার শাসকশ্রেণ এব তথাকথিত প্রতিবাদ সন্ত্রাসবাদীর যার প্রতিদিন ইরাকি জনগণের উপর হত্যালীল চালিয় যাচ্ছ প্রতিরোধের নাম করেই।কিন্ত ইরাক যুদ্ধের হোতার মান ওই বুশ আর ব্লেয়ারর বহাল তবিয়তেই থেক যাচ্ছ, বর সন্ত্রাসবাদীদের নতুন নতুন হত্যালীল ওদের নতুন কোন যুদ্ধ নামার অজুহাত তৈরীত সাহায্য করছ যেমন ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটন আফগানিস্তান এব ইরাক আক্রমনের যুক্তি যুগিয় ছিল

 

এই সব যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদীদের প্রয়োজনে, পৃথিবীর উপর তাদের নিজ নিজ আধিপত্য বজায় রাখার এবএর মধ্য দিয়পুঁজিবাদশ্রেণীস্বাথ  সুরক্ষিত করার জন্যই সংঘটিত হচ্ছে।আর এই যুদ্ধবলহচ্ছঅগণিত অত্যাচারিত,শোষিত, পুঁজির মজুরীদাসেরা। সাম্রাজ্যবাদযুদ্ধ নিজেকযৌক্তিক প্রমাণ করতগিয়উসকদিচ্ছজাতীয়তাবাদ, জাতিবৈষম্যবাদের মত বিষাক্ত ধারণএবশ্র্রেণনিবির্শেষসমগ্র জনগণকপরিণত করছআক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে।  আপামর সাধারণ মানুষ অপমানিত,ধিকৃত,নিহত হচ্ছপ্রতিদিনযুদ্ধের এই যুক্তি শ্রমিককদাঁড় করিয়দিচ্ছশ্রমিককেরই বিরুদ্ধে,তার নিজ শ্রেণীর স্বাথঐক্যবদ্ধ লড়াই করাটাকদুঃসাধ্য করতুলছএই  যুদ্ধতার চেয়েও ভয়ংকর হলো যে যুদ্ধশ্রমিক শ্রেণীর কোন স্বার্থ নেই, শোষক শ্রেণীর স্বাথসেই যুদ্ধেই শ্রমিক শ্রেণীকজাতীয়রাষ্ট্রজাতীয় পতাকাতলস্বেচ্ছায় সম্মিলিত হতআহ্বান জানাচ্ছআর এভাবেই তার আন্তজার্তিক বিপ্লবসংহতি ও বিপ্লবযুদ্ধের পথ থেকতাকবিচ্যুত করতচাইছে ।

 

গ্রুপ-৮শীষ বৈঠকধনআর ক্ষমতাশালীদের সভায় লন্ডনবোমবিস্ফোরণ প্রসঙ্গব্লেয়ারের বক্তব্য:সন্ত্রাসবাদকাযকলাপের সঙ্গযুক্ত ব্যক্তিরবোঝে যে তাদের নিষ্পাপ নিরীহ জনগনকহত্যকরার প্রতিজ্ঞার তুলনায় আমাদের জীবনধারএবমূল্যবোধ রক্ষার সংকল্প অনেক বেশশক্তিশালী ” ।

সত্যি কথাটহল ব্লেয়ার এববিন লাদেনের মূল্যবোধ সম্পূণ একইতাদের জঘন্য লক্ষ্যপূরণের জন্য উভয়েই একইভাবনিরীহ ,নিরপরাধ মানুষকমারছে , চালাচ্ছধ্বংসলীলা । তফাত্‍ এই যে ব্লেয়ার বড় সাম্রাজ্যবাদমস্তান আর লাদেন তুলনায় ছোটসুতরাং আমাদের কতব্য এদের কোন পক্ষে না যাওয়া ,আমাদের উচিত এই দুই পক্ষের কোন একটাতযারআমাদের সামিল করতচায় তাদের সকলকঘৃণার সঙ্গপ্রত্যাখ্যান করা । যারলন্ডন বিস্ফোরণের শিকার তাদের পাশথাকার ঘোষনকরেছআজকেরবিশ্বনেতারা’ –এটতাদের ভন্ডামি ও দ্বিচারিতছাড়কিছনয় ,এরসেই সমাজব্যবস্থার নেতা যা গত শতাব্দীতে দু –দুটবিশ্বযুদ্ধ এবকোরিয়থেকউপসাগর ,ভিয়েতনাম থেকপ্যালেস্টাইনসবত্র চলতথাকযুদ্ধের মধ্যদিয়লক্ষ লক্ষ মানুষকমেরেছে । গেলডফ, বোনএবঅন্যান্যদের ছড়ানবিভ্রান্তির বিপরীতএরসেই সমাজের নেতা যে সমাজ তার নিজ প্রকৃতিগত কারণেইদারিদ্রকঅতীতের বিষয়করতুলতপারেনবরলক্ষ লক্ষ মানুষকদরিদ্র থেকদরিদ্রতর অবস্থার দিকনিয়যায়,প্রকৃতিকতার মুনাফার স্বাথদূষিত করঅহরহএরচায় বিভিন্ন শ্রেনীর মধ্যজাতীয় সংহতি,ভবিষ্যতের কোনসাম্রাজ্যবাদযুদ্ধ বাধানোর জন্য যা ওদের দরকার ---শ্রমিক শ্রেণীর কাছে এ সংহতি, আসলবিশ্বশ্রমিকের শ্রেণিগত সংহতির সম্পূণ পরিপন্থি ।  এই সংহতি তাই  একটভাঁওত  ছাড়কিছনয়

 প্রকৃত ঐক্য হল দুনিয়াজোড়শ্রমিকের সাধারন স্বাথের ভিত্তিতআন্তর্জাতি  ঐক্য ,এই একতাই সমস্ত জাতিগত ,ধমর্গত বিভেদকনস্যাতকরতপারে – পারপুঁজিবাদের সামরিকতন্ত্র আর  যুদ্ধসবর্স্বতার যৌক্তিকতাকপ্রতিহত করতে । শ্রমিক শ্রেণীর এই ঐক্য এবসৌভ্রাতৃত্বের শক্তি কতটা তা ইতিহাস থেকেই পাওয়যায় :

১৯১৪-১৮–র সেনবিদ্রোহ এবরাশিয়া ও জামার্নির বিপ্লব প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থামাতপুঁজিবাদকবাধ্য করেছি ; ইতিহাস আরদেখায যে  এই শ্রমিক শ্রেণীই যখন তার  এই শ্রেণিগত ঐক্য ছেড়জাতীয়তাবাদঘৃণএবশাসকশ্রেণির  প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতবিভক্ত হয়ে ২য় বিশ্বযুদ্ধসামিল হল তার জন্য সাড়পৃথিবজুড়ে কি ভয়ংকর মূল্যই তাকদিতহয়েছিল !

আজ পুঁজিবাদ আবার সারপৃথিবীতযুদ্ধজাল বিস্তার করছে, তাকঠেলদিচ্ছসবব্যাপি ক্যাওস আর ধ্বংসের দিকে, যদি আমরএকথামাতচাই তাহলঅতি অবশ্যই

শাসকশ্রেণির সমস্ত দেশাত্মবোধক আহ্বানকঘৃণার সঙ্গপ্রত্যাখ্যান করতহবে,

শ্রমিক হিসাবআমাদের শ্রেণিস্বাথ রক্ষার লড়াই করতহবে,  

এবএই মৃত্যুপথযাত্রি সমাজ যা ক্রমবধর্মান আতঙ্ক আর মৃত্যছাড়  আর কিছুই দিতপারে না  তার বিরুদ্ধআমাদের  ঐক্যবদ্ধ হতহবে ।

 

 ইন্টারন্যাশনাল কম্যুনিস্ট কারেন্ট ,৭জুলাই ২০০৫.

Communist Internationalist - 2007

 

সিঙুর , নন্দীগ্রাম - বামপন্থী বর্বরতার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ

পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী শাসিত পুঁজিবাদী সরকার রাজধানী কলকাতার অনতিদূরের গ্রামীন এলাকা সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের নিরস্ত্র শোষিত জনতা ও কৃষি শ্রমিকদের ওপর জঘণ্য আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। রাজ্যের বতর্মান সরকার গায়ের জোরে কৃষিজমি অধিগ্রহণ করছে তথাকথিত ‘শিল্পায়ন' এবং স্পেশ্যাল ইকোনোমিক জোন গড়ে তোলার জন্য যার প্রধান উদ্দেশ্য হল পুঁজিপতিদের শ্রমিকশ্রেণিকে ইচ্ছামত শোষন করার উপযুক্ত বিশেষ সুবিধা এবং অধিকার সুনিশ্চিত করা।  সিঙুর এবং নন্দীগ্রামের মানুষ এই জমি কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। এমতাবস্থায় রাজ্যের সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী ও সি পি আই (এম) [1]-র ক্যাডার বাহিনীর ‘পবিত্র' জোট আন্দোলনকারীদের ওপর ভয়ংকরভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বিনা প্ররোচনায় গত ১৪ই মার্চ এই পবিত্র জোট নিরস্ত্র শিশু, বৃদ্ধ মহিলা এবং পুরুষের ওপর নিবির্চারে গুলি চালিয়েছে, নারীদের ওপর যৌন নিযার্তন করেছে, শিশুদের পযন্ত রেহাই দেয় নি-খবরে প্রকাশ তাদেরকে নির্মমভাবে ধর থেকে মাথা ছিঁড়ে মেরে ফেলা হয়েছে। শত শত মানুষ আহত, নিহতের সংখ্যা এখনও সঠিক জানা যায় নি কারণ ওই পবিত্র জোট সেসব লাশ গায়েব ক'রে দিয়েছে। এই ভয়ংকর পাশবিক সন্ত্রাস যেকোন সুস্থ স্বাভাবিক অনুভূতিসম্পন্ন মানুষের মনে ভীষণ ঘৃণার উদ্রেক না করেই পারেনা। আসলে এই ঘৃণা প্রকাশের কোন ভাষা আমাদের জানা নেই।

এই সংগ্রামী মানুষজনের মধ্যে  এখানকার সবচেয়ে ক্ষমতাশালী  বাম দল সি পি আই (এম) তথা বামফ্রন্ট সরকারের প্রতি হয়তো কিছু ভ্রান্ত প্রত্যাশা ছিল যে তারা সংগ্রামী মানুষের কথা শুনবে এবং তাদের দাবী মেনে নেবে। বিশেষত: যখন এই সি পি আই (এম ) দল অবিরাম পশ্চিম বঙ্গের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের মর্যাদা তথা জীবনযাপনের মান উন্নয়নের কথা  সুনিশ্চিত করার কথা বলে চলে এবং বলতে গর্ব বোধ করে।   পাশাপাশি অন্যান্য রাজনৈতিক দল মানে পুঁজির বাম ডান দলগুলোও এই প্রত্যাশাতেই ইন্ধন যুগিয়েছে এবং তাদের এই অস্তিত্ব রক্ষার মরীয়া চেষ্টাকে নিজেদের সংসদীয় ক্ষমতা দখলের এবং রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে কাজে লাগাচ্ছে। বিপরীতে বিপ্লবী প্রলেতারিয়েতের কাজ   বতর্মান ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে জীবনযাপনের এই ক্রমবধর্মান সংকটের মূল কারণ, পুঁজিবাদী এই ব্যবস্থাটার আসল স্বরূপ উদ্ঘাটিত করা, শ্রমিক শ্রেণি তথা অন্যান্য শোষিত অংশের   শ্রেণি-সংগ্রামের গতি-প্রকৃতি এবং লক্ষ্য সম্বন্ধে সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করা।      

স্ট্যালিনিস্ট বর্বরতার ঘৃণ্য স্বরূপের সুস্পষ্ট প্রকাশ :

সি পি আই এম বলে গ্রামের গরীব মানুষের জন্য তারা যথেষ্ট করেছে, তাদের "অধিকার" দিয়েছে, ভূমিসংস্কারের প্রবর্তক তারাই; হ্যাঁ, তারা কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমি সংস্কারের কমর্সুচীকে যথাসম্ভব রূপায়িত করেছে, হয়তো অন্য রাজ্যগুলোর তুলনায় একটু ভালোভাবেই-তবে স্বভাবতই এসব করার কারণ তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রধান ঘাঁটি  অর্থাৎ গ্রামের মেহনতী মানুষকে  নিজের পক্ষে রাখাই।   বলতে গেলে গ্রামের ওপর ভিত্তি করেই এত বছর ধরে এরা সরকারে থাকতে পেরেছে। স্বভাবতই এতকাল ক্ষমতায় থাকার ফলে তাদের স্পর্ধা বা ঔদ্ধত্যও বাড়াবাড়িরকমের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।

যাহোক বতর্মানে তারা আবিষ্কার করেছে যে ‘তাদের' সাধের পশ্চিমবঙ্গ নাকি ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলোর থেকে শিল্পায়নের ব্যাপারে বেশ পিছিয়ে পড়েছে! অতএব কোন কিছুর তোয়াক্কা নাকরেই সাত তাড়াতাড়ি ‘দেশি/বিদেশি' পুঁজি টানার তোড়জোর শুরু করে দিয়েছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বা শিল্পকেন্দ্র বা নগরায়ণ যাই হোক তার জন্য লাগে জমি। ফলে তাদের জমি ‘দখলের' নয়া লড়াই ---- সরকারী আইনের মুখে ঝামা ঘষে, রাজনৈতিক মস্তান বাহিনী/ মাফিয়া নামিয়ে, সন্ত্রাস সৃষ্টি ক'রে, একথায় যেনতেনপ্রকারেণ বাম সরকার জমি কেড়ে নেওয়ার প্রয়াসে নেমে পড়েছে। আর তারই ফল হ'ল এই নারকীয় হত্যালীলা-যা গুজরাটে আরএস এসের মুসলিম নিধন যজ্ঞের কথা অথবা কংগ্রেসীদের ১৯৭১-র রাডিক্যাল লেফটিস্টদের খতম করার ইতিহাস বা ১৯৮৪-র শিখ নিধনের কথা মনে করিয়ে দেয়। এব্যাপারে এরা চীনের কমরেড ‘দোসরের' কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েছে যারা অনেককাল আগেই চীনের চাষীদের দুদর্শাকে পুঁজি ক'রে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে আর তারপর সেই চাষীদের ওপরই নিপীড়নের স্ট্রীম রোলার চালিয়েছে ‘শিল্পায়নে'র খাতিরে! একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিক কালে দ্রুত ‘শিল্পায়ন'-র রাষ্ট্রীয় নীতির ফলে উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া হাজার হাজার কৃষকের সরকার বিরোধী আন্দোলন বর্বরোচিতোভাবে   দমন করা হয়েছে। খবরে প্রকাশ,  গত কয়েক বছরে চীনে কৃষির সঙ্গে যুক্ত মানুষের প্রায় ৯০,০০০ প্রতিবাদ আন্দোলন হয়েছে। এথেকে বোঝা যায়, রাডিক্যাল, অতিউগ্রসহ সবরকমের বামপন্থীরা পুঁজির দক্ষিণ অংশের মতই পুঁজিবাদকে টিকিয়ে রাখার জন্য সমস্তরকমের অমানবিক কাযর্কলাপ করতে পারে, পারে মানুষের ক্ষোভ বিক্ষোভকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাতে।

অনেকেই ভাবেন সিপিএম দীর্ঘকাল সরকারে থাকার জন্যই এমন পচনশীল , দূর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। শুধু বতর্মান অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই এটা সত্য মনে হতে পারে। কিন্তু ইতিহাসের আলোয় বিচার করলে ব্যাপারটা অন্যরকম: প্রকৃতপক্ষে সিপিআই (এম), সিপিআইএম (এল), সিপিআই এবং অন্যান্য স্ট্যালিনিস্ট, মাওয়িস্ট ট্রটস্কাইট পার্টিগুলো আসলে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সেই সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ধারা যারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রলেতারিয়েতের আন্তর্জাতিকতা এবং বিপ্লবী লাইন বর্জন ক'রে পুঁজিবাদী শিবিরে যোগদান করেছিল, আর জার্মানে  ১৯১৯-র বিপ্লবের প্রয়াসকে ধ্বংস করেছিল। এরাই খুন করেছিল বিশ্ব বিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ যোদ্ধা রোজা লুক্সেমবার্গ, কার্ল লিবনেখট্ আর লিও যোগিসেসের মত কম্যুনিস্টদের। যে তৃতীয় আন্তর্জাতিক বিশ্ব বিপ্লবের অগ্রণী নেতৃত্ব দেবার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এরাই স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সেই আন্তর্জাতিককে প্রতিবিপ্লবের আখরাতে পরিণত করার কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। মার্কসবাদের নামে এই গভীরতম প্রতিবিপ্লব বিশ্ব প্রলেতারিয়েতকে শুধুমাত্র শারীরিকভাবে নয়, তাকে পর্যুদস্ত করেছিল রাজনৈতিক ও মতাদর্শগতভাবেও। এই প্রতিবিপ্লব প্রলেতারিয়েতের সংগ্রামের সমস্ত ঐতিহাসিক শিক্ষা, তার তাত্ত্বিক হাতিয়ার, তার সংগঠন সবকিছুকেই লোপাট ক'রে দিয়েছিল। এরা মার্কসবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং স্ববিরোধী বিষয়কেই মার্কসবাদ হিসেবে উপস্থিত করেছিল। এককথায়, এরা মার্কসবাদের কবর খনক ছাড়া কিছুই নয়। স্ট্যালিন নিয়ন্ত্রিত বলসেভিক পার্টি বা মাও নিয়ন্ত্রিত সিপিসি বা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা  অন্যান্য অফিসিয়্যাল কম্যুনিস্ট পার্টিগুলো আসলে সম্পূর্ণরূপে অধঃপতিত প্রতিবিপ্লবী দল যদিও এরাই প্রলেতারিয়েতের বিপ্লবী পার্টি হিসেবে নিজেদের জাহির করেছে। এই স্ট্যালিনিয় প্রতিবিপ্লবী ধারা সারা বিশ্বে শ্রমিকশ্রেণির কাছে ইতিহাসের সবথেকে বড় এই মিথ্যা প্রচার করেছে যে রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যদিও রাশিয়ায় যা ছিল তা   সবথেকে বেশি দমনপীড়ণ  এবং শোষনের ওপর প্রতিষ্ঠিত এক বিশেষ ধরণের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ ছাড়া কিছুই নয়।

মার্কসীয় তত্ত্ব  অনুযায়ী এক দেশে সমাজতন্ত্র কখনোই হতে পারে না।

পরন্তু এই প্রতিবিপ্লবী পার্টিগুলোই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শ্রমিকশ্রেণিকে ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার শ্লোগান দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য করেছিল।   শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিক বিপ্লবী লাইন হ'ল সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণি কোন পক্ষেই যোগ দিতে পারেনা, বরং লেনিন যেমন বলেছিলেন তাদের কাজ হ'ল  পৃথিবীর প্রতিটি দেশের পুঁজিবাদের আক্রমণের বিরুদ্ধে শ্রেণিসংগ্রামকে তীব্রতর করা।   এরা তার সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিকতার নীতির বিরুদ্ধে পুঁজিবাদের পক্ষ নিয়েছিল।

ফ্যাসিস্টদের মতই এরা এবং এদের ‘গণতান্ত্রিক' সাম্রাজ্যবাদী জোটসহ    সকলেই লক্ষ লক্ষ শ্রমিক তথা শোষিত মানুষের মৃত্যুর জন্য সমান পরিমাণে দায়ী। জন্মের প্রায় শুরু থেকেই উপরোক্ত প্রতিবিপ্লবীধারার অবস্থানগুলোই সিপিআই (যার থেকেই পরে সিপিআই (এম)-র জন্ম)-র ভিত্তি। সেদিক থেকে বলা যায় এদের শ্রমিকশ্রেণির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস শুরু ১৯৩০-র দশক থেকেই। শ্রমিক শ্রেণির ঐতিহাসিক পরাজয়ের সেই সময় থেকেই এইসব রাজনৈতিক দলগুলো মাকর্সবাদের নামে মাকর্সবাদকে কবরে পাঠানোর কাজই ক'রে চলেছে এবং পুঁজির সবথেকে নির্ভরযোগ্য রক্ষকের ভূমিকা পালন করছে। এদের এই প্রতিবিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণি বিরোধী চরিত্র নগ্নভাবে উদ্ঘাটিত হতে অনেক সময় লেগেছে: এর প্রধাণ কারণ ইতিহাসের এক দীর্ঘ সময় জুড়ে এই গভীরতম প্রতিবিপ্লবী ধারার প্রভাব--- ঐতিহাসিক কারণেই শ্রমিকশ্রেণির ওপর এদের নিয়ন্ত্রণ ছিল ---কেননা  পরাজয়ের কালে শ্রমিকেরা এদেরকেই তাদের স্বার্থরক্ষাকারী দল হিসেবে মনে করত, তাদের মতাদর্শগতভাবে বন্ধ্যা ক'রে রেখেছিল এইসব দলগুলো। কিন্তু ইতিহাসের নিজস্ব নিয়মে, শ্রমিকশ্রেণির বর্তমান শ্রেণিসংঘর্ষের নতুন পর্যায়ে, যখন তাদের সংগ্রামী মনোভাব এবং শ্রেণি সচেতনতা অর্জনের প্রয়াস ক্রমবর্ধমান এবং ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদ যখন সারা পৃথিবীতেই স্থায়ীভাবে তীব্রতর সংকটের মধ্যে দিয়ে চলেছে তখন এই প্রতিবিপ্লবী শক্তি নিজেদের ভেতরকার আসল কুৎসিত, ঘৃণ্য এবং পুতিগন্ধময় চেহারাটা আর আড়াল করতে পারছে না, তাদের নখ দাঁত বেড়িয়ে পড়ছে শোষিত মানুষের , বিশেষতঃ শ্রমিক শ্রেণির মানুষের বিরুদ্ধে, শুধু ভারতেই নয়, সারা পৃথিবীতেই।

অন্যান্য রাজনৈতিক দল বা গ্রুপগুলো কি কৃষিতে যুক্ত মানুষগুলোর প্রকৃত বন্ধু?

সিপি আই এম-র এই দমন-পীড়ণ অতিবাম, দক্ষিণসহ  সব  বিরোধী রাজনৈতিকদলগুলোর কাছে বিরাট রাজনৈতিক সুযোগ এনে দিয়েছে-এমনকি,  ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট্রের অন্যান্য শরিকদলগুলোও এই ফাঁকে তাদের বড় শরিককে সব রকমে একঘরে করা,  নস্যাৎ করা এবং তার ভেতর দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক আধিপত্য সুনিশ্চিত করতে চাইছে। এদের মধ্যে কে কত বেশি চাষীভাইদের বন্ধু তা প্রমান করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। সিপিএমকে ভিলেন প্রমাণ করতে এরা মরীয়া। এরা চিৎকার করছে----   সিপিএম চাষীদের ওপর ফ্যাসিবাদী নিপীড়ণ চালিয়েছে। অতএব, ‘ফ্যাসিস্ট' সিপিএমের বিরুদ্ধে এ্যান্টিফ্যাসিস্ট ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট গড়ার প্রয়াস!   এরা বোঝাতে চাইছে তারাই একমাত্র আগমার্কা গণতান্ত্রিক দল! আর এইভাবে এরা শ্রমিকশ্রেণি তথা শোষিত মানুষকে আগামী নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে নিজেদের ‘গণতান্ত্রিক' পতাকাতলে আনতে চাইছে। লেফ্টিস্ট পার্টিগুলোর বিরুদ্ধে বিক্ষোভকে এরা তাদের ক্ষমতায় আসার পুঁজি করতে চাইছে। এরা এই সত্যটাকে আড়াল করতে চাইছে যে সরকারে গেলে এরাও একইরকম বা তার চাইতে  বেশি পরিমাণেই দমন-পীড়ণের আশ্রয় নেবে কেননা শোষিত মানুষ, বিশেষতঃ শ্রমিকশ্রেণির জীবন-জীবিকার ওপর ক্রমবর্ধমান     পুঁজিবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইকে ঠান্ডা করা তাদেরও কাজ। এটা তাদের শুভইচ্ছার ওপর নির্ভর নয়, বরং, যত গণতান্ত্রিক বলেই তারা নিজেদের দাবি করুক, আসলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে এটা তারা করতে বাধ্য কারণ এরা সকলেই পুঁজির বাম কিংবা ডান হাত ছাড়া কিছুই নয়। আমাদের বুঝতে হবে বর্তমানে পুঁজিবাদ টিকে থাকতে পারে শুধুমাত্র শ্রমিকশ্রেণিসহ অন্যান্য শোষিত মানুষের ওপর তার শোষন তীব্র থেকে তীব্রতর করার মধ্যে দিয়েই।   

বিরোধীরা বলছে এই বর্বর সিপিআইএমকে গদীচ্যূত করলেই সব সমস্যার সমাধান।   পুলিশ-ক্যাডার জোটের হাতে নিহত মানুষগুলোর প্রতি তারা আমাদের দৃষ্টি আবদ্ধ রাখতে চাইছে। এঘটনা সত্যিই অসহনীয়, কিন্তু আমরা কি ভুলে যাব গত দুতিন বছরে এই ভারতেই ২০ থেকে ৩০ হাজার চাষী আত্মহত্যা করেছে- বিশেষ ক'রে সেইসব জায়গায় যেখানে কৃষি অত্যন্ত উন্নত, ফলে বিশ্ব বাজারের সঙ্গে দারুনভাবে অন্বিত। এদের জমি কেড়ে নেওয়া হয় নি, জমির মালিকানা থাকা সত্ত্বেও তারা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে।  বিশ্ব-পুঁজিবাদের কোন্ বস্তুগত পরিস্থিতির চাপে এই অবস্থা হল একথা তারা কেউ বলছে না, বরং তার বিপরীতে একটা ভুল ধারণা মাথায় ঢোকাতে চাইছে যে নন্দীগ্রামের এই ঘটনাটা যেন বা পৃথিবীর পুঁজিবাদের সংকটের বাইরে, এটা শুধুমাত্র কোন্ সরকার  ক্ষমতায় আছে তার ওপর নির্ভর; এককথায় যেনতেন প্রকারে, রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম করা, আর সর্বোপরি গদীটি দখল করা এদের মূল লক্ষ্য:  এদের কাছে এই বর্বরতা, এই মৃত্যু,  শোষিতমানুষের   মরীয়া হয়ে বাঁচার চেষ্টা সবই হল সেই লক্ষ্য পূরণের সহায়ক হাতিয়ারমাত্র।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আক্রমণ:

পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে প্রাক-পুঁজিবাদী পণ্য-উৎপাদন ও বিনীময় ব্যবস্থার গর্ভ থেকে। আর পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিকাশের পথে লক্ষ লক্ষ খুদে উৎপাদক এবং চাষী তাদের জমি  অথবা উৎপাদনের উপায় গুলো  থেকে উচ্ছেদ হয়েছে। বাস্তবত, পুঁজিবাদ টিকে থাকতে  পারে প্রাক-পুঁজিবাদী ধরণের উৎপাদন ক্ষেত্রগুলোকে ক্রমাগত আত্মসাৎ করেই। এইসব খুদে মালিক ও উৎপাদকেরা পুঁজিবাদী উৎপাদিকা শক্তির বিপুল তেজের সামনে খড়কুটোর মত ভেসে যায়: সস্তা পণ্যের বিপরীতে তাদের পুরোণো ধরণের উৎপাদন বাজারে কোন জায়গাই করতে পারে না-ফলে তাদের পুরোণো জীবনযাপনের ধরণ বজায় রাখাও ক্রমাগত অসম্ভব হয়ে পড়ে। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীতে পুঁজিবাদী বিকাশের বিপুল জোয়ারের সময় এই সব উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া মানুষদের পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার অন্তর্ভূক্ত করে নেওয়া সম্ভব ছিল।

কিন্তু বতর্মানে পুঁজিবাদ নিজেই একটা জরাগ্রস্ত, বাতিল ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। তার সংকট এখন আর আকস্মিক নয়, বরং তা একটা স্থায়ী এবং ক্রমবর্ধমান রূপ লাভ করেছে। এ পর্যায়ে পুঁজিবাদ লক্ষ লক্ষ মানুষকে তার নিজের উৎপাদন ব্যবস্থার বাইরে বের ক'রে দিতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে, অসংখ্য মানুষ ক্রমাগত আরো বেশি দুর্দশা, বেকারি, অনিশ্চয়তার দিকে চলে যাচ্ছে। মানুষকে ভবঘুরেতে পরিণত ক'রে দিচ্ছে এই সিস্টেম।

  যে কোন উপায়ে লাভের অংক বাড়ানোই পুঁজিবাদের মূলমন্ত্র। পুঁজির ডান বাম সব দল বা গোষ্ঠীর কাজ শেষবিচারে এই প্রচেষ্টাকেই সফল ক'রে তোলা। তবে এই কাজ যত অসম্ভব বা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে, তত বেশি বেশি ক'রে পুঁজিপতিদের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সেইসব সেক্টরগুলো নিয়ে মারমার কাটকাট প্রতিযোগিতা চলছে যেসব সেক্টরে টাকা ঢাললে সবথেকে বেশি এবং সবথেকে তাড়াতাড়ি লাভ হবে। আর একারণেই শিল্প-ক্ষেত্রগুলোর স্থান বদল (relocation) এবং আউটসোর্সিং এত গতি পাচ্ছে। ইউরোপীয় এবং আমেরিকান পুঁজিপতিরা তাদের উৎপাদন পদ্ধতির কিছুটা বা পুরোপুরি স্থানান্তরিত করছে বা তাদের অনেক কাজই আউটসোর্শ করছে সেইখানে যেখানে যথেষ্ট সস্তায় যথেষ্ট দক্ষ শ্রমিক পাওয়া যাবে। এই হল বতর্মানে চীন এবং ভারতের ‘আশ্চর্য্য' উন্নতির ভেতরের কারণ। পচে যাওয়া পুঁজিবাদী এই ব্যবস্থার মধ্যে  এই ‘শিল্পায়ন'-র জন্যই এখন জমি দরকার। রিয়েল এস্টেটের বাড় বাড়ন্ত এরই ভিত্তিতে এবং শুধু চীন ভারত নয়, সারা বিশ্বেই এই বিজনেস এখন দ্রুত গতি লাভ করেছে। অতীতের ‘স্বর্ণ-তৃষা'র মত এখন ‘ ভূমি-তৃষা' সারা ভারতে মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়েছে-জমির দাম বাড়ছে অবিশ্বাস্য হারে। জমি নিয়ে ফাটকা কারবার চলছে দ্রুততার সঙ্গে প্রচুর লাভ তুলে আনার জন্য। কৃষকদের পক্ষে তাদের জীবিকার ওপর এই আপাত অদৃশ্য পুঁজিবাদী আক্রমণ প্রতিহত করা অসম্ভব। ঐতিহাসিক ভাবে বাতিল হয়ে যাওয়া মৃত্যুপথযাত্রী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চলমান অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই  লক্ষ লক্ষ কৃষক জমি হারাচ্ছে এবং হারাবে।

তাছাড়া, গ্রামীন অর্থনীতি পুরোপুরি বিশ্ব পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে আত্মীকৃত হয়ে গেছে। বাজার-অক্টোপাশ সমস্ত   অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে তার সহস্র পাশে বেঁধে দমবন্ধ ক'রে দিচ্ছে, হাজার হাজার খুদে চাষীর জীবন সম্পূর্ণ অনিশ্চিত, আশাহীন হয়ে পড়ছে এই সুবিপুল এবং মূলত নিয়ন্ত্রণহীন বিশ্ব তথা জাতীয় বাজারের প্রচন্ড চাপের মুখে। এই পরিস্থিতি তাদের আত্মহত্যা অথবা জমি বিক্রির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ফলতঃ যেভাবেই হোক কৃষকদের জীবন জীবিকার চলতি উপায় বজায় রাখার কোন উপায় আজ আর খোলা নেই। যতদিন এই পুঁজিবাদ টিকে আছে ততদিন বুর্জোয়াদের নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য জমি নেওয়ার এই প্রক্রিয়া রোধ করা সম্ভব নয়। যত ভালো স্বপ্নই তারা দেখাক বা দেখুক না কেন, কোন রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক দল একে আটকাতে পারবে না।

ভুয়ো বিকল্প

সরকার এবং বিরোধী দল সকলেই কতকগুলো ভুয়ো বিকল্প হাজির করেছে। বামফ্রন্ট সরকার বলছে ‘শিল্পায়ন'-র মাধ্যমে যারা জমি দিচ্ছে বা  যারা জমির ওপর ভিত্তি ক'রে জীবিকা করে তারা সকলেই অন্নসংস্থানের সুযোগ পাবে। এটা নির্জলা মিথ্যা। বেশিদিনের কথা নয়, সিপিআইএম নিজেই বলেছে ভারতের বর্তমান অর্থনৈতিক গ্রোথ আসলে কার্মসংস্থানহীন গ্রোথ। এটা সত্যি। তাহলে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এটা উল্টো হবে কোন্ ম্যাজিকে? বিরোধীরা বলছে চাষীদের হাত থেকে জমি কেড়ে না নিলেই প্রবলেম সলভ্‌ড্-কিন্তু আমরা আমাদের বিশ্লেষণে দেখিয়েছি পুঁজিবাদের আজকের এই সংকটের মুখে একথা হানড্রেড পারসেন্ট ভাঁওতা ছাড়া কিছুই নয়। এই জঘণ্য মিথ্যাচার ক'রে এরা চাষীদের প্রাকপুঁজিবাদী জীবনধারণের অনিশ্চয়তার গাড্ডাতেই রেখে দিতে চাইছে যাতে ক'রে প্রয়োজন মত তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বলী দেওয়া যায়। আসলে এই ব্যবস্থার মধ্যে কোন সমাধান আজ আর নেই।

সমাধানের একমাত্র রাস্তা

ওইসব মিথ্যে বিকল্পগুলোর কোনটাই সমস্যার সমাধান করতে পারেনা। বাম সরকার পাল্টে ডান বা অতিবাম তথাকথিত ভীষণ ‘গণতান্ত্রিক' সরকার এনেও কোন সমাধান সম্ভব নয়। ভীষণরকম রাডিক্যাল উপায়ে (যথা মাওয়িস্ট) লাঙল যার জমি তার ক'রে জমিকে হাজার টুকরো ক'রে অসংখ্য ক্ষুদ্র মালিকানা তৈরি করাটাও কোন সমাধান নয়-এটা বাস্তবে প্রমাণিত। আসলে, এই ভয়ংকর অবস্থার জন্য দায়ী যে বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তাকে উচ্ছেদ করাটাই হল আজকের একমাত্র কর্তব্য। এই কাজ করতে না পারলে মানব প্রজাতির অস্তিত্বই আরো বিপন্ন হয়ে পড়বে। তাই আজ যারা পুঁজির বাম ডান সবরকম দলের বাইরে দাঁড়িয়ে,   নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা যাঁরা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলছেন, যাঁরা নন্দীগ্রামের মত এই নিদারুণ অমানবিক ঘটনায় গভীরভাবে ব্যথিত তাঁদের চিন্তা করা দরকার সঠিক বিকল্পটা  অর্থাৎ বিশ্বপুঁজিবাদের ধ্বংস সাধন।  আর একমাত্র বিশ্ব-শ্রমিকশ্রেণিই পারে একাজে নেতৃত্ব দিতে এবং এই কাজকে সফলভাবে সমাধা করতে। এখানেই নিহিত আছে শ্রমিকশ্রেণিসহ সমস্ত শোষিত অংশের মুক্তির চাবিকাঠি। অতএব সমস্ত শোষিত মানুষের, বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রামের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করা ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই, কেননা প্রকৃত সমাধানের পথে একমাত্র শ্রমিকশ্রেণিই তাদের প্রকৃত বন্ধু হতে পারে।

 ইন্টারন্যাশনাল কম্যুনিস্ট কারেন্ট (আইসিসি)

২০শে মার্চ, ২০০৭

[1] বতর্মানে ভারতের প্রাধান্য বিস্তারকারী স্ট্যালিনিস্ট পার্টি

Communist Internationalist - 2008

 

ইন্টারন্যাশানাল কম্যুনিস্ট কারেন্ট আয়োজিত আলোচনা সভা

বামপন্থা, অতিবামপন্থা এবং কম্যুনিজম্‌ তারিখ: ২৭শে এপ্রিল, ২০০৮   বিষয় উপস্থাপনা

প্রিয় সাথী,

সকলকে আইসিসি'র পক্ষ থেকে স্বাগত জানাই। আপনাদের মধ্যে অনেকেই জানেন আইসিসি, মানে ইন্টারন্যাশানাল কম্যুনিস্ট কারেন্ট ধারাবাহিকভাবে সারা পৃথিবী জুড়েই শ্রমিকশ্রেণির সচেতনতা বিকাশে সাহায্য করতে সচেষ্ট।  বর্তমান সময়কালে শ্রমিকশ্রেণির সচেতনতার অর্থ কী হবে, তার বর্তমান সংগ্রামের গতিপ্রকৃতি কী হবে, কম্যুনিজমের পথে এগোনোর জন্য শ্রেণির আজকের কর্তব্য কী ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন, খোলামেলা আলোচনা এবং স্বচ্ছতা অর্জনের নিরলস প্রয়াস আজকের দিনে আমাদের কর্তব্য ব'লে আইসিসি মনে করে এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে তা পালন করার চেষ্টা করে। ভারতে আজকের এই আলোচনা সভা সেই স্বচ্ছতা অর্জনেরই একটা প্রয়াস হিসেবে দেখতে হবে এবং আইসিসি তার রাজনৈতিক কর্তব্য হিসেবেই এই আলোচনা সভা আয়োজন করেছে।  

প্রথমতঃ এই বিষয়টা কেন আমরা রেখেছি তা নিয়ে অবশ্যই দুকথা বলার দরকার আছে। ভারতীয় প্রেক্ষাপটেই শুধু নয়,সারা পৃথিবীতেই বামপন্থা এবং অতিবামপন্থার নানান ভ্যারাইটি আমরা দেখতে পাই এবং চলতি ধারণা মোতাবেক এদের কমর্কান্ডের সঙ্গে কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রামকে এক ক'রে দেখানো হয়। যখন মেলে না তখন এক বিরাট শূণ্যতার বোধ আমাদেরকে গ্রাস করে। সত্যিকারের কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রাম আর এদের সংগ্রামের মঝে এক বিরাট ফাঁক আজ যেকোন মানুষের চোখে পড়ে। কিন্তু বোঝা যায় না কিভাবে এটা ব্যাখ্যা করা যায় এবং কিভাবেই বা শ্রমিক শ্রেণির কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রাম সম্ভব বা আদৌ তার আর কোন তাৎপর্য আছে কিনা। এর ফলে অনেক মানুষ যাঁরা তাঁদের জীবনের অনেকটা সময় শ্রমিকশ্রেণির মুক্তির জন্য ব্যয় করতে চেয়ে অত্যন্ত সততার সংগে হয় কোন না কোন গ্রূপ বা দলের হয়ে কাজ করেছেন বা করছেন, অর্ন্তদন্দ্বে ভুগছেন অথবা সঠিক বিকল্প অনুসন্ধান করছেন অথচ কোন পথের দিশা বা আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে সঠিক এবং সুসংহত একটা ফ্রেমওয়ার্ক পাচ্ছেন না তাঁদের কাছে আজকের দিনে এই বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব'লে মনে হয়েছে।

দ্বিতীয়তঃ, শ্রমিকশ্রেণির প্রধান হাতিয়ার তার সচেতনতা এবং তার সংগঠন। সত্যিকারের শ্রেণিসংগঠনের রূপরেখা কী হতে পারে, আদৌ এইসমস্ত ধরণের বামপন্থার সাথে তার বিন্দুমাত্র কোন যোগ আছে কিনা, তা বুঝতে না পারলে শ্রেণি তার আজকের সংগ্রামের দিকদিশা ঠিক করতে পারেনা। এক্ষেত্রে তার সামনে সবচেয়ে বড় বাধা তার সনাতনভাবে লালিত এই ধারণা যে বামপন্থা তা সে যেমনই হৌক, পারলিয়ামেনটারি অথবা বিপরীত তা শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থের সংগে সংস্লিষ্ট।

তৃতীয়তঃ, সারা বিশ্বজুড়ে শ্রমিকশ্রেণি আবার সংগ্রামের মন্চে হাজির হচ্ছে। সারা পৃথিবী জুড়েই সচেতনতা অর্জনের প্রয়াসে নতুন জোয়ার এসেছে। আজ পুঁজিবাদী বর্বরতার পর্যায়ে মানব অস্তিত্ব বিপন্ন। এঅবস্থায় সচেতনতার মূর্ত নির্দিষ্ট অর্থ হ'ল কম্যুনিজমের অপরিহার্যতার উপলব্ধি, কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রামকে বিকশিত করা; আর এই লক্ষ্যেই আমাদের প্রথম দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় সংগ্রামের সামনে বাধাগুলো সম্বন্ধে স্বচ্ছতা অর্জন। যে রাজনীতি কম্যুনিজমের নামে   কম্যুনিজমের ঠিক বিপরীত ধারাকে শ্রমিকশ্রেণির ওপর চাপিয়ে দিয়েছে এবং আজো তাইই ক'রে চলেছে, তার স্বরূপ উন্মোচন করা আমাদের দায়িত্ব।

বিষয়ে আসা যাক।

আমরা জানি পুঁজিবাদী সমাজের বিবর্তনের পথে তার বস্তুগত পরিস্থিতির বদলের সঙ্গে শ্রেণিসংগ্রামের গতিপ্রকৃতি ও দিকদিশা বদলায়। প্রকৃতপক্ষে এই দুইয়ের একটিকে অন্যটির সাথে বিচ্ছিন্ন ক'রে দেখা  যায় না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা সামন্ততন্ত্রের গর্ভ থেকে জন্মলাভ ক'রে দীর্ঘ বুরজোয়া বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে গেছে এবং নিজেকে সমৃদ্ধতর করতে থেকেছে। তারপর নিজ নিয়মেই সেটা বিকাশের চূড়ান্ত পর্যায় অতিক্রম ক'রে ক্ষয়ের পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। আর এই দীর্ঘ কাল পর্বে শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রামেরও বিবর্তন ঘটেছে। বিকাশের পর্ব থেকে ক্ষয়ের পর্বে যেমন পুঁজিবাদ পৌঁছেছে তেমনই শ্রেণিসংগ্রামও   সংস্কারমূলক কর্মসূচির কালপর্ব থেকে প্রলেতারীয় বিশ্ব বিপ্লবের কর্মসূচির কাল পর্বে পৌঁছেছে। ফলতঃ বিপ্লবী লক্ষ্যের সাপেক্ষেই তার সংগ্রামের প্রকৃতি, উপায় ইত্যাদিরও বদল ঘটেছে।

পুঁজিবাদের বিকাশের দশা বা Ascendant phase-র   প্রধান বৈশিষ্ট হ'ল এই পর্যায়ে পুঁজির সম্প্রারণের পথে কোন মৌলিক বাধা নেই, সমগ্র উৎপাদন সম্পর্ক উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যে একটা তালমেল আছে, শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রামগুলোর প্রধান লক্ষ্য আশু দাবীদাওয়া ভিত্তিক যা মূলতঃ তার জীবনযাপনের মানকে আরো উন্নত করবে, সুনিশ্চিত করবে, রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্রীয় কাজে আর প্রত্যক্ষ যোগ থাকবে(পার্লামেনটে অংশ নেওয়া)। এককথায় এই পর্যায়ের রাজনীতি চালিত হয়েছে সংগ্রাম এবং সহাবস্থান এই ভিত্তিতে। অবশ্য এই পর্যায়েই শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রামের ঐতিহাসিক লক্ষ্য স্থিরীকৃত হয়ে গেছে: কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টোয় মার্কস তারই ঘোষণা করেছেন সুস্পষ্ট ভাষায়। বোঝা গেছে কম্যুনিজম কোন ইউটোপিয়া নয়, কোন ভাবাদর্শ নয়, এ হ'ল বাস্তবে অর্জনযোগ্য  শ্রেণিহীন শোষনহীন রাষ্ট্রীয় সীমানাহীন একটা বিশ্বব্যবস্থা, সমাজ গতির মধ্যেকার ক্রিয়াশীল দন্দ্বগুলোর পরিণতিতে এটা হয়ে ওঠে সম্ভবপর এবং অপরিহার্য। আর এর জন্য সংগ্রাম করতে, তাকে সফল ক'রে তুলতে পারে একমাত্র শ্রমিকশ্রেণি। তবে পুঁজির বিকাশের সেই পর্বে কম্যুনিজম   আশু কর্মসূচি হয়ে ওঠে নি।

পুঁজিবাদের ক্ষয়ের পর্যায়ের (decadence) প্রধান বৈশিষ্ট হ'ল বাধাহীনভাবে পুঁজির সম্প্রসারণে স্থায়ী সংকট। বিশ্বজুড়ে বৃহৎ পুঁজির মধ্যে বিশ্ববাজারটা একবার দখল হয়ে যাবার পর তার বাজারের সংকট স্থায়ী রূপ লাভ করতে থাকে।। এর ফলে অনিবার্য হয়ে ওঠে বাজার পুণর্দখলের লড়াই: দুদুটো বিশ্বযুদ্ধ তারই সুস্পষ্ট প্রতিফলন। বিংশশতাব্দীর প্রারম্ভ থেকেই মোটামুটিভাবে সুস্পষ্ট হতে থাকা এই পর্যায়কে সাম্রাজ্যবাদের যুগ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন লেনিন এবং বলেছেন এ হ'ল "মূমূর্ষ পুঁজিবাদ" (সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়"-লেনিন, ১৯১৬)। শ্রমিকশ্রেণির দিক থেকে তাই এই যুগ আর কোন দাবী দাওয়া আদায়ের সংগ্রামের যুগ নয়: এ হ'ল প্রলেতারীয় বিশ্ববিপ্লবের যুগ। এই পর্যায়ে তাই তার কাছে কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রামটা নিছক শ্লোগান থাকতে পারেনা, বরং তার সংগ্রামের গতিপ্রকৃতি হয়ে ওঠে কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রামের অভিমুখী। বর্তমান পর্যায় সেই কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রামের পর্যায়।   সহাবস্থান বজায় রেখে সংগ্রাম   নয়,এ হ'ল পুঁজিবাদের উচ্ছেদের জন্য সংগ্রামের পর্যায়।

দুই পর্যায়ের রাজনীতি তাই শ্রমিকশ্রেণির কাছে একইরকম হতে পারেনা।

 আমরা দেখি পুঁজির বিকাশের দশায় সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিগুলোর প্রধান কাজ ছিল দাবীদাওয়াভিত্তিক সংগ্রামগুলো সংগঠিত করা, তাকে নেতৃত্ব দেওয়া। তখনও অব্দি বুর্জোয়াদের মধ্যে থেকে প্রগতিশীল বুর্জোয়া অংশ খুঁজে পাওয়া যেত যাদের কে প্রলেতারিয়েত কোন কোন প্রশ্ন সমর্থন করত পারত এবং তা শ্রমিকশ্রেণির তৎকালীন স্বার্থের পক্ষে সহায়কই হত।   দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মধ্যে বহুরকম "গণসংগঠন" গড়ে তোলার প্রোগ্রাম ছিল, ছিল পার্লামেন্টে অংশগ্রহনের কর্মসূচি। কম্যুনিজম ছিল সর্বদাই একটা দূরের বস্তু, শেষ লক্ষ্য। এরই অধীনে যেসব পার্টিগুলো  কাজ করত তাদেরকেই বলা হত বামপন্থী দল এবং তারা ছিল মূলতঃ সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি হিসেবে পরিচিত।   কম্যুনিজম তাদের কাছে আশু লক্ষ্য ছিল না আর তাই সংস্কারমূলক কাজ কর্মের মধ্যে নিয়োজিত থাকাটা ছিল শ্রমিকশ্রেণির রাজনীতিরই অংগ।  

কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ইতিহাসের সেই পর্যায়কে চিহ্নিত করল এই ব'লে যে পৃথিবী এক নূতন যুগে প্রবেশ করেছে-  সাম্রাজ্যবাদী বর্বরতা অথবা সমাজতন্ত্র এ‌ই হ'ল এযুগের দুই বিকল্প। সুতরাং শ্রমিকশ্রেণির রাজনীতিতে এক মৌলিক পরিবর্তন ঘটল: তার আশু এবং চূড়ান্ত সংগ্রাম সমার্থক হয়ে দাঁড়াল, বিপ্লবই হয়ে দাঁড়াল তার একমাত্র কর্মসূচি। সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিকযুগের সংস্কারমূলক সংগ্রাম সেকেলে হয়ে পড়ল, শ্রমিকশ্রেণি ট্রেডইউনিয়নের সংগ্রাম ছেড়ে "মাস-স্ট্রাইক"-র রাস্তা দেখাল। লেনিনসহ রোজা লুক্সেমবার্গ, কার্ল লিবনেখ্‌ট, পানেকোয়েক ইত্যাদি অগ্রণী কমরেডরা নতুন যুগের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি অনুযায়ী শ্রেণির সংগ্রামের পথ নির্দেশিকা হাজির করলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে এরই পরিণত প্রতিফলন ঘটল এই বিখ্যাত অবস্থানের মধ্য দিয়ে: সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের সবকটা পক্ষই সমান প্রতিক্রিয়াশীল এবং সাম্রাজ্যবাদী; এর মধ্যে কোন পক্ষই শ্রমিকশ্রেণি গ্রহণ করতে পারেনা। তার কাজ সাম্রাজ্যবাদী এই  যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধে পরিণত করা। সোজা বাংলায় যার মানে হ'ল বিশ্বজুড়ে প্রলেতারীয় বিপ্লব সংগঠিত করা। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মধ্যে বেশিরভাগ অংশই এই লাইনকে মেনে নেয়নি। 

 প্রথম বিশ্বযুদ্ধে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক  শ্রমিকশ্রেণিকে এক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অপর সাম্রাজ্যবাদী পক্ষ অবলম্বন করতে আহ্বান জানাল।     জাতীয়তাবাদের ধারণাকে উস্কে দিয়ে এভাবেই এক অংশের শ্রমিকশ্রেণিকে অন্য অংশের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিল; ফলে শ্রমিকশ্রেণির আন্তর্জাতিকতার কোন প্রশ্নই দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মধ্যে রইল না। স্পষ্টতই লেনিনসহ মাইনরিটি অংশ দ্বিতীব আন্তর্জাতিকের রাজনীতি পরিত্যাগ করলেন। ঘোষণা করলেন দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক মৃত। এভাবে ইতিহাসের বিপ্লবী যুগের সূচনাতেই আমরা দেখলাম শ্রমিকশ্রেণির রাজনীতিতে দুটি সুষ্পষ্ট ধারা: একটি অধঃপতিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের, অন্যটি লেনিন, রোজা ইত্যাদিদের মাইনরিটি ধারা। ইতিহাস দেখিয়ে দিয়েছে কোন্ ধারাটি প্রকৃত বিপ্লবী লাইনের প্রতিনিধিত্ব করেছে। লেনিনেরা সংখ্যায় অল্প ছিলেন কিন্তু প্রলেতারীয় অবস্থান নেওয়ার প্রশ্নে তাঁরাই প্রকৃত বিপ্লবী ধারার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। বিপরীতে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের রাজনীতি শ্রমিকশ্রেনীর প্রতি বেইমানিই করেছে, কারণ শ্রমিকশ্রেণি সারা পৃথিবী জুড়ে সাম্রাজ্যবাদী নিধনযজ্ঞের শিকারই হয়েছে। মুখে-আন্তর্জাতিকতার বিপরীতে লেনিনেরা বাস্তবে আন্তর্জাতিক শ্রেণিলাইনটি আঁকড়ে ছিলেন যারই ধারাবাহিকতায় পৃথিবীতে প্রথম সফল প্রলেতারীয় বিপ্লব সংঘটিত হ'ল রাশিয়ায়। তার ঢেউ আছড়ে পড়ল সারা ইউরোপে- জার্মানি হয়ে উঠল বিশ্ব প্রলেতারীব বিপ্লবের সাফল্যের নির্ধারক শক্তি। আর সেই জার্মানেই আমরা বিপ্লবকে পরাজিত হতে দেখলাম দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের অন্তর্গত সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিগুলোর বেইমানির কারণেই।   সেই সময় থেকেই বাস্তবতঃ বামপন্থী সোস্যাল ডেমোক্র্যাসির সঙ্গে কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রামের সম্পর্ক রইল না। যদিও তারা টিকে রইল কিন্তু তাদের অস্তিত্ব শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রামকে বেপথু করা ছাড়া শেষ বিচারে কিছুই করে নি। জার্মানিতে প্রতিবিপ্লবের বিজয় তারই সুনিশ্চিত প্রমাণ।  

১৯১৭-র রুশ বিপ্লব দিয়ে শুরু হল শ্রমিক শ্রেণির প্রথম বিশ্বজোড়া বিপ্লবের ঢেউ। সেই ঢেউ শেষঅব্দি পরাজিত হ'ল। শ্রমিকশ্রেণির এই পরাজয়  তার শ্রেণি সচেতনতার ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব বিস্তার করল। তার হেরে যাওয়ার ওপর ভিত্তি করেই ক্রমাগত সেই ধারার বিকাশ এবং বিস্তার ঘটতে থাকল যা লেনিনেরা পরিত্যাগ করেছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালেই।  বিজয়ী রুশ বিপ্লবের ওপর ভিত্তি করেই যে বিপ্লবী শিক্ষা দুনিয়ার শ্রমিক শ্রেণি অর্জন করছিল, তারই ওপর ভিত্তি ক'রে তৃতীয় আন্তর্জাতিক গঠিত হয়েছিল। তার মূল লক্ষ্যই ছিল বিশ্ব বিপ্লবকে জয়ী করা। কিন্তু সেই বিপ্লবী তরংগে যখন ভাটা এল, তখন সেই ভাটার হাত ধরেই তার মধ্যে ফিরে আসতে থাকল সেই রাজনৈতিক অবস্থানের কথা যা লেনিনেরা পরিত্যাগ করেছিলেন দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সময়কালেই। এল বুরজোয়াদের সংগে ইউনাইটেড ফ্রন্ট গঠনের রাজনীতি, ফিরে এল সংস্কারমূলক কর্মসূচির জন্য লড়াই, ট্রেডইউনিয়নিজম, ফিরে এল পার্লামেন্টে অংশ গ্রহণের রাজনীতি, ফিরে এল বাণর্স্টাইনের শান্তিপূর্ণ সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব, ফিরে এল সেকেলে হয়ে যাওয়া এবং বাস্তবতই ভিত্তিহীন হয়ে পড়া বুরজোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তত্ত্ব অর্থাৎ এককথায় সেইসবকিছু যা পুঁজির বিকাশের যুগের শ্রমিকশ্রেণির রাজনীতির সঙ্গে খাপ খায়। আন্তর্জাতিকতার প্রশ্নটি একটি বাগাড়ম্বরে পরিণত হল।  রাশিয়ার সফল বিপ্লব শেষ অবধি অধঃপতিত হতে হতে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদে রূপলাভ করল।    আর এরই ধারাবাহিকতায় এল ইতিহাসের ভয়ংকরতম শ্রমিকশ্রেণি বিরোধী লাইন যা এর আগে কোন কম্যুনিস্ট কোনদিন কল্পনাও করতে পারেননি: ঘোষিত হ'ল: একদেশে সমাজতন্ত্র সম্ভব! যদি একদেশে সমাজতন্ত্র সম্ভব হয় তাহলে আন্তর্জাতিকের  দরকার থাকে না।  সেটা আর দুনিয়ার শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী সংগ্রামকে নেতৃত্ব দিতে পারেনা।

ইতিহাসের সেই পর্বে তৃতীয় আন্তর্জাতিকের মধ্যে কি তবে কোন ডিবেট ছিল না? কোন অংশই কি সেদিন ছিল না যারা দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মধ্যে লেনিনেরা যা ভূমিকা পালন করেছিলেন সেই একই ভূমিকায় কমিনর্টানের মধ্যে প্রলেতারীয় লাইনকে তুলে ধরেছেন, আন্তর্জাতিক শ্রেণি লাইনকে প্রাণপণে রক্ষা করার লড়াই করেছেন? আমরা কি কখনও তাদের ইতিহাস ঘেঁটে দেখেছি? আসলে আবারো আমরা দেখব দুটি ধারার বিভাজন: একটি ধারা যা শ্রমিক শ্রেণির নামে বুরজোয়াদেরই স্বার্থরক্ষাকারী ধারা যাদেরকে আজ আমরা বামপন্থী হিসেবে চিনি এবং এদের সাথে কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রামের কোন সম্পর্ক নেই। অপর ধারা যেটা কমিনটার্ণের মূল মার্কসীয় ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে, প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাকে একমূহুর্তের জন্যও পরিত্যাগ করেনি। বরং যাদেরকে   ইন্টারন্যাসনাল থেকে বের ক'রে দেওয়া হয়েছিল বা যারা অধঃপতিত হতে থাকা ইন্টান্যাশনাল থেকে নিজেরাই বেরিয়ে এসেছিল শ্রমিকশ্রেণির অবস্থানকে রক্ষা করতে।এদের মধ্যে ইটালিয়ান লেফ্‌ট্, জার্মান লেফ্‌ট্ ইত্যাদি অংশের ঐতিহাসিক ভূমিকা অপরিসীম। ইতিহাসে এরা কম্যুনিস্ট লেফ্‌ট্ নামে পরিচিত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই দুই ধারার মৌলিক অবস্থানই আমাদের নিশ্চিতভাবে চিনতে সাহায্য করে কোন্ ধারাটি প্রলেতারিয়েতের বিপ্লবী অংশের প্রতিনিধিত্ব করেছে। আমরা জানি তৃতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেসে সকলেই " সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে কোন পক্ষ নেওয়া নয়, আসল কাজ তাকে গৃহযুদ্ধে পরিণত করা" এই অবস্থান গ্রহণ করেছিল কারণ মার্কসের ভাষায় প্রলেতারিয়েতের কোন ‘পিতৃভূমি" নেই, থাকতে পারেনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই অবস্থানকে আঁকড়ে ধরার আহ্বান রেখেছিল কারা? সেই মাইনরিটি অংশ যারা লেনিন রোজা ইত্যাদিদের যোগ্য উত্তরসূরি। এই মাইনরিটি ধারার নাম কী? ইতিহাসে এদের নামকরণ হয়েছে কম্যুনিস্ট লেফ্‌ট্।  বিপরীতে স্ট্যালিনের আহ্বান কী ছিল? পিতৃভূমি রক্ষার লড়াই। এ পিতৃভূমি কার? নিশ্চয়ই বুরজোয়ার রাশিয়া যার একটি অংশ।, নিশ্চয়ই সারা পৃথিবী জুড়ে শ্রমিকশ্রেণির মানুষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়ার চক্রান্ত বুরজোয়া রাজনীতিরই অঙ্গ। এই রাজনীতিই কম্যুনিস্ট লেফ্‌টদের সংগ্রামের ইতিহাস মুছে দেওয়ার চেষ্টা করেছৈ। মার্কসবাদের নামে একটি ধারা সারা পৃথিবীতে লালন করেছে বামপন্থী দলগুলো, যাদের ভিত্তি হল অধঃপতিত হতে থাকা কম্যুনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের রাজনৈতিক অবস্থানগুলো।  

   একদিন দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক থেকে লেনিনদের একটি ছোট্ট অংশ বেরিয়ে এসেছিলেন শ্রমিকশ্রেণির প্রকৃত অবস্থানকে আঁকড়ে ধ'রে, ঠিক তেমনই সেই বিপ্লবীদের প্রকৃত মার্কসীয় ধারাকে অব্যাহত রাখার জন্য অধঃপতিত তৃতীয় আন্তর্জাতিকের রাজনীতিকে পরিত্যাগ ক'রে শ্রমিকশ্রেণির  প্রকৃত আন্তর্জাতিকতার অবস্থানকে গ্রহণ ক'রে এবং তাকে বিকশিত ক'রে তোলার কাজে যাঁরা হাত লাগিয়েছিলেন তাঁরাই ‘কম্যুনিস্ট লেফ্‌ট্ কারেন্ট"। এঁরা বামপন্থী নন, এঁদের গ্রূপ বা কারেন্ট কোন শ্ট্যালিনীয় বা মাওবাদী বা ট্রটস্কিবাদী অফিসিয়াল ধারাকে প্রতিনিধিত্ব করে না, এরা হ'ল কম্যুনিস্ট লীগ থেকে শুরু ক'রে, তিনটি আন্তর্জাতিকের যা কিছু বিপ্লবী ঐতিহ্য তারই ধারাবাহিকতার ফসল, তারই প্রকৃত উত্তরাধিকারী: এখানেই বামপন্থার সঙ্গে কম্যুনিস্ট লেফ্‌টের মৌলিক তফাৎ। বিপ্লববিরোধী রাজনীতির বিপুল ঢেউয়ের তলায় চাপা দিয়ে দেওয়া হয়েছে এদের সমস্ত প্রয়াসকে। ইন্টারন্যাশানাল কম্যুনিস্ট কারেন্ট সেই কম্যুনিস্ট লেফ্‌টের অংশ, তাদেরই আরধ্য কাজেরই ধারাবাহিকতায় আইসিসি তার আজকের কর্মকান্ড পরিচালনা করছে। লেনিন যে কম্যুনিস্ট লেফ্‌টদের ছেলেমানুষ বলেছিলেন ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে তাদের অবস্থানই আজ আরো সুসংহত এবং সত্যরূপে প্রকাশিত হয়েছে। স্পষ্টতই, বামপন্থার হাজার ভ্যারাইটির মধ্যে এবং তাদের থেকে ভেঙে বেরিয়ে আসা হাজারটা দল উপদল থেকে বা আপাত রা‌ডিক্যাল অতিবামপন্থা, তৃতীয় ধারা, চতুর্থ ধারা ইত্যাদির মধ্যে আমাদের কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রামের একটি কণাও খুঁজে পাওয়া যাবে না, কেননা তাদের প্রতিটি অবস্থানই আজকের যুগে সেকেলে হয়ে পড়েছে  তা সে যতই মার্কসবাদের নাম দিয়ে বিশুদ্ধ করে তোলার চেষ্টা হোক। বিপরীতে কম্যুনিস্ট লেফ্‌টরাই প্রকৃতঅর্থে কম্যুনিজমের সংগ্রাম বিকাশের ধারার প্রতিনিধিত্ব করেছে এবং করছে। এইসব বামপন্থী দলের অস্তিত্ব আজ কোন না কোনভাবে বুরজোয়াদেরই স্বার্থ সুরক্ষিত করতে বাধ্য। যদিও এইসব বামপন্থী দলে যুক্ত মানুষের মধ্যে অনেক মানুষ আছেন যাঁরা অকৃত্রিম সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গেই কমিউনজিমের জন্য সংগ্রাম করতে চান।       

সুতরাং আজ কমিউনিজমের জন্য সংগ্রামে রত মানুষের কাছে ইতিহাসের একটি সত্য উপলব্ধি করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে যে বামপন্থার সঙ্গে কমিউনিজমের জন্য সংগ্রামের কোন সম্পর্ক নেই। যাঁরা দীর্ঘ সময় ধ'রে কোন না কোনভাবে এই কাজে রত আছেন বা থাকতে চান তাঁদের প্রয়াসের সততায় কোন সন্দেহই থাকতে পারেনা। তাই তাঁদের যুক্তিবোধ, মার্কসীয় আলোকে সবকিছুকে বারাবার ফিরে দেখার যে প্রয়াস তাকে স্বাগত জানিয়ে আশা করব আসুন আমরা খোলামেলা আলোচনার ভেতর দিয়ে স্বচ্ছতর হবার চেষ্টা করি। আমরা কেউই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর নিয়ে বসে নেই, কিন্তু প্রলেতারিয়েতের কাছে যৌথ আলোচনার ভেতর দিয়ে সঠিকতায় পৌঁছোনোর প্রয়াস সর্বদাই ছিল, আছে, থাকবে।

উপস্থাপনার পর্ব শেষ। আমরা আশা করব সকলের সম্মিলিত আলোচনায় আজকের সভা প্রাণবন্ত, ফলপ্রসূ হয়ে উঠবে এবং ভারতবর্ষে প্রলেতারীয় রাজনৈতিক চর্চার ক্ষেত্রে তা একটি সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে। এখানে আপনাদের মতামত, প্রশ্ন, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, বিরোধ যা আছে তা নির্দ্বিধায় রাখার অনুরোধ করছি।

অভিনন্দনসহ,

ইন্টারন্যাশনাল কম্যুনিস্ট কারেন্ট

২৭ ০৪ ০৮

১৯২৯-২০০৮ – পুঁজিবাদ হয়ে উঠেছে একটা দেউলিয়া ব্যবস্থা সম্ভব হয়ে উঠেছে অন্য এক বিশ্বব্যবস্থা: কমিউনিজম

বিশ্ব ব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের গভীরতা বোঝাতে তাবড় অর্থনীতিবিদ এবং রাজনীতিবিদেরা আজ হতবাক। কেউ বলেছেন "অতল খাদের কিনারে", কেউবা বলছেন "অর্থনৈতিক সুনামি", কারোর মতে "অর্থনৈতিক পার্ল হারবার" কারোর বা "অথর্নীতির ৯/১১"[1] তবে "টাইটানিক"-র সঙ্গে তুলনাটাই কেবল বাদ গেছে। আসলে ঠিক কী ঘটছে? এক নগ্ন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু উদ্বেগজনক প্রশ্ন উঠে আসছে: আমরা কি ১৯২৯-র মতই এক নতুন বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি? কিভাবে এই অবস্থার সৃষ্টি হল আর কিভাবেই বা আমরা এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে পারি? আচ্ছা,কিরকম পৃথিবীতেই বা আমরা বাস করছি?

আমাদের জীবনযাত্রার মান নির্মম অবনমনের দিকে

এব্যাপারে সত্যিই কোন সন্দেহ নেই। সমগ্র বিশ্বজুড়ে মানবতা তার অস্তিস্ত্বের ভয়াবহতম অবক্ষয়কে প্রত্যক্ষ করতে চলেছে। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ভান্ডার (আই এম এফ) তার সাম্প্রতিক রিপোর্টে ঘোষণা করেছে যে ২০০৯ সালের প্রথমার্ধের মধ্যেই দুর্ভিক্ষ কবলিত দেশগুলোর তালিকায় আরো ৫০টি নতুন নাম অন্তর্ভূক্ত হতে চলেছে যাদের মধ্যে আফ্রিকা, লাটিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান এমনকি এশিয়ার বেশকিছু দেশ রয়েছে।  শুধু সরকারী মতেই ইতিমধ্যেই ইথিওপিয়ার বারো মিলিয়ন মানুষ শুধু অনাহারজনিত কারণে মরণাপন্ন। ভারত ও চীনের মত তথাকথিত  পুঁজির নতুন "সোনার হরিণ"-র ভুখন্ডেও  লক্ষ লক্ষ শ্রমিক নিদারুণ দারিদ্রে পীড়িত হচ্ছে এবং হবে। একইরকমভাবে আমেরিকা এবং ইউরোপের জনগনের একটা বিরাট অংশ এক অসহ্য বঞ্চনার শিকার। সব সেক্টরের শ্রমিকেরাই আক্রান্ত: অফিস, ব্যাঙ্ক, ফ্যাক্টরি, হাসপাতাল, তথ্য-প্রযুক্তিক্ষেত্র, গাড়িশিল্প, গৃহনির্মাণ সবক্ষেত্রেই লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের ছাঁটাই হওয়া শুধুমাত্র কিছুসময়ের অপেক্ষা। বেকারী গগনচুম্বী। ২০০৮-র শুরু থেকে, শুধুমাত্র আমেরিকাতেই প্রায় ১০লক্ষ শ্রমিককে ইতোমধ্যেই আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করা হয়েছে। আর এই সবে শুরু। উদ্বৃত্ত ঘোষনার এই উন্মাদ তরঙ্গের অভিঘাত এসে পড়বে সোজা শ্রমিক-পরিবারগুলোর ওপর: নেহাত ভাত কাপড়ের যোগাড় কিংবা মিনিমাম স্বাস্থ্য রক্ষার ব্যবস্থাটুকু জোটানোও হয়ে পড়বে দুঃসাধ্য। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আর কোন উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তুলে ধরতে পারেনা।

ওরা গতকালও ছিল মিথ্যেবাদী আর আজও মিথ্যেকথাই বলে চলেছে

শাসকদলের স্বার্থরক্ষাকারী সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ এবং পুঁজিবাদী বিশ্বের দন্ডমুন্ডের কর্তারা এই ধ্বংসোন্মুখ অবস্থাটাকে আর কোনভাবেই গোপন রাখতে পারছে না। আর পারবেই বা কিভাবে? পৃথিবীর বৃহৎ ব্যাঙ্কগুলোর কয়েকটা ইতোমধ্যেই দেউলে হয়ে গেছে: ধন্যবাদ রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপকে: সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক থেকে শতশত বিলিয়ন ডলার, পাউন্ড, ইউরোর ইন্‌জেকসন দিয়ে কোনরকমে তাদের প্রাণভ্রমরা টিকিয়ে রাখা হয়েছে। আমেরিকা, এশিয়া এবং ইউরোপের শেয়ার বাজার অতলান্ত সংকটে নিমগ্ন: ২০০৮-র জানুয়ারি থেকে আজ অব্দি ২৫ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে যা আমেরিকার দুবছরের সামগ্রিক উৎপাদনের সমান।  এথেকেই বোঝা যায় গোটা বিশ্বের শাসকশ্রেণির আসল আতঙ্কের উৎসটা কোথায়। স্টক মার্কেটের বিপর্যয়ের কারণ শুধুমাত্র ব্যাঙ্কগুলোর বিপর্যস্ত অবস্থা নয়; আমরা দেখব অথনৈতিক ক্ষেত্রে বিপুল অধোগতি, ব্যবসায়িক কর্মোদ্যোগগুলোর ক্রমবর্ধমান দেউলিয়াপনা, সর্বোপরি গত চল্লিশ বছরে দেখা যায়নি এমন অর্থনৈতিক মন্দা, যার  ফলে পুঁজিপতিরা বুঝতে পারছে যে তাদের লাভের অঙ্ক এত কমে যাবে যে তাদের   মাথা ঘুরে যাবে। বস্তুতঃ লাভের এই পতনের অঙ্কটাও স্টক-মার্কেটের পতনের  অন্যতম একটা কারণ। 

বুশ, মারকেল, ব্রাউন, সারকোজি ও হু জিন তাওদের মত পৃথিবীর দন্ডমুন্ডের কর্তারা একের পর এক শীর্ষ সম্মেলন ক'রে চলেছেন (যেমন কিনা জি-ফোর, জি-এইট, জি-সিক্সটিন, জি-ফর্টি সম্মেলন)-উদ্দেশ্য একটাই:   এই ভয়াবহ ক্ষতিটাকে সীমিত ক'রে রাখা এবং আরো ভয়ংকর পরিস্থিতি এড়ানোর চেষ্টা করা।   নভেম্বরের মাঝামাঝি আবার একটা শীর্ষ-সম্মেলন হচ্ছে যেটাকে কেউ কেউ "পুঁজিবাদের পুর্নস্থাপনা" করার উপায় ব'লে ভাবছেন। আর  রাজনীতিকদের বিচলিত অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যাবে আজকের টিভি, রেডিও আর খবরকাগজগুলোর  বিশেষজ্ঞদের দিশাহীন অবস্থার; একটাই বিষয়: ‘সংকট'।

কেন এই ভ্রমজাল পাতা?

এরা অর্থনৈতিক মহা বিপর্যয়টাকে লুকোতে যখন পারছে না তখন যে করেই হোক চেষ্টা করছে সত্যটাকে আড়াল করার; সোজা কথায়, যে করেই হোক বোঝাও পুঁজিবাদের অস্তিত্ব নাকচ হয়নি, হবেও না---আসল কথা হ'ল সাময়িক কিছু "অপব্যবহার" আর "বাড়াবাড়ির" বিরুদ্ধে লড়াই করা। দেখানো হচ্ছে দোষটা আসলে ফাটকাবাজদের, অতিলোভী মুনাফাবাজদের, দোষ ‘সরকারী কর-নীতি"র, দোষ ‘নিও-লিব্যারালিজম"-র!

এই রূপকথার গল্পটা গেলানোর জন্য পেশাদার ধাপ্পাবাজদের মাঠে নামানো হয়েছে। সেই একই বিশেষজ্ঞ যারা দুদিন আগে বলেছিল অর্থনীতি বেশ স্বাস্থ্যকর অবস্থায় আছে, ব্যাঙ্কগুলো ফার্স্টক্লাস রান করছে, তারাই আজ টিভি মিডিয়াতে হামলে পড়ছে নতুন মিথ্যে শোনানোর জন্য। সেই লোকেরাই যারা গতকাল ‘নিও-লিবারালিজম" কে বলেছিল "একমাত্র" সমাধানের রাস্তা, বলেছিল অর্থনৈতিক ব্যাপারে রাষ্ট্রের নাক গলানো কমিয়ে ফেলা দরকার, তারাই আজ রাষ্ট্রকে আরো আরো বেশি বেশি ক'রে হস্তক্ষেপ করতে বলছে।

আরো রাষ্ট্র----আরো ‘নৈতিকতা', ব্যাস, তাহলেই পুঁজিবাদ চাঙ্গা! এই মিথ্যেটাই তারা আজ আমাদের খাওয়াতে চাইছে।

পুঁজিবাদ কি তার সংকট কাটিয়ে উঠতে পারে?

আসল কথা হল যে-সংকট আজ বিশ্বপুঁজিবাদকে ছাড়খার ক'রে দিচ্ছে তার সূচনা ইউএসেতে ২০০৭-র গ্রীষ্মকালে আবাসনশিল্পের ফানুসটা ফাটতে শুরু করার মধ্যে দিয়ে হয়নি। ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধ'রে একটার পর একটা মন্দা এসেছে যথা ১৯৬৭. ১৯৭৪, ১৯৮১, ২০০১-র মন্দা। দশকের পর দশক ধ'রে বেকারি একটা স্থায়ী এবং মহামারীর মত সংক্রমনে পরিণত হয়েছে, শোষিত মানুষের জীবনযাত্রার মানের ওপর নেমে এসেছে পাহাড় প্রমান আক্রমণ। কিন্তু কেন?

কারণ পুঁজিবাদ এমনই এক ব্যবস্থা যেখানে উৎপাদন করা হয় মানুষের প্রয়োজনের জন্য নয়, তা হয় বাজারে বিক্রির এবং লাভের জন্য। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের হাজারো চাহিদা পূরণ হয় না কারণ তাদের সাধ্য নেই বা সোজা ক'রে বললে তাদের ক্রয় ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। যদি পুঁজিবাদ সংকটে পড়ে থাকে, যদি কোটি কোটি মানুষকে অসহনীয় ক্ষুধা আর দুর্দশার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হতে হয়, তবে তার কারণ এই নয় যে পুঁজিবাদ যথেষ্ট উৎপাদন করতে পারছে না, বরং বিপরীত, এ ব্যবস্থায় যতটা বিক্রি হতে পারে তার চেয়ে অনেক বেশি উৎপাদিত হচ্ছে । যতবার বুরজোয়ারা সংকটে পড়ছে ততবার তারা বিপুল পরিমাণ ঋণ দেওয়া-নেওয়া  আর কৃত্রিম বাজার তৈরির আশ্রয় নিচ্ছে। এভাবে সাময়িকভাবে বেঁচে উঠতে গিয়ে পুঁজিবাদ তার ভবিষ্যতকে আরো বিপদগ্রস্ত ক'রে তুলছে, কেননা শেষ পর্যন্ত এই বিপুল ঋণ শোধ করতে হবে! বর্তমানে ঠিক এটাই ঘটে চলেছে। গত কয়েকবছরের ‘অভাবনীয় সমৃদ্ধি'-র ভিত্তিই হ'ল এই ঋণ। বিশ্ব অর্থনীতি "ঋণ"-র ওপর ভর করেই বেঁচে ছিল আর এখন যখন সেই ধার শোধ করার পালা তখন তা তাসের ঘরের মতই ভেঙে পড়ল। ব্যাঙ্কারদের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ, ব্যবসায়ীদের ফাটকাবাজি বা রাজনীতিকদের পরিচালনার ত্রুটির জন্যই পুঁজিবাদী অর্থনীতির এই বিপর্যয় তা কিন্তু নয়;এরা পুঁজিবাদের নিয়মগুলোই প্রয়োগ করেছে কিন্তু সমস্যাটা এই যে পুঁজিবাদের এই নিয়মগুলো নিজগুনেই এমন যে তা এই ব্যবস্থাটাকে ধ্বংসের দিকেই নিয়ে যায়। আর এই কারণেই রাষ্ট্র আর তার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলো যতই কোটি কোটি টাকা বাজারে ঢালার চেষ্টা করুক না কেন তাতে কোন ইতিবাচক বদল আসবে না। বরং আরো ভয়াবহভাবে ঋণের ওপর ঋণের স্তুপ জমতে থাকবে। ব্যাপারটা তেল ঢেলে আগুন নেভানোর সামিল। এরকম বেপরোয়া এবং নিষ্ফলা পদক্ষেপ নেওয়ার মধ্যে দিয়ে বুরজোয়াদের অক্ষমতাটাই প্রকট হয়ে উঠছে। আজই হোক বা দুদিন পর, এভাবে টাকা ঢেলে সংকট কাটানোর প্রচেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হতে বাধ্য। এতে ক'রে পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রকৃত পুনরুদ্ধার কোনমতেই সম্ভব নয়। বামপন্থী বা দক্ষিণ পন্থী কারো কোন পলিসিই আর এই মারণ ব্যাধিতে র্জজরিত ব্যবস্থাটাকে রক্ষা করতে পারেনা।

পাহাড়প্রমাণ দারিদ্রের বিরুদ্ধে শ্রেণি-সংহতি আর শ্রেণি-সংগ্রাম!

সর্বত্রই ১৯২৯-র অর্থনৈতিক মহাপতন এবং ১৯৩০-র মহা-মন্দার সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতির তুলনা করা হচ্ছে। সেই সময়ের ছবি আমাদের স্মৃতিতে এখনো উজ্জ্বল: বেকার শ্রমিকের অন্তহীন মিছিল, গরীব মানুষের জন্য লঙ্গরখানা, চারিদিকে বন্ধ হয়ে যাওয়া কল কারখানা। কিন্তু আজকের সংকটটা কি সেদিনের মত? না। হয়তো পুঁজিবাদ অতীতের থেকে শিক্ষা নিয়ে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ এবং তুলনামূলকভাবে উন্নত আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের সাহায্যে চূড়ান্ত পতনটা এখনও এড়াতে পারছে, তবুও আজকের সংকট আরো ভয়াবহ, আরো গভীর।

সেদিনের সঙ্গে আজকের একটি মৌলিক তফাৎ আছে। ১৯৩০-র গ্রেট-ডিপ্রেসন্‌ পুঁজিবাদকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে ঠেলেছিল; আর আজকের এই মন্দা কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে?   এটা ঠিকই যে,  যুদ্ধই সংকট থেকে বেরোবার একমাত্র পুঁজিবাদী-সমাধান আর আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণিই একমাত্র এই পুঁজিবাদী সমাধানকে প্রতিহত করতে পারে। ১৯৩০-এ শ্রমিকশ্রেণি সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে প্রতিহত করতে পারেনি বরং তার শিকার হয়েছিল, কারণ, ১৯১৭-য় রাশিয়ায় শুরু হওয়া বিশ্ব-বিপ্লবের ঢেউয়ের ব্যর্থতার ধারাবাহিকতায় সেসময় শ্রমিকশ্রেণি সেই গভীর পরাজয়ের পর্যায়ের মধ্যে দিয়েই চলেছিল। কিন্তু ১৯৬৮ থেকে তাদের বিশাল সংগ্রামের ভেতর দিয়ে শুরু ক'রে শ্রমিকশ্রেণি দেখিয়েছে যে সে পরাজয়ের পর্যায় পার ক'রে আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। যার ফলে এখন আর  সে  শোষক-শ্রেণির জন্য রক্ত ঝরাতে মোটেই রাজী নয়। গত চল্লিশ বছর ধ'রে অনেক বেদনাদায়ক পরাজয় হয়েছে, তবু শ্রেণি দাঁড়িয়ে আছে; আর বিশেষতঃ ২০০৩ থেকে সে আরো বেশি বেশি ক'রে সংগ্রামের পথে চলেছে। সংকট চলতে থাকার অর্থই হল কোটি কোটি শ্রমিকের ভয়ংকর দুর্ভোগ, এটা শুধু পিছিয়ে পড়া দেশেই নয়, উন্নত দেশেও। বেকারি, দারিদ্র এমনকি দুর্ভিক্ষেরও শিকার হতে হবে। কিন্তু এটা শোষিত শ্রেণির প্রতিরোধ সংগ্রামেরও জন্ম দেবে।

বুরজোয়াদের অথর্নৈতিক আক্রমণগুলো ঠেকানোর জন্য এইসব সংগ্রামগুলো চূড়ান্তভাবে দরকার যাতে ক'রে তারা শ্রমিকশ্রেণিকে নিরঙ্কুশ দারিদ্রের মধ্যে ঠেলে দিতে না পারে। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে শ্রমিকশ্রেণি তাদের সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে পুঁজিবাদের এই গভীর থেকে গভীরতর সংকটে ডুবতে থাকাটাকে থামাতে পারেনা। একারণেই এইসব প্রতিরোধ-সংগ্রাম আরো গুরুত্বপূর্ণ এক সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তাকে স্পষ্ট ক'রে তোলে। এইসব সংগ্রাম শোষিত শ্রেণিকে আরো ঐক্যবদ্ধ, সুসংহত হতে এবং সমষ্টিগত শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে, তাদের মধ্যে এই চেতনার সঞ্চার করে যে এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটাকে উৎখাত করাটাই বর্তমানে একমাত্র বিকল্প যার ভেতর দিয়ে মানব প্রজাতি রক্ষা পেতে পারে। এই সমাজকে উৎখাত ক'রে তার জায়গায় এমন এক সমাজ গঠন করা যার ভিত্তিটাই হবে পুঁজিবাদী  সমাজের থেকে গুনগতভাবে আলাদা। এহবে এমন এক সমাজ যা শোষন এবং লাভের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়,সে সমাজে বাজারের জন্য  উৎপাদন না হয়ে তা হবে মানুষের প্রয়োজনের জন্য উৎপাদন; তাহবে এমন এক সমাজ যা সংগঠিত হবে খোদ উৎপাদকদের নিজেদের দ্বারাই, বিশেষসুবিধাভোগী সংখ্যালঘিষ্ঠ কিছু মানুষের দ্বারা নয়। এককথায় তা হবে কমিউনিস্ট সমাজ।

আটটা দশক ধ'রে বুরজোয়াদের ডান বাম সব অংশই হাতে হাত মিলিয়ে পূর্ব ইউরোপ এবং চীনকে  ‘কমিউনিস্ট ব্যবস্থা' ব'লে প্রচার করেছে, যদিও সেগুলো রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের বর্বরোচিত প্রকাশরূপ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। বুরজোয়াদের মতলব হল এটা বোঝানো যে অন্য কোন সমাজ ব্যবস্থার কথা ভাবা নেহাতই নিষ্ফল, পুঁজিবাদই শেষ কথা। কিন্তু এখন পুঁজিবাদের  ঐতিহাসিক দেউলিয়াপনা জলের মত পরিষ্কার, আর তাই বিপরীতে কমিউনিস্ট সমাজ গঠনের লক্ষ্য ও সচেতনতায় শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রামকে উদ্বুদ্ধ হতে হবে।

পুঁজিবাদের লাগামছাড়া আক্রমণের সামনে দাঁড়িয়ে, সমস্ত শোষণ, দারিদ্র আর যুদ্ধের ববর্রতার অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে----

দুনিয়ার শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রাম দীর্ঘজীবি হোক!

দুনিয়ার মজদুর এক হও!

ইন্টারন্যাশানাল কমিউনিস্ট কারেন্ট, ২৫ ১০ ২০০৮



[1]   Respectively: Paul Krugman (the last Nobel Prize winner in economics); Warren Buffet (an American investor, nicknamed the ‘oracle of Omaha', so much is the opinion of this billionaire from small town Nebraska respected in the world of high finance); Jacques Attali (economic adviser to French president Nicolas Sarkozy) and Laurence Parisot (president of the French bosses' association)