আইসিসি-র প্ল্যাটফর্ম

Platform of the ICC

১৯৮০’র শীতকাল

 


ইতিহাসের দীঘর্তম ও গভীরতম প্রতিবিপ্লবের পর শ্রমিকশ্রেণী আবার শ্রেণীসংগ্রামের পথ খুঁজে নিচ্ছে । ছয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে একদিকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্কট তীব্র রূপ ধারণ করেছে অন্যদিকে শ্রমিকশ্রেণীর বতমান –প্রজন্মের উপর অতীতের দারুন পরাজয়ের প্রভাব পূবজদের তুলনায় অনেক কম , আর তাই বতর্মানের শ্রেণীসংগ্রাম ইতিমধ্যেই ধারণ করেছে ব্যাপকতম রূপ।১৯৬৮ সালের ফ্রান্সের ঘটনাবলীর পর থেকে ইতালি থেকে আজের্ন্টিনা,ব্রিটেন থেকে পোল্যান্ড সুইডেন থেকে মিশর,চীন থেকে পতুর্গাল ,আমেরিকা থেকে ভারত ,জাপান থেকে স্পেন সবত্র বিস্তৃত শ্রমিক সংগ্রাম পুঁজিপতিশ্রেণীর দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছে ।
শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী চরিত্রকে অস্বীকার করার উদ্দেশ্যে প্রতিবিপ্লবের পযায়ে যে সব মতাদর্শ তৈরী করা হয়েছিল, বা করা সম্ভব হয়েছিল, ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে শ্রমিকশ্রেণির এই পুনরাগমন সেই সবকিছুকে সুস্পষ্ট, সুনিশ্চিত রূপে নস্যাৎ করে দিয়েছে।শ্রমিক শ্রেণিই যে আজকের দিনে একমাত্র বিপ্লবী শ্রেণি এই সত্যকে সুস্পষ্টরূপে প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছে শ্রেণীসংগ্রামের বতর্মান এই জোয়ার।
কোন শ্রেণীর সামাজিক নেতৃত্ব ও আধিপত্য নতুন উৎপাদন সম্পকের প্রতিষ্ঠা ও বিস্তারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূণ হলেই তাকে বিপ্লবী শ্রেণী বলা যায় ।উৎপাদিকা শক্তিগুলোর(Productive forces) বিকাশ এবং পুরনো উৎপাদন সম্পকের(relation of production) অবক্ষয়ের ফলে নতুন উৎপাদন সম্পকের সৃষ্টি ও বিস্তার অপরিহায হয়ে ওঠে । প্রাক-পুঁজিবাদী অন্যান্য উৎপাদন ব্যবস্থাগুলোর মতই পুঁজিবাদও হচ্ছে সমাজ বিকাশের একটা বিশেষ পযার্য় । পুঁজিবাদও একসময় সমাজবিকাশের প্রগতিশীল একটা ব্যবস্থাই ছিল । কিন্তু সারা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হওয়ার পর পুঁজিবাদ নিজেই তার অবলুপ্তির শতাবর্লি সৃষ্টি করে দিয়েছে । পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বিশেষভাবে নিদির্ষ্ট সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকে শ্রমিকশ্রেণী। (বিক্ষিপ্ত ব্যক্তিগত নয়), শ্রমিকশ্রেণীর চরিত্র হচ্ছে যৌথ উৎপাদকের,উৎপাদনের উপকরণগুলোকে ক্রিয়াশীল করে তোলে সে, কিন্তু সেগুলোর মালিকানা থেকে সে সম্পূণ বঞ্চিত,পুঁজিবাদী সমাজকে টিকিয়ে রাখার কোনরকম স্বাথ বা প্রয়োজনীয়তা তাই তার নেই । আর তাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটিয়ে নতুন উৎপাদন ব্যবস্থা বা কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করতে সব দিক থেকে সক্ষম একমাত্র শ্রমিকশ্রেণীই।শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামের বতর্মান জোয়ার কমিউনিজমের ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তাই শুধু নয় তার বাস্তব হয়ে ওঠার সম্ভাবনার বিষয়টিকে আরো একবার তুলে ধরছে । কিন্তু পুঁজিবাদকে উৎখাত করার অবশ্য-প্রয়োজনীয় অস্ত্রসম্ভারে নিজেকে সুসজ্জিত করার জন্য শ্রমিকশ্রেণীকে এখনো অত্যন্ত কঠোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে । শ্রমিকশ্রেণীর এই পুণর্জাগরণের শুরু থেকে এই প্রচেষ্টার ফল এবং সক্রিয় উপাদান হিসেবে অনেক বিপ্লবীধারা ও ব্যক্তির আবিভাব ঘটেছে । এই সংগ্রামকে নিদির্ষ্ট লক্ষ্যাভিমুখে বিকাশের বিরাট দায়িত্ব এখন এঁদের কাঁধে। এই দায়িত্ব পালনের জন্য শ্রমিকশ্রেণীর ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সুনিশ্চিতভাবে প্রমানিত শ্রেণী অবস্থানগুলোর ভিত্তিতে এঁদেরকে অবশ্যই নিজেদেরকে সংগঠিত করতে হবে এবং এঁদের সমস্ত সক্রিয়তা ও শ্রমিকশ্রেণীর সচেতনতা বিকাশের প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ অবশ্যই এগুলোর ভিত্তিতেই নিয়ন্ত্রিত হওয়া দরকার।
বাস্তবিক ও তাত্ত্বিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই পুঁজিবাদের উচ্ছেদ ও কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক সংগ্রামের অস্ত্রসম্ভার ও পরিণতি সম্বন্ধে সচেতনতা অজর্ন করে শ্রমিকশ্রেণী ।শ্রেণীস্বার্থ সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠা ও বুর্জোয়া শাসকশ্রেণীর চিন্তাভাবনা ও বিভ্রান্তিকর মতাদর্শের খপ্পর থেকে নিজেকে মুক্ত করার অবিরাম প্রচেষ্টাই পুঁজিবাদের জন্মলগ্ন থেকেই শ্রমিকশ্রেণীর সামগ্রিক ক্রিয়াকলাপের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে । এই প্রচেষ্টা শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়েই প্রতিফলিত । প্রথমদিকের গুপ্ত সমিতি থেকে শুরু করে তৃতীয় আন্তজাতিক থেকে বেরিয়ে আসা Left fractions পরযন্ত বিস্তৃত শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনের সামগ্রিক পরযায় জুড়েই এই ধারাবাহিকতা। অবস্থান ও ক্রিয়াকলাপের সমস্ত রকমের অস্বচ্ছতা ও বুর্জোয়া মতাদর্শের চাপ ও প্রভাবের প্রতিফলনের ছাপ থাকা সত্ত্বেও শ্রমিকশ্রেণীর বিভিন্ন সংগঠনগুলো হল শ্রেণীসংগ্রামের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার শৃঙ্খলে অপরিহারয(irreplaceable) যোগসূত্র । পরাজয় বা অভ্যন্তরীন অধঃপতনের শিকার তারা হয়েছে এ কথা ঠিক, কিন্তু তা দিয়ে কোনভাবেই শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামে তাদের মৌলিক অবদানের গুরুত্বকে খাটো করা যায়না। আর তাই (অর্ধশতাব্দীর প্রতিবিপ্লব এবং অতীতের শ্রেণীসংগ্রাম থেকে সম্পর্কচ্যুত হয়ে পড়ার ঘটনার পর) বতর্মানের শ্রেণীসংগ্রামের সাধারন পুনর্জাগরণের প্রতিফলন রূপেই পুনর্গঠিত হচ্ছে বিপ্লবীদের যে সব সংগঠন , তাদেরকে অতি অবশ্যই দৃঢ়ভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে অতীতের সংগ্রামের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতাকে ।
অতীত অভিজ্ঞতার শিক্ষার অস্ত্রে শ্রমিকশ্রেণীর বতর্মান ও ভবিষ্যৎ সংগ্রামগুলিকে সুসজ্জিত করা এবং দীর্ঘ চলার পথে ছড়িয়ে থাকা আংশিক পরাজয়গুলোকে ব্যর্থ হতে না দিয়ে চূড়ান্ত বিজয়ের দিকনিদের্শে রূপান্তরিত করে তোলাই হচ্ছে এর একমাত্র উদ্দেশ্য ।
কমিউনিষ্ট লিগ,প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় আন্তজার্তিক এবং তার থেকে বেরিয়ে আসা Left fraction গুলো বিশেষ করে জার্মান, ডাচ, ইতালিয়ান Leftদের অবদানের সঙ্গে নিজেদের ধারাবাহিকতাকে দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করছে International Communist Current। এইসব অত্যাবশ্যক অবদানের ভিত্তিতেই আমরা সমস্ত শ্রেণী-অবস্থানকে সুসমন্বিত সাধারন এক তাত্ত্বিক কাঠামোয় একীভূত করতে সমর্থ হয়েছি আর সেটিই সূত্রবদ্ধ করা হয়েছে আমাদের এই কর্মসূচিতে।

কমিউনিষ্ট বিপ্লবের তত্ত্ব

The Theory Of Communist Revolution

 

শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামের মৌলিক তাত্ত্বিক ফসল হচ্ছে মার্কসবাদ । মার্কসবাদ-এর ভিত্তিতেই শ্রেণীসংগ্রামের সমস্ত শিক্ষাকে সুসমন্বিত এক সামগ্রিক কাঠামোয় সংহত করা সম্ভব । শ্রেণী সংগ্রাম অর্থাৎ উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের দ্বারা নির্ধারিত সামাজিক কাঠামোয় অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষার সংগ্রামের বিকাশের মাপকাঠিতেই ইতিহাসের ব্যাখ্যা করে এবং পুঁজিবাদ উচ্ছেদের বিপ্লবী সংগ্রামে শ্রমিকশ্রেণীকে বিপ্লবী নেতৃত্ব ও শক্তির স্বীকৃতি দিয়ে মার্কসবাদ শ্রমিকশ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গী ও চিন্তা চেতনার সত্যিকার প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম একমাত্র বিশ্বদৃষ্টিকোণ ও ব্যাখ্যায় পরিণত হয়েছে । তাই মার্কসবাদ বিশ্বের কোন বিমূর্ত,ধোঁয়াশাচ্ছন্ন অনুমান বা ব্যাখ্যা নয় । এর সম্পূর্ণ বিপরীতে মার্কসবাদ হয়ে উঠেছে প্রথমতঃ এবং প্রধানতঃ শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামেরই এক হাতিয়ার । ইতিহাসে এই প্রথম শ্রমিকশ্রেণী হচ্ছে এমন একমাত্র শ্রেণী যে তার মুক্তি সমগ্র মানবসমাজের মুক্তির ভিত্তিতেই শুধু সম্ভব এবং তার সামাজিক আধিপত্য কখনোই কোন নতুন শোষণব্যবস্থার জন্ম তো দেয়ই না বরং সমস্ত রকম শোষণের অবসান ঘটায় । আর তাই কোনরকম অন্ধবিশ্বাস বা বিভ্রান্তি ছাড়াই বস্তুগত ও বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তিতে সামাজিক বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে একমাত্র মার্কসবাদই সক্ষম।
সেজন্য শুরু থেকেই মার্কসবাদ হয়ে দাঁড়িয়েছেএমনএকমাত্র framework যে তার থেকেই এবং তার ভিতরেই বিপ্লবী তত্ত্ব বিকশিত হতে পারে,যদিও তা কোন নিশ্চল সীমাবদ্ধ মতবাদ তো নয়ই,বরং তার সম্পূর্ণ বিপরীত এবং শ্রেণীসংগ্রামের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও সজীব সম্পর্কের ভিত্তিতে ক্রমাগত নিজেকে সম্প্রসারিত এবং অতীতের তাত্ত্বিক সংগ্রামের সমস্ত সাফল্যকে অঙ্গীভূতকরে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করে তুলেছে।


প্রলেতারিয় বিপ্লবের স্বরূপ

The Nature Of The Proletarian Revolution

সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে নতুন উৎপাদনসম্পর্কের প্রতিনিধিত্বকারীশ্রেণি সমস্ত সমাজের উপর নিজের রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম করে। প্রলেতারিয় বিপ্লবের ক্ষেত্রেও এই সাধারন সূত্র প্রযোজ্য,যদিও তার অন্তবর্স্তু(content) ও শর্তাবলী(conditions)অতীতের সমস্ত বিপ্লব থেকে মৌলিক ভাবে পৃথক । অতীতের বিপ্লবগুলো একটা শোষকশ্রেণীর আধিপত্যের বদলে আর একটা শোষকশ্রেণীর আধিপত্য
কায়েম করেছে ।কারণ ঐসব বিপ্লবের মাধ্যমে অভাবভিত্তিক একটা উৎপাদন ব্যবস্থার জায়গায় আর একটা নতুন অভাবভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সম্পত্তি ও সম্পত্তি-সম্পর্কের একটা রূপের বদলে অন্য একটা রূপের এবং একধরনের বিশেষ অধিকারের জায়গায় অন্য ধরনের বিশেষাধিকার প্রতিষ্ঠার ভিতর দিয়েই এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর সম্পূর্ণ বিপরীতে প্রলেতারিয় বিপ্লবের লক্ষ্য হল অভাবভিত্তিক উৎপাদন সম্পর্কের বদলে প্রাচুরযভিত্তিক উৎপাদনসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা । আর তাই এই বিপ্লব সমস্ত
রকমের সম্পত্তি,শোষণ ও বিশেষাধিকারের সম্পূর্ণ অবলুপ্তিকেই সূচিত করে । উপরোক্ত পার্থক্যের ফলে প্রলেতারিয় বিপ্লবের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত সব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে । প্রলেতারিয় বিপ্লবকে জয়যুক্ত করতে হলে শ্রমিকশ্রেণীর অবশ্যই এই সব বৈশিষ্ট অনুধাবন করা দরকার :

ক) ইতিহাসে এই প্রথম এটা হচ্ছে এমন এক বিপ্লব যাকে হতে হবে অবশ্যই বিশ্বব্যাপী। দেশের সমস্ত সীমা অতিক্রম করে বিশ্ববিপ্লবের জোয়ারে পরিণত হতে না পারলে এই বিপ্লব জয়যুক্ত হতে পারেনা । কারণ ব্যক্তিগত মালিকানা উচ্ছেদ করতে হলে শ্রমিকশ্রেণীকে অবশ্যই তার স্থানীয়,আঞ্চলিক,রাষ্ট্রীয় সমস্ত রূপের সম্পূর্ণ অবলুপ্তি ঘটাতে হবে । সারা দুনিয়া জুড়ে পুঁজির একই ধরণের আধিপত্য থাকার ফলে এই কাজ একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় ও সম্ভব হয়ে উঠেছে।
খ)ইতিহাসে এই প্রথম একই শ্রেণী একই সঙ্গে বিপ্লবী এবং শোষিত দুটোই। আর তাই এই নতুন বিপ্লবী শ্রেণী পুরোণ সমাজের গর্ভেই অজির্ত কোনরকম অর্থনৈতিক ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের পথে অগ্রসর হতে পারেনা । শ্রমিকশ্রেণীর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে দাঁড়ায় অর্থাৎ অতীতের বিপ্লবী কর্মকান্ডের সম্পূর্ণ বিপরীতে উৎক্রমনশীল (transitional) (অর্থাৎ যে পযায়ে পুরোন উৎপাদন সর্ম্পক গুলো ধ্বংস করে নতুন সামাজিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কাজ চলে ) পযায়ের আগেই শ্রমিকশ্রেণীকে অতি অবশ্যই রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের কাজটি সম্পূর্ণ করে ফেলতে হবে ।
গ) এই প্রথম সমাজের একটি শ্রেণী একই সঙ্গে বিপ্লবী এবং শোষিত হওয়ার তাৎপয হচ্ছে এই যে , শোষিত হিসেবে সংগ্রাম কখনোই বিপ্লবী হিসেবে সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন বা তার বিপরীত হতে পারেনা । শোষিতশ্রেণী হিসেবে সংগ্রামের ক্রমাগত গভীরতর ও ব্যাপকতর হয়ে ওঠার ওপরেই নির্ভর করছে প্রলেতারিয়েতের বিপ্লবী সংগ্রামের বিকাশ। প্রুধোঁবাদ(Proudhonism) এবং অন্যান্য পেটি বুজোর্য়া সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে মার্কসবাদ শুরু থেকেই এই সত্যটি দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করে এসেছে ।
 

পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবক্ষয়

The Decadence of Capitalism

শুধুমাত্র একটা আশা বা বিমূর্ত ঐতিহাসিক সম্ভাবনা বা পরিপ্রেক্ষিত হিসেবে না থেকে একটা মূর্ত বাস্তব কমর্কান্ডে রূপলাভের জন্য  প্রলেতারীয় বিপ্লবকে মানব সমাজের বিকাশের লক্ষ্যে বস্তুগতভাবে  প্রয়োজনীয়  হয়ে উঠতে হত; প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে মানব সমাজের মধ্যে  বস্তুগত পরিস্থিতি সেদিকেই মোড় নিয়েছে।

এই যুদ্ধ সূচিত করেছে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার উথ্থানের যুগের(ascendant phase) অবসান। পুঁজিবাদের  উথ্থানের যুগের শুরু ষোড়শ শতাব্দীতে এবং  ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে তা পৌঁছে যায় উথ্থানের সর্বোচ্চ শিখরে।   তারপর থেকে যে নতুন এক পযার্য়ে পুঁজিবাদ প্রবেশ করে  তা হল পুঁজিবাদের অবক্ষয়ের যুগপূববর্তী সমস্ত সমাজব্যবস্থার মতোই পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থাও তার  প্রথমপযার্য়ে  উৎপাদন সম্পর্কের ঐতিহাসিকভাবে প্রয়োজনীয় চরিত্রের অর্থাৎ সমাজের উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ও বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অপরিহারয ভূমিকারই অভিব্যক্তি হয়ে উঠেছিল। দ্বিতীয় পযার্য়ে কিন্তু এই সর্ম্পকগুলো উৎপাদিকা শক্তির অব্যাহত বিকাশের পথে ক্রমাগত বেশিবেশি করে বাধা ও শৃঙ্খলে পরিণত হতে থাকল।উৎপাদন সর্ম্পকের সহজাত অর্ন্তনিহিত দ্বন্দ্বগুলোর বিকাশের মধ্যেই পুঁজিবাদের অবক্ষয়ের জন্ম। নিম্নলিখিতভাবে এর সারসংক্ষেপ করা যায় :পণ্যের অস্তিত্ব যদিও প্রায়সমস্ত পূবর্তন সমাজব্যবস্থাতেই ছিল কিন্ত পুঁজিবাদী অর্থনীতিই হচ্ছে প্রথম অর্থনীতি যার মূল ভিত্তিই হল পন্য উৎপাদন। তাই পুঁজিবাদ বিকাশের অত্যাবশ্যক শর্তগুলোর অন্যতম একটা হল ক্রমবর্ধমান বাজারের অস্তিত্ব । বিশেষ করে শ্রমিকশ্রেণীর শোষন থেকে উদ্ভূত উদ্বৃত্ত মূল্যের উপলব্ধি (realization) পুঁজি সঞ্চয়ের জন্য অপরিহায । এটাই হল এই ব্যবস্থার অত্যাবশ্যক চালিকাশক্তি। বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় বাজার পুঁজিবাদীউৎপাদন আপনা-আপনি   এবং খুশিমত সৃষ্টি করতে পারে না । পুঁজিবাদের স্তাবক ও উপাসকদের দাবির সম্পূর্ণ বিপরীতে এটা ঘটে থাকে । প্রাক্ পুঁজিবাদী(Non-capitalist) দুনিয়ার গর্ভেই পুঁজিবাদের জন্ম আর এই দুনিয়াতেই সে খুঁজে পেয়েছিল বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় বাজার কিন্তু সারা দুনিয়া জুড়ে উৎপাদন সম্পর্কের বিস্তার ঘটিয়ে এবং বিশ্ববাজারকে একসূত্রে বেঁধে পুঁজিবাদ এমন এক অবস্থায় পৌঁছল যে ঊনবিংশ শতাব্দীর অব্যাহত বৃদ্ধির সহায়ক বাজার সম্পৃক্ত হয়ে উঠল। উপরন্তু, উদ্বৃত্ত মূল্যের উপলব্ধির জন্য বাজার খুঁজে পাওয়ার ক্রমবর্ধমান অসুবিধা লাভের হার কমে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে জোরদার করে তোলে । উৎপাদনের উপকরণের মূল্য এবং তাকে ক্রিয়াশীলকরার জন্য নিযুক্ত শ্রমশক্তির মুল্যের অনুপাত ক্রমাগত বেড়ে চলে আর তাই লাভের হার কমে যেতে থাকে। এখন এটা শুধুমাত্র প্রবণতা না হয়ে বেশি বেশি করে বাস্তব ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে । পুঁজি সঞ্চয়ের প্রক্রিয়া এবং ফলে গোটা ব্যবস্থার গতিশীলতার  পক্ষেই এটা যেন এখন গোদের ওপর বিষফোঁড়া । পণ্য বিনিময়কে একসূত্রে গ্রথিত ও বিশ্বজনীন করে তুলে আর তাই অগ্রগতির পথে মানবসমাজের বিরাট উল্লম্ফন ঘটানোর ফলে পুঁজিবাদ আজ পণ্য বিনিময়ের ভিত্তির উপর গড়ে ওঠা উৎপাদন সম্পর্কের অবলুপ্তির বিষয়টিকে (ঐতিহাসিক) কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করে তুলেছে । কিন্তু শ্রমিকশ্রেণী যতদিন পযন্ত না অবলুপ্তির এই কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করে তুলছে,এই সম্পর্কগুলো থেকেই যায় এবং মানবসমাজকে একের পর এক বেশি বেশি অর্ন্তদ্বন্দ্বে জর্জরিত করে তোলে ।পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার অর্ন্তনিহিত দ্বন্দ্বগুলোর বৈশিষ্ট্যসূচক অভিব্যক্তি হল অতি উৎপাদন।

অতীতে ব্যবস্থাটা সুস্থ, সবল থাকার সময়ে,বাজার সম্প্রসারনের ক্ষেত্রে এটা  অনুপ্রেরণাই  যোগাত।   আর এটাই এখন পরিণত হয়েছে স্থায়ী সঙ্কটে ।পুঁজির উৎপাদন ক্ষমতার পুরোটা পুঁজিবাদ আর কাজে লাগাতে পারে না,একটা কম অংশকে মাত্র কাজে লাগানোটাই   স্থায়ী চরিত্র অর্জন করেছে । শুধুমাত্র জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সঙ্গে তাল রেখেই সামাজিক আধিপত্যের বিস্তার ঘটাতে অসমর্থ হয়ে পড়েছে  পুঁজিবাদ । পুঁজিবাদ আজ সারা দুনিয়া জুড়ে চরম দুঃখ ও দারিদ্রেরই বিস্তার ঘটাতেই শুধু সক্ষম। অনেক পিছিয়ে পড়া দেশে ইতিমধ্যেই এটা মারা দেখেছি।এই অবস্থায় পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেকার প্রতিযোগিতা ও বিরোধ বেশি বেশি করে অদম্য তীব্রতাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ১৯১৪ সাল থেকে ছোট,বড় প্রতিটি রাষ্ট্রের বেঁচে থাকার উপায় হয়ে উঠেছে সাম্রাজ্যবাদ আর তা সমস্ত মানবসমাজকে নিক্ষেপ করেছে সংকট-যুদ্ধ-পুর্নগঠন-নতুন সংকট ......এই নারকীয় চক্রের ভয়ংকর আবর্তে। প্রচুর পরিমানে মারণাস্ত্রের উৎপাদন হলএই চক্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।পুঁজিবাদের কাছে ক্রমাগত বেশি করে নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের এবং উৎপাদিকা শক্তির পূর্ণমাত্রায়   ব্যবহারের একমাত্র ক্ষেত্র এখন এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে । পুঁজিবাদের এই অবক্ষয়ের যুগে আত্মহনন (Self-mutilation) ও ধ্বংসসাধনের স্থায়ী বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মধ্যে বাস করাটাই হয়ে উঠেছে মানবসমাজের নিয়তি।দারিদ্রের যে মূর্ত,নগ্ন রূপ অপেক্ষাকৃত কম বিকশিত দেশ গুলোকে পিষে পিষে নাজেহাল করে তুলছে, বেশি বিকশিত দেশ গুলোতে সামাজিকসম্পর্কের অভূতপূর্ব অমানবিক অবমূল্যায়নের মধ্য দিয়ে অভিব্যক্ত হচ্ছে তারই প্রতিধ্বনি । বেশি বেশি করে ভয়ানক,ঘাতকযুদ্ধ এবং সুব্যবস্থিত,সুপরিকল্পিত,বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শোযণ ছাড়া আর অন্য কোন ভবিষ্যতের দিকে মানবসমাজকে নিয়ে যেতে পুঁজিবাদের চূড়ান্ত অপারগতার এটাই  হল  পরিণতি। ফলে অন্যান্য পতনশীল সমাজব্যবস্থার মতোই,সামাজিক প্রতিষ্ঠান, পুঁজিবাদী মতাদর্শ,নৈতিক মূল্য ,শিল্পকলার রূপ এবং পুঁজিবাদের অন্যসব সাংস্কৃতিক রূপের    পচনশীলতা ক্রমেই  বেড়ে চলেছে । বিপ্লবী বিকল্পের   অবতর্মানে ফ্যাসিবাদ ও স্তালিনবাদের মত মতাদর্শের বিকাশ   দানবীয় ববরর্তার বিজয়েরই অভিব্যক্তি।

রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ

State Capitalism

সমস্ত ব্যবস্থার পতনশীলতার পযায়ে সমাজব্যবস্থার দ্বন্দ্বগুলো বিস্ফোরনমুখী হয়ে উঠলে, নির্ধারক (dominant) উৎপাদন সম্পর্ক বজায় রাখার উদ্দেশ্যে সমাজসত্তার সংহতি রক্ষার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে হয় রাষ্ট্রকে । নিজেকে ক্রমাগত জোরদার করে তোলার প্রবণতা দেখা যায় রাষ্ট্রের মধ্যে যাতে করে শেষ পযন্ত  সমাজজীবনের সব কিছুকে স্ফীতকায় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ  গুলোর ভিতরে সমাহিত (incorporate) ক'রে নেওয়া যায় । রোমান সাম্রাজ্যের প্রশাসন ব্যবস্থা এবং সাবর্ভৌম রাজতন্ত্রের স্ফীতকায় বৃদ্ধি যথাক্রমে রোমান দাস সমাজ ও সামন্ত সমাজের পতনশীলতার যুগে এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যেরই অভিব্যক্তি ছিল ।  পুঁজির পতনশীলতার যুগে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী হয়ে ওঠার সাধারণ একটা প্রবণতা সমাজ জীবনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে । অব্যাহত বিকাশ ও বিস্তৃতি অসম্ভব হয়ে পড়ায় , সাম্রাজ্যবাদী প্রতিদ্বন্দ্বিতার তীব্রতা বৃদ্ধির পরিস্থিতিতে,অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা এবং আভ্যন্তরীন ক্ষেত্রে সামাজিক দ্বন্দ্বগুলোর বেড়ে ওঠা ও বিস্ফোরনের মোকাবিলার উদ্দেশ্যে প্রত্যেকটি রাষ্ট্রীয় পুঁজিই যতটা সম্ভব  সুদক্ষভাবে নিজেকে সংগঠিত করতে বাধ্য হয়। এই সব কাজ করতে সক্ষম সমাজের একমাত্র   শক্তিই  হচ্ছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রই কেবল পারে :

  • বিশ্ববাজারের প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়ানোর ক্ষমতাকে জোরদার করার উদ্দেশ্যে,অর্থব্যবস্থার দূর্বলতার জন্য দায়ী আভ্যন্তরীন প্রতিযোগিতাকে প্রশমিত করতে  এবং সামগ্রিক এক  কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির দায়িত্ব নিতে ।
  • ক্রমবর্ধমান আর্ন্তজাতিক বিরোধ ও সংঘর্ষের পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সামরিক শক্তির বিকাশ ঘটাতে।
  • সবশেষে,বেশি বেশি পীড়নমূলক ও আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্রের বলে বলীয়ান হয়ে,অর্থনৈতিক ভিত্তির ক্রমবর্ধমান পচনশীলতার ফলে বিচ্ছিন্নতায় আক্রান্ত সামাজিক সংহতিকে রক্ষা ও জোরদার করতে । মানবিক সম্পর্কগুলোকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিয়ন্ত্রনের অক্ষমতা বেড়ে চলে যে সমাজব্যবস্থায়,যে ব্যবস্থা সমাজের অস্তিত্বের পক্ষেই ক্রমাগত বেশি বিপজ্জনক ,অযৌক্তিক হয়ে ওঠার সাথে সাথে বেশি বেশি প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয় ,তাকে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা রাষ্ট্র কেবল করতে পারে সর্বব্যাপক  হিংসা ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে ।

রাষ্ট্র কর্তৃক উৎপাদনের চরম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোর অধিগ্রহণের মাধ্যমেই প্রতিফলিত হয় অর্থনৈতিক স্তরে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের প্রবণতা । যদিও তা কখনোই সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয় না । এর মানে এই নয় যে , মূল্যের নিয়ম(Law of value) প্রতিযোগিতা অথবা উৎপাদনের নৈরাজ্যের মত পুঁজিবাদী অর্থনীতির মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো আর ক্রিয়াশীল থাকেনা । বাজারের নিয়ম গুলো তখনো সব জায়গাতেই বহাল  তবিয়তেই থেকে যায় এবং যতই রাষ্ট্রীয়কৃত (Statified) বা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন হোক না কেন,প্রতিটি জাতীয়অর্থনীতির উৎপাদনের অবস্থার নির্ণায়ক অবস্থানে থাকে বলে , সারা দুনিয়ার পটভূমিতেএই বৈশিষ্ট্যগুলো বাস্তবায়িত হতে থাকে । মূল্য ও প্রতিযোগিতার নিয়মগুলো কোথাও অকেজো করে দেওয়া হয়েছে বা উল্লঙ্ঘন করা হয়েছে মনে হলে এটাই ধ'রে নিতে হবে যে , বিশ্বপটভূমিতে ওগুলোর প্রভাব আরো জোরদার হয়ে উঠবে । রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার দরুন কোথাও খানিকটা প্রশমিত মনে হলেও বিশ্বপটভূমিতে উৎপাদনের নৈরাজ্য আরো মারাত্মক রূপে ফিরে আসে, বিশেষ করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার তীব্র সংকট কালে, যাকে নিবৃত্ত করার কোন ক্ষমতা নেই রাষ্ট্রীয়পুঁজিবাদের। বিজ্ঞানসম্মত ভাবে পুনর্গঠনের (rationalization) প্রক্রিয়ার সূচক হওয়া তো দূরের কথা, রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ পুঁজির অবক্ষয়ের অভিব্যক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়।

পুঁজির রাষ্ট্রীয়করনের প্রক্রিয়া দুইভাবে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে । সব থেকে উন্নত দেশগুলোতে এটা ঘটে সাধারনত ‘ব্যক্তিগত' এবং রাষ্ট্রীয় পুঁজির ক্রমাগত (gradual) মিলনের মাধ্যমে ।

অন্যদিকে সাধারণভাবে সব থেকে দূবর্ল ব্যক্তিগত পুঁজির দেশগুলোতে হঠাৎ একলাফেই বিশালাকার ও সম্পূর্ণ জাতীয়করণের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয় এই প্রক্রিয়া । 

বাস্তব ক্ষেত্রে যদিও পৃথিবীর সবর্ত্রই রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের প্রবনতার প্রকাশ ঘটে ,কোনো দেশ পতনশীলতার ফলে মারাত্মক ভাবে বির্পযস্ত হয়ে পড়ার সময়ে এটা বেশি দ্রুত ও স্পষ্ট হয়ে ওঠে । ঐতিহাসিকভাবে প্রকাশ্য সংকট (Open crisis) অথবা যুদ্ধের সময় এবং ভৌগোলিকভাবে দূবর্লতম আর্থিকব্যবস্থার দেশ গুলোতে এটা ঘটে থাকে । কিন্তু রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ শুধুমাত্র পিছিয়ে পড়া দেশগুলোরই নির্দিষ্ট বৈশিষ্টসূচক কোনো ব্যাপার নয় । বিপরীতে বরং বেশি বিকশিত দেশগুলোতে পুঁজিরকেন্দ্রীভবন (concentration) - এর উচ্চমাত্রার ফলে অর্থনেতিক জীবনের উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রন সাধারনভাবে অনেকবেশি কাযর্কর হয় যদিও পশ্চাদপদ পুঁজির ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক (formal) রাষ্ট্রীয়করণ বা জাতীয়করনের মাত্রা প্রায়ই বেশি হয়ে থাকে । সমাজ জীবনের সবর্ত্র সবকিছুর উপর রাষ্ট্রযন্ত্রের বিশেষ করে আমলাতান্ত্রিক-প্রশাসনিক কাঠামোর বেশি

বেশি সুব্যবস্থিত ও জোরালো নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে, কোথাও বা এটা ফ্যাসিবাদ বা স্তালিনবাদের মত চূড়ান্ত,সবর্গ্রাসী একচ্ছত্র আধিপত্যকামি রূপে ঘটে থাকে আবার অন্য কোথাও ঘটে গণতন্ত্রের মুখোশের আড়ালে।রোমের বা সামন্ততন্ত্রের পতনশীলতার যুগের তুলনায় অনেক অনেক বেশি পরিমানে বিকটাকার,দানবীয়,আবেগহীন ,নৈব্যর্ক্তিক যন্ত্রবিশেষ হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকের রাষ্ট্র আর গ্রাস করে নিয়েছে নাগরিক জীবনের সারবস্তুকেই। 

 

তথাকথিত ‘সমাজতান্ত্রিক’ দেশসমূহ

The so-called ‘Socialist’ Countries

 

রাষ্ট্রের হাতে পুঁজিকে কেন্দ্রীভূত ক'রে , উৎপাদনের উপকরণের ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান এবং বুজোর্য়া শ্রেণীর উচ্ছেদের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ । ‘এক দেশে সমাজতন্ত্রের' স্তালিনীয় তত্ত্ব দিয়ে কিছু রাষ্ট্রকে ‘সোসালিষ্ট' অথবা ‘কমিউনিষ্ট' নামে চিহ্নিত করা বা ‘সমাজতন্ত্রের পথে অগ্রসরমান' ব'লে প্রচার করার মত ডাঁহা মিথ্যার উৎস হলএই বিভ্রান্তিই।     

শুধু সম্পত্তি মালিকানার আইনগত বিচার বিভাগীয় (Juridical) রূপের মধ্যেই রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের প্রবণতার ফলে সংঘটিত পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করা যায়, উৎপাদনের বুনিয়াদী সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার কোন প্রভাবই চোখে পড়ে না । এই সব পরিবর্তন উৎপাদনের উপকরণের ব্যক্তিগত মালিকানার (উৎপাদন সম্পর্কগত দিকটার) নয়,তার আইনগত বিচারবিভাগীয় (juridical) দিকটারই কেবল অবসান ঘটায় । শ্রমিকদের অবস্থান থেকে বিচার করলে দেখা যাবে উৎপাদনের উপকরণগুলো ব্যক্তিগত সম্পত্তিই থেকে গেছে। আমলাতন্ত্রের(bureaucracy) জন্য উৎপাদনের উপকরণগুলো ‘যৌথ মালিকানায়' আনা হয় মাত্র ।আমলাতন্ত্রই যৌথভাবে এগুলোর পরিচালনা করে এবং মালিকানা ভোগ করে ।

শ্রমিকশ্রেণীর  উদ্বৃত্ত শ্রমশোষণ ও জাতীয় পুঁজি সঞ্চয়ের নিদির্ষ্ট অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালনকারী রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রই হয়ে ওঠে একটি শ্রেণী । কিন্তু এটা কোন নতুন শ্রেণী নয় । রাষ্ট্রীয়কৃত (Statified ) রূপে সেই একই পুরনো পুঁজিপতি ছাড়া যে এটা অন্য কিছুই নয় , এই ভূমিকা থেকেই সেটা স্পষ্ট । শ্রেণী হিসেবে বিশেষাধিকারের প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের ক্ষেত্রে বৈশিয্ট্যসূচক দিকটি হল এই যে , পুঁজির ব্যক্তিগত মালিকানার আয় তার উৎস নয় । চালু রাখা ও পরিচালনার জন্য খরচা (running cost), বোনাস এবং কাজের গুণাগুণের বিচারে  নিদির্ষ্ট পদ্ধতিতে প্রদত্ত এর পারিশ্রমিকই হচ্ছে এর উৎস। এই পারিশ্রমিক দেখতেই শুধু ‘মজুরির' মত, আসলে মজদুরদের যে মজুরি দেওয়া হয় ,তার থেকে এটা প্রায়ই কয়েক দশক বা শতক গুণ বেশি হয়ে থাকে।

রাষ্ট্র ও আমলাতন্ত্র কতৃর্ক পুঁজিবাদী উৎপাদনের কেন্দ্রীকরণ (centralization) ও পরিকল্পনা শোষনের অবসানের পথে কোন পদক্ষেপ তো নয়ই বরং দক্ষতার সঙ্গে শোষনকে তীব্রতর করারই উপায় মাত্র ।

অর্থনৈতিক স্তরে রাশিয়া কখনোই, এমন কি শ্রমিকশ্রেণীর দখলে রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকার সংক্ষিপ্ত সময়কালেও , পুঁজিবাদকে অবলুপ্ত করতে সমর্থ হয় নি । প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয় এবং পরে গৃহযুদ্ধের বিশৃংখল পরিস্থিতির দরুণ অথর্নৈতিক ক্ষেত্রের লন্ডভন্ড অবস্থা (economic disorganization) ,পতনশীল বিশ্বপুঁজিবাদী ব্যবস্থায় জাতীয় পুঁজি হিসাবে রাশিয়ার অস্তিত্বকে অনেক বেশি কঠিন করে তুলেছিল বলেই , রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ সেখানে অত্যন্ত বিকশিত রূপে , এত দ্রুত শেকড় গেড়ে বসল ।

প্রতিবিপ্লবের বিজয় সূচিত হল রাশিয়ার জাতীয় অথর্নীতিকে পুনরায় সংগঠিত রূপদানের কর্মসূচিরূপে আর এতে কাজে লাগানো হল রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের সবথেকে  বিকশিত রূপ গুলোকে আর এ গুলোকে নির্লজ্জভাবে উপস্থাপিত করা হল ‘অক্টোবরের ধারাবাহিকতা' এবং ‘সমাজতন্ত্রের নিমার্ণ' হিসাবে । এই দৃষ্টান্তই অনুসরন করা হল চীন, পূর্ব ইউরোপ , কিউবা , উত্তর কোরিয়া , ভিয়েতনাম  ইত্যাদি  দেশে। যাইহোক না কেন , প্রলেতারিয় বা কমিউনিষ্ট বলে কোনো কিছুই এ সব দেশের কোনোটাতেই নেই । আসলে এসব দেশে চূড়ান্ত অবক্ষয়ী পুঁজির ধরণে পুঁজিবাদী একনায়কত্বেরই শাসন শোষন চলে সমাজতন্ত্রের নামে। ইতিহাসের চরম মিথ্যাগুলোর অন্যতম এই মিথ্যাচার। তাই যতই সমালোচনামূলক (critical)বা শতার্ধীন(conditional) হোক না কেন এই সব দেশের কোনরকম সমর্থন বা পক্ষাবলম্বন ,সম্পূর্ণরূপে প্রতিবিপ্লবী ক্রিয়াকলাপ ছাড়া আর কিছুই নয় ।  

পতনশীল পুঁজিবাদের যুগে শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রাম

The proletarian struggle under decadent capitalism

 

শ্রেণী স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রাম শুরু থেকেই পুঁজিবাদের উচ্ছেদ ও কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত লক্ষ্য ও পরিকল্পনাকে ধারণ ক'রে এসেছে । কোনো স্বগীর্য় অনুপ্রেরনা চালিত বিশুদ্ধ আদর্শবাদের বশবর্তী হয়ে কিন্তু শ্রমিকশ্রেণী সংগ্রামের চূড়ান্ত  লক্ষ্যাভিমুখে এগিয়ে চলে না । বস্তুগত অবস্থার বিবর্তনের ফলে তাৎক্ষনিক সংগ্রামের প্রচলিত পদ্ধতিগুলো যখন শুধু বির্পয়ের মুখেই ঠেলে দেয় , তখনি কমিউনিষ্ট বিপ্লবের কর্মসূচি গ্রহণ করতে শ্রমিকশ্রেণী বাধ্য হয় ।

উথ্থানের যুগে বিশাল বিস্তৃতির ফলে শ্রমিকশ্রেণীর জীবনযাত্রায় সত্যিকার সংস্কার ঘটাতে পুঁজিবাদের সক্ষম  থাকার সময়ে , শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামে বিপ্লবী কর্মসূচি রূপায়নের জন্য প্রয়োজনীয় বস্তুগত অবস্থার (objective conditions)অভাব ছিল । 

বুর্জোয়া বিপ্লবের পযার্য়েও শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনে সবথেকে সচেতন ধারাগুলির ঘোষিত বিপ্লবী,কমিউনিষ্ট লক্ষ্য ও আকাঙ্খা সত্ত্বেও , সেই ঐতিহাসিক যুগে শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলন , সংস্কারের জন্য সংগ্রামের সীমারেখা অতিক্রম করতে পারত না ।

ট্রেড ইউনিয়ন ও সংসদীয় সংগ্রামের মাধ্যমে অথনৈর্তিক  রাজনৈতিক সংস্কারের দাবিদাওয়াগুলো জিতে নেবার উদ্দেশ্যে , নিজেকে সংগঠিত ক'রে তোলার রীতি পদ্ধতি শিখে নেওয়ার সামগ্রিক প্রক্রিয়াটা , ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে শ্রমিকশ্রেণীর যাবতীয় কর্মকান্ডের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু (focal point) ছিল । তাই ‘সংস্কারবাদী'(reformist) লোকজন ও বিপ্লবীদের পাশাপাশি থাকতে দেখা যেত শ্রমিকশ্রেণীর সত্যিকার (genuine) সংগঠনগুলির ভিতরে । ( প্রথমোক্তদের মতে শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামের সমস্তটাই হল শুধু সংস্কারের জন্য সংগ্রাম । শেষোক্তদের কাছে বিপ্লবী শ্রেণীসংগ্রামের অভিমুখে বিকশিত হবার প্রক্রিয়া একটা ধাপ বা মুহূর্তমাত্র হল সংস্কারের জন্য সংগ্রাম )। শ্রেণীর এবং উৎপাদিকা শক্তিগুলিরও বিকাশের পক্ষে অনুকূল সামাজিক পরিবর্তনে গতিসঞ্চারের জন্য বুজোর্য়াদের বেশি প্রতিক্রিয়াবাদী অংশের বিরুদ্ধে অন্য কোন কোন অংশকে সমর্থন করাও সেই যুগে শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষে সম্ভব ছিল । 

এইসব অবস্থার মৌলিক পরিবর্তন ঘটে গেল পতনশীল পুঁজিবাদের যুগে ।  বতর্মানের সমস্ত জাতীয় পুঁজিকে ধারণ করতে হলে যতটা বড় হওয়া দরকার , তার থেকে অনেক ছোট হয়ে পড়েছে পৃথিবী । প্রতিটি রাষ্ট্রেই চূড়ান্ত সীমা পযন্ত শ্রমের উৎপাদনক্ষমতা (productivity) বাড়াতে (অর্থাৎ শ্রমিকশ্রেণীর শোষণ বাড়াতে ) পুঁজি বাধ্য হচ্ছে । সংগঠিত রূপে এই শোষণ পরিচালনা (organization of exploitation) এখন আর শুধু ব্যক্তিগত নিয়োগকর্তা ও শ্রমিকদের মধ্যেকার বিষয় নয় । রাষ্ট্র ও অন্যান্য হাজারো ধরনের সাংগঠনিক কাঠামোর চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এটা। শ্রমিকশ্রেণীকে নিদির্ষ্ট সীমার মধ্যে আটকে রাখা, চালিত করা এবং বিপ্লবী সংগ্রামের বিপজ্জনক রাস্তা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে এইসব সাংগঠনিক কাঠামো আর এসবের সাহায্যে সুব্যবস্থিত এবং প্রতারণাপূর্ণ দমনের শিকারে পরিনত ক'রে রাখা হয় শ্রমিকশ্রেণীকে ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই মুদ্রাস্ফীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী একটা ব্যাপার । যে কোন বেতনবৃদ্ধির  সম্ভাব্য সুফলকে তৎক্ষনাৎ গিলে ফেলে এই মুদ্রাস্ফীতি । কাজের সময়ের পরিমান হয় একই আছে অথবা একটু কমেছে । তবে কর্মস্থলে যেতে আসতে প্রয়োজনীয় বেশি সময়টার কিছুটা ক্ষতিপূরণ এবং সামাজিক জীবন ও কাজের দমবন্ধ করা গতির ফলে শ্রমিকশ্রেণীর চূড়ান্ত স্নায়ু বৈকল্যের (total nervous collapse) সম্ভাবনা এড়ানোর জন্যই শুধু কাজের সময়টা খানিকটা কমানো হয়েছে  । 

সংস্কারের জন্য সংগ্রাম হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা নিরর্থক কল্পনাবিলাস । এই যুগে পুঁজির বিরুদ্ধে চূড়ান্ত উচ্ছেদের লক্ষ্যে পরিচালিত সংগ্রামেই শুধু শ্রমিকশ্রেণী লিপ্ত হতে পারে । লক্ষ লক্ষ বিধ্বস্ত,বশমানা, পরস্পর বিচ্ছিন্ন লোকেদের একটা সমষ্টি হয়ে থাকতে রাজি হওয়া অথবা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই লড়াই এর উদ্দেশ্যে অনিবারয সংগ্রামগুলোকে সম্ভাব্য ব্যাপকতমভাবে সাধারন শ্রেণীসংগ্রামে রূপান্তরিত করা----- এদুয়ের মাঝামাঝি আর কোন বিকল্প তার কাছে নেই । এইভাবে বিশুদ্ধ অর্থনেতিক , স্থানীয় বা বিভাগীয় স্তরে সংগ্রামকে সীমিত হতে দিতে অবশ্যই অস্বীকার করতে হবে তাকে এবং ভবিষ্যতের শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্বের সংগঠন বা workers council-এর ভ্রূণ হিসেবে নিজেকে সংগঠিত করতে হবে ।

এইসব নতুন ঐতিহাসিক অবস্থায় পুরনো হাতিয়ারের অনেককিছুকেই শ্রমিকশ্রেণী আর কাজে লাগাতে পারেনা । বস্তুতপক্ষে , শ্রমিকশ্রেণীকে শোষনের যাঁতাকলে বেঁধে রাখা এবং সংগ্রামের ইচ্ছাকে স্তিমিত করার জন্যই শুধু , কোনো কোনো রাজনৈতিক ধারা  ঐসব হাতিয়ারকে এখনো ব্যবহার করার কথা বলতে থাকে। চূড়ান্ত(maximum) ও ন্যূনতম(minimum) কর্মসূচির মধ্যে যে পাথর্ক্যরেখা টেনেছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলন , আজ তা সমস্ত অর্থ বা তাৎপরয হারিয়ে ফেলেছে । ন্যূনতম কর্মসূচি আর সম্ভব নয়। চূড়ান্ত বা কমিউনিষ্ট বিপ্লবের কর্মসূচির প্রেক্ষাপটের অন্তর্ভুক্ত করেই কেবল শ্রমিকশ্রেণী তার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

ট্রেড ইউনিয়ন : অতীতে শ্রমিক-সংগ্রামের হাতিয়ার, বতর্মানে হাতিয়ার পুঁজির

The Trade Unions: yesterday organs of the proletariat, today instruments of capital

ঊনবিংশ শতাব্দীতে পুঁজির চরম সমৃদ্ধির যুগে শিল্প বা পেশাভিত্তিক স্থায়ী সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুলেছিল শ্রমিকশ্রেণী । অনেক ক্ষেত্রেই তিক্ত ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমেই গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল এইসব সংগঠন। শ্রমিকশ্রেণীর অর্থনৈতিক স্বার্থের সুরক্ষার উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি হয়েছিল এইসব সংগঠনের। শ্রমিকশ্রেণীর জীবনযাত্রার অবস্থার ব্যাপক উন্নতি এবং বিভিন্ন সংস্কারের জন্য সংগ্রামে অত্যাবশ্যক ভূমিকা পালন করেছিল এইসব সংগঠন । পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পক্ষেও সে সময় সম্ভব ছিল এইসব সংস্কার ও উন্নতির দাবী মেনে নেওয়া ও রূপায়িত করা । শ্রেণীর সকল সদস্যকে একতাবদ্ধ করার এবং শ্রেণী সংহতি ও শ্রেণীচেতনা বিকাশের একটা কেন্দ্রবিন্দুও (focus) হয়ে উঠেছিল এইসব সংগঠন । আর তাই ‘কমিউনিজমের স্কুল' হিসেবে গড়ে তোলা ও কাজ করার ব্যাপারে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে বিপ্লবীরা সেই সময় এইসব সংগঠনের ভিতরে আলাপ আলোচনা ও বিতর্কে সক্রিয় অংশ নিতে পারত । মজুরি শ্রমের অস্তিত্বের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হয়ে থাকা এবং সেই যুগেও প্রায়ই বেশ ভালো পরিমাণেই আমলাতন্ত্র কবলিত হয়ে পড়া সত্ত্বেও, ততক্ষণ অব্দি ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিকশ্রেণীর প্রকৃত নির্ভরযোগ্য সংগঠন ছিল যতক্ষণ পরযন্ত মজুরি- শ্রমের অবলুপ্তি ঐতিহাসিক কর্মসূচি হয়ে ওঠেনি।

পতনশীল পযার্য়ে প্রবেশ করার ফলে শ্রমিকশ্রেণীর জন্য আর নতুন কোন সংস্কার ও উন্নতিবিধানের ব্যবস্থা করতে পুঁজিবাদ অসমর্থ হয়ে পড়ল। শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার পূবর্তন ক্রিয়াকলাপ বজায় রাখার/পালন করার সমস্ত সম্ভাবনা ট্রেডইউনিয়নগুলো হারিয়ে ফেলল। মজুরি-শ্রমের অবলুপ্তি ঐতিহাসিক কমর্সূচি হয়ে ওঠায় এর সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত ট্রেডইউনিয়নগুলোর অবলুপ্তিও বাস্তব কমর্সূচি হয়ে দাঁড়াল। এই পরিস্থিতিতে ট্রেডইউনিয়ন, সত্যিকার অর্থেই হয়ে উঠল পুঁজিবাদের রক্ষক , শ্রমিকশ্রেণীর ভিতরে থেকে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের দালালি করার প্রতিষ্ঠান। নতুন যুগে এইটাই ছিল তাদের টিকে থাকার একমাত্র উপায়। পতনশীল পযায়ের আগেই ভালো পরিমানে আমলাতন্ত্র কবলিত হয়ে পড়ার ঘটনা এবং অবক্ষয়ের যুগে সমস্ত সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনকে অঙ্গীভূত (absorb) করে নেবার অদম্য রাষ্ট্রীয় প্রবণতা , ইউনিয়নগুলোর এই বিবর্তনে সহায়ক হল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টিগুলোর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাম্রাজ্যবাদী হত্যাকান্ডে শ্রমিকশ্রেণীকে সামিল করার কাজে সাহায্য করল ট্রেড ইউনিয়ন গুলো আর এভাবেই সবর্প্রথম প্রমাণিত হল তাদের শ্রমিকশ্রেণী বিরোধী ভূমিকা । যুদ্ধের পর বিপ্লবী আন্দোলনের জোয়ারের সময় , শ্রমিকশ্রেণীর পুঁজিবাদ ধ্বংস করার প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ ও বিধ্বস্ত করার যথাসাধ্য সবকিছুই করেছিল ইউনিয়নগুলো । শ্রমিকশ্রেণী নয়, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রই তখন থেকে তাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে । রাষ্ট্রের জন্য বেশ কয়েকটি ক্রিয়াকলাপের দায়িত্ব এখন থেকে পালন করে এরা । যথা:

  • পুঁজিবাদী যৌক্তিকতার ভিত্তিতে অর্থনীতিকে পুর্নগঠিত করা, শ্রমশক্তির বিক্রয় নিয়ন্ত্রিত ও নিয়মিত করা এবং শোষণকে তীব্র করার রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করা।
  • Strike ও অন্যান্য বিদ্রোহকে কারখানা শাখা ও শিল্পভিত্তিক কানাগলিতে আটকে ফেলে পথভ্রষ্ট করা এবং শ্রমিকশ্রেণীর স্বনির্ভর ,স্বাধীন, স্ব-উদ্যোগে গড়ে ওঠা আন্দোলনগুলোর খোলাখুলি দমন পীড়নের মাধ্যমে , ভিতর থেকে শ্রেণী সংগ্রামের অন্তর্ঘাত মূলক কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়া ।

ইউনিয়নগুলো তাদের প্রলেতারিয় চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে; সুতরাং শ্রমিকশ্রেণির সেগুলোকে পুণর্দখল ক'রে কাজে লাগানোর কথা ওঠেনা বা সেগুলো আর বিপ্লবীদেরও কর্মক্ষেত্র থাকেনা।বুজোর্য়া রাষ্ট্র ষন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত , এইসব সংগঠনের কাজকর্মে অংশগ্রহণের ব্যাপারে শ্রমিকদের আগ্রহ ক্রমাগত কমে গেছে অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় জুড়ে । জীবনযাত্রার মানের ক্রমাবনতির প্রতিরোধে , ইউনিয়নের বাইরে থেকে ও বিরুদ্ধে আকস্মিক ধমর্ঘটের (wildcat strike) রূপগ্রহণের প্রবনতা দেখা গেছে শ্রমিকদের সংগ্রামে । সাধারণ সভা দ্বারা পরিচালিত এবং সাধারণ সংগ্রামের ক্ষেত্রে এইসব সভা দ্বারা নিবার্চিত ও প্রত্যাহারযোগ্য প্রতিনিধিদের কমিটি দ্বারা সমন্বিত (coordinated) শ্রমিক সংগ্রাম অচিরেই চলে গেছে রাজনৈতিক স্তরে কারণ তা কারখানার ভিতরে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরূপে হাজির ট্রেড ইউনিয়নের বিরোধিতার মোকাবিলা করেই এগিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে । এই ধরণের সংগ্রামগুলো সাধারণীকরণ(generalization) ও আমূল পরিবর্তনমুখী ক'রে (radicalization) তুলেই কেবল শ্রমিকশ্রেণী রক্ষণাত্মক অবস্থান থেকে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে খোলাখুলি , মুখোমুখি আক্রমনে চলে যেতে সমর্থ হয় এবং বুজোর্য়া রাষ্ট্রব্যবস্থাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার জন্য অপরিহারয হয়ে ওঠে ট্রেড ইউনিয়নের উচ্ছেদ

বিশেষভাবে সংগঠিত ( পেশা বা শিল্পভিত্তিক ) বা ‘নেতারা খারাপ' হওয়ার জন্যই শুধু পুরনো ট্রেড ইউনিয়ন গুলোর চরিত্র শ্রমিকশ্রেণী বিরোধী হয়ে ওঠেনি । এটা হয়েছে এই জন্য যে , বতর্মান পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক স্বার্থের সুরক্ষার উদ্দেশ্যে স্থায়ী ভাবে কোনো সংগঠন শ্রমিকশ্রেণী রাখতে পারেনা । ফলে এইসব সংগঠনের পুঁজিবাদী ক্রিয়াকলাপের বিষয়টা , একইরকম ভূমিকা পালনকারী অন্য সমস্ত ‘নতুন' সংগঠনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য , তা তারা যেভাবেই সংগঠিত হোক বা তাদের শুরুর সময়ের বাসনা যাই থাক । কোন তাৎক্ষনিক সংগ্রাম শেষ হবার পর টিকে থাকা __এমনকি ইউনিয়নের বিরোধিতা করেও __এবং শ্রমিকের তাৎক্ষনিক স্বার্থের সুরক্ষার ‘প্রকৃত নির্ভরযোগ্য' কেন্দ্র হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর (মজদুর কমিটি , মজদুর কমিশনের মত )সব সংগঠন ,‘Revolutionary Unions', ‘Shop Stewards'ইত্যাদির ক্ষেত্রেও এটা খাটে । এই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকা এইসব সংগঠন বেসরকারীভাবে বা কানুনী কাঠামো বহিভূর্তভাবে হলেও বুজোর্য়া রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে অঙ্গীভূত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা এড়াতে পারেনা।

ট্রেড ইউনিয়ন ধাঁচের সংগঠনকে ‘ব্যবহার', ‘পুনর্জীবিত', বা ‘পুনর্দখল' করার যে কোন রাজনৈতিক রণনীতি শুধুমাত্র পুঁজিবাদী স্বার্থকেই সুরক্ষিত করে কেননা এটা হ'ল শ্রমিকদের দ্বারা ইতোমধ্যেই পরিত্যক্ত পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানগুলোতেই নতুন ক'রে প্রাণ সঞ্চার করার চেষ্টা।

এইসব সংগঠনের শ্রমিকশ্রেণী বিরোধী চরিত্রের পঞ্চাশ বছরের বেশি সময়কার অভিজ্ঞতার পর, এই রণনীতির সপক্ষে বা সমর্থনে যেকোন অবস্থানই হচ্ছে মৌলিকভাবে শ্রমিকশ্রেণী-বিরোধী (Non-Proletarian) ।

পালার্মেন্ট ও নিবার্চনের বিভ্রান্তি

The mystification of parliament and elections

পুঁজির উথ্থানের যুগে বুজোর্য়াদের রাজনৈতিক জীবনকে সংগঠিত করার সবচেয়ে উপযুক্ত কাঠামো ছিল পালার্মেন্ট । বিশেষভাবে বুজোর্য়া প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে এটা কখনোই শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেনি এবং সংসদীয় ক্রিয়াকলাপ ও নিবার্চনে অংশগ্রহনের অবশ্যম্ভাবী বিপজ্জনক ঝুঁকিগুলোর বিরুদ্ধে বিগত শতাব্দীর বিপ্লবীরা সবসময় শ্রমিকশ্রেণীকে সতর্ক ক'রে দিয়েছিলেন ।

যাইহোক, পুঁজির বিকাশের সেই যুগে প্রলেতারিয় বিপ্লব বাস্তব কমর্সূচি হয়ে ওঠেনি এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে শ্রমিকশ্রেণির পক্ষে সংগ্রামের মাধ্যমে দাবি-দাওয়া আদায় করার সম্ভাবনাও ছিল যথেষ্ট। ফলতঃ সেই যুগে সংস্কারমূলক দাবী-দাওয়া আদায়ের সংগ্রামে চাপ সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় , নিবার্চনী অভিযানকে প্রলেতারীয় কর্মসূচির প্রচার আন্দোলনের জন্য এবং বুজোর্য়া রাজনীতির কলঙ্কজনক দিকগুলোর উন্মোচন ও বিরোধিতার উদ্দেশ্যে , শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষে পালার্মেন্টে অংশগ্রহণের রণকৌশলকে ব্যবহার করা সম্ভব ছিল। আর সেজন্যই ঊনবিংশ শতাব্দীতে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়কে কেন্দ্র করে শ্রমিকশ্রেণী সংগঠিত হয়েছিল, তার মধ্যে সবর্জনীন ভোটাধিকারের জন্য সংগ্রাম অনেক দেশেই অন্যতম হয়ে উঠেছিল ।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবক্ষয়ের শুরুর সময় থেকে সংস্কারমুলক দাবি-দাওয়া আদায়ের সংগ্রামের ক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য একটা হাতিয়ার হিসেবে পালার্মেন্টের অস্তিত্বের অবসান ঘটল । কমিউনিষ্ট আন্তর্জাতিকের (তৃতীয় আন্তর্জাতিক) বক্তব্য অনুযায়ী, ‘এখন রাজনৈতিক জীবনের ভরকেন্দ্র(centre of gravity)পালার্মেন্টের সীমারেখার বাইরে সম্পূর্ণ এবং চূড়ান্তরূপে অপসারিত হয়ে গেছে'। তারপর থেকে পালার্মেন্ট শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির হাতিয়ার হিসাবেই তার ভূমিকা পালন ক'রে আসছে আর এই ভূমিকা পালনের জন্যই তাকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। সুতরাং পালার্মেন্টকে শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থে ব্যবহার করার সমস্ত সম্ভাবনা চূড়ান্তভাবে খারিজ হয়ে গেল। পুঁজির অবক্ষয়ের পরযায়ে, যখন কোনপ্রকার সংস্কার মুলক দাবী দাওয়া আদায়ের বস্তুগত পরিস্থিতিরই অবসান ঘটল তখন রাজনৈতিকভাবে সত্যিকারের কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে অসমর্থ একটি বুরজোয়া প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কোনরূপ সংস্কারমূলক সংগ্রামের সাফল্যের কোন প্রশ্নই আর ওঠেনা। বুজোর্য়া রাষ্ট্র ব্যবস্থার যতসব প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ পালার্মেন্টেরও ধ্বংস সাধন এবং সাবর্জনীন ভোটাধিকার ও সংশ্লিষ্ট অন্য সবকিছুর ধ্বংসস্তূপের উপর শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠাই যখন অবশ্য পালনীয় ঐতিহাসিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, পালার্মেন্ট ও নিবার্চিত সংস্থাগুলোয় অংশগ্রহণের কর্মসূচি, (প্রবক্তাদের অন্তরের বাসনা যাই হোক না কেন), মরণোন্মুখ ঐসব কাঠামোয় নতুন জীবনীশক্তিই শুধু সরবরাহ ক'রে থাকে ।

পালার্মেন্ট ও নিবার্চনে অংশগ্রহণের ফলে গত শতাব্দীর সুযোগ সুবিধার সমস্ত সম্ভাবনা এখন নিঃশেষ । বিপরীত পক্ষে , এখন এপথ ভরা শুধু বিপদে , বিশেষ করে তথাকথিত workers party গুলোর সংসদীয় সংখ্যাধিক্য অজর্নের ফলে ‘শান্তিপূর্ণ পথে' অথবা ‘ক্রমে ক্রমে' সমাজতন্ত্রে উত্তরণের সম্ভাবনার যতসব মোহাচ্ছন্নতা বজায় থাকার বিপদ ।

নিবার্চন ও সংসদীয় ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর ভ্রষ্টাচারগ্রস্ত ও বুজোর্য়া ব্যবস্থার অঙ্গীভূত হয়ে পড়ার ঘটনা ছাড়া , ‘বিপ্লবী' প্রতিনিধিদের দিয়ে ‘ভিতর থেকে পালার্মেন্ট ধ্বংস করার' রণনীতির দ্বিতীয় কোন পরিণতি থাকতে পারে না। ইতিহাস এটা চূড়ান্তভাবে প্রমান ক'রে দিয়েছে।

শেষতঃ, পালার্মেন্টারি ক্রিয়াকলাপ মূলত বিশেষজ্ঞদেরই চিন্তাভাবনার বিষয় ও রাজনৈতিক দলগুলোর কারসাজিরই ক্ষেত্র; ফলে এখানে শ্রমিকদের স্ব-উদ্যোগের মোটেই বিকাশ ঘটে না, বরং আন্দোলন ও প্রচারের হাতিয়ার হিসাবে পালার্মেন্ট ও নিবার্চনকে ব্যবহার করার মধ্যে বুজোর্য়া সমাজের রাজনৈতিক ভিত্তিভূমিকেই বজায় রাখা ও শ্রমিকশ্রেণির নিষ্ক্রিয়তায় উৎসাহ দানের প্রবণতাই থেকে যায়। তৎসত্ত্বেও ইতিহাসের যে পযার্য়ে বিপ্লবের তাৎক্ষনিক সম্ভাবনা ছিল না সেসময় এই সমস্যাটা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল, কিন্তু পুরনো সমাজব্যবস্থার মূলোচ্ছেদ এবং কমিউনিষ্ট সমাজের নিমার্ণই যখন একমাত্র ঐতিহাসিক কর্মসূচি হয়ে উঠেছে এবং শ্রেণির সমস্ত অংশেরই সচেতন সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া যখন তা সম্ভব নয় তখন এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে শ্রমিক শ্রেণির লক্ষ্যের পথে চূড়ান্ত একটা বাধা।

‘বিপ্লবী পালার্মেন্টবাদ'-র (Revolutionary Parliamentarism) রণকৌশলের দারুন ক্ষতিকারক পরিণতি থেকে এটা পরিষ্কার যে, এটা আসলে বুজোর্য়া শ্রেণী স্বার্থেরই পরিপূরক, যদিও তা শুরুতে ছিল মূলতঃ শ্রমিকশ্রেণি ও তার সংগঠনগুলোর উপর অতীতের চিন্তাভাবনার প্রভাবেরই প্রতিফলন ।

সংযুক্ত মোর্চার রাজনীতি : শ্রমিকশ্রেণিকে শ্রেণিলাইন থেকে বিচ্যুত করার রণনীতি

Frontism: a strategy for derailing the proletariat

পুঁজির পতনশীলতার  যুগে একমাত্র প্রলেতারীয় বিপ্লবই ঐতিহাসিকভাবে প্রগতিশীল হওয়ায় , ‘প্রগতিশীল' ‘গণতান্ত্রিক' অথবা ‘জনপ্রিয়' (Popular) হওয়ার দাবিদার , শাসকশ্রেণীর কোন অংশের সঙ্গেই বিপ্লবী শ্রেণির মুহূর্তের জন্যও কোনরকম মিলিত কর্মসূচির কোন প্রশ্নই উঠতে পারেনা । পুঁজির উথ্থানের যুগের সম্পূর্ণ বিপরীতে, পতনশীল অবস্থায় বুজোর্য়া শ্রেণির যেকোন অংশের কোন রকম প্রগতিশীল ভূমিকা হয়ে পড়ে একদম অসম্ভব । বিশেষ করে ঊনবিংশ শতাব্দীতে সামন্ততন্ত্রের অবশেষের পটভূমিতে প্রগতিশীল, বুজোর্য়া গনতন্ত্রের  রাজনৈতিক ব্যবস্থার আসল যা কিছু সারপদার্থ, তা নিঃশেষ হয়ে গেছে পুঁজির পতনশীল পযায়ে। বুর্জোয়া গণতন্ত্র শুধু রাষ্ট্রের সবর্গ্রাসী ক্ষমতাবৃদ্ধিকে (Strengthening of the totalitarian power of the state) আড়াল করার প্রতারণা মূলক আবরনের ভূমিকাই পালন করে এবং বুজোর্য়াদের  গণতন্ত্রের পূজারী অংশটা অবশিষ্ট অংশের মতো একই রকম প্রতিক্রিয়াশীল। 

প্রথম মহাযুদ্ধের সময় থেকে শ্রমিকশ্রেণীর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত সব থেকে  বেশি দূরভিসন্ধিমুলক ও ক্ষতিকারক আফিমগুলোর অন্যতম হিসেবে ‘গণতন্ত্র' নিজেকে উপস্থাপিত করেছে। গণতন্ত্রের দোহাই দিয়েই যুদ্ধের পর ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশের শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী অভ্যুথ্থান চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হয়েছিল। ‘ফ্যাসিজমের' বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের কথা বলেই লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী মহাযুদ্ধে সামিল হতে প্ররোচিত করা হয়েছিল। গণতন্ত্রের নামেই আজ আবার একবার পুঁজির প্রবক্তারা শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামকে শ্রেণী লাইন থেকে বিচ্যূত ক'রে ‘ফ্যাসিজম', ‘প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি', ‘দমনপীড়ণ', সবর্গ্রাসী রাষ্ট্র ও শাসনতন্ত্র, (totalitarianism) ইত্যাদির বিরুদ্ধে সংষুক্ত মোর্চা (United front)-র প্রতিবিপ্লবী লাইনে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

ফ্যাসিবাদ হ'ল ইতিহাসের একটি পযার্য়ের বিশেষ ফসল যখন ইতোমধ্যে শ্রমিকশ্রেণি চূড়ান্তভাবে পরাজিত এবং পযুর্দস্ত।  বতর্মানে ‘ফ্যাসিবাদ' বিকাশের সেই ঐতিহাসিক এবং বস্তুগত পরিস্থিতি নেই; সুতরাং, ‘ফ্যাসিজমের বিপদ' সম্বন্ধে সমস্ত প্রচারাভিযান নিছক বিভ্রান্তি ছড়ানোর প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।  আরো একটা ব্যাপার হচ্ছে এই যে, দমনপীড়নের monopoly বা একাধিকার যে শুধু ফ্যাসিবাদেরই আছে ,তা নয় । গণতান্ত্রিক ও বামপন্থী রাজনৈতিক ধারার প্রবক্তারা নিজেরাই   যে   শ্রমিকশ্রেণীর ওপর সুপরিকল্পিত ভাবে দমনপীড়ণ চালিয়ে  থাকে এবং বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন পরযুদস্ত করার প্রতিবিপ্লবী কর্মকান্ডে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সবসময় ওরাই  যে পালন করছে --- এই সত্যকে  আড়াল করার জন্যই ওরা ফ্যাসিজম আর দমনপীড়ণকে এক করে দেখায়।

‘জনপ্রিয় মোর্চা' (Popular Fronts) এবং ‘ফ্যাসিবিরোধী ফ্রন্টের'(anti-fascist front ) মতোই ‘সংযুক্ত মোর্চার' (United Fronts) রণকৌশলও যে শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামকে শ্রেণী লাইন থেকে বিচ্যুত করারই  গুরুত্বপূর্ণ একটা হাতিয়ার তা প্রমানিত হয়েছে । "শ্রমিক সমুদায় থেকে বিচ্ছিন্ন করা এবং মুখোশ খুলে দেবার উদ্দেশ্যে , তথাকথিত "workers parties" বা শ্রমিক দলগুলির সঙ্গে বিপ্লবী সংগঠনের সংযুক্ত মোর্চা গ'ড়ে তোলার" রণকৌশল আসলে ঐসব বুজোর্য়া পার্টির প্রকৃত চরিত্রটা বোঝার ক্ষেত্রেই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে,  ঐসব পার্টির ওপর  ‘প্রলেতারীয়' চরিত্রের মুখোশই পরায়  আর তাই  ঐসব দল থেকে শ্রমিকশ্রেণীর সম্পূর্ণ বিচ্ছেদকে বিলম্বিতই করে। 

বিপ্লবের অভিমুখে শ্রেণী সংগ্রামের বিস্তারের প্রথম পূবর্শর্ত সমাজের অন্যসব শ্রেণির অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রলেতারীয়েতের শ্রেণি স্বাতন্ত্র্যের নীতি।   অন্যান্য শ্রেণি বা স্তরের সঙ্গে, বিশেষ ক'রে বুজোর্য়াদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে সংষুক্ত মোর্চার কর্মসূচি , শ্রেণি-লাইন পরিত্যাগ করার পথে চালিত ক'রে শ্রেণিশত্রুর আক্রমনের মুখে শ্রমিকশ্রেণিকে কেবল নিরস্ত্রই করে, কারণ শুধুমাত্র শ্রেণিলাইন দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরেই   সে ইস্পাতের মত মজবুত শক্তির অধিকারী হয়ে উঠতে পারে । এই শ্রেণি লাইন পরিত্যাগ করার পরামর্শ বা প্ররোচনা দাতা যেকোন রাজনৈতিক প্রবণতা সরাসরি বুজোর্য়া স্বার্থেরই সেবা করে থাকে।

‘জাতীয় মুক্তির’ প্রতিবিপ্লবী কল্পকথা (Myth)

The counterrevolutionary myth of national liberation

জাতীয় মুক্তি এবং নতুন জাতির গঠন বা সৃষ্টি কখনোই শ্রমিকশ্রেণীর বিশেষ ভাবে নিদির্ষ্ট কর্তব্য (specific task) হয়ে ওঠে নি। ঊনিশ শতকে কোনও কোনও ক্ষেত্রে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে সমর্থন করা সত্ত্বেও , এসব আন্দোলনের পুরোপুরি বুজোর্য়া চরিত্র সম্বন্ধে বিপ্লবীদের বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। ‘জাতি সমূহের আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকারের' নামেও কিন্তু তাঁরা ঐসব আন্দোলন সমর্থন করেন নি। উথ্থানের যুগে পুঁজির বিকাশের পক্ষে সবথেকে উপযুক্ত কাঠামো ছিল জাতি বা জাতিরাষ্ট্র এবং প্রাক-পুঁজিবাদী সামাজিক সম্পর্কের শ্বাসরোধকারী অস্তিত্বকে শেষ করে নতুন জাতি বা জাতিরাষ্ট্রের গঠন ছিল  বিশ্বব্যাপী উৎপাদিকা শক্তির আরো বিকাশ অর্থাৎ সমাজতন্ত্রের জন্য অপরিহারয বাস্তব শর্তাবলীর পরিপক্কতার পথে অগ্রগামী পদক্ষেপ, আর সে জন্যই এইসব আন্দোলন বিপ্লবীরা সমর্থন করেছিলেন । 

পতনশীলতার যুগে প্রবেশের সাথে সাথে পুঁজির উৎপাদন সম্পর্ক সহ জাতিরাষ্ট্রের সামগ্রিক কাঠামোটা এতই সংকীর্ণ হয়ে পড়ল যে উৎপাদিকা শক্তির যথাসম্ভব বিকাশের পক্ষে আর তা সহায়ক নয় । সবচেয়ে পুরনো এবং শক্তিশালী দেশগুলোর আরো বিকাশলাভে অক্ষম হয়ে পড়ার পরিস্থিতিতে, নতুন করে বৈধ জাতিরাষ্ট্রের গঠন(Juridical Constitution of new countries ) আসলে প্রগতির কোন পদক্ষেপই নয় । পরস্পর বিরোধী সাম্রাজ্যবাদী শিবিরে বিভাজিত পৃথিবীতে ‘জাতীয় মুক্তির' সংগ্রাম প্রগতিশীল কোনও পদক্ষেপ তো নয়ই, বরং তা কেবল প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরের মধ্যেকার অনিবারয ,অবিরাম সংঘাতের একটা মুহূর্ত বা ক্ষেত্র হিসেবেই  পরিগণিত হতে পারে আর এইসব সংগ্রামে, স্বেচ্ছায় হোক বা বলপ্রয়োগের মাধ্যমেই হোক ,শ্রমিক ও কৃষকেরা সামিল হন শুধু কামানের খোরাক হিসেবেই ।

সাম্রাজ্যবাদের উৎসমূল অর্থাৎ পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের উৎখাতের লক্ষ্যে পরিচালিত নয় ব'লে , এই ধরনের সব সংগ্রাম ‘সাম্রাজ্যবাদকে দুবর্ল' করে না কোনভাবেই। এগুলোর ফলে কোন একটা সাম্রাজ্যবাদী শিবির দুবর্ল হয়ে পড়লে অন্যটা অবশ্যই জোরদার হয়ে ওঠে ; এবং  এইসব সংঘাতের ফলে গড়ে ওঠা নতুন সব জাতিরাষ্ট্রকেও সাম্রাজ্যবাদী হতেই হবে , কারণ, পতনশীলতার  যুগে ছোট, বড় নিবির্শেষে কোন দেশই সাম্রাজ্যবাদী নীতি অনুসরন না করে টিকে থাকতে পারে না । 

বর্তমান যুগে ‘জাতীয় মুক্তির' সংগ্রামের ‘সাফল্য' বা ‘বিজয়ের' অর্থই হল সংশ্লিষ্ট দেশের সাম্রাজ্যবাদী প্রভুর ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন মাত্র। শ্রমিকদের, বিশেষ করে নতুন ক'রে গজিয়ে ওঠা তথাকথিত ‘সমাজতান্ত্রিক' দেশের শ্রমিকদের কাছে এর অর্থ হল সামরিক ধাঁচে ,সুব্যবস্থিত ও সুপরিকল্পিত পদ্ধতিতে রাষ্ট্রীয়কৃত পুঁজির (Statified Capital) শোষনের তীব্রতা বৃদ্ধি । এই রাষ্ট্রীয়কৃত পুঁজি বুজোর্য়া ব্যবস্থার বরবতারই একটা সুচকরূপে ‘মুক্ত ,স্বাধীন' জাতি-রাষ্ট্রকে বিশাল এক বন্দীশালায় রূপান্তরিত করার পথে এগিয়ে চলে।   কিছুলোকের দাবীর সম্পূর্ণ বিপরীতে, তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণীর কাছে এইসব সংগ্রাম শ্রেণীসংগ্রামের পথে বিরাট উল্লম্ফনের সুযোগ এনে দেয় না । ‘দেশপ্রেমের' বিভ্রান্তি ছড়িয়ে জাতীয় পুঁজির স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে শ্রমিকশ্রেণিকে সংগঠিত ক'রে সবসময়ই শ্রেণীসংগ্রামের পথে বিরাট বাধা হবে দাঁড়ায়  এই সংগ্রামগুলো। এই শ্রেণীসংগ্রাম প্রায়ই অত্যন্ত বেদনাদায়ক , রক্তক্ষয়ী রূপধারণ করে এইসব দেশে । কমিউনিষ্ট বা তৃতীয় আন্তর্জাতিকের ঘোষণার বিপরীতে , গত পঞ্চাশ বছরের  ইতিহাস সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ করে দিয়েছে যে , ‘জাতীয় মুক্তি' যুদ্ধ (National Liberation Struggle), শিল্পোন্নত বা পিছিয়ে পড়া কোন দেশেরই শ্রমিকদের সংগ্রামে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে না । এইসব সংগ্রামে শ্রমিকশ্রেণীর কোন অংশেরই লাভ করার কিছুই নেই এবং সমর্থনের জন্যে কোনো পক্ষকেই তারা বেছে নিতে পারেনা । তথাকথিত ‘জাতীয় মুক্তি' জমকালো আবরনে ‘জাতীয় প্রতিরক্ষার' পরবর্তী কালের সংস্করণ ছাড়া আর কিছুই নয় । এইসব সংঘাত সংঘর্ষে একমাত্র বিপ্লবী শ্লোগান  হচ্ছে : বিপ্লবী পরাজয়বাদ (Revolutionary defeatism) অর্থাৎ ‘সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে বিপ্লবী গৃহযুদ্ধে পরিণত করুন'। বিপ্লবীরা শ্রমিকশ্রেণীর কাছে এই আহ্বানই রেখেছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় । ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত যে ভাবেই হোক না কেন , এইসব সংঘর্ষের প্রতি ‘বিনা শর্ত' বা ‘ সমালোচনা মুলক' সমর্থনের যেকোন অবস্থানই প্রথম মহাযুদ্ধের সময়কার ‘ উৎকট স্বদেশভক্ত সমাজ গণতন্ত্রী' দের (সোস্যাল সোভিনিস্ট /Social-chauvinists) অবস্থানের একদম অনুরূপ । সঙ্গতিপূর্ণ ও সুসংহত কমিউনিষ্ট ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে তাই এটা একদম খাপ খায়না ।

স্ব-পরিচালনা : শ্রমিকদের স্ব-শোষণ

Self-management: workers’ self-exploitation

জাতিরাষ্ট্র (nation-state) নিজেই এখন এমন এক অত্যন্ত সংকীর্ণ কাঠামোয় পরিণত যে উৎপাদিকা শক্তির অব্যাহত বিকাশ ঘটাতে সে আর সক্ষম নয় । পৃথক পৃথক প্রতিটি শিল্পোদ্যোগের ক্ষেত্রে তাই এই সত্য আরো অনেক বেশি করে প্রযোজ্য । পুঁজিবাদের সাধারণ নিয়মগুলোর খপ্পর থেকে এইসব শিল্পোদ্যোগের সত্যিকার কোন স্বাতন্ত্র্য কোনদিনই ছিল না। পতনশীল অবস্থায় এরা আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে ঐসব নিয়ম ও রাষ্ট্রের ওপর । এই কারণেই গত শতাব্দীতে স্ব-পরিচালনা (অর্থাৎ পুঁজিবাদী সমাজের মধ্যেই শ্রমিকদের দ্বারা উদ্যোগ ধান্দার পরিচালনা)-র পক্ষে প্রুধো-পন্থীদের (Proudhonist) প্রচার যদিও আসলে পেটিবুজোর্য়া কল্পনাবিলাস মাত্রই ছিল আজ তা শ্রমিকদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর পুঁজিবাদী প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়

নিজেদের শোষণ নিজেরাই সংগঠিত করে সংকটগ্রস্ত শিল্পোদ্যোগকে বাঁচিয়ে তোলার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে শ্রমিকশ্রেণীকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য পুঁজির অর্থনৈতিক হাতিয়ারের ভূমিকাই পালন করে এটা । এটা প্রতিবিপ্লবের রাজনৈতিক হাতিয়ারের ভূমিকাও পালন করে যেহেতু:

  • কারখানা ,এলাকা ও বিভাগ (sector) গত ভাবে শ্রমিক শ্রেণীকে আবদ্ধ ও বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে বিভাজিত করে ।
  • পুঁজিবাদী অর্থনীতি টিকিয়ে রাখার দায়দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দেয় শ্রমিকশ্রেণীর কাঁধে যখন কিনা তার সম্পূর্ণ উচ্ছেদই হয়ে উঠেছে একমাত্র কর্তব্য ।
  • মুক্তির সম্ভাবনা সুনিশ্চিত করার জন্য অপরিহারয মৌলিক কর্তব্য অর্থাৎ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের ধ্বংস সাধন এবং সারা দুনিয়া জুড়ে শ্রেণী একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার পথ থেকে বিচ্যুত করে শ্রমিকশ্রেণীকে ।
পুঁজিবাদী নিয়ম নীতির কাঠামোর মধ্যে তো নয়ই ,তাকে ধ্বংস করেই এবং সারা দুনিয়ার ভিত্তিতেই কেবল উৎপাদনব্যবস্থার আসল পরিচালনার দায়দায়িত্ব নিতে পারে শ্রমিকশ্রেণী ।
স্ব-পরিচালনার সমর্থনে যে কোনও রাজনৈতিক অবস্থান (এমন কী তা ‘শ্রমিকশ্রেণীর অভিজ্ঞতা' অথবা ‘শ্রমিকদের মধ্যে নতুন সম্পর্ক গ'ড়ে তোলা'র নামে হলেও ) আসলে কিন্তু পুঁজিবাদী সর্ম্পক টিকিয়ে রাখতেই সাহায্য ক'রে চলেছে ।

‘আংশিক’ সংগ্রাম: প্রতিক্রিয়াশীলতার গোলকধাঁধা

‘Partial’ struggles: a reactionary dead-end

পুঁজির পতনশীল অবস্থা সবরকম নৈতিক মূল্যের পচনশীলতার প্রক্রিয়াকে (decomposition) জোরদার ক'রে তুলেছে এবং মানবিক সম্পর্কের জগৎকে চরম অধঃপতন ও ভাঙনের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে ।

এ কথা সত্য যে শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লব নতুন সম্পর্কের সৃষ্টি করবে সমাজজীবনের সব ক্ষেত্রে কিন্তু তার মানে এই নয় যে __বর্ণবৈষম্য, মহিলাদের অবস্থান , দূষণ ,যৌনতা ,  এবং দৈনন্দিন জীবনের এই রকম অন্যান্য সব সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে নিদির্ষ্ট ধরনের আংশিক আন্দোলন সংগঠিত করার মাধ্যমে প্রলেতারীয় বিপ্লবের অগ্রগতিকে জোরদার ক'রে তোলা সম্ভব; আসলে এইরকম চিন্তা একদম ভুল ।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অথনৈর্তিক বুনিয়াদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্যেই নিহিত আছে উপরিকাঠামোগত দিকের (Super-structural aspects) বিরুদ্ধে  সংগ্রাম, এর বিপরীতটা নয়।  ‘আংশিক' সংগ্রামের চরিত্রই এমন যে তা প্রলেতারীয়েতের পক্ষে চরম গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণীস্বাতন্ত্রে‌র ভিত্তিকে মজবুত তো করেই না ,বরং বিপরীতে ( বর্ণগত, লিঙ্গগত, জাতিগত, যুব সম্প্রদায়গত ইত্যাদি) কতকগুলো অস্পষ্ট সামাজিক স্তরের(confused categories) ভিত্তিতে শ্রমিকশ্রেণিকে সংগঠিত ক'রে তার শ্রেণি চরিত্রকেই গুলিয়ে দেয় এবং শেষপযর্ন্ত ইতিহাসের গতির মুখে নস্যাৎ হয়ে যাওয়া ছাড়া এসংগ্রামের আর কিছুই করার থাকে না।   এইজন্যই বুজোর্য়া সরকার এবং সব রাজনৈতিক দল আংশিক সংগ্রামকে জোরালো করে তোলা এবং সামাজিক ব্যবস্থা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে ভালোভাবে ব্যবহার করার ব্যাপারটা রপ্ত করে নিয়েছে ।  

‘শ্রমিকদের’ পার্টিগুলির প্রতিবিপ্লবী চরিত্র

The counter-revolutionary character of the “workers' parties”

যে সমস্ত পার্টি বা সংগঠন--‘সমাজতন্ত্র' ‘গণতন্ত্র' , ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা' (Anti-Fascism) , ‘জাতীয় স্বাধীনতা' (National Independence) , ‘সংযুক্ত মোর্চা'(United front) অথবা ‘মন্দের ভালো'(Lesser evil)-র নামে বুজোর্য়া রাষ্ট্র ও গোষ্ঠীগুলোর মধ্যেকার অনিবারয দ্বন্দ্বে কোন না কোন রাষ্ট্র বা গোষ্ঠীর পক্ষে দাঁড়ায় (এমন কি তা সমালোচনামূলক এবং শর্তাধীন হলেও ), --যারা বুজোর্য়াদের নিবার্চনী সার্কাস বা শ্রমিকশ্রেণী বিরোধী ট্রেড ইউনিয়নবাদী ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহন অথবা স্ব-পরিচালনার (Self management) বিভ্রান্তি সৃষ্টির মধ্যে রাজনৈতিক ক্রিয়ার্কমের ভিত্তি খুঁজে পায়, তারা সকলেই বুজোর্য়াদের রাজনৈতিক যন্ত্রের অংশ এবং পুঁজির দালাল মাত্র। সোসালিষ্ট ও কমিউনিষ্ট পার্টিগুলির ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে প্রযোজ্য বা সত্য ।

একসময় বিশ্ব প্রলেতারিয়েতের সত্যিকার অগ্রবাহিনী হয়ে উঠেছিল এইসব পার্টি । কিন্তু অধঃপতন প্রক্রিয়ার পরিণতি এইসব পার্টিকে শেষ পযন্ত নিয়ে এসেছে বুজোর্য়া শিবিরে (সোসালিষ্ট পার্টিগুলি দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক বা Second International এবং কমিউনিষ্ট পার্টিগুলি তৃতীয় আন্তর্জাতিক বা Third International এর অন্তর্ভুক্ত ছিল ) । International গুলির সত্যিকার অর্থে মৃত্যুর পরও (যদিও তারা প্রলেতারীয় স্বরূপবিহীন বাহ্যিক রূপ ধারণ করে টিকে ছিল ) এইসব পার্টির প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা ভাবে নিজেদের দেশের বুজোর্য়া রাষ্ট্র যন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য( এবং প্রায়শই বেশ গুরুত্বপূর্ণ ) অঙ্গে অর্থাৎ জাতীয় পুঁজির বিশ্বস্ত ম্যানেজারে ক্রমাগত বেশি রূপান্তরিত হয়েই টিকে থাকল । 

সোসালিষ্ট পার্টিগুলোর ক্ষেত্রে এটা ঘটল যখন সুবিধাবাদ (opportunism) ও সংস্কারবাদের (reformism) পচনশীল প্রক্রিয়ার পরিণাম স্বরূপ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়  (যা দ্বিতীয়  আন্তর্জাতিকের মৃত্যু সূচিত করল ) দক্ষিনপন্থী উগ্র সামাজিক স্বাদেশিকতার (social chauvinism) নেতৃত্বে প্রধান প্রধান পার্টিগুলোর অধিকাংশই ‘ জাতীয় প্রতিরক্ষা' (National defense) এবং পরে যুদ্ধ পরবর্তী বিপ্লবী জোয়ারের খোলাখুলি বিরোধিতার নীতিই শুধু গ্রহণ করলনা, ১৯১৯ এর জামার্নীর মত অন্যত্রও  প্রলেতারিয়েতের  ঘাতকের ভূমিকা পযন্ত পালন করল । এই দক্ষিনপন্থী অংশ তখন থেকেই অর্থাৎ যুদ্ধের সময় থেকেই বুজোর্য়া শিবিরের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গিয়েছিল । নিজ নিজ দেশের বুজোর্য়া রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে এইসব পার্টির প্রত্যেকটির চূড়ান্ত একীভবন (Integration) ঘটতে লাগল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ  পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে । তবে ১৯২০ এর দশকের শুরুর দিকেই এই একীভবন প্রক্রিয়ার নিশ্চিত সমাপ্তি ঘটে গেল যখন এইসব পার্টির মধ্যেকার প্রলেতারীয় ধারাগুলিকে হয় বার করে দেওয়া হল অথবা তারা নিজেরা বেরিয়ে এসে Communist International এ যোগদান করল ।

কমিউনিষ্ট পার্টিগুলোর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটল। একই রকম সুবিধাবাদী অধঃপতন পরিণামে তারাও পুঁজিবাদি শিবিরের অন্তভুর্ক্ত হয়ে পড়ল । ১৯২০ এর দশকের প্রথম দিকেই এই  প্রক্রিয়ার শুরু । কমিউনিষ্ট ইন্টারন্যাশনাল প্রকৃত অর্থে শেষ হয়ে যাওয়ার পরও এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে ( ১৯২৮এ ‘একদেশে সমাজতন্ত্রের' তত্ত্বের স্বীকৃতির দ্বারাই এই পরিসমাপ্তি সূচিত হল ) । Left fraction  গুলোর আপোষহীন সংগ্রাম সত্ত্বেও এবং পরবর্তী কালে তাদের বহিষ্কারের পর ১৯৩০-এর দশকের শুরুতে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে   এইসব পার্টির সম্পূর্ণ একীভবনই হল এই প্রক্রিয়ার পরিণতি । আপন আপন দেশে বুজোর্য়াদের সমরাস্ত্র সংগ্রহ অভিযানে অংশগ্রহণ এবং ‘Popular front' গুলিতে যোগদানের মাধ্যমে সূচিত হল এই একীভবন । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘প্রতিরোধ যুদ্ধ'(resistance) এবং যুদ্ধ পরবর্তী কালে জাতীয় পূর্ণনির্মাণে (national reconstruction ) সক্রিয় অংশগ্রহণ সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেছে যে  এইসব পার্টি হল আসলে জাতীয় পুঁজির বিশ্বস্ত চাকর এবং প্রতিবিপ্লবের সবচেয়ে নিখুঁত প্রতিমূর্তি'

‌যে সব পার্টি সুনিশ্চিত ভাবে বুজোর্য়াদের শিবিরে যোগদান করেছিল , সমস্ত তথাকথিত বিপ্লবী ধারা যেমন মাওবাদ হল তাদেরই একটা প্রকারভেদ মাত্র । কমিউনিষ্ট পার্টিগুলোর প্রতারণার বিরুদ্ধে প্রলেতারীয় প্রতিবাদের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠার পর ট্রটস্কিবাদও এইরকম অধঃপতন প্রক্রিয়ার শিকার হল। সোসালিষ্ট ও কমিউনিষ্ট পার্টিগুলোর ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংযুক্ত মোর্চার' (anti-fascist alliances) মত কোনকোন অবস্থানের পক্ষে দাঁড়িয়ে চলতিধারার নৈরাজ্যবাদ (traditional anarchism) বর্তমানে তাদেরই দৃষ্টিকোণ  ও চিন্তাভাবনার অনুসারী হয়ে উঠেছে আর তাই তারাও একই অর্থাৎ পুঁজিবাদী শিবিরেরই  অন্তভুর্ক্ত । এদের প্রভাব কম হতে পারে বা এরা বেশ গরম গরম আপাত যুক্তিপূর্ণ নতুন ধরনের কথাবার্তা বলতে পারে কিন্তু তাতে তাদের কর্মসূচির বুজোর্য়া ভিত্তির কোনরকম পরিবর্তন হয় না , বরং এতে তারা বুজোর্য়া পার্টিগুলোর আরো ভালো পরিপূরক ও উপযোগী দালাল হয়ে ওঠে মাত্র ।   

বিশ্ব শ্রমিকশ্রেণীর বিশ্বব্যাপী বিপ্লবী সংগ্রামের প্রথম বিশাল জোয়ার

The first revolutionary wave of the world proletariat

পুঁজির পচনশীল অবস্থার শুরুর  সূচক হিসেবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এটাও প্রমাণ করে দিল যে শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় বস্তুগত অবস্থা (Objective conditions) পরিপক্ক হয়ে  উঠেছে । সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী অভ্যুথ্থানের জোয়ারের বজ্রনিনাদে কেঁপে উঠল রাশিয়া ও ইউরোপ , সেই দুনিয়া কাঁপানো আওয়াজে বেশ ভালোভাবেই প্রভাবিত হল উভয় আমেরিকাও , চীনেও প্রতিধ্বনিত হল সে আওয়াজ  আর এইভাবে এই বিপ্লবী অভ্যুথ্থানের ঢেউ পুঁজিবাদ উচ্ছেদের ঐতিহাসিক কর্তব্য পালনের পথে বিশ্ব শ্রমিকশ্রেণীর প্রথম প্রচেষ্টায় পরিণত হল । 

১৯১৭ থেকে ১৯২৩ ব্যাপী এই বিপ্লবী সংগ্রামের উচ্চতম পযার্য়ে রাশিয়ায় রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে নিল শ্রমিকশ্রেণি , ক্ষমতা দখলের শ্রমিকগণঅভ্যুথ্থানে লিপ্ত হল জামার্নিতে এবং পুঁজিব্যবস্থার ভিতকেই সজোরে কাঁপিয়ে দিল ইতালি ,অস্ট্রিয়া এবং হাঙ্গেরীতে । স্পেন , গ্রেট ব্রিটেন , উত্তর ও দক্ষিন আমেরিকা এবং অন্যান্য জায়গায় তীব্র ও তিক্ত শ্রেণী সংগ্রামের রূপে আত্মপ্রকাশ করল এই বিপ্লবী ঢেউ যদিও তার জোর ছিল কিছুটা কম । আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একের পর এক দেশে হেরে যাওয়ার পর ১৯২৭ সালে চীনের সাংহাই ও ক্যান্টনে শ্রমিক অভ্যুথ্থান পরযুদস্ত ও চূর্ণ -বিচূর্ণ হয়ে গেল আর এই ভাবে চূড়ান্তরূপে সূচিত হল এই বিশ্ব বিপ্লবী জোয়ারের শোচনীয় পরাজয় ও ব্যর্থতা । এইজন্যই রাশিয়ার ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবকে ‘বুজোর্য়া', ‘রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী'(State Capitalism) , ‘দ্বৈত'(dual) , অথবা ‘স্থায়ী'(permanent)বিপ্লব হিসেবে নয় , এই বিশাল বিশ্বজোড়া শ্রেণী সংগ্রামের  উচ্চতম রূপ ও সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশ হিসেবেই শুধু সঠিক ভাবে অনুধাবন করা যায় । বুজোর্য়ারা নিজেরা ‘বুজোর্য়া গণতান্ত্রিক' কর্তব্যগুলো সম্পন্ন করতে আপারগ হয়ে পড়ায়, প্রথমোক্তভাবে এই বিপ্লবকে বোঝার বা প্রতিষ্ঠিত করার অর্থই হল শ্রমিকশ্রেণীকে কোন না কোন ভাবে এইসব করতে বাধ্য করা ।

১৯১৯ সালে তৃতীয় আন্তর্জাতিক বা কমিউনিয্ট আন্তর্জাতিকের সৃষ্টি একই ভাবে এই বিপ্লবী জোয়ারের অংশ হিসাবেই হয়েছিল । কমিউনিষ্ট আন্তজার্তিক দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের পার্টিগুলো থেকে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক পার্টিগুলো বিচ্ছিন্নতা ঘোষণা করল । সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে অংশগ্রহণ, এইসব পার্টির বুজোর্য়া শিবিরে যো্দানের ব্যাপারটাকে একদম স্পষ্ট করে দিল । ‘সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে গৃহযদ্ধে পরিণত করুন', ‘পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে ফেলুন' এবং ‘সোভিয়াতের হাতে সমস্ত ক্ষমতা' এইসমস্ত স্লোগানের মাধ্যমে প্রতিফলিত সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ ও তৃতীয় আন্তর্জাতিক সংগঠিত করার প্রক্রিয়ায় নির্ণায়ক ভূমিকা পালন ক'রে বলশেভিক পার্টি এই বিপ্লবী কর্মকান্ডে মৌলিক অবদানই শুধু রাখল না , সেই বৈপ্লবিক কালে সারা দুনিয়ার শ্রমিকশ্রেণীর সত্যিকার অগ্রগামী বাহিনীতে পরিণত হল। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ছেড়ে বেরিয়ে আসা বিপ্লবী বামের(revolutionary Left) অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই এই অগ্রগামী ভূমিকা পালন করল বলশেভিক পার্টি । 

রাশিয়ার বিপ্লব ও তৃতীয় আন্তর্জাতিক উভয়েরই আধঃপতনের মূলে যদিও ছিল আসলে অন্যান্য দেশে বিপ্লবী অভ্যুথ্থানের শোচনীয় পরাজয় এবং বিপ্লবী জোয়ারের স্তিমিত ও নিঃশেষিত হয়ে পড়ার ঘটনা , এই আধঃপতনের প্রক্রিয়ায় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শ্রমিকশ্রেণীর পরাজয়ে বলশেভিক পার্টির ভূমিকাকে অনুধাবন করাও সমানভাবে জরুরি কারণ অন্যান্য সব পার্টির আপেক্ষিক দুবর্লতার জন্য তৃতীয় আন্তর্জাতিকে বলশেভিক পার্টিই হয়ে উঠেছিল নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দু । উদাহরণ হিসাবে ক্রন্সটাড্ট্ বিদ্রোহের (Kronstadt uprising) দমন এবং ( তৃতীয় আন্তর্জাতিকের বাম অংশের বিরোধিতা সত্ত্বেও ) ‘ইউনিয়ন গুলিকে জয় করা' (conquering the unions) , সংদীয় ব্যবস্থাকে বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপের উদ্দেশ্যে ব্যবহার' (Revolutionary Parliamentarism) এবং ‘সংযুক্ত মোর্চা'র (United Front) অবস্থানের সপক্ষে দাঁড়ানোর ফলে এই বিপ্লবী জোয়ারের পরিসমাপ্তিতে বলশেভিকের প্রভাব ও দায়িত্ব , এই জোয়ারের বিকাশের পরযায়ে তাদের অবদানের থেকে কোন অংশেই কম ছিল না ।

‘বাইরে থেকেই' শুধু নয় , ‘ভিতর থেকে'ও এবং বিশেষ ক'রে বলশেভিক পার্টি যে রাষ্ট্র কাঠামো গ'ড়ে তুলেছিল  এবং যার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল , খোদ রাশিয়াতেই প্রতিবিপ্লব  তার ভিতর থেকেই এগিয়ে এসেছে। ১৯১৭ সালের অক্টোবরে যেগুলো ছিল   সাংঘাতিক ভুলমাত্র এবং নতুন ঐতিহাসিক যুগে রাশিয়ার শ্রমিকশ্রেণীর এবং সারা দুনিয়ার শ্রমিক আন্দোলনের সচেতনতার অপরিপক্কতার আলোকে স্বাভাবিক ব'লে ব্যাখ্যা করা যেত , তখন থেকে সেগুলোই হয়ে উঠল প্রতিবিপ্লবের আবরণ ও মতাদর্শগত যৌক্তিকতা (ideological justification) এবং প্রতিবিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করল। যাই হোক রাশিয়ার বিপ্লবী অভ্যুথ্থানসহ এই বিশ্ব বিপ্লবী তরঙ্গপ্রবাহ এবং তৃতীয় আন্তর্জাতিক কে শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনের প্রকৃত ও যথাযথ অভিব্যক্তি রূপে   বিবেচনা করেই কেবল যুদ্ধ পরবর্তী বিপ্লবী জোয়ার ও রুশ বিপ্লবের নিম্নমুখী গতি , তৃতীয় আন্তর্জাতিক ও বলশেভিক পার্টির অধঃপতন এবং একটা পরযায়ে প্রতিবিপ্লবী ভূমিকা পালনের বিষয়টিকে সঠিক ভাবে অনুধাবন করা যায় । অন্য যেকোন ব্যাখ্যা শুধু বিভ্রান্তির জন্মই দিতে পারে আর এই বিভ্রান্তি কর্তব্য সম্পাদনের পথে বাধা সৃষ্টিই শুধু করবে । এইসব বিভ্রান্তির পক্ষধর সমস্ত রাজনৈতিক ধারার ক্ষেত্রেই এটা ঘটবে । 

শ্রেণীর এই বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে জীবনযাত্রার মানের বস্তুগত কোন উন্নতি না হলেও এগুলোর প্রকৃতির(nature) গভীর অধ্যয়ন ও অনুধাবন থেকে শুরু করেই কেবল প্রকৃত ও গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক অগ্রগতি ও স্পষ্টতা অজর্ন করা সম্ভব । বিশেষ শ্রমিকশ্রেণী কতৃর্ক ক্ষমতা দখলের একমাত্র উদাহরণ (১৮৭১ সালের প্যারী কমিউনের স্বল্পকালস্থায়ী এবং ১৯১৯ সালের বাভেরিয়া ও হাঙ্গেরীয় ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা ছাড়া ) হিসেবে , বিপ্লবী সংগ্রামের দুটো নির্ণায়ক বিষয় অনুধাবনের ক্ষেত্রে দারুন মূল্যবান অনেক শিক্ষা দিয়ে গেছে অক্টোবর বিপ্লব । সেই বিষয় দুটো হল : বিপ্লবের সারবস্তু (content of the revolution) এবং বিপ্লবীদের সংগঠনের প্রকৃতি (nature of the organization of revolutionaries) ।

শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব।

The Dictatorship of the Proletariat

পুঁজিবাদী সমাজের বিপ্লবাত্মক রূপান্তরের প্রাথমিক শর্ত  এবং প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে শ্রমিক শ্রেণীকে সারা পৃথিবী জুড়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে হবে অর্থাৎ প্রথমতঃ সারা দুনিয়ার সমস্ত বুজোর্য়া রাষ্ট্রযন্ত্রকে সম্পূণরূপে ধ্বংস করতে হবে ।  

রায্ট্রযন্ত্রের সাহায্যেই বুজোর্য়ারা সমাজের উপর আধিপত্য বজায় রাখে , বিশেযাধিকার ভোগ করে এবং অন্যান্য শ্রেণীর বিশেষ করে শ্রমিকশ্রেণির শোযণ চালায় বলে অবশ্যম্ভাবী রূপেই  এইসব কাজের উপযোগী করেই গড়ে তোলা হয়েছে এই যন্ত্রটিকে । আর তাই কোনরকম বিশেষাধিকার বজায় রাখা বা শোষণ চালাবার কোন প্রয়োজন নেই বলে শ্রমিক শ্রেণী এই রাষ্ট্রযন্ত্রটিকে ব্যবহার করতে পারেনা । এর তাৎপরয হচ্ছে এই যে , ‘সমাজতন্ত্রে পৌঁছনোর কোনো শান্তিপূর্ণ রাস্তা' নেই অল্পসংখ্যক শৌষকের বেশি বেশি সুপরিকল্পিত ,খোলাখুলি বা ভন্ডামিভরা হিংসার বিরুদ্ধে শ্রেণীহিংসারই ব্যবহার শুধু করতে পারে শ্রমিকশ্রেণী । ।

অর্থনৈতিক রূপান্তরের হাতিয়ার হসেবে শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্বের (অর্থাৎ যখন শ্রমিকশ্রেণীই হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকারী ) মূল কাজ হবে উৎপাদনের উপকরণ গুলোর সামাজিকীকরনের মাধ্যমে শোষকশ্রেণীকে দখলচ্যুত করা এবং সমস্ত উৎপাদনমূলক কাজকর্মে এই সামাজিকীকৃত ক্ষেত্রকে ক্রমাগত প্রসারিত করা । রাজনৈতিক ক্ষমতার উপর একচ্ছত্র অধিকারের ভিত্তিতে , মজুরিশ্রম(wage labour) ও পণ্য উৎপাদনের অবসান ও মানবসমাজের প্রয়োজন মেটাবার উদ্দেশ্যে পরিচালিত অর্থনৈতিক কর্মসূচি রূপায়নের মাধ্যমে , বুজোর্য়াদের রাজনৈতিক অর্থনীতির (political economy) বিরুদ্ধে আক্রমন চালাতে হবে শ্রমিকশ্রেণীকে । 

পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে উত্তরণের উৎক্রমণকালে (Period of transition) শ্রমিকশ্রেণী ছাড়াও অ-শোষক (non -exploiting) অন্যান্য শ্রেণি এবং সামাজিক স্তর থেকে যাবে । অর্থনীতির অ-সামাজিকীকৃত (non-socialized) ক্ষেত্রটাই হচ্ছে এদের টিকে থাকার ভিত্তি । সেজন্য সমাজব্যবস্থার মধ্যে পরস্পরবিরোধী অর্থনৈতিক স্বার্থের অনিবারয সংঘাতের প্রতিফলন ইসেবে তখন ও চলতে থাকবে শ্রেণীসংগ্রাম । এই পরিস্থিতি জন্ম দেবে একটি রাষ্ট্রের । এইসব দ্বন্দ্ব বিরোধ যাতে সমস্ত সমাজকেই ছিন্নভিন্ন ও ধ্বংস করতে না পারে , সেটা সুনিশ্চিত করাই হবে এর কাজ । কিন্তু সামাজিকীকৃত ক্ষেত্রের মধ্যে এইসব শ্রেণির সদস্যদের বেশি বেশি করে অর্ন্তভুক্তি এবং ফলে শ্রেণী গুলোর কখমাগত অদৃশ্য হয়ে পড়ার প্রক্রিয়া চলতে থাকে এবং শেষপরযন্ত শ্রেণী বিভাজনের সম্পূর্ণ অবলুপ্তি ঘটে  আর তারই সাথে শেষ হয়ে যেতে হবে স্বয়ং রাষ্ট্রকেও ।

ওয়াকারর্স কাউন্সিলের (worker's council) রূপই (form) হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্বের ঐতিহাসিকভাবে আবিষ্কৃত রূপ । এগুলো হল শ্রমিকদের সাধারণ সভা দ্বারা নিবার্চিত এবং যে কোন সময়ে প্রত্যাহারযোগ্য (revocable) প্রতিনিধিদের দিয়ে গঠিত ঐক্যমূলক (Unitary) , কেন্দ্রীয় পদ্ধতিতে পরিচালিত (centralized) , শ্রেণী ব্যাপী মজদুর পরিষদ (class wide assembly) । এইভাবে গোটা শ্রণীটা সত্যিকারের সামূহিক পদ্ধতিতে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে সমর্থ হয় । আস্ত্রশস্ত্রের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ শুধু কাউন্সিলগুলোর হাতেই থাকবে  আর এটাই হবে শ্রমিকশ্রেণির একচ্ছত্র রানৈতিক ক্ষমতার (exclusive political power) গ্যারান্টি । 

শ্রমিক সমুদায়ের সমগ্রটাই কেবল আর্থ-রাজনীতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে । সমাজের কমিউনিষ্ট রূপান্তর ঘটাতে হলে এটা অপরিহারয । এই জন্যই অতীতের বিপ্লবী শ্রেণীগুলির ক্রিয়াকলাপের বিপরীতে , বিপ্লবী অগ্রগামী বাহিনীসহ যেকোন সংখ্যালঘু অংশ বা প্রতিষ্ঠানের হাতে কোন নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ছেড়ে দিতে পারেনা শ্রমিকশ্রেণি । সংখ্যালঘু অগ্রগামী বাহিনী worker's council এর ভিতর সমস্ত কাজকর্মে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় সক্রিব অংশগ্রহণ করবে ঠিকই , কিন্তু এই অগ্রগামী সংগঠন বা কমিউনিষ্ট পার্টি কখনোই সমগ্র শ্রেণীর ঐক্যমূলক সংগঠন অর্থাৎ কাউন্সিলগুলোকে প্রতিস্থাপিত করতে পারেনা । শ্রমিকশ্রেণীর ঐতিহাসিক লক্ষ্য অর্জনের পথে এটা অপরিহারয ।  

একই ভাবে রাশিয়ার বিপ্লবের অভিজ্ঞতা , সংক্রমনকালীন পরযায়ে (period of transition) রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং শ্রমিকশ্রেনীর মধ্যেকার সম্পর্কের জটিলতা ও গুরুত্বের বিষয়টাকেও বেশ জোরালো ভাবে তুলে ধরেছে । আগামী দিনে শ্রমিকশ্রেণি এবং বিপ্লবীরা এই সমস্যাকে এড়িয়ে যেতে তো পারবেনই না বরং তার সমাধানের সমস্ত রকম চেষ্টাই তাঁদের অতি অবশ্যই করতে হবে । 

প্রলেতারীয় একনায়কত্বের অর্থ হচ্ছে , যে কোন বাহ্যিক শক্তির অধীনতা মেনে নেওয়ার ধারণা এবং শ্রমিকশ্রেণীর বিভিন্ন অংশের মধ্যে হিংসার সম্পর্কেরও সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান । সংক্রমনকালীন পরযায় জুড়ে , শ্রমিকশ্রেণীই হচ্ছে সমাজের একমাত্র বিপ্লবী শ্রেনী । শ্রেণী সচেতনতা এবং সংঘবদ্ধতাই (cohesion) হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্বকে কমিউনিজমের পরিণতির লক্ষ্যে নিয়ে যাবার অত্যাবশ্যক গ্যারান্টি।

The organization of revolutionaries

a. বিপ্লবীদের সংগঠন শ্রেণী সচেতনতা এবং সংগঠন (class consciousness and organization)

সচেতন এবং সংগঠিতরূপেই কেবল প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত যে কোন শ্রেণি কারযকর ভাবে সংগ্রাম চালাতে পারে । কোন নতুন সমাজব্যস্থার ধারক ও বাহক না হওয়া সত্ত্বেও ক্রীতদাস ও কৃষকদের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই এটা ঘটেছিল, সংগঠনের রূপ ও সচেতনতায় যতই অপূর্ণতা এবং বিচ্ছিন্নতাবোধ (alienation) থাকুন না কেন । কিন্তু সমাজের বিবর্তনের ফলে যে উৎপাদন সম্পর্ক অপরিহারয হয়ে ওঠে তার ধারক ও বাহক ঐতিহাসিক শ্রেণী গুলোর ক্ষেত্রে এটা আরো বেশি করে প্রযোজ্য ।এইসব ঐতিহাসিক শ্রেণির মধ্যে প্রলেতারিয়েতই হচ্ছে একমাত্র শ্রেণি , পুরনো সমাজের মধ্যে যে কোনরকম অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধিকারি নয় বা হতে পারেনা । এইজন্যই  প্রলেতারিয়েতের শ্রেণী সংগ্রামের ক্ষেত্রে সংগঠন এবং সচেতনতার  ভূমিকা আরো অনেক বেশি নির্ণায়ক (decisive) । 

বিপ্লবী সংগ্রাম পরিচালনা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলে রাখার জন্য শ্রমিকশ্রেণী worker's council- এর মত সংগঠনই সৃষ্টি করে । শ্রমিকশ্রেণীর সমস্ত সদস্যের সচেতন সক্রিয়তারই ফসল হল বিপ্লব  এবং বিপ্লবের মুহূর্তে সকলেই তারা এিসব সংগঠনের মধ্যে একতাবদ্ধ হয় । কিন্তু শ্রেণীর সচেতন হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা কোনভাবেই যুগপৎ (simultaneous) বা সমরূপ (homogeneous) নয় । শ্রেণী সংগ্রাম সাফল্য ও ব্যর্থতার অনেক আঁকাবাঁকা ঘুরপথের ভিতর দিয়েই বিকাশলাভ করে শ্রেণি সচেতনতা । শ্রমিকশ্রেণীকে বিভাগীয় (sectional) এবং জাতীয় (national)সমস্ত বিভাজনকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে । পুঁজিবাদী সমাজে এইসব বিভাজন খুবই ‘স্বাভাবিক' আর শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে এই বিভাজন গুলোকে স্থায়ী করে তোলার মধ্যেই আছে পুঁজিবাদের যাবতীয় স্বার্থ ।

b.বিপ্লবীদের ভূমিকা   (The role of revolutionaries)

সচেতন হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া অসমরূপ(heterogeneous) হওয়ায় শ্রমিকশ্রেণীর একটা অংশ অন্যদের থেকে আগে ‘প্রলেতারীয় আন্দোলনের এগিয়ে চলার পথ ,সামগ্রিক অবস্থা এবং সাধারণ চূড়ান্ত পরিণতি' (Communist Manifesto) সম্বন্ধে সুস্পষ্ট সচেতনতা অর্জন করেন । বিপ্লবীরা হচ্ছেন সচেতনতার দিক থেকে এগিয়ে থাকা শ্রমিকশ্রেণীর এই অংশেরই সদস্য । পুঁজিবাদী সমাজে ‘শাসকশ্রেণীর ধারণাগুলোরই প্রাধান্য বজায় থাকে' , আর তাই বিপ্লবীদের নিয়ে গঠিত শ্রমিকশ্রেণির অংশটা অবশ্যম্ভাবীরূপে সংখ্যালঘুই হয়ে থাকে । 

 শ্রেণীর ভিতর থেকে উদ্ভূত এবং সচেতন হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ার বাস্তব প্রতিফলন হিসাবে , এই প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভুমিকা পালন করেই কেবল , বিপ্লবী সত্তা বজায় রাখতে পারেন বিপ্লবীরা ।অলঙ্ঘনীয়ভাবে এই কর্তব্য সম্পন্ন করার জন্য বিপ্লবী সংগঠন :

  • শ্রমিকশ্রেণীর সমস্ত সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে এবং সবথেকে দৃঢ়চেতা এবং সচেতন লড়াকু যোদ্ধা হিসেবে নিজেদের স্বাতন্ত্র প্রতিপন্ন করেন বিপ্লবীরা ।
  • এই সব সংগ্রামের মধ্যে থেকে শ্রমিকশ্রেণীর সমস্ত অংশের সাধারণ স্বার্থ (general interests) এবং চূড়ান্ত লক্ষ্যের গুরুত্বকে সব সময় সক্রিয় ভাবে তুলে ধরে ।
  • সমস্ত শ্রেণীর সচেতনতা বিকাশের প্রক্রিয়ায় এই সক্রিয় অংশগ্রহণের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হীসেবে আরো বেশি তাত্ত্বিক স্বচ্ছতা ও গভীরতা অর্জন এবং বিচার বিশ্লেষণের কাজে সম্পূর্ণ আন্তরিকতাসহ স্থায়ী ভাবে আত্মনিয়োগ করে । এইভাবেই কেবল শ্রেণীর সমস্ত অতীত অভিজ্ঞতা এবং এই তাত্ত্বিক কাজের দ্বারা নির্ধারিত সংগ্রামের ভবিষ্যৎ রূপরেখার উপর ভিত্তি করে , সাধারণ ক্রিয়াকলাপ সঞ্চারিত করা সম্ভব হবে । বিপ্লবী রাজনৈতিক সংগঠনের সবথেকে বিকশিত রূপ হল পার্টি । ঐতিহাসিক ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সচেতনতার বিকাশ , সেই ভবিষ্যতের লক্ষ্যে সংগ্রাম গুলির রাজনেতিক দিশা নির্ধারণের প্রয়োজনীয় অঙ্গ হিসেবে শ্রমিকশ্রেণী সৃষ্টি করেছে এই বিপ্লবী রাজনৈতিক সংগঠন । এইজন্যই পার্টির অস্তিত্ব ও ক্রিয়াকলাপ শ্রমিকশ্রেণির চুড়ান্ত বিজয়ের অপরিহারয পূর্বশর্ত হয়ে ওঠে ।

c. শ্রমিকশ্রেণী এবং বিপ্লবীদের সংগঠনের মধ্যেকার সম্পর্ক (The relationship between the class and the organization of the revolutionaries)   

শ্রমিকশ্রেণীর সাধারণ সংগঠন (general organization) এবং বিপ্লবীদের সংগঠন একই আন্দোলনের অংশ , কিন্তু দুইয়ের মধ্যেকার পার্থক্য বেশ স্পষ্ট (distinct)।

প্রথমটি অর্থাৎ কাউন্সিলগুলো (councils) গোটা শ্রেণীটাকে ঐক্যবদ্ধ করে । শ্রমিকমাত্রই এগুলোর অন্তভুর্ক্ত হতে পারেন ।

পক্ষান্তরে দ্বিতীয়টি অর্থাৎ বিপ্লবী সংগঠন শ্রেণীর বিপ্লবী সদস্যগণকেই কেবল জোটবদ্ধ বা ঐক্যবদ্ধ করে । সদস্যতার মাপকাঠি সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক ;সমাজবিদ্যাগত(sociological) মাপকাঠি  আর কোনমতেই খাটেনা অর্থাৎ শ্রমিক হলেই শুধু সদস্য হওয়া যায় না । কর্মসূচির সমর্থন ও স্বপক্ষে দাঁড়ানোর অঙ্গীকারবদ্ধতাই হচ্ছে সদস্যতার মাপকাঠি । এই কারণেই সমাজবিদ্যাগত ভাবে শ্রমিকশ্রেণীর অংশ নন এমন ব্যক্তিরাও শ্রমিকশ্রেণীর অগ্রগামী বাহিনীর (vanguard) অন্তভুর্ক্ত হতে পারেন । এইসব ব্যক্তি নিজেদের শ্রেণীর সঙ্গে সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে প্রলেতারিয়েতের ঐতিহাসিক শ্রেণী স্বার্থের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠেন ।

অগ্রগামী বাহিনীর সংগঠন এবং সমগ্র শ্রমিকশ্রেণী পরস্পরের থেকে সুস্পষ্ট রূপে পৃথক হওয়া সত্ত্বেও তারা কখনোই পরস্পর বিচ্ছিন্ন , বহিরাগত বা বিরোধী নয়  যদিও একদিকে ‘Leninist' ও অন্যদিকে ‘ouvrierist-councilist' ধারার প্রবক্তারা সম্পূর্ণ বিপরীতটাই দাবী করে থাকেন । পরস্পরের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হওয়া তো দূরের কথা , সমগ্র ও সমগ্রের অংশ হিসেবে শপমিকশ্রেণি ও বিপ্লবীরা পরস্পরের প্রকৃত পরিপূরক । ওই উভয় ধরনের প্রবক্তারাই অস্বীকার করেন এই সত্যকে । কমিউনিষ্টদের কাছে ‘প্রলেতারিয়েতের সমস্ত অংশের সাধারণ স্বার্থ ছাড়া অন্য কোন আলাদা স্বার্থ নেই' (Communist Manifesto) বলে , অগ্রগামী বাহিনী ও শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে কোনোরকম বলপ্রয়োগের সম্পর্ক কখনোই থাকতে পারে না ।

শ্রেণীর একটা অংশ হিসেবে বিপ্লবীরা কখনোই সমগ্র শ্রেণীর বদলে নিজেদেরকে প্রতিস্থাপিত(substitute) করতে পারে না । পুঁজিবাদী কাঠামোর মধ্যে সংগ্রামের ক্ষেত্রে এটা যেমন প্রযোজ্য , পুঁজিবাদের উৎখাৎ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলে রাখার ক্ষেত্রে এটা আরো বেশি করে প্রযোজ্য । সংখ্যালঘু অংশের সচেতনতা যতই বিকশিত ও উন্নত হোক না কেন , প্রলেতারিয়েতের কর্তব্যগুলো সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে তা যথেষ্ট নয় । অন্যান্য ঐতিহাসিক শ্রেণীর ক্ষেত্রে কিম্তু এমনটা ছিলনা । সৃজনধর্মী ক্রিয়াকলাপ ও অন্যান্য যাবতীয় কাজকর্মে সমগ্র শ্রেণির সমস্ত সদস্যের সব সময় সক্রিয় অংশগ্রহণ , এইসব কর্তব্য সম্পাদনের জন্য অপরিহারয ।

সমগ্র শ্রেণী ব্যাপী শ্রেণী সচেতনতার বিকাশ(generalized consciousness) ই হচ্ছে প্রলেতারীয় বিপ্লবের একমাত্র গ্যারান্টি আর এটা আসলে বাস্তব অভিজ্ঞতারই ফল হওয়ায় , বিপ্লবের যাবতীয় ক্রিয়াকলাপে শ্রেণীর সব অংশেরই সক্রিয় অংশগ্রহণের কোনো ও বিকল্প নেই । বিশেষ করে , প্রয়োজনে হিংসাত্মক ক্রিয়াকলাপের সাহায্য নেওয়ার বিষয়টিকে শ্রেণীর সাধারণ সংগ্রাম (general movement) বা আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না । এইজন্যই ব্যক্তিগত বা বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীগত উদ্যোগে পরিচালিত সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণির নিজস্ব পদ্ধতির কোনরকম সম্পর্ক বা সাদৃশ্য নেই । বুজোর্য়া গোষ্ঠীগুলোর (fractions) মধ্যেকার কুৎসিৎ নগ্ন রেষারেষি ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের স্পষ্ট অভিব্যক্তি না হয়ে থাকলে , এটা বড়জোর পেটি বুজোর্য়া অধৈয ও হতাশার প্রকাশমাত্রই হতে পারে । শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামের মধ্যেই এর আবির্ভাব , শ্রেণীর বাইরেকার অর্থাৎ বুজোর্য়া বা পেটি বুজোর্য়া প্রভাবগুলোকেই সূচিত করে এবং শ্রেণী সচেতনতা বিকাশের ভিত্তিকেই কেবল দুর্বল করে থাকে ।

শ্রমিক সংগ্রামের স্ব - সংগঠন (self-organization) এবং শ্রেণির সমস্ত অংশের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রয়োগ এবং নিয়ন্ত্রণ কমিউনিজমে পৌঁছনোর অনেক পরস্পর তুলনীয় রাস্তার মধ্যে একটামাত্র রাস্তা শুধু নয় , এটা হল একমাত্র রাস্তা

d. শ্রমিকশ্রেণীর স্বাতন্ত্র‌ (The autonomy of the working class  )

প্রতিস্থাপনার চিন্তাভাবনার (Substitutionist conception) বিপরীতে ouvrierist(ওয়ার্কারিস্ট) এবং anarchist(নৈরাজ্যবাদী) ধারার প্রবক্তারা ‘শ্রেণী স্বাতন্ত্রের' (class autonomy) যে ধারণা ব্যবহার করে থাকে , তার তাৎপরয সম্পূর্ণরূপে প্রতিক্রিয়াশীল ও পেটিবুজোর্য়া। এদের এই ‘স্বাতন্ত্র' (autonomy) প্রায়ই ক্ষুদ্র গোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের ‘স্বাতন্ত্রের' ই নামান্তর মাত্র হয়ে থাকে । প্রতিস্থাপনার প্রবক্তাদের ঘোরতর বিরোধিতা করেও , তাদের মতোই শ্রমিকশ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করার দাবী করে এরা । এসব ছাড়াও এদের এই ধারণার দুটো প্রধান দিক বা তাৎপরয আছে :

  • শ্রমিকদের দ্বারা যে কোন ধরনের রাজনৈতিক পার্টি বা সংগঠনের সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান ।
  • অন্যান্য অংশের সঙ্গে সম্পর্কের পরিপ্রক্ষিতে শ্রমিকশ্রেণীর প্রতিটি অংশের (কারখানা , পারিপার্শ্বিক এলাকা ,অঞ্চল , জাতিরাষ্ট্র ইত্যাদি ) স্বাতন্ত্র যার অর্থ হল federalism বা বিকেন্দ্রীবূত অবস্থা ।

আজকের দিনে এইসব ধারণা সবথেকে ভালো হলে , বড় জোর Stalinist আমলাতন্ত্র এবং সবর্শক্তিমান,সর্বগ্রাসী শাসনতন্ত্র বা রাষ্ট্রযন্ত্র বিকাশের বিরুদ্ধে প্রাথমিক ধরণের প্রতিক্রিয়ামাত্র হতে পারে আর সবথেকে খারাপ হলে , পেটি বুজোর্য়াদের বৈশিষ্ট্যসূচক বিচ্ছিন্নতাবোধ বা বিভাজিত অবস্থার রাজনেতিক অভিব্যক্তিই হয়ে থাকে । কিন্তু এই দুটোই প্রলেতারিয়েতের বিপ্লবী সংগ্রামের তিনটি মৌলিক দিক বা তাৎপরযের উপলব্ধির সম্পূর্ণ অভাবকেই সূচিত করে :

  • শ্রেণীর রাজনৈতিক কর্তব্যগুলোর (বুজোর্য়া রাষ্ট্র ব্যবস্থার ধ্বংসসাধন ,প্রলেতারিয়েতের বিশ্বব্যাপী একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা ) গুরুত্ব এবং অগ্রাধিকার ।
  • শ্রেণীর ভিতর বিপ্লবীদের সংগঠনের গুরুত্ব এবং অপরিআরযতা ।
  • শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী সংগ্রামের ঐক্যমূলক (Unitary) , কেন্দ্রীভূত(centralized) এবং বিশ্বব্যাপী চরিত্র ।

মার্কসবাদী হিসেবে , আমাদের কাছে শ্রেণী স্বাতন্ত্রের অর্থ হল সমাজের অন্যান্য শ্রেণী থেকে শ্রমিকশ্রেণীর স্বতন্ত্রতা বা স্বাধীনতা (independence) । আজকের দিনে প্রলেতারিয়েতইেকমাত্র বিপ্লবী শ্রেণী হওয়ায় , বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপের জন্য এই স্বাতন্ত্র অপরিহারয পূবর্শর্ত INDISPENSABLE PRECONDITION হয়ে উঠেছে । সাংগঠনিক (কাউন্সিলগুলোর সংগঠন, The organization of the councils)এবং রাজনৈতিক উভয়স্তরেই এই স্বতন্ত্রতার অভিব্যক্তি ঘটে আর প্রলেতারিয়েতের কমিউনিষ্ট অগ্রগামী বাহিনী বা vanguardএর সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্কের ভিত্তিতেই এটা ঘটে । ouvrierist ধারার প্রবক্তাদের ঘোষণার তাই এটা বিপরীত।

e.শ্রেণী সংগ্রামের বিভিন্ন মুহূর্তে বিপ্লবীদের সংগঠন (The organization of revolutionaries in the different moments of the class struggle) 

কাজকর্মের বিচারের ভিত্তিতে শ্রমিকশ্রেণীর সংগঠন(general organization) এবং বিপ্লবীদের সংগঠন যেমন পরস্পর পৃথক তেমনি তাদের উদ্ভবের পরিস্থিতিও পৃথক । পুঁজিবাদী পুরো ব্যবস্থাটারই বিরুদ্ধে বিপ্লবী চ্যালেঞ্জের সময়ই কেবল   কাউন্সিলগুলোর (worker's council) আবির্ভাব ঘটে যখন শ্রেণীর সমস্ত সংগ্রামই রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যাভিমুখে চালিত হয় । কিন্তু শ্রেণী সচেতনতা বিকাশের জন্য শ্রেণীর সক্রিয় প্রচেষ্টার কোনও বিরাম নেই , জন্মলগ্ন থেকেই চলছে সেই প্রচেষ্টা আর চলতেও থাকবে যতক্ষণ না কমিউনিষ্ট সমাজের মধ্যে পৃথক একটা শ্রেণী হিসেবে অবলুপ্তি ঘটেছে তার । এই বিরামহীন প্রচেষ্টার মূর্ত প্রকাশ হিসেবে কমিউনিষ্ট সংখ্যালঘু অংশের অস্তিত্ব সবসময়ই তাই থেকে গেছে শ্রেণীর মধ্যে । কিন্তু এই সংখ্যালঘু অংশের উদ্দেশ্য , প্রভাব , ক্রিয়াকলাপের পরিধি , পদ্ধতি , নীতি এবং সংগঠনের ধরনধারন ইত্যাদি সবকিছুই শ্রেণীসংগ্রামের সামগ্রিক অবস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্কে আবদ্ধ। 

শ্রেণীর সংগ্রামী ক্রিয়াকলাপ তীব্র রূপ ধারন করার পরযায়ে , ঘটনার বাস্তব গতিপ্রকৃতির উপর সরাসরি   (direct) প্রভাব থাকে এই সংখ্যালঘু অংশের । কমিউনিষ্ট vanguard-এর সংগঠনকে সেই সময় পার্টি নামে অভিহিত করা যেতে পারে । অন্যদিকে , পরাজয় বা শ্রেণী সংগ্রামে ভাঁটার পরযায়ে , ইতিহাসের তাৎক্ষনিক গতিপ্রকৃতির উপর বিপ্লবীদের আর কোন প্রত্যক্ষ প্রভাব থাকে না । এই প্রতিবিপ্লবী পরযায়ে [শ্রেণী সহযোগিতা , (Class collaboration) , ‘Union sacrees' , ‘প্রতিরোধ সংগ্রাম' (resistance), ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা'(‘Anti-Fascism') ,ইত্যাদির মাধ্যমে ]শ্রমিকশ্রেণীকে নিরস্ত্র ও নিজেদের পক্ষে সমাবেশিত করার বুজোর্য়া তৎপরতার সময় শ্রমিকশ্রেণীর সংগঠন হিসেবে বেশ ক্ষুদ্রতর আকারের সংগঠনমাত্রই কেবল থাকতে পারে । তাৎক্ষনিক আন্দোলন বা ঘটনার গতিপ্রকৃতিকে প্রভাবিত করার কোন কাজ আর তার থাকে না । তাকে প্রতিহত করাই অর্থাৎ (প্রতিবিপ্লবী)স্রোতের বিপরীতে দৃঢ়ভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়াই তার একমাত্র কাজ হয়ে ওঠে । শ্রেণীর পূর্বের অভিজ্ঞতার সারসংকলন ও শিক্ষাগুলোকে তুলে ধরা এবং এইভাবে শ্রমিকশ্রেণীর ভবিষ্যতের পার্টির জন্য অপরিহারয তাত্ত্বিক এবং কর্মসূচিগত কাঠামো নির্মাণই সেই সময় হয়ে ওঠে তার অত্যাবশ্যক কর্তব্য । শ্রমিকশ্রেণীর এই পার্টির পুনরাবির্ভাব অবশ্যম্ভাবী রূপেই ঘটবে  শ্রমিক সংগ্রামের পরবর্তী জোয়ারের পরযায়ে । পার্টির পুনরাবির্ভাবের সময় পযর্ন্ত রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক সেতুর ভূমিকা পালন করে সেই সব গ্রুপ এবং  fraction এর কর্তব্য হয়ে ওঠে , যারা শ্রেণী সংগ্রামের ভাঁটার সময় অধঃপতনের তলদেশে নিমজ্জমান পার্টি থেকে বিচ্ছেদ ঘটায় বা পার্টির অবলুপ্তির পরও টিকে থাকে ।

f.   বিপ্লবীদের সংগঠনের কাঠামো (The structure of the organization of revolutionaries)

প্রলেতারীয় বিপ্লবের চরিত্র অপরিহারযভাবে বিশ্বব্যাপী এবং কেন্দ্রীভূত (centralized) হওয়ায় , শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টিকেও অতি অবশ্যই বিশ্বব্যাপী এবং কেন্দ্রীভূত হতে হবে । এই পার্টির ভিত গড়ে তোলার কাজে নিযুক্ত fraction এবং গ্রুপ গুলোর মধ্যেও তাই অবশ্যম্ভাবীরূপেই বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রভবন (centralization)   বা কেন্দ্রিকরণের প্রবণতা দেখা যায় ।

পরপর দুটো মহাধিবেশন বা কংগ্রেসের অন্তবর্তীর্কালীন পরযায়ে রাজনৈতিক কাজকর্মের দায়িত্বসম্পন্ন কেন্দ্রীয় কমিতি বা সংস্থার অস্তিত্বের ভিতর দিয়েই বাস্তবায়িত হয় এই কেন্দ্রীভবন বা কেন্দ্রীকরণের সিদ্ধান্ত । কেন্দ্রীয় কমিটি বা সংস্থা কংগ্রেসের কাছে সমস্ত কাজকর্মের জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য । বিপ্লবীদের সাংগঠনিক কাঠামোর ক্ষেত্রে দুটো মৌলিক প্রয়োজনীয়তার বিষয়ের উপর গুরুত্ব অবশ্যই দিতে হবে ।

  • সংগঠনের মধ্যে বিপ্লবী সচেতনতার সম্ভাব্য সম্পূর্ণ বিকাশের পথকে সব সময়ই অবশ্যই উন্মুক্ত রাখতে হবে আর তাই non-monolithicসংগঠনে (অর্থাৎ যে সংগঠনে সবরকম মতবিরোধ ব্যক্ত করার অবাধ স্বাধীনতা থাকে ) স্বাভাবিকভাবে উঠে আসা সমস্ত প্রশ্ন ও মতবিরোধের উপর যথাসম্ভব বিস্তৃত ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিতর্ক ও আলোচনার পুরো সুযোগ দিতে হবে সংগঠনকে ।
  • একই সঙ্গে সংগঠনের সংঘবদ্ধতা (cohesion) এবং ক্রিয়াকলাপ বা action এর ক্ষেত্রে একতাকেও সুনিশ্চিত করতে হবে । এর অর্থ বিশেষ করে হল এই যে , সংগঠনের প্রতিটি অংশকে সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত অবশ্যই মেনে চলতে হবে ।
একইভাবে সংগঠনের বিভিন্ন অংশের এবং সদস্যদের মধ্যেকার সম্পর্কের উপর অবশ্যম্ভাবীরূপেই পুঁজিবাদী সমাজের দাগ বা প্রভাব থেকে যায় আর তাই পুঁজিবাদী সমাজের ঘেরাবন্দীর ভিতরে সংগঠন কমিউনিষ্ট সম্পর্কের একটা দ্বীপে পরিণত হতে পারে না । তা সত্ত্বেও এইসব সম্পর্ক কিন্তু বিপ্লবীদের লক্ষ্যের একেবারে ঘোর বিপরীতও হতে পারে না । এইসবের ভিত্তি অতি অবশ্যই হতে  হবে পারস্পরিক আস্থা ও সংহতি । কমিউনিজমের উদ্দেশ্য সাধনে ব্রতী শ্রমিকশ্রেণীর সংগঠনের সদস্যদের যোগ্যতা নিদের্শক বৈশিষ্ট্যই (Hallmarks) হচ্ছে এই পাস্পরিক আস্থা ও সংহতি ।