Communist Internationalist - 2020s

Communist Internationalist - 2020

Covid-19 pandemic: সর্বাত্মক পুঁজিবাদী বর্বরতা অথবা প্রলেতারিয় বিশ্ববিপ্লব

প্রতিদিন হাজারো মানুষ মারা যাচ্ছে। হাসপাতালগুলিতে নাভিশ্বাস অবস্থা। তারা ভয়ানক দ্বিধায় আছে যে, অসুস্থদের মধ্যে কে আগে চিকিৎসা পাবে, তরুণরা নাকি বৃদ্ধরা ? স্বাস্থ্যকর্মিরা নিজেরাই সংক্রমিত, অবসন্ন এবং মৃত্যুপথযাত্রী। সর্বত্রই চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব। প্রতিটি দেশের সরকার এখন ‘ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’, ‘জাতীয় অর্থনীতির স্বার্থ’ ইত্যাদির দোহাই দিয়ে নিজেদের মধ্যে মারাত্মক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। অর্থনৈতিক বাজার নিম্নমুখী। কোন দেশ কার মাস্ক চুরি করছে তাই নিয়ে আধিভৌতিক তরজা চলছে। ইতিমধ্যে দশ মিলিয়ন লোক বেকারত্বের নরকে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। সরকার এবং তার পোষা মিডিয়ার মিথ্যাচারের বন্যা অব্যাহত। এটাই হচ্ছে বর্তমান পৃথিবীর ভয়ানক হকিকত। ১৯১৮-১৯ সালের ভয়ানক স্প্যানিস ফ্লুর পরে সব থেকে ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্যসংকট এই করোনা মহামারী। যদিও সেই সময়ের থেকে আজকের বিজ্ঞান অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ রকম বিপর্যয় কেন? কীভাবে এমন ঘটলো?

আমাদেরকে বারেবারে এই কথাটা বলা হচ্ছে যে, এই ভাইরাসটি বিশেষ ধরণের। এর সংক্রমণের ক্ষমতা অন্যান্যদের চেয়ে অনেক বেশি এবং স্বভাবতই অনেক বেশি মারাত্মক। কথাটা সত্যি তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু বর্তমানের বিধ্বংসী রূপটাকে ব্যাখ্যা করার জন্য যথেষ্ট নয়। দুনিয়াজোড়া ধ্বংসের দায়িত্ব, হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর দায় এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত আছে। মানুষের প্রয়োজনের জন্য নয়, মুনাফার জন্যই উৎপাদন এবং শ্রমজীবী শ্রেণিকে অমানুষিক শোষণের বিনিময়ে সস্তা উৎপাদনের নিরন্তর খোঁজ, বঞ্চিত মানুষজনের জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান হিংসাত্মক আক্রমণ, দেশ এবং কোম্পানীদের মধ্যে লাগামছাড়া প্রতিযোগিতা- এইসবই হচ্ছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য, যেগুলো একত্রিত হয়ে উপহার দিয়েছে বর্তমান বিপর্যয়ের।

পুঁজিবাদের অপরাধযোগ্য অবহেলা

যারা এই সমাজব্যবস্থা চালায়, মানে বুর্জোয়া শ্রেণি এবং তার পেটোয়া রাষ্ট্রযন্ত্র ও পোষা মিডিয়া আমাদেরকে বারংবার এত্তেলা করে যে এই মাহামারী খুবই অনভিপ্রেত। সাধারণত দূষণাভিমুখী জলবায়ূ পরিবর্তনের জন্য ওরা যে মিথ্যা বলে অনেকটা সেই রকমই। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে কোভিড-১৯ এর মত অতিমারীর কথা বলে আসছেন। কিন্তু সরকার সবসময়ই সেসব শুনতে অস্বীকার করেছে। এমনকি তারা ২০০৯ সালের CIA এর রিপোর্টকেও পাত্তা দেয় নি, যেখানে পরিষ্কার করে বর্তমান অতিমারির ভয়ানক চরিত্রের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। প্রশ্ন হলো, বুর্জোয়া সমাজ এবং রাষ্ট্র কেন এরকম অন্ধের মত আচরণ করে? এটা তারা করে খুবই সাধারণ কারণের জন্য। পুজিবাদের সাধারণ ধর্ম মুনাফার জন্য বিনিয়োগ এবং সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেই মুনাফা অর্জন। আগামীকালের মানবসমাজের জন্য বিনিয়োগ মোটেই লাভজনক নয়, বরং সেটা শেয়ার বাজারের মূল্যের পতন ঘটায়। তাই সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বপরিস্থিতিতে জাতীয় বুর্জোয়াদের স্বার্থরক্ষার জন্যই যাবতীয় বিনিয়োগের পরিকল্পনা গ্রহণ করে তারা। আমরা জানি, মিলিটারি এবং প্রতিরক্ষা গবেষণার জন্য পাগলের মত খরচ না করে জনস্বাস্থ্যে এবং জনকল্যাণে যদি খরচ করা হতো তাহলে এই অতিমারী কখনো গড়ে উঠতো না। কিন্তু এই সম্ভাব্য স্বাস্থ্য-সংকটের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে সরকার সবসময় স্বাস্থ্যব্যবস্থাকেই আক্রমণ করেছে। এই আক্রমণ দুই দিক থেকেই,- গবেষণার মান ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সরবরাহকৃত প্রযুক্তি ও পরিকাঠামো।

আজ যদি উন্নত বিশ্বের মধ্যমণি রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিক মাছির মত মারা যায় তার প্রধানতম কারণ হচ্ছে রোগ-প্রতিরোধ গবেষণার ক্ষেত্রে আর্থিক বরাদ্দ কমানো। সেইজন্য ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প জাতীয় সুরক্ষা পরিষদ ভেঙে দেন, যেটা অতিমারী আটকানোর জন্য বিশিষ্ট দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প নতুন কিছুই করেন নি। যুগ যুগ ধরে রাষ্ট্রনেতারা যা করে এসেছেন সেটা তারই অনুকরণমাত্র। সেইজন্য করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত যাবতীয় গবেষণা গত পনেরো বছর আগেই সর্বত্র বন্ধ হয়ে গিয়েছে, কারণ এর ভ্যাকসিন দামে পোষাবে না।

একইভাবে সেই সব হাসপাতালগুলির দুরবস্থা এবং সর্বনাশা চিত্র দেখে বাম-ডান সব ধরণের বুর্জোয়া নেতা এবং রাজনীতিবিদদের ন্যাক্কারজন নাকি ক্কান্না খুবই বিরক্তিকর যেখানে স্বাস্থ্যকর্মিদের বাধ্য হয়ে সেখানে কাজে যেতে হয় এবং যেখানে বুর্জোয়া সরকার খুব পরিকল্পনামাফিক গত পঞ্চাশ বছরে এগুলিকে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত করেছে, বিশেষ করে এটা ঘটেছে ২০০৮ সালের মহামন্দার পর থেকে। সর্বত্রই স্বাস্থ্য-পরিষেবা সংকুচিত করা হয়েছে। হাসপাতালের বেড সংখ্যা কমানো হয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মিদের কাজের চাপ প্রচুর বাড়ানো হয়েছে। তার ফলে এখন আমরা কী দেখছি, মাস্ক, প্রোটেক্টিভ ড্রেস, জীবানুনাশক টেস্টিং কিটের সর্বত্রগামী হাহাকার, বেশ কিছু বছর থেকেই প্রায় সমস্ত দেশই এই সব রক্ষাকারী অতিপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মজুত কমিয়ে এনেছে শুধুমাত্র খরচ বাঁচানোর জন্য। গত কয়েকমাস আগেও তারা COVID-19 এর দ্রুত অতিসংক্রমণ আন্দাজ করতে পারে নি। এমন কি গত নভেম্বর,২০১৯ থেকে তারা নিজেদের অপরাধজনক দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আড়াল করার জন্য এটা প্রচার করছে যে যারা বাহক নয় তাদের ক্ষেত্রে মাস্কের কোন প্রয়োজন নেই। আর পৃথিবীর ধারাবাহিকভাবে অবহেলিত মহাদেশ আফ্রিকা অথবা লাতিন আমেরিকার ক্ষেত্রে হিসেবটা কেমন? কঙ্গোর কিনসায় ১০ মিলিয়ন মানুষের জন্য ৫০ টি ভেন্টিলেটর! মধ্য আফ্রিকায় যেখানে খাবার জল নেই সেখানে হাত ধোয়ার পদ্ধতি সম্বলিত লিফলেট বিলি হচ্ছে। সর্বত্রই একই পীড়াদায়ক কান্না,- “আমরা অতিমারির মুখে নিতান্তই অসহায়”!

পুঁজিবাদ হলো সকলের বিরুদ্ধে প্রত্যেকের লড়াই

প্রতিটি দেশের মধ্যে ভয়ানক বৈরীতার পরিবেশ এই ভাইরাসকে আটকানোর জন্য যে ন্যূনতম পারস্পরিক সহযোগিতা প্রয়োজন তার প্রতিবন্ধক। যখন এটা শুরু হল, চীনা বুর্জোয়া নিজের অর্থনীতি এবং মর্যাদা রক্ষার জন্য এর ভয়াবহতা লুকোনোর জন্য সবিশেষ গুরুত্ব দিলো। যে ডাক্তার এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সজাগ করতে চেয়েছিল রাষ্ট্র তাকে শাস্তি দিতে দ্বিধা করে নি। শুধু তাই নয়, তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। এমনকি এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য যে আন্তর্জাতিক সাধারণ সমন্বয় নীতি বুর্জোয়া গোষ্ঠি গঠণ করেছিল সরঞ্জামের অপ্রতুলতার জন্য তা ভেঙে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা নির্দেশিকা দিতে অক্ষম আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন কোনো মিলিত পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ। এই বিভাজনই লক্ষণীয়ভাবে বিশৃঙ্খলা বাড়তে দিয়েছে এবং অতিমারীর উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। “প্রতিটি মানুষ নিজের জন্য” – এই তত্ত্ব এবং সাধারণ প্রতিযোগিতার তীব্রতাই শাসক শ্রেণীর প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু ‘মাস্কের জন্য লড়াই’ এর একটা জলজ্যান্ত উদাহরণ। প্রতিটি দেশই ফাটকা খেলে, যুদ্ধকালীন আদেশে এমনকি চুরিচাপাটি করে জিনিসপত্র দখল করছে। আমেরিকা ফ্রান্সের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ চীনা মাস্কভর্তি প্লেন আটক করছে, ফ্রান্স আবার সুইডেনগামী মাস্কের জাহাজ বাজেয়াপ্ত করেছে, চেক-প্রজাতন্ত্র তার নিয়ন্ত্রণরেখায় ইটালীগামী ভেন্টিলেটর এবং মাস্ক আটক করে নিয়েছে, জার্মানী কানাডার জন্য যে মাস্ক তৈরি করেছিল তা অদৃশ্য হয়ে গেছে । এই হচ্ছে ‘মহান গণতন্ত্রের’ আসলি চেহেরা যা নিকৃষ্টতম চোর এবং গুন্ডা ছাড়া অন্য কিছু নয়।

শোষিতের উপর অভাবনীয় আক্রমণ

‘বুর্জোয়াদের কাছে আমাদের জীবনের চেয়ে মুনাফা দামী” এই সত্য ইটালিতে ধর্মঘটী গাড়ি-শ্রমিকেরা চিৎকার করে জানিয়ে দিচ্ছে। সমস্ত দেশই যে কোন মূল্যে নিজেদের জাতীয় উৎপাদন চালু রাখার জন্য দেশের জনগণকে অবরুদ্ধ করে সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে যতটা গড়িমসি করা যায় ততটাই করছে। বল্গাহীনভাবে বেড়ে চলা মৃত্যু মিছিলের ভয় লকডাউনের দিকে চালিত করে নি। অনেক সাম্রাজ্যবাদী ধ্বংসলীলা শতাব্দী ধরে চলছে। জাতীয় স্বার্থ রক্ষার অজুহাতে যুদ্ধলীলা, নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেছে শোষিতশ্রেণির জীবনের প্রতি শাসক সম্প্রদায়ের নিদারুণ অবজ্ঞা। আমাদের শাসক আমাদের জীবনের তোয়াক্কা করে না। বিশেষতঃ যখন ভাইরাসের যুতসই অজুহাত আছে। বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গিতে অসুস্থ এবং বৃদ্ধলোকেদের মেরে ফেলাই উচিত। কারণ তারা অ-উৎপাদনশীল। এখন দেখছি হার্ড-ইমিউনিটির নামে ভাইরাসকে ছড়িয়ে পড়তে দেওয়া এবং তার ‘স্বাভাবিক’ কাজ করতে দেওয়া বরিস জনসন এবং অন্যান্য নেতার প্রাথমিক পছন্দ ছিলো। প্রতিটি দেশই অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার ভয়ে লকডাউনের দিকে ঝুঁকলো। কিছু দেশে ধারাবাহিক অবহেলার বিরুদ্ধে জমে ওঠা ক্ষোভ এবং ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর সংখ্যা থেকে উদ্ভূত সামাজিক বিশৃঙ্খলার ভয়ে এই লকডাউন কার্যকর হলো। এইভাবে যদি তারা অর্ধেক লোকের ক্ষোভকেও ঠেকিয়ে রাখতে পারে। সামাজিক আইসোলেশন আসলে একটা সম্পূর্ণ ধাপ্পা। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ বাসে ট্রেনে টিউবে কারখানায় সুপার মার্কেটে একত্রিত হতে বাধ্য। ইতিমধ্যে বুর্জোয়ারা চাইছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লকডাউন তুলে দিতে। যখন অতিমারী মারাত্মক থাবা বসাচ্ছে তখনই তারা সেক্টরের পর সেক্টর ফার্মের পর ফার্মে অসন্তোষ সত্তেও শ্রমিকদের কাজে পাঠানোর ফন্দী আটছে।

বুর্জোয়া সম্প্রদায় শোষণের সব শর্ত বহাল রাখছে এবং তাকে আরো পাশবিক করে তোলার জন্য আক্রমণের নতুন পরিকল্পনা করছে। শুধুমাত্র আমেরিকাতেই প্রথম তিন সপ্তাহে দশ লক্ষ কর্মহীন, যাদের অনিয়মিত অথবা অস্থায়ী কাজ বন্ধ আছে তাদের অধিকাংশেরই কোনো উপার্জন থাকবে না। আর যাদের বেঁচে থাকার সামান্য সামাজিক সুবিধা আছে তারাও আর বেশিদিন বাড়িভাড়া কিংবা চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে পারবে না। সারা বিশ্বজুড়ে মন্দার পরিস্থিতি ও তার ফলে অর্থনৈতিক লুটপাটের পরিস্থিতি ত্বরান্বিত হতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবিষ্ফোরণ, প্রচুর ছাঁটাই, বেতন কাটা, ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি ভীতিজনক পরিস্থিতির সঞ্চার হয়েছে। প্রতিটি দেশই ‘ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের’ জন্য আত্মত্যাগের নমনীয় নীতি গ্রহণ করেছে।

বুর্জোয়াদের ডাকা জাতীয় স্বার্থ আজকে আমাদের স্বার্থ নয়। এটা জাতীয় অর্থনীতির সেই রক্ষাকবচ এবং বাজেটবরাদ্দ কমিয়ে শোষিতের জীবনধারণের মানকে তলানিতে নামিয়ে আনার পুরাতন সাধারণ কৌশল। আগামীকাল আমাদের এই মিথ্যেই খাওয়ানো হবে যে অর্থনীতির এই বেহাল দশা অতিমারীর জন্য। এতে করে শোষিতদের আরো বেশি করে কষে বাঁধা যাবে এবং তারা আরো দারিদ্র্য এবং বঞ্চনা মেনে নেবে। বর্তমান পচনশীল সমাজ, পরিবেশ নিধন, দূষণ, জলবায়ূ পরিবর্তন, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে এবং ধ্বংসের বিস্তার, অধিকাংশ মানুষের ক্রমবর্ধমান হারে অনিবার্য দারিদ্র্যের মধ্যে নিমজ্জিত হওয়া, অসংখ্য মানুষের পরিযায়ী বা রিফিউজি হয়ে উঠতে বাধ্য হয়ে যাওয়া, ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয় আদর্শবাদ, ধর্মান্ধতাবাদ ইত্যাদি নানাবিধ বৈশিষ্ট্যের মতোই এই অতিমারীও পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার অবক্ষয়িত অবস্থার একটা লক্ষ্মণমাত্র। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা যে তার শেষের দিনে পৌঁছে গেছে তা নিশ্চিত। এই ব্যবস্থা মানবসভ্যতাকে দারিদ্র্য, বর্বরতা, ধ্বংস এবং মৃত্যুর দিকে চালিত করছে।

শুধুমাত্র প্রলেতারিয়াতই পারে পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে

কিছু সরকার এবং তার মিডিয়া যুক্তি দিচ্ছে যে অতিমারীর পর পৃথিবী আর আগের মত থাকবে না। এই বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশগুলি আরো মানবিক এবং আরো ভালো পরিচালিত পুঁজিতন্ত্র হয়ে উঠবে। এই একই ধুয়ো আমরা ২০০৮ সালের পরেও শুনেছিলাম। রাষ্ট্রনেতারা বুকে হাত দিয়ে গোটা দুনিয়াকে জানিয়েছিলো,-“দুর্বৃত্ত অর্থনীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ”। প্রতিজ্ঞা করেছিল দুঃসময়ের আত্মত্যাগকে পুরস্কৃত করা হবে। শুধুমাত্র দুনিয়াজোড়া ক্রমবর্ধমান অসাম্যের দিকে নজর দিলেই বোঝা যাবে পুঁজিতন্ত্র “সংস্কারেরে” এইসব মিথ্যা বুলি শুধুমাত্র আমাদের জীবনযাত্রার নতুন অধঃপতিত মানকে হজম করানোর জন্য।

শোষকশ্রেণি পৃথিবীর পরিবর্তন আনতে পারে না এবং তারা কখনোই মানুষের জীবন ও সামাজিক চাহিদাকে তাদের নির্দয় অর্থনীতির নিয়মের উপরে রাখতে পারে না। পুঁজিতন্ত্র একটি শোষণভিত্তিক ব্যবস্থা যেখানে মুষ্টিমেয় শাসকগোষ্ঠি বৃহত্তর সম্প্রদায়ের শ্রম থেকে মুনাফা এবং সুবিধা ভোগ করে। আগামীর চাবি, অন্য পৃথিবীর প্রতিজ্ঞা, দেশ ও শোষণ ছাড়া সত্যিকারের মানবিক পৃথিবীর সম্ভাবনা শুধুমাত্র দুনিয়াজোড়া সংগ্রামরত শ্রমিকশ্রেণির ঐক্য এবং সংহতির উপর নির্ভরশীল।

স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর অসহ্য নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমাদের স্বতস্ফূর্ত সংহতির প্রবাহ সরকার এবং রাজনীতিবিদরা বিপথগামী করলো, ফলে সেটা দুনিয়াজুড়ে দরজা আর বারান্দা থেকে হাততালিতে পরিণত হলো। অবশ্যই এইসব হাততালি হয়ত সেইসব কর্মীদের হৃদয় উষ্ণ করবে যারা এই নাটকীয় কর্মপরিস্থিতিতে সাহস আর উৎসর্গীকৃত ইচ্ছায় ভর করে মানুষের সেবা করছে এবং প্রাণ বাঁচাচ্ছে। কিন্তু শোষিত শ্রেণির প্রতি আমাদের এই সংহতি শুধুমাত্র পাঁচমিনিটের হাততালিতে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। মোদ্দাকথা, রাজনৈতিক রঙ নিরপেক্ষভাবে দুনিয়াজোড়া সমস্ত সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের নিন্দায় সোচ্চারিত হতে হবে। অর্থাৎ, মাস্ক ও অন্যান্য রক্ষাকারি সরঞ্জামের দাবি জানাতে হবে, যখনই সম্ভব ধর্মঘট ক’রে নিশ্চিত করতে হবে যতদিন স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজেদের প্রয়োজন মত সরঞ্জাম পাবে না ততদিন তারা অনাবৃত মুখ নিয়ে মৃত্যুর মুখে নিক্ষিপ্ত হবে না আর যেসব শ্রমিক হাসপাতালের নয় তারা সেখানে কাজ করবে না।

আজ যখন লকডাউন লাগু আছে তখন আমরা এই হত্যাকারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বৃহত্তর আন্দোলন করতে পারবো না। আমরা সমবেত হয়ে সংগ্রাম ধর্মঘট বা প্রতিবাদ কর্মসূচির মাধ্যমে আমাদের রাগ কিংবা সংহতি কিছুই প্রকাশ করতে পারবো না। তার কারণ শুধুমাত্র লকডাউন নয়, পাশাপাশি আমাদেরকে আমাদের আসল শক্তির উৎস পুনরুদ্ধার করতে হবে। এই দৈত্যাকার ব্যবস্থা এবং শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে আমাদের সম্মিলিত লড়াই এবং বৃহত্তর আন্দোলনের রসদ যা আমরা অতীতে অনেকবার দেখিয়েছি কিন্তু ভুলে গেছি।

ইতালিতে গাড়ি শিল্প ধর্মঘট, কিংবা ফ্রান্সের সুপার মার্কেটে, নিউইয়র্কের হাসপাতালের সামনে, কিংবা উত্তর ফ্রান্সে শ্রমিকশ্রেণির যে যথেচ্ছ ধিক্কার, শুধুমাত্র শাসকের লাভের জন্য মাস্ক গ্লাভস সাবান ছাড়া পশুর পালের মত ‘ভাইরাসের খাদ্য’ হয়ে কাজ করতে অস্বীকার করা - এগুলো সব বিক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া এবং এগুলি সমগ্র শ্রমিকশ্রেণির শক্তিকে খন্ডিত করে। তবুও শ্রমিকশ্রেণি শাসকের এই দায়িত্বজ্ঞানহীন অপরাধ যে অবশ্যম্ভাবী তা মানতে রাজি নয় তা জানান দেয়।

শ্রেণিসংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হবার এই সেই পরিস্থিতি। কারণ COVID-19 এর পরে পৃথিবীজোড়া অর্থনৈতিক মন্দা, প্রচুর বেকারত্ব এবং আত্মত্যাগের নতুন “সংস্কার” শুরু হবে। তাই এক্ষুণি আমাদের আগামী সংগ্রামের জন্য তৈরি হতে হবে। কিন্তু কীভাবে? এটা হতে পারে বিভিন্ন ইন্টারনেট চ্যানেলে, ফোরাম্‌ ফোনে যথাসম্ভব বেশি ‘আলোচনা করে এবং অভিজ্ঞতা ও ধারণা বিনিময় করে’।

বুঝতে হবে COVID-19 নয়, পুঁজিতন্ত্রই আমাদের চরমতম শত্রু। রাষ্ট্রের পিছনে মিছিল করে নয়, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই আসল সমাধান। প্রত্যাশা ভন্ড রাজনীতিকদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে তৈরি হয় না, তৈরি হয় শ্রমিকশ্রেণির লড়াইয়ের ঐক্য নির্মাণে। পুঁজিবাদী বর্বরতার একমাত্র বিকল্প বিশ্ববিপ্লব!
 

আমাদের ভবিষ্যত শ্রেণিসংগ্রামের উপরই নির্ভর করছে!

ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিস্ট কারেন্ট

www.internationalism.org

Communist Internationalist - 2021

আমাদের কমরেড কিষণের প্রতি শ্রদ্ধা

২০২০ সালের ২৬ শে মার্চ সারা বিশ্ব যখন কোভিড ১৯ এ আক্রান্ত  তখনই কমরেড কিষণের মৃত্যুতে  আই. সি. সি  র সঙ্গে যুক্ত  সকলেই এক বেদনাঘন অবস্থার সম্মুখীন হলাম। তাঁর মৃত্যু 'আই সি সি ' র কাছে যেমন বিশাল ক্ষতি,  তেমনি ' আই. সি. সি' র ভারতীয় অংশের কাছেও সমান ক্ষতি । কিষণের অভাব আমরা  সবাই গভীর ভাবে অনুভব করব। আই সি সি র কর্মকান্ডে কিষণের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত  কিষণ ছিলেন একজন লড়াকু  যোদ্ধা ।

ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের এক গন্ডগ্রামে   ১৯৩৯ সালে কিষণ জন্মগ্রহণ করেন ।   ঊনিশ শতকের  ষাটের দশকে  কিষণ যখন  স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের জন্য উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করছে  ঠিক সেই সময়  দীর্ঘ বিরতির পর  শ্রমিক শ্রেণীর পুনরাবির্ভাব  হচ্ছে ১৯৬৮  সালে ফ্রান্সের নয় লক্ষ  শ্রমিকের  স্ট্রাইকে   অংশ গ্রহণের মাধ্যমে।    পরের বছর ১৯৬৯ সালের ঊষ্ণ শরতে ইটালীর শ্রমিকদের স্ট্রাইকে অংশ গ্রহণ এবং ১৯৭০সালে  পোলিস শ্রমিকদের স্ট্রাইকে অংশ গ্রহণের মধ্যে দিয়ে তা আরও তীব্রতর হচ্ছে ।এর অর্থই হচ্ছে প্রতিবিপ্লবী পর্বের  অন্তিম লগ্নের ঘোষণা মুখরিত হয়ে উঠছে। ঊনিশ শতকের ষাটের দশক সারা পৃথিবীর সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়  ছাত্রছাত্রী দের কাছে  প্রতিবাদের দশক। বিশেষ করে ভিয়েতনাম যুদ্ধ  ও জাতিবৈষম্যের বিরুদ্ধে তারা তৎপর হয়ে ওঠে। তাদের কাঙ্খিত বিপ্লবী পরিবর্তনের কাজ  যথেষ্ট   আন্তরিক ছিল  কিন্তু  'তৎক্ষণাৎ সমাজ পরিবর্তনের গোলকধাঁধায় তারা  মূলত পেটিবুর্জূয়া  শিবিরের হয়ে ই কাজ করেছিল। ১৯৬৮ সালের আগে বা পরে সারা পৃথিবীতে যে সব তথাকথিত 'বামপন্থী সংগঠণ’' অর্থাৎ বুর্জোয়া সংগঠণগুলি ছিল তারা যুব সম্প্রদায়কে শ্রমিকশ্রেণীর  স্বার্থরক্ষকের ভূমিকার  পরিবর্তে নিজেদের  স্বার্থ রক্ষার কাজে নিযুক্ত করতে  তৈরি ছিল। পৃথিবীব্যাপি এই অবস্থার মধ্যে কিষণও বিভ্রান্তির শিকার হয়  এবং নকশাল আন্দোলনে  ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৬৩-৬৫ সেশনে কিষণ উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্সের এম. এস সি র  ছাত্র ছিল।  মাস্টার্স  ডিগ্রিতে কিষণ ফিজিক্সে  ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয় ।  গবেষণার কাজে লিপ্ত থাকার সময়ই কিষণ   যুব সম্প্রদায়ের অংশ হিসেবে  নকশাল আন্দোলনের প্রতি  আকৃষ্ট হয়। ধীরে ধীরে নকশাল আন্দোলন আর  মাওবাদ সমার্থ হয়ে ওঠে। গবেষণার কাজ অসমাপ্ত রেখেই কিষণ   নকশাল আন্দোলনের ঘুর্নাবর্তে নিজেকে নিক্ষেপ করে। আর এর ফল হিসেবে   তাকে জেলে যেতে  হয়। দীর্ঘ আট বছর  পূর্ন মেয়াদের জেল খাটার পর ১৯৭৮ সালে কিষণ জেল থেকে  ছাড়া পায়।  জেলের অকথ্য অত্যাচারের ক্ষত তাকে জীবনের  শেষ দিন পর্যন্ত বয়ে বেড়াতে হয়েছে। জেলের  অপ্রশস্থ ও অস্বাস্থ্যকর     কুঠুরী  এবং  অপর্যাপ্ত ও কখনো কখনো অখাদ্য খাবারের কারণে তার টি. বি  হয়।  ফুসফুসের   এই সংক্রমণের   ক্ষত জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত  তার সর্বক্ষণের  সাথী  হয়ে থেকে গিয়েছিল। জেলে বসেই কিষণ কার্ল মার্ক্সের বিশেষ কিছু লেখা পড়েন।  পরবর্তী কালে   কম্যুনিস্ট  লেফট এর  সংস্পর্শে এলে এসব পড়াশোনাই তাকে  খোলামেলা  আলোচনায় অংশগ্রহণে সাহায্য করে। 

খুব কম সংখ্যক মানুষের মধ্যে কিষণ একজন ব্যক্তি, বামপন্থী বুর্জোয়া আদর্শেরই ব্যাধিপূর্ণ  উত্তরাধিকারি মাওবাদ  যাকে শুঁষে  নিলেও  সেখান থেকে যিনি নিজেকে  সম্পূর্ণ মুক্ত করে  কম্যুনিস্ট লেফট ধারার সংগে নিজেকে যুক্ত করে শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থে নিজের জীবন উৎসর্গ করে। এই উত্তরণের  জন্য   অনিবার্য রূপে তার সোপান  ছিল আশি ও নব্বইয়ের দশক জুড়ে গভীর ধৈর্য সহকারে  আই সি সি র  সঙ্গে  দীর্ঘ আলোচনার  মাধ্যমে   স্বচ্ছ ধারনা অর্জনের প্রক্রিয়া। এই  স্বচ্ছ ধারণা লাভের চলমান প্রক্রিয়া ই হয়ে ওঠে  ১৯৮৯ সালে  ভারতবর্ষের বুকে  প্রথম'  আই সি সি' র ভ্রূণ তৈরির   প্রধান  হাতিয়ার।    আই সি সি র সংগে যুক্ত হওয়ার পরই  কম্যুনিস্ট লেফট এর  আসল ইতিহাস কিষণ জানতে পারে। আই সি সি র সংগে দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে  কিষণ যখন বুঝতে পারে মাওবাদ হল বুর্জোয়া আদর্শেরই অন্য রূপ,    প্রতিবিপ্লবী  রাজনীতির  স্রোত , তখন সে চমকে  উঠেছিল। “মাওবাদ কোনভাবেই শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামের সাথে যুক্ত নয়, না তার  সচেতনতা না তার বৈপ্লবিক প্রতিষ্ঠানের সাথেমার্কসীয় ধারার সাথে এর কোনো সংযোগ নেই:  এটা না কোনো অভ্যন্তরীণ প্রবণতা, না সর্বহারার বৈপ্লবিক তত্ত্বের কোন অগ্রগমনপক্ষান্তরে বলা যায়, মাওবাদ মার্কসীয় ভাবধারার একটি স্থূল মিথ্যাকরনের প্রয়াস; এর এক   একমাত্র  লক্ষ্য হল প্রত্যেক বৈপ্লবিক নীতিকে সমূলে কবর দেওয়া, সর্বহারার শ্রেণিসচেতনতাকে বিভ্রান্ত করা এবং নিকৃষ্টতম নির্বুদ্ধিতা সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করা। ‘তত্ত্ব’ হিসাবে  মাওবাদ প্রতিবিপ্লব   সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের কালে ক্ষয়িষ্ণু বুর্জোয়া সম্প্রদায় দ্বারা  গৃহীত এক দুষ্ট অবলম্বন স্বরূপ”(১)। মাওবাদ সম্পর্কে আই সি সি র এই ব্যাখ্যা কমরেড কিষণের উপর দারুণ প্রভাব ফেলেছিল। কিষণের অতীত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার পূর্ণ সমালোচনা করার এই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তার একটি সত্যিকারের  বিপ্লবী সংগঠণের সহযোদ্ধা হয়ে উঠার পক্ষে জরুরি ছিল।

 ১৯২৫ সালে  কম্যুনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল  যখন ইতিমধ্যেই ক্ষয়িষ্ণু হতে শুরু করেছে , বিপ্লবী সংগঠন গুলির  গুরুত্বপূর্ণ   আন্দোলনগুলি পরাজিত হচ্ছে, বিশেষ করে রাশিয়ান ও জার্মান বিপ্লব পরাজিত হয়েছে , তখনই  ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম হল। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম  থেকেই লক্ষ্য ছিল অন্যান্য জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে উপনিবেশিক শক্তির বিরোধীতা বা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা।  ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টির ওপর জাতীয়তাবাদ  ও দেশাত্মবোধের প্রভাব খুব বেশী ছিল। ভারতের শ্রমিক শ্রেণী কম্যুনিস্ট লেফট এর পরম্পরা ও ধারাবাহিকতা থেকে  বঞ্চিত থেকেছে এবং তাকে  ভুগতে হয়েছে। এই রকম  রাজনৈতিক  পরিস্থিতিতে  ভারতবর্ষের কাছে কম্যুনিস্ট লেফট এর প্রকৃত ঐতিহাসিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরার  ক্ষেত্রে আই সি সি র এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থেকে গেছে।

গভীর অধ্যয়ণ এবং ধারাবাহিক আলোচনার পথেই কিষণ ধীরে ধীরে আই সি সি’র ভারতীয় অংশের সহযোদ্ধা হয়ে উঠেছিল। আই সি সি  এবং আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামের প্রতি  কিষণের  আনুগত্যই  তাকে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী  রূপে চিহ্নিত করেছে। অপরিমেয় নিষ্ঠার সঙ্গে কিষণ  সব সময় আই সি সি র  অবস্থানকে সমর্থন করেছে। আই সি সি র সঙ্গে  বিতর্কে  তার ছিল গভীর নিষ্ঠা, সে বিতর্ক আন্তর্জাতিক স্তরের  হোক বা আই সি সি র আমাদের ভারতীয় অংশের  মধ্যেই হোক  । আই সি সি র কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন স্তরে  কিষণের অবদান  গুরুত্বপূর্ণ। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে  আই. সি সি র বই বিক্রি করার উপযুক্ত দোকান খুঁজে বের করেছে। যেখানে যতটা সম্ভব হয়েছে কমরেড কিষণ  বিভিন্ন আলোচনা চক্র এবং পাবলিক মিটিং  এ অংশ গ্রহণ করেছে। আই সি সি র পত্র পত্রিকার গ্রাহকসংখ্যা বাড়ানোর ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা ছিল দৃষ্টান্ত  মূলক। তিনি আই সি সি’র নানাবিধ আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে অংশগ্রহণ এবং সক্রিয় ভূমিকা পালনের পাশাপাশি আমাদের ভারতীয় অংশেও সমান ভূমিকা রেখেছেন। তার মূল্যবান এবং সুচিন্তিত মতামত রাজনৈতিক স্বচ্ছ্বতা অর্জনের প্রক্রিয়াকে আরো ধারালো করে তুলেছিল। তার সবচেয়ে বড় শক্তি  হল সংগঠনের ওপর সমস্তরকমের আক্রমণ ও কুৎসা রটনার রিরুদ্ধে  প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

জীবনের অসংখ্য উত্থান পতন কাটিয়ে ওঠার ক্ষমতা কমরেড কিষণের ছিল। সবচেয়ে কঠিন রাজনৈতিক  অবস্থাতেও  আই সি সি র রাজনীতির প্রতি তার  দৃঢ় বিশ্বাস   ও  আশাবাদী ভূমিকাই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত  তাকে আই. সি সি র পাশে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করেছে। শ্রমিক শ্রেণীর শৃঙ্খল মোচনের জন্য কমরেড কিষণের যে রাজনৈতিক সংগ্রাম তার সঠিক মূল্যায়ণের জন্য এই  ছোট্ট একটি লেখা  যথেষ্ট নয়।  কিষণ সম্পর্কে আরো বলা যায় সে ছিল অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ এবং মাটির মানুষ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ  অথবা ভারতবর্ষের অন্যান্য অংশের আই সি সি র  কমরেডদের  প্রতি   কমরেড কিষণের ছিল উদার  আতিথ্য। আতিথিদেরও সে অভিজ্ঞতা  বার বার  ই হয়েছে। তার পরিবারের প্রতি আমরা সংগ্রামী  শ্রদ্ধা ও  দায়বদ্ধতা জ্ঞাপন করছি ।

 আই সি সি   সবরকম সহানুভূতি ও দায়বদ্ধতা নিয়ে তার স্ত্রী  ও কন্যার পাশে আছে ।

 

আই সি সি, অক্টোবর ২০২০.

(১) আমাদের ওয়েবসাইটে ‘Maoism, a monstrous offspring of decadent capitalism’ নামক প্রতিবেদন দেখুন. 

https://en.internationalism.org/ir/094_china_part3.html#_ftnref4

কোভিডের মোকাবিলায় এক বছরের অবহেলা: পুঁজিবাদই হন্তারক!

এপ্রিল মাসের শুরু থেকেই পৃথিবীর চারিদিকে কোভিড-১৯ দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়েছে। দু হাজার কুড়ির নভেম্বর মাস থেকে সারা বিশ্বে কোভিড এর আরো ভয়ংকর হয়ে ওঠার যাত্রা অব্যাহত রয়েছে। ইউরোপের অবস্থার কিছুটা উন্নতি এবং আমেরিকা তার ভয়ংকর অবস্থা কিছুটা কাটিয়ে উঠলে ও ল্যাটিন আমেরিকা এবং ভারতীয় উপমহাদেশ এই মুহূর্তে সংক্রমণের শীর্ষে।  চাইনার মতো দেশগুলিতে বৃহৎ সংখ্যক জনগণকে ভ্যাকসিন(1) দেওয়া সত্ত্বেও  সংক্রমণ পিছু হঠে নি । পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর যে চীনা কর্তৃপক্ষের মধ্যেও কিছু কণ্ঠস্বর ভ্যাকসিনের "অপর্যাপ্ত" কার্যকারিতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। চীন এবং অন্যান্য বেশ কিছু দেশের মিথ্যা তথ্য সত্ত্বেও সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকারি নথি অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ৩২ লক্ষ।

বিগত এক বছরের গবেষণায় হয়ত ভাইরাস সম্পর্কে আরও বেশি কিছু জানা যেত, এটি কীভাবে ছড়ায়  এবং এর বিরুদ্ধে কীভাবে লড়াই করা যায় সে সম্পর্কে আরও ভাল ধারণা গড়ে তোলা যেত, কিন্তু আন্তর্জাতিক স্তরের সমস্ত রাষ্ট্রের ক্রমাগত অবহেলা এবং বুর্জোয়া শ্রেণীর দায়িত্বহীনতা মূলত সুসঙ্গত এবং কার্যকর ব্যবস্থা বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে কাজ করেছে।  প্রতিযোগিতার দর্শনে জর্জরিত রাষ্ট্রগুলি টিকা নীতির ক্ষেত্রে পারষ্পরিক ন্যূনতম সমন্বয় রক্ষা করতে সক্ষম হয়নি।

এই রকম অসহযোগিতা মূলক পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে প্রতিটি রাষ্ট্রই  আশ্রয় নিয়েছে স্বল্প মেয়াদি স্বাস্থ্য পরিকল্পনায়, তারা কখনো লক ডাউন করে, কখনো লকডাউন প্রত্যাহার করে নিয়ে বা আবার তা চালু করে বা কখনো আংশিক লকডাউন ঘোষণা করার মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে। দীর্ঘকালীন আর্থিক সংকটে জর্জরিত এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লড়াইইয়ে মত্ত প্রতিটি রাষ্ট্রই  চিকিৎসা ক্ষেত্রে চরম  অবহেলা  এবং  আর্থিক  বরাদ্দ কাছাঁট করার পথে এগিয়ে চলেছে যার ফল স্বরূপ এই মুহূর্তে প্রতি দিনকার ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর কাছে মাথা নত করা এবং হাসপাতাল মর্গ ও শ্মশানগুলিতে  চরম  বিশৃঙ্খলাকে  সামাল দেওয়া ছাড়া  তাদের আর কিছু ই করার নেই। একেই শাসক শ্রেণী  '‘ভাইরাসের সঙ্গে সহাবস্থানের শিক্ষা' নামে চিহ্নিত করেছে। ফলস্বরূপ যদিবা কিছু রাষ্ট্র দ্রুত ভ্যাকসিন দিতে সক্ষম হচ্ছে কিন্তু অন্যদিকে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে ভাইরাস রূপ বদল করে আরো সংক্রামক চেহেরায় দ্রুত চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে।

 ভারতবর্ষ এবং  ব্রাজিল - - - - ভাবি চিত্র

এই ভূতের নাচের  সব চেয়ে ভয়ংকর চিত্রের দর্শক এই মুহূর্তে ভারত এবং ব্রাজিল। একজন  ব্রাজিলিয়ান বিঞ্জানীর মতে এই অতিমারির অবস্থা বর্তমানে আয়ত্তের বাইরে : চারিদিকে নতুন নতুন সমাধি ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে, বাসে করে মৃত দেহ স্থানান্তরিত করা হচ্ছে এবং হাজারে হাজারে সংক্রমণ  এখানের প্রাত্যহিক চিত্র। খুব তাড়াতাড়ি  মৃত্যু সংখ্যা পাঁচ লাখের কোঠায় পৌঁছে যাবে এবং রেকর্ড অনুযায়ী ইউনাইটেড স্টেট কে ছাপিয়ে যাবে। হাসপাতাল গুলি কোভিড রোগীতে ভর্তি, শয্যার অভাবে মানুষ স্ট্রেচারের ওপরে শুয়েই মৃত্যু বরণ করছে, আর এ সবই ঘটছে আ্যমাজোনাস স্টেটের শহর থেকে আসা একটি নতুন প্রজাতির ভাইরাসের কারণে যেখানে ২০২০ র শেষের দিকে হার্ড ইমিউনিটির  গুজব ফেরি করা হয়েছিল,  একই সঙ্গে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ব্রাজিল কে টালমাটাল করে তুলেছে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বলসোনারো, যিনি পূর্বে ভাইরাসটি কে তুচ্ছ জ্বর হিসাবে উল্লেখ করে ছিলেন, তিনি বার বার বলে চলেছেন ‘কাজে ফিরে যাওয়া এবং অভিযোগ বন্ধ করা অত্যন্ত জরুরি’। একই সঙ্গে এমন একটি  বিপর্যয়ময় পরিস্থিতিতে তিনি তাঁর মন্ত্রীদের পোশাক পরিবর্তনের মতো পরিবর্তন করে চলেছেন।

এদিকে লোকচক্ষুর অন্তরালে ব্রাজিলের আ্যমাজোনে পশু পাচারের ঘটনা  এবং একইসঙ্গে মারাত্মক রূপে অরণ্য নিধনের বিষয়টি  মানুষকে আরো বেশি করে ভাইরাসের সামনে বেআব্রু করে তুলেছে। মানাউসের একজন জীব বিজ্ঞানী  নুকাস ফেরান্ডের মতে, আমরা উহানে(2) যা প্রত্যক্ষ করেছি তার থেকে ভয়ংকর এবং নতুন ভাইরাসের সম্ভাবনা অপেক্ষা করে আছে অ্যামাজনের জঙ্গলে। গত কয়েক বছরে এই জঙ্গল নিধন এক ভয়ংকর পর্যায়ে পৌঁছলেও বুর্জোয়া শ্রেণীর যে অংশটি  এরই লভ্যাংশ এর ওপর নির্ভর করে টিকে আছে তারা এই জঙ্গল নিধন বন্ধ  করতে একে বারেই রাজি নয়।

 গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারত বর্ষের পরিস্থিতিও তাকে সংবাদ পত্রের শিরোনামে এনে দিয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটির  ভয়ংকর স্বাস্থ্য বিপর্যয় কে তুলে ধরার জন্য কোনো শব্দই বোধহয় যথেষ্ট নয়। ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক উন্নতি এবং প্যানডেমিকের শুরুতে  স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল অবস্থা গভীর এক বৈপরীত্যকে চিহ্নিত করে। স্বাস্থ্য এখানে সামান্যতমও অগ্রাধিকার পায় নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, যিনি কি না বলসেনারোর একেবারে দোসর স্বরূপ, তিনি ফেব্রুয়ারি মাসে গর্বের সঙ্গে প্রচার করেন যে ভারতবর্ষ ইতিমধ্যেই কোভিড ভাইরাসকে বধ করে বিশ্বে নজির সৃষ্টি করেছে। সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষ,  চায়না এবং অন্যান্য প্রভাবশালী  দেশ গুলিকেও প্রতিষেধক টিকা সরবরাহ করেছে। যদিও এই মুহূর্তে ভ্যাকসিন সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।

এটা দেখা গেছে যে, হিন্দু মৌলবাদের প্রতিনিধিত্ব  করা ভারতের সরকার জানুয়ারির শুরু থেকেই সেদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় কুম্ভমেলার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা তীর্থ যাত্রীদের ইচ্ছাকৃত ভাবে উৎসাহিত করতে থাকে।  এপ্রিলের প্রথম দুই সপ্তাহে দেখা যায় আঠাশ লক্ষ হিন্দুর এক বিশাল জনস্রোত মাস্ক, দূরত্ববিধি, করোনা পরীক্ষা ছাড়াই  গঙ্গারজলে  নিজেদেরকে নিমজ্জিত করেছে, যে জল নিজেই বর্জ্য  পদার্থ নিক্ষেপের মাধ্যমে তথা গঙ্গা বক্ষে সংক্রামিত মৃত দেহের উদ্দেশ্যে  পালিত ধর্মিয় আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কলুষিত, দূষিত। এরই পাশাপাশি ভোট প্রচারের উদ্দেশ্যে জমায়িত  বিশাল জনস্রোত ভাইরাসের বিস্ফোরকের কাজ করেছে। এই সমস্ত উন্নাসিকতা ও অজ্ঞতার ফল অদূরেই ওঁত্ পেতে ছিল। সংক্রমণ  এবং মৃত্যুর হার লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। দৈনিক চার লাখ সংক্রমন এবং মৃত্যুর পরিমান চার হাজারে গিয়ে পৌঁছয়, যদিও সংবাদ মাধ্যমের সরকার প্রদত্ত পরিসংখ্যান বাস্তব পরিসংখ্যানের সঙ্গে  একেবারেই সাযুজ্যহীন। হাসপাতালের সামনে রোগীর লম্বা লাইন, লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় রোগীর মৃত্যু, অপ্রতুল অক্সিজেন, শয্যার অভাব, একই শয্যায় একাধিক রোগী, মোটরবাইকের ওপর রোগীর মৃত্যু, অনাদরে রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহ গুলি  সংবাদ মাধ্যমের দাবি কে আরো শক্ত ভাবে প্রতিষ্ঠা করছে। এ সব দৃশ্য এমন একটি দেশের মধ্যে দেখা যাচ্ছে যে দেশ ব্রাজিলের মতোই নিজেকে বিশ্বের মধ্যে বৃহদাকার অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিযোগিতায় মত্ত।  কিন্তু এ সবের পরিবর্তে আমাদের  চোখে পড়ছে সেই সব অসহায় পরিবার গুলি যারা প্রিয় জনের অন্ত্যেষ্টির উদ্দেশ্যে এক টুকরো জায়গার খোঁজে দিশেহারা । অসংখ্য জমে থাকা মৃতদেহের অন্ত্যেষ্টির জন্য শত শত মিটার জুড়ে অন্ত্যেষ্টির চিতা ক্রমাগত  প্রজ্জ্বলিত, অসংখ্য জমে থাকা মৃতদেহের  শেষ   প্রাপ্য সম্মানটুকুও পায় নি। ব্রাজিল   এবং অন্যান্য জায়গার মতো এখানেও সমাজের সব চেয়ে বঞ্চিত অংশ, শ্রমিকশ্রেণী এবং মানব সমাজের অন্যান্য শোষিত অংশকেই এই গাফিলতি ও অসাবধানতার চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। যদিও হাস্যকর ভাবেই এখনো এই দুটি রাষ্ট্র এবং দক্ষিণ আফ্রিকা (3)  কে চীনের সমকক্ষীয় উন্নতির সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ এবং পুঁজিবাদের চির স্থায়িত্ব ও চলমানতার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

পচনশীলতায় ডুবন্ত পুঁজিবাদ

করোনা শুধুমাত্র পুঁজির পচনশীলতার উৎপাদনই নয় বরং এই পচনকে ত্বরান্বিত করার শক্তিশালী অনুঘটক স্বরূপও। অর্থহীন আর অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের জন্যে বিখ্যাত, প্রবল জনপ্রিয় সরকারের দ্বারা পরিচালিত মোদীর ভারতবর্ষ এবং বলসেনারোর ব্রাজিল হলো পুঁজিবাদের বর্তমান অচলাবস্থার চূড়ান্ত প্রকাশ।

  এ ক্ষেত্রে ভুল হওয়ার নয যে মোদী, বলসেনারো, ট্রাম্প এবং অন্যান্য প্রবল জনপ্রিয় প্রতিনিধিরা তাদের  নিজেদের খামখেয়ালি ও সংকীর্ণমনা পরিচালনপন্থা  এবং আভিজাত্যহীন বক্তৃতা সত্ত্বেও নিজেদেরকে  রাষ্ট্রীয় এবং বৈশ্বিক পুঁজিবাদের শক্তিশালী ধারক এবং উপযুক্ত বাহক  প্রতিপন্ন করতে চেয়েছে।  সয়া রপ্তানিকারি দেশ গুলির স্বার্থে  আমাজনের জঙ্গল নিধন এবং মারাত্মক পরিমানে খনিজ পদার্থের উত্তোলনের মধ্যে দিয়েই তাদের চরিত্রের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এদিকে মোদীর ভারতবর্ষের এমন  "সুরক্ষিত" কৃষি-আইন প্রণয়ন করা হয়েছে যাতে পুঁজির (4) প্রয়োজনে আরও গ্রামীণক্ষেত্রগুলোকে উন্মুক্ত করা যায়।

কোভিড ১৯ মহামারী সম্পর্কিত ২০২০ এর জুলাই মাসের রিপোর্ট অনুযায়ী বলা যায়, এই অতিমারি  পুঁজির পতনশিলতার বিভিন্ন উপাদান গুলিকে এক জায়গায় টেনে এনে নিজেকে ইতিমধ্যেই পুঁজিবাদের পচনশীলতার দ্যোতক  হিসাবে তুলে ধরেছে।

এই উপাদান গুলির অন্তর্গত বিষয়: -  

- উনিশ শো সাতষট্টি থেকে চলতে থাকা অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং তারই সাপেক্ষে নেওয়া কঠোর ব্যবস্থাপনা একদিকে যেমন এই অতিমারির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বুর্জোয়া শ্রেণীর অপ্রতুল এবং বিশৃঙ্খল  প্রতিক্রিয়ার জন্য দায়ী অন্যদিকে দীর্ঘ সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে থাকা উত্পাদন এই অর্থনৈতিক সংকটকে  আরো ত্বরান্বিত করে তুলেছে।

-খুব পরিষ্কার ভাবেই এই অতিমারির উত্স হল পুঁজিবাদের দীর্ঘকালীন সংকট, অতি উত্পাদনের কারণে উত্তরোত্তর বর্ধিত পরিবেশের ধ্বংসসাধন।

- সাম্রাজ্যবাদী বিশেষ করে পূর্বে মিত্রতার চুক্তিতে আবদ্ধ শক্তি গুলির বিশৃঙ্খল শত্রুতা এই অতিমারির বিরুদ্ধে নেওয়া বিশ্ব পুঁজিবাদের পদক্ষেপ গুলিকে একটি বিশ্ব বিপর্যয়ে পরিণত করেছে।

-  এই স্বাস্থ্য সংকটের সম্মুখে দাড়িয়ে শাসক শ্রেণীর বুদ্ধিহীনতা  তার  রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণহীনতা  এবং সামাজিক জীবনের ওপর রাষ্ট্রের প্রবল নিয়ন্ত্রণকেই সূচিত করে। শক্তিশালী পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলিতে নিজেদের ব্যর্থতা কে ঢাকতে রাষ্ট্র নেতাদের হাস্যকর মিথ্যাচার এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন অর্থহীন বক্তৃতা শাসক শ্রেণীর রাজনৈতিক এবং সামাজিক কর্ম ক্ষমতা হ্রাস এবং মতাদর্শগত পচনকে  আরো স্পষ্ট করে তুলেছে।

সাম্রাজ্যবাদি, অর্থনৈতিক, ভাবাদর্শগত প্রতিটি ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী সমাজের যে অবক্ষয়তা এবং পচনশীলতা তাকে কোভিড-১৯ আরো পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরেছে। বর্তমান স্বাস্থ্য সংকট পুঁজিবাদী শ্রেণীর নিজস্ব গঠণ তন্ত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণহীনতাকে এবং মনুষ্য সমাজকে  ভবিষ্যতের পথ দেখানোর পরিপ্রেক্ষিতহীনতাকে বেআব্রু করে দিয়েছে। পুঁজিবাদের অবক্ষয়ের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত আত্ম নিধনের যে প্রবণতা তা পচনশীলতার যুগে পৌঁছে নিজের স্বরূপ পরিবর্তন করে বিশ্বযুদ্ধের অনুঘটক থেকে নিজেকে রূপান্তরিত করে হয়ে উঠেছে বিশ্-বিশৃঙ্খলার অনুঘটকস্বরূপ, যা মানব প্রজাতিকে ধ্বংসের কিনারায় এনে দাঁড়  করিয়েছে।

এই অতিমারী শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামের পথে সাময়িক বিরতির সূচনা করলেও তা পুঁজিবাদী সমাজের বিশৃঙ্খল চরিত্রটিকে পরিবর্তন করে দিতে পারেনি। বরং এই অতিমারি শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবের অপরিহার্যতা কেই আরো বেশি করে চিহ্নিত করেছে। এই ঐতিহাসিক ফলাফল সম্পূর্ন ভাবে নির্ভর করবে এই সময়ের একমাত্র বৈপ্লবিক শক্তি শ্রমিক শ্রেণীর নিজের শ্রেণীগত অস্তিত্বকে নতুন করে আবিষ্কার করার সচেতনতা ও বৈপ্লবিক কর্ম ক্ষমতার ওপর। কারণ শ্রেণীগত স্বায়ত্বশাসন এবং প্রতিরক্ষার স্বার্থে পরিচালিত এবং সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণীই একমাত্র সক্ষম এই পুঁজিবাদী শাসনের বিনাশ ঘটিয়ে একটি শোষনহীন এবং শ্রেণীহীন সমাজের সূচনা করতে।

Inigo, May 6, 2021

 


[1] China and Russia have taken advantage of the situation in order to flood African and Latin American countries with vaccines for their own imperialist ends.

[2] "Amazon: point of departure of a new pandemic?", France Culture (April 19, 2021).

[3] For Africa and particularly South Africa see https://en.internationalism.org/content/16990/covid-19-africa-vain-hopes...

[4] https://en.internationalism.org/content/16997/lessons-indian-famers-move...

 

 

Communist Internationalist - 2022

ইউক্রেন-যুদ্ধ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট লেফট গ্রুপগুলির যৌথ বিবৃতি

ইউক্রেন-যুদ্ধ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট লেফট গ্রুপগুলির যৌথ বিবৃতি


শ্রমিক শ্রেণীর  কোন দেশ নেই !

সমস্ত  সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নিপাত যাক !

 পুঁজিবাদী বর্বরতা পরিবর্তে সমাজতন্ত্র !

ইউক্রেনের যুদ্ধের হচ্ছে ছোট-বড় বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি গুলির পারস্পরিক স্বার্থ সংঘাতের  জন্য, এর সাথে কোনো ভাবেই আন্তর্জাতিক ঐক্যের প্রতীক  শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থের কোনো  রূপ কোনো সম্পর্ক নেই । প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সামরিক এবং অর্থনৈতিক প্রভুত্ব কায়েমের জন্য এটি আমেরিকা,রাশিয়া পশ্চিম-ইউরোপীয় রাষ্ট্রযন্ত্রগুলির দায়িত্বে থাকা যুদ্ধবাজদের একটি ভূ-আঞ্চলিক কৌশলগত লড়াই। এই লড়াইয়ে ইউক্রেনের শাসক শ্রেণীকে  বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী  দাবার  মঞ্চে একটি বোড়ে হিসেবে কাজে লাগানো  হচ্ছে।
 
 ইউক্রেনীয় রাষ্ট্র নয়, এই যুদ্ধের আসল বলি হচ্ছে  সমগ্র  শ্রমিক শ্রেণী,  যেখানে  নারী ও শিশুরা অসহায়ভাবে নিহত হচ্ছে, ক্ষুধার্ত উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে,  উভয় সেনাবাহিনীর  কামানের খোরাক হিসেবে তারা ব্যবহৃত হতে বাধ্য হচ্ছে। এই যুদ্ধের প্রভাবে নেমে আসা ক্রমবর্ধমান রিক্ততা থেকে পৃথিবীর কোনো অংশের   শ্রমিক শ্রেণিই রেহাই পাবে না।  

পুঁজিবাদী শ্রেণি এবং তাদের বুর্জোয়া উৎপাদন পদ্ধতি কখনোই  দেশভিত্তিক প্রতিযোগিতাকে অতিক্রম করতে শেখায় নি। এই প্রতিযোগিতারই ফল হলো এই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ। কোনোভাবেই এই  পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তার গভীরতর বর্বরতায় ডুবে যাওয়া থেকে নিজেকে আটকাতে পারবে না ।
 
ক্রমশ অধোগামী মজুরি এবং জীবনযাত্রার নিম্ন মানের মুখে দাঁড়িয়ে  বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণি এই ব্যবস্থার  বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামকে  কোনোভাবেই অস্বীকার করতে  পারে না। এই যুদ্ধ যেটাকে বলা যেতে পারে   1945 সালের পরে  ইউরোপের  সবচেয়ে  ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ,  সেটা এই মুহূর্তে সারা বিশ্বকে আরো একবার   পুঁজিবাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে  এই সতর্ক বার্তা  দিচ্ছে যে এই ধ্বংস এক মাত্র এড়ানো সম্ভব যদি  শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রাম বুর্জোয়াদের উৎখাত করে শ্রমিকশ্রেণির এক-নায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

যুদ্ধের উদ্দেশ্য এবং বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মিথ্যাচার

রাশিয়ান সাম্রাজ্যবাদ তাদের 1989 সালের নিদারুণ পশ্চাদাপসরণের ধাক্কাকে কাটিয়ে উঠে আবার বিশ্বশক্তিতে পরিণত হতে চাইছে । অন্য দিকে  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সুপার পাওয়ার মর্যাদা এবং বিশ্বনেতৃত্বের পদকে  অটুট রাখতে চাইছে। ইউরোপীয় শক্তিগুলি একাধারে যেমন  রাশিয়ার শক্তিবৃদ্ধিকে ভয় পায় তেমনি  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যকেও ভয় পায়। ইউক্রেন চায় নিজেকে সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের  মিত্র হিসেবে দেখতে । 

আসুন দেখি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা শক্তিগুলি আসলে কী প্রতিপন্ন করতে চায়? তাদের কাছে থাকা সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মিথ্যাচার  এবং তাকে  প্রচার করার জন্য বৃহত্তম  মিডিয়াগুলি এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন রাশিয়া একটা ছোট্ট সার্বভৌম রাষ্ট্রকে আক্রমণ করছে আর তারা  ক্রেমলিন এর  স্বৈরাচার আর পুতিনের নৃশংসতার মুখ থেকে  গণতন্ত্রকে রক্ষা করার ধ্বজা ধরে আছে।  

সাধারণত সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী গুন্ডাদের কাছেই  সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য যুদ্ধ-প্রোপাগান্ডা মজুত  থাকে। তারা তাদের কার্যকর রণকৌশল কে কাজে লাগিয়ে শত্রুদেরকে  প্রথমে গুলি চালাতে উসকানি দিতে পারে।  মনে রাখবেন, সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে, সিরিয়ায়, ইরাকে এবং আফগানিস্তানে এইসব শক্তির শান্তির ললিত বাণী প্রচারের ন্যাকামোপণা। ইদানিং আমেরিকা কীভাবে মসুল শহরকে চিড়েচ্যাপ্টা করে দিয়েছে, কীভাবে মিত্রশক্তি  সাদ্দাম হোসেনের কাছে মানব-নিধনকারী অস্ত্র থাকার মিথ্যা অভিযোগে ইরাকের জনগণকে তরবারির ডগায় রেখেছে।  আরো একটু পিছিয়ে যান, মনে করুন গত শতাব্দীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অগুনতি অপরাধ, যেগুলো  এইসব তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশগুলি আপামর নিরীহ জনগণের উপর নামিয়ে এনেছিল। হতে পারে সেটা ১৯৬০ সালের ভিয়তনাম, হতে পারে ১৯৫০ এর কোরিয়া, কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন হিরোসীমা, ড্রেসডেন বা হামবুর্গ। ইউক্রেণের সাধারণ মানুষের উপর রাশিয়ার এই অত্যাচার সেই সাম্রাজ্যবাদী প্লেবুক থেকেই নেওয়া ।

পুঁজিবাদ মানবতাকে স্থায়ী সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের যুগে নিয়ে গেছে, যে যুগে দাঁড়িয়ে যুদ্ধকে ‘বন্ধ’ করতে বলাটাও একটা বিভ্রম। পুঁজিবাদের এই পর্যায়ে  'শান্তি'  শুধু একটি সাময়িক বিরতি ছাড়া কিছুই না ।

পুঁজিবাদ যতই অমীমাংসিত সংকটে ডুবে যাবে,  তার দূষণ এবং আঘাতের ক্রমবর্ধমান বিপর্যয়ের  পাশাপাশি সামরিক ধ্বংসও ততই ত্বরান্বিত হবে।   পুঁজিবাদের পচন যত বাড়বে  বিপ্লবী পরিবর্তনের সম্ভবনা ততটাই অপরিহার্য হয়ে উঠবে। 

শ্রমিক শ্রেণিই হলো সেই ঘুমন্ত দৈত্য  

সর্বৈবভাবে  যুদ্ধের এবং ভয়াবহতার ব্যবস্থাতে পরিণত হওয়া  পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, যার শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বর্তমানে এমন কোনও উল্লেখযোগ্য শ্রেণি-বিরোধিতা খুঁজে পাওয়া যায় না, যার ফলস্বরূপ  সর্বহারা শ্রেণি একদিকে যেমন পুঁজিবাদের ক্রমবর্ধমান শোষণের শিকার হয়, অন্যদিকে  সাম্রাজ্যবাদের ডাকে  যুদ্ধক্ষেত্রে চূড়ান্ত বলিদান দিতে বাধ্য হচ্ছে।  

শ্রমিকশ্রেণির  শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার লড়াইয়ের বিকাশ এবং সেইসাথে বিপ্লবী ভ্যানগার্ডের অপরিহার্য ভূমিকা দ্বারা উদ্দীপিত  শ্রেণি-চেতনা অনেক বড় সম্ভাবনাকে লুকিয়ে রাখে।  সেই সম্ভবনা হলো শ্রেণি হিসাবে একত্রিত হওয়ার এবং  রাজনৈতিক শোষণযন্ত্রকে উৎখাত করার ক্ষমতা যা তারা ১৯১৭ সালে   রাশিয়ায় করেছিলো এবং সেই সময়ের  জার্মানি এবং অন্যান্য কিছু স্থানেও করে ফেলার সম্ভাবনা তৈরি করেছিলো। এটাই সেই সম্ভাবনা যা নিরন্তর যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাওয়া ব্যবস্থাকে ছুঁড়ে ফেলতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, অক্টোবর বিপ্লব শুধু যুদ্ধের বিরোধিতাই নয়, বুর্জোয়া রাষ্ট্রশক্তির উপর  আক্রমণেরও একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।    

আজ আমরা সেরকম একটি বিপ্লবী পরিস্থিতি থেকে অনেক দূরে। একইভাবে, প্রথম সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের সময় প্রলেতারিয়াতদের লড়াইয়ের যে অবস্থা ছিলো তার থেকে আজকের পরিস্থিতি অনেক আলাদা। অন্যদিকে, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের মোকাবিলায় যা এখনও একই রয়ে গেছে, তা হল সর্বহারার  আন্তর্জাতিকতাবাদ। এখন বিপ্লবী সংগঠনগুলির আশু কর্তব্য হলো চলতি স্রোতের বিরুদ্ধে এই মূল নীতিগুলিকে  অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে সমর্থন করা আর প্রলেতারিয়েতের সামনে তুলে ধরা ।  

এই  রাজনৈতিক ঐতিহ্য একাধারে  সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং আন্তর্জাতিকতাবাদের পক্ষে লড়াই করেছে ও করে চলেছে।

সুইজারল্যান্ডের জিমারওয়াল্ড এবং কিয়েনথাল - এই গ্রামগুলি  প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে উভয় পক্ষের সমাজতন্ত্রীদের মিলনস্থল হিসেবে বিখ্যাত হয়েছিলো। আবার এই স্থানটিই দেশপ্রেমের ধ্বজাধারী সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিগুলির সমালোচনা এর মাধ্যমে  একটি আন্তর্জাতিক সংগ্রাম শুরুর উৎস স্থল হিসাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।  এই স্থানের সেই বৈঠকেই ব্রেমেন লেফট ও ডাচ  লেফট দ্বারা সমর্থিত বলশেভিকরা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রয়োজনীয় নীতিগুলিকে সামনে নিয়ে আসে যা আজও সমানভাবে  বৈধ এবং প্রাসঙ্গিক:
কোনো সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের  প্রতিই কোনো প্রকার সমর্থন নয়; সমস্ত শান্তিবাদী বিভ্রম প্রত্যাখ্যান; এবং এই স্বীকৃতি দেওয়া যে একমাত্র শ্রমিকশ্রেণি এবং তার বিপ্লবী সংগ্রামই শ্রমশোষণভিত্তিক এবং স্থায়ী সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের জন্মদাতা এই ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে পারে।

1930 এবং 1940-এর দশকে শুধুমাত্র সেই পলিটিক্যাল কারেন্ট  বর্তমানে যাকে  আমরা কমিউনিস্ট লেফট বলি সেই সংগঠনগুলিই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে  বলশেভিকদের দ্বারা বিকশিত আন্তর্জাতিকতাবাদী নীতিগুলিকে দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইতালীয়ান লেফট এবং ডাচ লেফট খুব সক্রিয়ভাবে মানব-নিধনের ফ্যাসিস্ট এবং অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট  উভয়পক্ষের সাফাইকে নাকচ করেছিলো, উল্টোদিকে ট্রটস্কিবাদী সহ অন্যান্য ধারাগুলি এটাকে প্রলেতাড়িয়-বিপ্লব হিসেবে দাবী করেছিলো। সেইসময় এইভাবেই  কমিউনিস্ট  লেফটরা  স্তালিনবাদী-রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদের প্রতি যে কোনো প্রকার সমর্থনকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। 

আজ, ইউরোপে সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব ত্বরান্বিত হওয়ার মুখে, কমিউনিস্ট লেফটদের ঐতিহ্য বহনকারী রাজনৈতিক সংগঠনগুলি  সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদের পতাকাকে তুলে ধরেছে এবং যারা বিশ্ব প্রলেতারিয়েতের মূল নীতিগুলিকে  সমর্থন করতে চায় তাদের জন্য একটি মাপকাঠি পয়েন্ট প্রদান  করছে।
 
এই কারণেই আজ কমিউনিস্ট লেফট সংগঠন ও গোষ্ঠীগুলি, সংখ্যায় অল্প এবং প্রায় নগন্য হওয়া সত্ত্বেও একটা  যৌথ বিবৃতিটি রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং যতটা সম্ভব ব্যাপকভাবে আন্তর্জাতিকতাবাদের নীতিসমূহকে সম্প্রচার করতে চাইছে যেটা দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধের বর্বরতার বিরুদ্ধে  অনুশীলিত হয়েছিলো।

 
ইউক্রেনে সাম্রাজ্যবাদী হত্যাকাণ্ডে কোনো পক্ষের সমর্থণ নয়   

শান্তিবাদের  কোন বিভ্রম নয় : পুঁজিবাদ কেবল অবিরাম যুদ্ধের মাধ্যমেই বাঁচতে পারে


শুধুমাত্র শ্রমিকশ্রেণিই তার শোষণের বিরুদ্ধে শ্রেণি-সংগ্রামের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের অবসান ঘটাতে পারে


দুনিয়ার মজদুর এক হও!

 

International Communist Current (en.internationalism.org)

Istituto Onorato Damen http://www.istitutoonoratodamen.it

Internationalist Voice (en.internationalistvoice.org)

Internationalist Communist Perspective (Korea) fully supports the joint statement (국제코뮤니스트전망 - International Communist Perspective (jinbo.net)

ব্রিটেনে এখন ‘অসন্তুষ্টির গ্রীষ্ম’ : শাসক শ্রেণী চায় শ্রমিকের আত্মবলিদান; শ্রমিকশ্রেণীর প্রতিক্রিয়া হল সংগ্রাম করা!

“যথেষ্ট  হয়েছে”-  গত  বেশ কয়েক  সপ্তাহ  ধরে  UK   তে ঘটে  চলা  ধর্মঘটে এই ধ্বনি  প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে। ‘অসন্তোষের গ্রীষ্ম  ' নামে ভূষিত   এই বিশালাকার আন্দোলন  মনে  করিয়ে  দিচ্ছে ১৯৭৯ এর অসন্তোষের  শীত’কে। দেশের  বিভিন্ন  প্রান্ত থেকে  এই আন্দোলনে রেলওয়ে  থেকে  শুরু করে  ভূগর্ভস্হ শ্রমিক, বৃটিশ  টেলিকম, ফেলিক্সো  ( দক্ষিণ পূর্ব  বৃটেনের  গুরুত্বপূর্ণ  বন্দর)  এর বন্দর  কর্মীরা, বরখাস্ত  শ্রমিক,  বাসচালক,  এ্যামাজন কর্মী  যোগদান  করেছে।   এই আন্দোলনের গতি   যানবাহন  থেকে   স্বাস্থ্যকর্মী শিক্ষক  সর্বত্র  ঝড়ের গতিতে  ছড়িয়ে  পড়ছে। সমস্ত  সাংবাদিক  ও ভাষ্যকাররা একে শতাব্দীর  সবচেয়ে  বড়ো  আন্দোলন  আখ্যা  দিয়েছে।  এর আগে শুধুমাত্র ১৯৭৯  এর  ধর্মঘটগুলি এর থেকে  বড়ো  এবং বিস্তৃত  আকার ধারণ  করতে পেরেছিল। এই ব্যাপক মাত্রার আন্দোলন  বৃটেনের  মতো  দেশে শুধু  মাত্র  স্হানীয়  ভাবে  গুরুত্বপূর্ণ তা নয়, আন্তর্জাতিক  ক্ষেত্রে এবং  গোটা পৃথিবীর  সমস্ত  প্রান্তের  শোষিত  শ্রমিকশ্রেণীর কাছে  গুরুত্বপূর্ণ।  

' শ্রেণীসংগ্রাম  ই হল শোষিত  শ্রেণীর  জীবনযাত্রার ওপর নেমে  আসা বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে  একমাত্র  উত্তর  '

অন্যান্য সমস্ত  উন্নত  দেশগুলির মত বৃটিশ  সরকারও  ধারাবাহিক  ও নিরলস  ভাবে  শতাব্দীর  পর শতাব্দী ধরে  শ্রমিক  শ্রেণীর  জীবন  ও কর্মক্ষেত্রের ওপর আক্রমণ  চালিয়ে  গেছে। বিশ্ব পুঁজিবাদের  প্রতিযোগিতার  আসরে টিঁকে  থাকা  এবং  আরো বেশি  মুনাফা আত্মসাতের  নেশায়  শ্রমিকশ্রেণীর  জীবনকে নিরাপত্তাহীন ও অনিশ্চিত  করে তুলেছে।   এই আক্রমণগুলির অন্যতম ফল স্বরূপ  বৃটেনে শিশু  মৃত্যুর  হার ২০১৪ সাল থেকে  নজিরবিহীন  ভাবে  বৃদ্ধি  পেয়েছে (medical journal BJM Open[1]).।  বর্তমানে  মূল্যবৃদ্ধি সুনামির  আকার ধারণ  করেছে।  মূল্য  বৃদ্ধির হার   জুলাই  মাসে   ছিল ১০.  ১ শতাংশ, অনুমান  করা হচ্ছে  অক্টোবর  মাসে তা ১৩ শতাংশ  এবং জানুয়ারি মাসে ১৮ শতাংশে পৌছবে, যার ফল হবে  ভয়ংকর রকমের  ধ্বংসাত্মক।  N H S   ইতিমধ্যেই  সতর্কবার্তা দিয়েছে  অনেক  মানুষই  তাদের খাদ্যতালিকা  কাটছাট  করতে বাধ্য  হবে, অথবা  বাধ্য  হবে  ঘর উষ্ণ  করার পদ্ধতি  বন্ধ  রাখতে।  যার ফলে বহু  মানুষকে স্যাঁতসেতে  অবস্থা   এবং  প্রবল শীতের  মধ্যে দিন  অতিবাহিত  করতে হবে। এপ্রিলের প্রথমেই গ্যাস এবং  ইলেক্ট্রিসিটির   ৭৪ শতাংশ  মূল্য বৃদ্ধি  এবং  অক্টোবরের শুরুতে ৭৮  শতাংশ  মূল্য বৃদ্ধি  পরিস্থিতিকে  আরো  অচলাবস্থার দিকে  ঠেলে  দিয়েছে।  থ্যাচারের শাসনকালে বৃটিশ  শ্রমিকদের ওপর প্রবল  বিপর্যয়  নেমে  আসে  যার ফল স্বরূপ   তাদের  প্রতিক্রিয়া  জানানোর  ক্ষমতাটুকু  ও নিঃশেষ  হয়ে যায়।  আজকের  বৃটিশ  শ্রমিকদের আন্দোলন  সেই  ধারাবাহিক নিস্ক্রিয়তার সমাপ্তি  সূচনা করে আজকের  বৃটিশ  শ্রমিকের জীবনে  নেমে  বিপর্যয়ের বিপক্ষে  একটি     যোগ্য  জবাব হয়ে উঠতে পেরেছে। 

অতীতে বৃটিশ  শ্রমিকরা  বিশ্বের মধ্যে  সবচেয়ে  সংগ্রামশীল বলে পরিচিত  ছিল।  ধর্মঘটের দিনের  সংখ্যার ভিত্তিতে ১৯৭৯ এর ' অসন্তোষের  শীতকাল'   কে মে ১৯৬৮ এর ফ্রান্সের যে আন্দোলন তার পরবর্তী  কালের  সবচেয়ে  বৃহদাকার  আন্দোলন  বলা চলে,  যার আকার এমন  কি ১৯৬৯ এর  ইটালির   ‘উষ্ণ  শরত’  এর থেকেও বড়ো  ছিল। শ্রমিকদের ওপর  একের পর এক তিক্ত  পরাজয় নামিয়ে এনে থ্যাচার সরকার  সক্ষম  হয়েছিল এই  বিশাল  আন্দোলনকে দমন করতে,  যার মধ্যে  উল্লেখযোগ্য ছিল   ১৯৮৫ এর খনি শ্রমিকদের আন্দোলন।  এই পরাজয়ের  সাথে  সাথে  যুক্তরাজ্যে এমনকি  গোটা বিশ্বের  শ্রমিকশ্রেণির  লড়াকু চরিত্রের দ্রুত  অবনমন হতে  শুরু  করে।  পাঁচ বছর  পর ১ ৯৯০ সালে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত  ভাবে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র  হিসাবে  প্রচারিত USSR  এর পতনের সঙ্গে সঙ্গে ‘কমিউনিজমের  মৃত্যু’ 'এবং  'পুঁজিবাদের  নিশ্চিত  বিজয় ' এই দুটি প্রচার শ্রমিকশ্রেণির  জীবনে বিপর্যয়  হয়ে  নেমে আসে।  তারপর থেকে  পরিপ্রেক্ষিতের অভাব  শ্রমিকশ্রেণির  আত্মবিশ্বাস ও শ্রেণীচেতনাকে ক্ষয় থেকে  আরো ক্ষয়ের দিকে  এগিয়ে  নিয়ে গেছে,  যার ফল পৃথিবীর  সমস্ত   জায়গার  থেকে  বেশি  ভোগ করে বৃটেনের  শ্রমিকরা। লড়াই  করার অক্ষমতা তাদেরকে   ধারাবাহিক  ভাবে  সরকারের   আক্রমণের সহজ শিকারে পরিণত  করে। 

কিন্তু  আজকে শ্রমিকশ্রেণীর  আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে  ক্ষোভ  দিনে  দিনে ঘনীভূত  হচ্ছে।  বৃটেনের শ্রমিকশ্রেনী বারংবার  প্রমাণ করছে  যে সে লড়াই  করতে প্রস্তুত এবং  পুঁজিবাদের  দাবি অনুসরণ  করে  ত্যাগ স্বীকার  করতে  সে একেবারেই প্রস্তুত নয়। এই পরিবর্তন  অত্যন্ত অর্থবহ এবং  শ্রমিক শ্রেণীর  আন্দোলনের  আন্তর্জাতিক  গতিশীলতার ইঙ্গিত বহন করে।  গত বছর  থেকে  পৃথিবী  একের  পর এক ধর্মঘটের সাক্ষী  থেকেছে।, যার মধ্যে  অন্যতম  শীতের  স্পেন ও আমেরিকায় ঘটে  যাওয়া ধর্মঘট  গুলি। এবারে গরমে জার্মানি ও বেলজিয়ামে শ্রমিকদের কর্ম ত্যাগ  এবং  ইতিমধ্যেই অনুমান  করা হয়েছে  যে ফ্রান্স  ও ইতালি একটি বিস্ফোরক  সামাজিক  পরিস্থিতির সাক্ষী  হতে চলেছে।  অদূর ভবিষ্যতে  কখন এবং  কোথায়  শ্রমিক আন্দোলন  ব্যাপক আকার ধারণ করবে তার ভবিষ্যদ্বানী না দেওয়া হলেও এটা নিশ্চিত  ভাবে  বলা যায়  যে বর্তমানের  বৃটেনের  শ্রমিক শ্রেণীর  সংঘবদ্ধতা  শ্রমিকশ্রেণীর  ইতিহাসে একটি  উল্লেখযোগ্য ঘটনা।  নিষ্ক্রিয়তা এবং নতিস্বীকারের দিনের  সমাপ্তি  ঘটেছে  এবং নতুন  প্রজন্মের  শ্রমিকরা মাথা উঁচু  করে দাঁড়াচ্ছে।

 সাম্রাজ্যবাদী  যুদ্ধের সমকালে শ্রেণীসংগ্রাম

 শুধুমাত্র দীর্ঘ  সময়ের নিষ্ক্রিয়তার অবসান  ঘটানোই এই আন্দোলনের  গুরুত্ব  নয়, এই আন্দোলনগুলি এমন এক  সময়ে বিকশিত  হচ্ছে  যখন বিশ্ব আরো একটি সাম্রাজ্যবাদী  যুদ্ধের মুখোমুখি,  যে যুদ্ধ  রাশিয়াকে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে  দাঁড়  করিয়েছে  এবং  ন্যাটো অন্তর্ভুক্ত  দেশগুলি কে একত্রিত  করেছে  এবং  যার প্রভাব বিশ্ববাসীকে নাজেহাল  করে  তুলেছে।  এর প্রভাব  শুধুমাত্র  অস্ত্রের বাজারে নয়, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক  এবং  আদর্শগত সমস্ত  ক্ষেত্রেই পরিলক্ষিত  হচ্ছে।  পশ্চিমের দেশ গুলির সরকার  জনগণকে  স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র  রক্ষার্থে ত্যাগ স্বীকারের জন্য  আহ্বান  করছে। আরো পরিষ্কার  পরিভাষায়  বলা যায় এই সমস্ত  দেশের  শ্রমিক  শ্রেণীর  এই মুহূর্তে  কর্তব্য  হল, আরো শক্ত ভাবে  ইউক্রেনের শ্রমিক  শ্রেণির  প্রতি  সংহতি প্রদর্শন  ও আরো পাশে এসে দাঁড়ানো।

বিশ্ব  উষ্ণায়নের ফলে নেমে  আসা  বিপর্যয়,   শক্তি  এবং খাদ্যের  ঘাটতির  ঝুঁকিকে ( জাতি  সংহের মহাসচিবের  মতে এখনো পর্যন্ত  সবচেয়ে  খারাপ  খাদ্য  সংকট)  অজুহাত  করে বিভিন্ন দেশের  সরকার নির্লজ্জ  ভাবে শ্রমিক শ্রেণীর  ওপর  তাদের  অর্থনৈতিক আক্রমণকে ন্যায্যতা দিচ্ছে।   শাসকশ্রেণী একই সঙ্গে  শান্তির ও ডাক দেয় আবার প্রাচুর্যের  পরিসমাপ্তি  ঘোষণা  করে।   একই সময়ে  তার  যুদ্ধের অর্থনীতিকে আরো শক্তিশালীও করে তুলেছে।  ২০২১ সালে  বিশ্বব্যাপী সামরিক  ব্যয় ২,১১৩  বিলিয়ন  ডলারে  পৌঁছেছে। ১৯৪৫ সালের  পর এই প্রথম  সামরিক  ব্যয়ের শীর্ষে থাকা ৫  রাষ্ট্রের  মধ্যে  অন্যতম  UK সমেত  জার্মানি এবং  বিশ্বের প্রতিটি  দেশ তাদের  অস্ত্র  প্রতিযোগিতাকে ত্বরান্বিত  করে চলেছে। 

এটি একটি  রসিকতার  মতই শোনায় যে,  যে সময়ে শাসক দেশ গুলি  যুদ্ধে তাদের  ব্যয়  বাড়িয়ে  পরিস্থিতিকে আরো খারাপের  দিকে নিয়ে  চলেছে,  সেই  সময়ে তারাই আবার   মুদ্রাস্ফিতির  বিরুদ্ধে  লড়াই  করার জন্যে  আত্মত্যাগের আহ্বান  জানাচ্ছে।  এই ঘটনা  এটাই প্রমাণ করে  যে পুঁজিবাদ  এবং তার প্রতিযোগী জাতীয়  বুর্জুয়াদের আরো যুদ্ধ, আরো ধ্বংস,  আরো  শোষণ, আরো দুর্দশা  ছাড়া  কিছুই দেবার নেই। 

শ্রমিকশ্রেণী সম্পূর্ণভাবে সচেতন  না হলেও  বৃটেনের  আন্দোলনের  গুরুত্ব  এখানেই যে শাসকশ্রেণীর  স্বার্থের জন্য  আরো  বেশি ত্যাগ স্বীকার  করতে  অস্বীকার,  জাতীয়  অর্থনীতি এবং  মানবতাকে বিপর্যয়ের শেষপ্রান্তে  এনে দাঁড়  করানো যুদ্ধ  প্রচেষ্টার  জন্য  আত্মত্যাগ করতে অস্বীকার। এর বিকল্প গুলিও অত্যন্ত পরিষ্কার, সেটা হলো- সমাজতন্ত্র  অথবা  মানবতার  ধ্বংস । 

 পুঁজিবাদের  পাতা ফাঁদ এড়িয়ে  চলা প্রয়োজন 

 দীর্ঘ দিন  ধরে বৃটেনের এর উগ্র  জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ  সমগ্র  অত্যাচারিত শ্রমিকশ্রেণীকে বিদেশী-স্বদেশী,  সাদা-কালো, নারী-পুরুষ, এমন অনেক  গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে  রাখতে সক্ষম  হয়েছিল।  এমন কি সেখানকার শ্রমিকশ্রেণী  ও বিশ্বাস  করেছিল  যে ব্রেক্সিটে   UK এর পশ্চাদপসরণ  ই তাদের  সমস্ত  সমস্যার  সমাধান  করবে। এমতাবস্থায় শ্রমিকশ্রেণীর বর্তমান অবস্থান  গ্রহণ  খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। শুধু   তা নয়, বুর্জোয়ারা  আরো  কঠিন  ক্ষতিকর এবং  ভয়ংকর  ফাঁদ পেতে রেখেছে  শ্রমিকশ্রেণির  আন্দোলনের  পথে।  বর্তমান  ধর্মঘটগুলোর অধিকাংশই  ডাক দিয়েছে  ট্রেড ইউনিয়নগুলি যারা নিজেদেরকে শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থরক্ষা  এবং  সংগ্রাম  সংঘটিত  করার ক্ষেত্রে  সবচেয়ে  কার্যকর  সংস্থা  হিসাবে  দাবি করে।  তারা  কার্যকর  তো বটেই,  তবে  বুর্জুয়াদের স্বার্থ  রক্ষার্থে এবং  শ্রমিকশ্রেণীর পরাজয় সংঘটিত  করতে।    এ কথা   মনে রাখা প্রয়োজন  যে, ইউনিয়নগুলির নাশকতা ছাড়া থ্যাচারের বিজয় কখনোই  সম্ভব  হোতো না।  ১৯৮৪ সালের  মার্চ মাসে  যখন কুড়ি  হাজার ( ২০, ০০০) চাকরি  ছাঁটাই ঘোষণা  হয়  তখন কয়লাখনি শ্রমিকদের প্রতিক্রিয়া ছিল তাৎক্ষণিক,-   ধর্মঘটের প্রথম  দিনই ১৮৪ টি কূপের   মধ্যে  ১০০ টি বন্ধ  করে  দেওয়া হয়েছিল।  কিন্তু  বেশ কিছু  ট্রেডইউনিয়ন ধর্মঘটকারিদের দ্রুত  বেষ্টন করে  ফেলতে সক্ষম  হয়েছিল। রেলওয়ে  শ্রমিক  এবং নাবিক  ইউনিয়ন  ধর্মঘটে  তাদের  প্রতীকী সমর্থন  জানিয়েছিল। শক্তিশালি বন্দর কর্মী  ইউনিয়ন  অনেক  দেরি করে  এই ধর্মঘটকে তাদের  সমর্থন  জানায়। ট্রেডইউনিয়নের জাতীয়-কংগ্রেস  এই ধর্মঘটকে সমর্থন জানাতে অস্বীকার  করে। স্টিল শ্রমিক  ও ইলেক্ট্রিসিয়ানদের ইউনিয়নগুলি এই ধর্মঘটের   বিরোধিতা  করে।  সংক্ষেপে  বলা যায় যে  ইউনিয়ন  গুলি অত্যন্ত সক্রিয়  ভাবে একটি সর্বজনীন   সংগ্রামের  সম্ভাবনাকে সমূলে বিনষ্ট  করেছিল। সর্বোপরি খনি শ্রমিকদের ইউনিয়ন  NUM ( National   Union  of mine workers)  কোকিং ডিপো থেকে কয়লা চলাচল রোধ করার প্রয়াসকে  কেন্দ্র  করে  খনি শ্রমিকদের পুলিশের  সঙ্গে  নিরর্থক এবং পূর্বপরিকল্পিত একটি লড়াই  এর মধ্যে  সীমাবদ্ধ  রেখে  এই জঘন্য  কাজটি সম্পন্ন  করে ( এটি এক বছরের  ও বেশি স্থায়ী  হয়েছিল।)  ইউনিয়নের এই নাশকতার  সাহায্য  নিয়েই পুলিশের  সাথে  এক দীর্ঘ  নিষ্ফল এবং অবিরাম  সংঘর্ষের মাধ্যমে  তীব্র  সহিংসতার সাথে এই ধর্মঘটের দমন সম্পন্ন  হয়েছিল।  এই পরাজয় ছিল সমগ্র শ্রমিকশ্রেণির  পরাজয়। আজ যদিও UK তে  এই একই ইউনিয়নগুলি বিভিন্ন  সেক্টরগুলির  মধ্যে  শ্রমিকশ্রেণির  প্রতি  সংহতি  প্রদর্শনের ডাক দিচ্ছে  এবং একটি  সর্বজনীন  ধর্মঘট  সংঘটনের   আস্ফালন  ও করছে। কিন্তু  তার কারণ হল , একদিকে যেমন তাদের  অস্তিত্ব  টিকেই আছে  শ্রমিক শ্রেণির  রাগ, তাদের  সংগ্রাম  এবং তাদের এই অনুভূতি  যে  আমাদের  একসাথে  লড়াই  করতে হবে  এ সবের ওপর, অন্য  দিকে  শ্রমিক শ্রেণির  এই লড়াই কে যতো তারা নিজেদের  কব্জায় করতে পারবে ততো তারা তাদের  দমণ করতে সক্ষম  হবে। বাস্তবে  তারা এই ধর্মঘটকে কেন্দ্র  করে তাদের পরিকল্পনা  সাজাচ্ছে  অন্যভাবে  ;  ' সবার জন্য  উচ্চ  মজুরি 'র শ্লোগান  সামনে  রেখে বিভিন্ন  সেক্টরগুলিকে কর্পোরেটবাদী আলোচনায়  আটক ও বিচ্ছিন্ন  করে রেখেছে।  তার থেকেও বড়ো  কথা, তারা অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে  শ্রমিকদের বিভিন্ন  সেক্টরের মধ্যে  আলোচনার পরিধিকে বাধা দিয়ে  চলেছে।  এ এমতাবস্থায়  কোথাও  কোনো   Cross  industry এর সাধারণ সভা হচ্ছে  না। এ রকম পরিস্থিতিতে  যখন বরিস জনসনের  স্থলাভিষিক্ত  করার লড়াই  এর সামনের  সারিতে থাকা  Liz trass   ঘোষণা  করে যে, সে প্রধানমন্ত্রী  হলে কখনোই সে বৃটেনকে জঙ্গি  ট্রেড  ইউনিয়নগুলির  মুক্তি পণে আটকে থাকতে দেবেন না, তখন তার দ্বারা  বোকা না বনাই  ভালো।  সে কেবল তার রোল  মডেল  মার্গারেট  থ্যাচারের পদাঙ্ক  অনুসরণ  করছে। ইউনিয়নগুলিকে শ্রমিকদের সবচেয়ে  সংগ্রামী এবং বিশ্বাসযোগ্য  প্রতিনিধি  হিসাবে উপস্থাপিত করে শ্রমিকশ্রেণিকে একটি একত্রিত  পরাজয়ের  দিকে নিয়ে  যাওয়ার  প্রচেষ্টা  চালাচ্ছে। 

 ২০১৯ সালে ফ্রান্সে  লড়াই  এর উত্থান  এবং বিভিন্ন  প্রজন্মের  মধ্যেকার সংহতির  বিস্ফোরণের মুখোমুখি  দাঁড়িয়ে  ইউনিয়ন  গুলি  একই কৌশল অবলম্বন  করে।  সেখানে  তারা একক আন্দোলনের  বিকল্প  হিসাবে  আন্দোলনকারিদের বিভিন্ন  সেক্টর  এবং  কোম্পানির  ভিত্তিতে গোষ্ঠী  ভুক্ত করে। 

আমাদের  জীবনযাত্রার  ওপর নেমে আসা নিরলস আক্রমণ  যা আগামীতে আরও  বেশি  তীব্র  হতে চলেছে,  তাকে প্রতিহত করতে UK  এবং পৃথিবীর  সমস্ত  প্রান্তে  এই মুহূর্তে  প্রয়োজন  হল অসংখ্য  বিতর্ক  সভার আয়োজন  এবং  তারই মাধ্যমে  শ্রমিক শ্রেণীর  আন্দোলনের  পদ্ধতি  গুলিকে আরও  বেশি  শক্তিশালী  করে তোলা, যা কিনা ইতিহাসের  বিভিন্ন  মুহূর্তে  বুর্জোয়া  ব্যবস্থাকে নাড়িয়ে  দিতে সক্ষম  হয়েছিল ;

- আমাদের ‘কারখানা,' আমাদের‘কোম্পানি’, 'আমাদের ‘শহর’, আমাদের ‘অঞ্চল’, আমাদের ‘দেশ’, এই সমস্তকিছু  কে ছাড়িয়ে  পৃথিবীর  সমস্ত  প্রান্তে সংহতি এবং  সমর্থনের সন্ধান করা।

-  শ্রমিক  ইউনিয়নগুলির  এবং তথাকথিত  সবজান্তাদের ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে  আসতে  প্রয়োজন  শ্রমিকদের নিজস্ব  স্বায়ত্তশাসিত  সংগঠণ এবং   general  assemblies . 

 -    সংগ্রামের  প্রয়োজনীয়তা এবং অতীতের  ঘটে যাওয়া সংগ্রাম  এবং  পরাজয় থেকে  ইতিবাচক  শিক্ষা  গ্রহণকে কেন্দ্র  করে  আলোচনার পরিধিকে আরও  বিস্তৃত  করে তুলতে  হবে।  কারণ পরাজয় হল অবশ্যম্ভাবি কিন্তু  সব চেয়ে  বড়ো  পরাজয় হল প্রতিক্রিয়া  না জানিয়ে  পরাজয় সহ্য করে যাওয়া। সংগ্রামে প্রবেশই হল শোষিতের প্রথম  সবচেয়ে  গুরুত্বপূর্ণ  বিজয়।

        UK   তে প্রবলভাবে  ছড়িয়ে  পরা ধর্মঘটের প্রত্যাবর্তন যেমন সর্বহারা শ্রেণির  লড়াই এর প্রত্যাবর্তন কে চিহ্নিত  করে,  তার সঙ্গে  এটাও মনে  করিয়ে দেয় যে ১৯৮৫ র পরাজয়ের সংকেত বহনকারী  দুর্বলতা গুলিকে অবশেষে অতিক্রম  করা সম্ভব  হয়েছে,  যেমন কর্পোরেটিজম এবং ট্রেডইউনিয়নের বিভ্রম ।  সংগ্রামের স্বায়ত্তশাসন ঐক্য  এবং সংহতি ই হল আগামীর  সংগ্রামের  প্রস্তুতির অপরিহার্য   মাপকাঠি।  

এর জন্য  প্রয়োজন  হল নিজেদেরকে একই শ্রেণীর  সদস্য  হিসেবে  চিহ্নিত  করা,  সেই  শ্রেণীর  নাম  হল শ্রমিক  শ্রেণী, যার সংগ্রাম সংহতির  দ্বারাই ঐক্যবদ্ধ।  আজকের  লড়াই  শুধু  মাত্র  এই কারণেই  গুরুত্বপূর্ণ  নয় যে শ্রমিকশ্রণী অবশেষে  তার বিরুদ্ধে  নেমে আসা আক্রমণের বিরোধিতা  করতে সক্ষম  হচ্ছে, বরং  এই কারণেও যে এই লড়াই  তার বিশ্বব্যাপী শ্রেণী পরিচয় পুনরুদ্ধারের পথকে নির্দেশ  করে, আমাদের  সমস্ত  দারিদ্র্য  ও বিপর্যয়ের কারণ এই পুঁজিবাদী  ব্যবস্থাকে  উৎখাতের একটি ধাপ হয়ে  উঠতে সক্ষম হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর  ধ্বংস,  যুদ্ধ, বেকারত্ব,  দারিদ্র্য,  অনিশ্চয়তা এ সবের  কোনো সমাধানই পুঁজিবাদী  ব্যবস্থার মধ্যে  লুকিয়ে  নেই।  সমস্ত  শোষিত  এবং অত্যাচারিতকে সঙ্গে  নিয়ে  বিশ্ব শ্রমিক  শ্রেণীর লড়াই-ই  একমাত্র  বিকল্প  পথের  সন্ধান  দিতে পারে। 

বৃটেনের  ব্যাপক ধর্মঘট পৃথিবীর  অন্যান্য প্রান্তের  শ্রমিকশ্রেণী কে  লড়াই  এ যোগাদানের আহ্বান  জানায়।

 

[1]https://bmjopen.bmj.com

 

Communist Internationalist - 2023

না ইসরাইল না ফিলিস্তিন ! শ্রমিকদের পিতৃভূমি নেই !

গত শনিবার থেকে ইসরায়েল ও গাজায় বসবাসরত সাধারণ মানুষের উপর আগুনের অবিরাম ধারা বর্ষিত হচ্ছে। একদিকে হামাস, অন্যদিকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী, এরই মাঝখানে অবস্থানরত বেসামরিক নাগরিকদের গুলি ছোড়া হচ্ছে, কার্যকর করা হচ্ছে মৃত্যুদন্ড এবং বহু মানুষকে  গৃহবন্দী করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে সহস্রাধিক মানুষ মারা গেছে।    

এই দুই পক্ষের একটিকে বেছে নেওয়ার জন্য সারা বিশ্বের বুর্জোয়ারা আমাদের আহ্বান জানাচ্ছে। ইসরায়েলি নিপীড়নের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের জন্য অথবা ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি প্রতিক্রিয়াকে সমর্থণের জন্য এই আহ্বান । প্রত্যেকেই যুদ্ধকে ন্যায়সঙ্গত করার জন্য একে অপরের বর্বরতার নিন্দা করে চলে। ইসরায়েলি রাষ্ট্র কয়েক দশক  ধরে অবরোধ, হয়রানি, চেকপয়েন্ট এবং অপমান দিয়ে ফিলিস্তিনি জনগণের উপর নিপীড়ন চালিয়ে আসছে, তাই তাদের প্রতিশোধ বৈধ হবে এইরকম যুক্তি দিয়ে  ফিলিস্তিনি সংগঠনগুলো ছুরিকাঘাত ও বোমাহামলা চালিয়ে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করতে শুরু করেছে। একে অপরের রক্ত ঝরানোর যুক্তিকে  সামনে আনছে।   

হনন-জীঘাংসার এই ভয়ঙ্কর যুক্তিই আসলে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের যুক্তি। আমাদের শোষকশ্রেণি তথা রাষ্ট্রশক্তি সবসময় নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় নির্দয় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে যুক্তির আমদানি করে।  আর আমরা শ্রমিকশ্রেণি, যারা শোষিত, তারা সবসময় আমাদের জীবন দিয়ে এর মূল্য পরিশোধ করি।  

আমাদের জন্য, সর্বহারাদের জন্য, বেছে নেওয়ার মতো কোনও পক্ষ নেই, আমাদের কোনও স্বদেশ নেই, রক্ষা করার মতো কোনও জাতি নেই! সীমান্তের দু'পাশে, আমরা একই শ্রেণিসম্পর্কের সহোদর! আমরা না ইসরায়েল, না ফিলিস্তিন!

মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের কোন শেষ নেই সমগ্র বিংশ শতাব্দী ছিল যুদ্ধের এক শতাব্দী মানব ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস যুদ্ধগুলি সংঘঠিত হয়েছে এই শতাব্দীতে, এবং এই যুদ্ধগুলির কোনটিও  শ্রমিকদের স্বার্থে সংগঠিত হয় নিআমরা দেখেছি কখনো সেটা  "পিতৃভূমি", কখনো "সভ্যতা", কখনো "গণতন্ত্র", এমনকি কখনো "সমাজতান্ত্রিক পিতৃভূমি" (যেমন কেউ কেউ স্ট্যালিন এবং গুলাগের সোভিয়েত ) রক্ষার নামে তাদের শোষকদের স্বার্থে  লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করার জন্য সর্বদা আহ্বান জানিয়ে ছিলো

আজ মধ্যপ্রাচ্যে আবার এক নতুন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। উভয় পক্ষের শাসকশক্তি  ইহুদি বা ফিলিস্তিনি নির্বিশেষে শোষিতদের "স্বদেশ রক্ষার" আহ্বান জানাচ্ছে। অথচ ইসরায়েলে ইহুদি শ্রমিকরা ইহুদি  পুঁজিপতিদের দ্বারা শোষিত হয় এবং  ফিলিস্তিনির শ্রমিকরা একই সাথে ইহুদি পুঁজিপতিদের ও  আরব পুঁজিপতিদের দ্বারা শোষিত হয় (এবং প্রায়শই ইহুদি পুঁজিপতিদের  তুলনায় আরব পুঁজিপতিরা অনেক বেশি হিংস্র, যেহেতু ফিলিস্তিনি সংস্থাগুলিতে শ্রমআইন এখনও প্রাক্তন উসমানীয় সাম্রাজ্যের মতো)।

ইহুদি শ্রমিকরা  ১৯৪৮ সাল থেকে  পাঁচটি যুদ্ধের শিকার হয়েছে।  বুর্জোয়াদের যুদ্ধ উন্মাদনার জন্য ইতিমধ্যে তাদের ভারী মূল্য দিতে হয়েছে। বিশ্বযুদ্ধে বিপর্যস্ত  ইউরোপের  কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প এবং ঘেটোর ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা থেকে বেরিয়ে আসা  শ্রমজীবী মানুষের উত্তরসূরীরা পরে  ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধে সাহালের (ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী) ইউনিফর্ম পরছেন। আমরা দেখেছি,  '৬৭, '৭৩ ও '৮২ সালের যুদ্ধে তাদের বাবা-মা রক্তের মূল্য   পরিশোধ করেছেন। এই সৈন্যরা সত্যিই কি এতটা জঘন্য নৃশংস হতে চায়, যাদের একমাত্র চিন্তা হবে ফিলিস্তিনি শিশুদের হত্যা করা ?  তারা সবাই তরুণ সৈন্য, যাদের অধিকাংশই শ্রমিক, তারা পুলিশ হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে এবং তাদের মাথা আরবদের "বর্বরতা" সম্পর্কে প্রচারণায় ভরে গেছে।      

ফিলিস্তিনি শ্রমিকরাও এরই মধ্যে রক্তের ভয়াবহ মূল্য পরিশোধ করেছে। ১৯৪৮ সালে তাদের নেতাদের দ্বারা পরিচালিত যুদ্ধের দ্বারা তাদের বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত হয়ে, তারা তাদের জীবনের বেশিরভাগ সময় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে কাটিয়েছে, ফাতাহ, পিএফএলপি বা হামাস মিলিশিয়াদের সাথে কিশোর বয়সে যুক্ত হয়েছে।

ফিলিস্তিনিদের উপর সবচেয়ে বড় গণহত্যা ইসরাইলের সেনাবাহিনী দ্বারা সংঘটিত হয়নি, বরং জর্ডান এবং লেবাননের মতো যেসব দেশে তাদের পার্ক করা হয়েছিল: ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বরে ("ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর") "লিটল কিং" হুসেইন তাদের গণহারে হত্যা করেছিলেন, এমন পর্যায়ে যেখানে তাদের কেউ কেউ মৃত্যু থেকে বাঁচতে ইসরায়েলে আশ্রয় নিয়েছিল। ১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বরে, আরব মিলিশিয়ারা (স্বীকৃতভাবে খ্রিস্টান এবং ইসরায়েলের মিত্র) বেইরুটের সাবরা এবং শাতিলা শিবিরে তাদের গণহত্যা করেছিল।  

জাতীয়তাবাদ এবং ধর্ম, শোষিতদের জন্য বিষ  আজ, "ফিলিস্তিনি মাতৃভূমি" এর নামে, আরব শ্রমিকদের আবারও ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে একত্রিত করা হচ্ছে, যাদের বেশিরভাগই হচ্ছে ইসরায়েলি শ্রমিক, সেই তাদেরকেই  "প্রতিশ্রুত ভূমি" রক্ষায় আত্মাহূতি দিতে বলা হচ্ছে।

জাতীয়তাবাদী প্রোপাগান্ডা উভয় দিক থেকে ঘৃণ্যভাবে প্রবাহিত হয়, মনকে অসাড় করে তোলে ।  মানুষকে হিংস্র পশুতে পরিণত করার জন্য এই প্রোপাগান্ডা ডিজাইন করা হয়। ইসরায়েলি এবং আরব বুর্জোয়ারা অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এটিকে উত্তেজিত করে চলেছে। ইসরায়েলি এবং আরব শ্রমিকদের ক্রমাগত বলা হয়েছে যে তাদের অবশ্যই  পূর্বপুরুষদের ভূমি রক্ষা করতে হবে। সমাজব্যবস্থার মধ্যেই একটা নিয়মতান্ত্রিক সামরিকীকরণের পদ্ধতি  "ভাল সৈন্যে" নির্মাণের একটি সাইকোসিস তৈরি করেছে।  নিজের  বাসস্থান খুঁজে নেওয়ার জন্য ইস্রায়েলের সাথে যুদ্ধ করার আকাঙ্ক্ষাকে  জাগ্রত করা হয়েছে । সেইসব দেশের নেতারাই এই আকাঙ্খাকে জাগ্রত করছে যে সব দেশের নেতারা তাদের নাগরিকদের অনেককেই  কয়েক দশক ধরে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে রেখেছিলেন।

বুর্জোয়াদের উদ্ভাবিত সবচেয়ে খারাপ মতাদর্শগুলির মধ্যে একটি জাতীয়তাবাদ।  এটা সেই মতাদর্শ যা শোষক ও শোষিতদের মধ্যে শত্রুতা ঢাকতে দেয়, তাদের সবাইকে একই পতাকার আড়ালে একত্রিত করতে দেয়, যার জন্য শোষকদের সেবায়, শাসক শ্রেণীর স্বার্থ ও সুযোগ-সুবিধা রক্ষায় শোষিতদের হত্যা করা হয়।

সবকিছুর মুকুট পরানোর জন্য, এই যুদ্ধে ধর্মীয় প্রচারণার বিষ যুক্ত করা হয়েছে, যা এই পরিস্থিতে আরো  নিষ্ঠুর ধর্মান্ধতা তৈরি করেছে। ইহুদির আহ্বান জানানো হচ্ছে  তাদের রক্ত দিয়ে  সলোমনের মন্দিরের  প্রাচীর রক্ষা করতে। মুসলমানদের আহ্বান জানানো হচ্ছে  ওমর মসজিদ এবং  ইসলামের পবিত্র স্থানগুলির জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করতে ।  ঊনিশ শতকের বিপ্লবীরা ধর্ম সম্পর্কে যেটা বলেছিলেন, ‘জনগণের আফিম’ সেটা ইসরাজিল ও ফিলিস্তিনে এখন বেশি করে প্রমাণিত হচ্ছে। ধর্মের উদ্দেশ্য হচ্ছে শোষিত ও নিপীড়িতদের সান্ত্বনা দেওয়া। যাদের জন্য পৃথিবীতে জীবন জাহান্নাম, তাদের বলা হয় যে তারা তাদের মৃত্যুর পরে সুখী হবে যদি তারা জানে কিভাবে তাদের পরিত্রাণ অর্জন করতে হয়। এবং এই পরিত্রাণ ত্যাগ, আত্মসমর্পণ, এমনকি "পবিত্র যুদ্ধের" সেবায় তাদের জীবন উৎসর্গ করার বিনিময়ে বিনিময় করা হয়।

একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে, প্রাচীনকাল বা মধ্যযুগের মতাদর্শ এবং কুসংস্কারগুলি এখনও মানুষকে তাদের জীবন উৎসর্গ করার জন্য পরিচালিত করার জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।   মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশ্বের অন্যান্য অনেক অংশের মানুষেরা এখনো এর মধ্যে গভীরভাবে নিমজ্জমান।

পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিগুলো এই যুদ্ধের জন্য দায়ী বৃহৎ শক্তির নেতারাই এমন এক  নারকীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন, যেখানে এই অঞ্চলের হাজার হাজার শোষিত মানুষ মারা যাচ্ছে। ইউরোপীয় বুর্জোয়ারা, বিশেষত ব্রিটিশ বুর্জোয়ারা ১৯১৭ সালের "বালফোর" ডিক্লিয়ারেশনের মধ্য দিয়ে তাদের তাদের ‘বিভক্ত ও জয়’ করার নীতিকে চরিতার্থ করার জন্য  ফিলিস্তিনে একটি "ইহুদি আবাস" তৈরির অনুমতি দিয়েছিল।  এই ভাবে জায়োনিজমের আধিপত্যবাদী ইউটোপিয়াগুলিকে উৎসাহিত করা হয়েছিল। এই একই  বুর্জোয়ারা যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জিতেছিল, তারা মধ্য ইউরোপীয় ইহুদিদের শিবির ছেড়ে  তাদের মূল অঞ্চল থেকে দূরে বিতারিত করার পর ফিলিস্তিনে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। এর অর্থ হ'ল তাদের নিজেদের বাসভূমিতে নিয়ে যেতে হবে না।  

এই একই বুর্জোয়ারা, প্রথমে ব্রিটিশ এবং ফরাসি, তারপর আমেরিকান বুর্জোয়ারা, যারা স্নায়ুযুদ্ধের সময় এই অঞ্চলে পশ্চিমা ব্লকের নেতৃত্বের ভূমিকা দেওয়ার জন্য ইস্রায়েল রাষ্ট্রকে দাঁত পর্যন্ত সশস্ত্র করেছিল, যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন তার পক্ষে তার আরব মিত্রদের যতটা সম্ভব সশস্ত্র করেছিল। এই মহান "পৃষ্ঠপোষক" ছাড়া, 1956, 67, 73 এবং 82 এর যুদ্ধগুলি ঘটতে পারত না।

আজ লেবানন, ইরান এবং সম্ভবত রাশিয়ার বুর্জোয়ারা হামাসকে অস্ত্র দিয়ে সমৃদ্ধ করছে। যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ভূমধ্যসাগরে তাদের বৃহত্তম বিমানবাহী রণতরী পাঠিয়েছে এবং ইসরায়েলে নতুন অস্ত্র সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, সমস্ত বৃহৎ শক্তি এই যুদ্ধ এবং এই গণহত্যায় কমবেশি প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিচ্ছে! 

এই নতুন যুদ্ধ পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দিচ্ছে! বিশ্বের এই প্রান্তকে শুধু শোকের মধ্যে নিমজ্জিত করার জন্য  রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এটা নয়, সংগঠিত হত্যাকাণ্ডের মাত্রা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে বর্বরতা একটি নতুন স্তরে পৌঁছেছে: তরুণরা মেশিনগান নিয়ে একটি উত্সবে নাচছে, প্রকাশ্য রাস্তায় পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে নারী ও শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে।  অন্ধ  প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা ছাড়া আর কোনও উদ্দেশ্য নেই, পুরো জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করার জন্য বোমার কার্পেট বেছানো হয়েছে।  গাজার ২০ লাখ মানুষ জল, বিদ্যুৎ, গ্যাস, খাদ্যসহ সবকিছু থেকে বঞ্চিত। এই সমস্ত নৃশংসতার, এই সমস্ত অপরাধের কোনও সামরিক যুক্তি নেই! দু'পক্ষই সবচেয়ে ভয়ংকর ও অযৌক্তিক প্রাণঘাতী ক্রোধে জর্জরিত!

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে: এই প্যান্ডোরার বাক্সটি আর কখনও বন্ধ হবে না। ইরাকের মতো  আফগানিস্তান, সিরিয়া ও লিবিয়াতেও আর কখনো  'শান্তিতে ফিরে আসবে না'। পুঁজিবাদ মানবতার বৃহত্তর অংশকে যুদ্ধ, মৃত্যু এবং সমাজের পতনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেনে যুদ্ধ ইতিমধ্যে প্রায় দুই বছর ধরে চলছে এবং অন্তহীন হত্যাযজ্ঞে নিমজ্জিত। নাগোর্নো-কারাবাখেও গণহত্যা চলছে। ইতিমধ্যে প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়ার দেশগুলির মধ্যে একটি নতুন যুদ্ধের হুমকি রয়েছে। পুঁজিবাদ হচ্ছে যুদ্ধ!

যুদ্ধের অবসান ঘটাতে হলে পুঁজিবাদকে উৎখাত করতে হবে।

সকল দেশের শ্রমিকদের অবশ্যই যে কোন বুর্জোয়া শিবিরের পক্ষ নিতে অস্বীকার করতে হবে। বিশেষ করে যেসব বাম ও চরম বামপন্থি দলগুলো, নিজেদের শ্রমিকশ্রেণির দল বলে  দাবি করে, অথচ 'মাতৃভূমির' অধিকারের জন্য 'ফিলিস্তিনি জনগণের সঙ্গে সংহতি' দেখানোর  আহ্বান জানায়, তাদের বাগাড়ম্বরকে অস্বীকার করতে হবে। বোকা বনানোর কৌশলকে অস্বীকার করতে হবে। মনে রাখতে হবে,  ফিলিস্তিনি মাতৃভূমি কখনোই শোষকশ্রেণির সেবায় নিয়োজিত বুর্জোয়া রাষ্ট্র  ছাড়া আর কিছুই হবে না, তারাও  পুলিশ ও কারাগার দিয়ে এই একই  জনগণকে নিপীড়ন করবে। সবচেয়ে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির শ্রমিকদের সংহতি "ফিলিস্তিনি ও "ইসরায়েলিদের" সেই সমস্ত শ্রমিকদের কাছে পৌঁছায় না যাদের নিজেদের মধ্যে শোষক এবং শোষিতের বিভাজন রয়েছে। এটি ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের সেইসব শ্রমিক ও বেকারদের কাছে  যায় ( যারা তাদের সমস্ত মগজধোলাই সত্ত্বেও ইতিমধ্যে তাদের শোষকদের বিরুদ্ধে  সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে ), ঠিক যেমনটি বিশ্বের অন্যান্য সমস্ত দেশের শ্রমিকদের ক্ষেত্রে যায়। সেটাই হবে শ্রমিকদের সর্বোত্তম সংহতি, যা  তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী বিভ্রমকে উৎসাহিত করবে না।

এই সংহতির অর্থ সর্বোপরি সমস্ত যুদ্ধের জন্য দায়ী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের লড়াই, তাদের নিজস্ব বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তোলা।

বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদকে উৎখাত করে শ্রমিক শ্রেণীকে শান্তি অর্জন করতে হবে, এবং আজ এর অর্থ হল শ্রেণিসচেতন লাইনেই নিজেদের সংগ্রামকে বিকশিত করতে হবে। অপ্রতিরোধ্য  অর্থনৈতিক আক্রমণের বিরুদ্ধে শ্রেণিসংগ্রামকে বিকশিত করাটাই কাজ।

জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে, যে শোষকরা শোষিতকে যুদ্ধে সামিল করতে চায় তার বিরুদ্ধে:
সকল দেশের শ্রমিকেরা, ঐক্যবদ্ধ হও!  

ICC, 9 October 2023

ইসরায়েল, গাজা, ইউক্রেন, আজারবাইজানে গণহত্যা ও যুদ্ধ... পুঁজিবাদ মৃত্যুর বীজ বপন করে! আমরা কিভাবে এটা থামাতে পারি?

"ভয়াবহতা", "গণহত্যা", "সন্ত্রাসবাদ", "সন্ত্রাস", "যুদ্ধাপরাধ", "মানবিক বিপর্যয়", "গণহত্যা"... আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রথম পাতায় ছড়িয়ে পড়া শব্দগুলো গাজায় বর্বরতার মাত্রা সম্পর্কে অনেক কিছু বলে।

৭ ই অক্টোবর হামাস ১,৪০০ ইসরায়েলিকে হত্যা করে। বাড়িতে থাকা অবস্থাতেই  তারা বৃদ্ধ পুরুষ, মহিলা এবং শিশুদের হত্যা করে। এই ঘটনার পর থেকে ইসরাইল এর প্রতিশোধ নিতে শুরু করে এবং এখনো ব্যাপকভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। গাজায় দিন-রাত বোমা বর্ষণের ফলে ইতিমধ্যে ৪,৮০০ শিশুসহ ১০,০০০ এরও বেশি ফিলিস্তিনি মারা গেছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িতে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা জল, বিদ্যুৎ, খাদ্য এবং ওষুধ সহ সবকিছু থেকে বঞ্চিত। ঠিক  এই মুহুর্তে, আড়াই মিলিয়ন গাজাবাসী অনাহার এবং মহামারীর আতঙ্কে রয়েছে।  তাদের মধ্যে ৪০০,০০০ গাজা শহরে বন্দী রয়েছে।   প্রতিদিন শত শত লোক ক্ষেপণাস্ত্র  এবং বুলেটের সম্মুখীন হচ্ছে, তারা  ছিন্নভিন্ন হয়ে নিহত হচ্ছে, এবং ট্যাংক দ্বারা পিষ্ট হচ্ছে।  

ইউক্রেনের মতো গাজার সর্বত্রই মৃত্যু। রাশিয়ান সেনাবাহিনী কর্তৃক  মারিওপোলের ধ্বংস, মানুষের পলায়ন, কিম্বা ট্রেঞ্চযুদ্ধ যা জ্যান্ত মানুষকে কবর দেয় তা ভুলে যাবেন না। এখনও পর্যন্ত প্রায় ৫ ০০,০০০ মানুষ মারা গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নিহতের সংখ্যা উভয় পাশেই প্রায় সমান সমান। রুশ ও ইউক্রেনীয়দের একটি পুরো প্রজন্মকে এখন মাতৃভূমি রক্ষার নামে জাতীয় স্বার্থের বেদীতে উৎসর্গ করা হচ্ছে।  এছারাও আরো কিছু ঘটনা ঘটেছে : সেপ্টেম্বরের শেষে, নাগোর্নো-কারাবাখে, আজারবাইজানি সেনাবাহিনী এবং গণহত্যার হুমকির মুখে 100,000 মানুষ পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। ইয়েমেনে যে সংঘাতের কথা কেউ বলে না, তাতে দুই লাখেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এবং ২৩ লাখ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। ইথিওপিয়া, মিয়ানমার, হাইতি, সিরিয়া, আফগানিস্তান, মালি, নাইজার, বুরকিনা ফাসো, সোমালিয়া, কঙ্গো, মোজাম্বিকে একই ধরনের যুদ্ধ চলছে। সার্বিয়া ও কসোভোর মধ্যে সংঘাত চলছে।

এই বর্বরতার জন্য কে দায়ী? যুদ্ধ কতদূর যেতে পারে? এবং সর্বোপরি, কোন শক্তি এর বিরোধিতা করতে পারে?

সব দেশই যুদ্ধাপরাধী

এই লেখার সময়, সমস্ত দেশ ইসরায়েলকে তার আক্রমণ "পরিমিত" বা "স্থগিত" করার আহ্বান জানিয়েছে  । দেড় বছর আগে ইউক্রেনে একই নৃশংসতার সঙ্গে হামলা চালানো এবং ১৯৯৯ সালে একই 'সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের' নামে চেচনিয়ায় তিন লাখ বেসামরিক  নাগরিককে হত্যা করে রাশিয়া।একদিকে  চিন বলছে, তারা শান্তি চায়, কিন্তু অন্যদিকে তারা উইঘুর  জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করছে এবং তাইওয়ানের অধিবাসীদের আরও বেশি দাবানলের হুমকি দিচ্ছে। সৌদি আরব ও তার আরবমিত্ররা একদিকে ইয়েমেনের জনগণকে ধ্বংস করে এবং একই সাথে ইসরায়েলি আক্রমণের অবসান চায়। এদিকে তুরস্ক কুর্দিদের নির্মূল করার স্বপ্ন দেখে কিন্তু গাজায় হামলার বিরোধিতা করে। "ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার"কে  সমর্থন করার  সাথে সাথে প্রধান  গণতান্ত্রিক দেশগুলি,  এখন "মানবিক যুদ্ধবিরতি" এবং "আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা"র  আহ্বান জানাচ্ছে। বলা বাহুল্য, এই সমস্ত গণতান্ত্রিক দেশগুলি সেই ১৯১৪ সাল থেকে উল্লেখযোগ্য এবং ধারাবাহিকভাবে গণহত্যায় তাদের দক্ষতা প্রদর্শন করে চলেছে।    

বর্তমানে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রাথমিক যুক্তি: "গাজার ধ্বংস বৈধ", যেভাবে একসময় হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে ফেলা পারমাণবিক বোমা এবং ড্রেসডেন এবং হামবুর্গে কার্পেট-বোমা হামলার বিষয়েও যে কথা বলা হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ও ইরাকে একই  যুক্তি এবং একই পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালিয়েছিল যা আজ ইসরায়েল চালাচ্ছে।  সব দেশই যুদ্ধাপরাধী! বড় বা ছোট, আধিপত্যবাদী বা শক্তিশালী, আপাতদৃষ্টিতে যুদ্ধবাজ বা মধ্যপন্থী, তারা সকলেই বাস্তবে বিশ্ব-অঙ্গনে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে এবং তারা সবাই শ্রমিক শ্রেণীকে  কামানের খাদ্য হিসাবে বিবেচনা করছে।

এই ভণ্ডামি এবং প্রতারণামূলক কণ্ঠস্বরই এখন আমাদেরকে শান্তির জন্য তাদের অভিযানে সামিল করবে এবং তাদের সমাধানে বিশ্বাস করতে বাধ্য করবে, যেটা হলো, ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনকে দুটি স্বাধীন এবং স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া। ফিলিস্তিনি  যদি স্বায়ত্বশাসিত রাষ্ট্র হয়, তবু  সেই রাষ্ট্রটি কেমন হবে সেটা  হামাস এবং ফাতাহ ইতিমধ্যেই  তার পূর্বাভাস দিচ্ছে।  অন্য সবার মতো এটিও শ্রমিকদের শোষণ করবে; অন্য সকলের মতো, এটি জনগণকে দমন করবে; অন্য সবার মতো এটিও যুদ্ধে যাবে। পৃথিবীতে ইতিমধ্যে 195 টি  "স্বাধীন এবং স্বায়ত্তশাসিত" রাষ্ট্র রয়েছে। তারা সম্মিলিতভাবে "প্রতিরক্ষার জন্য বছরে 2,000 বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ব্যয় করে! আর ২০২৪ সালের মধ্যে এইখাতের খরচ  বিস্ফোরিত হতে চলেছে।

বর্তমান যুদ্ধ: পৃথিবীকে পুড়িয়ে ফেলার নীতি

তাহলে জাতিসংঘ হঠাৎ কেন ঘোষণা করেছে: "আমাদের অবিলম্বে মানবিক  কারণে যুদ্ধবিরতি প্রয়োজন। ত্রিশ দিন হয়ে গেছে। যথেষ্ট হয়েছে। এটা  এখনই বন্ধ করতে হবে"”। স্পষ্টতই, ফিলিস্তিনের মিত্ররা ইসরায়েলি আক্রমণের অবসান চায়। ইসরায়েলের মিত্রদের কথা বলতে গেলে অর্থাৎ যে "মহান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি" "আন্তর্জাতিক আইন"  কে সম্মান করে বলে দাবি করে, তারা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে কিছু না বলে যা খুশি করতে চায় তা করতে দিতে পারে না। আইডিএফ-এর গণহত্যা দিনের আলোর মতো দৃশ্যমান।  গণতান্ত্রিক দেশগুলি  ইউক্রেনকে "রাশিয়ান আগ্রাসন"  এবং  "যুদ্ধাপরাধের" বিরুদ্ধে সামরিক  সহায়তা প্রদান করছে এবং এখন তারা মনে করছে দুটি "আগ্রাসনের" বর্বরতা খুব বেশি অনুরূপ হতে দেওয়া উচিত নয়।  

কিন্তু এর চেয়েও গভীর কারণ আছে: সবাই বিশৃঙ্খলার সীমা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে।  কারণ এর ফলে সবাই প্রভাবিত হতে পারে।  যদি এই সংঘাত খুব বেশি দূরে ছড়িয়ে পড়ে তবে প্রত্যেকেরই হারানোর কিছু না কিছু আছে। হামাসের হামলা এবং ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে একটি মিল রয়েছে: পৃথিবীকে পুড়িয়ে ফেলার নীতি। গতকালের সন্ত্রাসী গণহত্যা এবং আজকের কার্পেট বোমা হামলা কোনও সত্যিকারের এবং স্থায়ী বিজয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে না। এই যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীলতা ও সংঘাতের যুগে নিমজ্জিত করছে।

ইসরায়েল যদি গাজাকে ধ্বংস করে ধ্বংসস্তূপের নিচে পুঁতে ফেলতে থাকে, তাহলে পশ্চিম তীরেও আগুন লাগার আশঙ্কা রয়েছে।  হিজবুল্লাহ লেবাননকে যুদ্ধের দিকে টেনে নিয়ে যাবে এবং ইরানও এতে জড়িয়ে পড়বে। পুরো অঞ্চলজুড়ে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়া কেবল আমেরিকান প্রভাবের জন্য নয়, চিনের বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্যও আঘাত হবে। কারণ চিনের মূল্যবান সিল্করোড এই অঞ্চলের মধ্য দিয়েই গেছে। 

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের হুমকি সবার মুখে মুখে। সাংবাদিকরা প্রকাশ্যে টেলিভিশনে এ নিয়ে বিতর্ক করছেন। বাস্তবে বর্তমান পরিস্থিতি অনেক বেশি বিপজ্জনক। ১৯১৪-১৮ এবং ১৯৩৯-৪৫ সালের মতো বা স্নায়ুযুদ্ধের পুরো সময়জুড়ে একে অপরের মুখোমুখি হয়ে সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো এবং সুনির্দিষ্ট  দুটি ব্লক নেই। যদিও চিন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের  প্রতিযোগিতা ক্রমবর্ধমান নৃশংস এবং নিপীড়নমূলক।  অন্য দেশগুলি এই দুটি বৃহৎ গোষ্ঠীর মধ্যে একটি বা অন্যটির আদেশের কাছে মাথা নত করছে না।  তারা বিশৃঙ্খলা, অনিশ্চয়তা এবং ডামাডোলের মধ্যে তাদের নিজস্ব খেলা খেলছে।  চিনের পরামর্শের  বিরুদ্ধে ইউক্রেন আক্রমণ করেছে রাশিয়া। ইসরাইল আমেরিকার পরামর্শের বিরুদ্ধে গাজাকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। এই দুটি সংঘাত সেই বিপদের প্রতীক যা সমগ্র মানবজাতিকে ধ্বংসের হুমকি দেয়। এটি যুদ্ধের বহুগুণ যার একমাত্র লক্ষ্য প্রতিপক্ষকে অস্থির করে তোলা বা ধ্বংস করা। এটি হলো সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং ধ্বংসাত্মক বহিষ্কারের  একটি অন্তহীন শৃঙ্খল। এখন প্রতিটি মানুষ নিজের জন্য, যে দর্শন আসলে অনিয়ন্ত্রিত বিশৃঙ্খলার সমার্থক ছাড়া অন্য কিছুই নয়।  

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং পূর্ব এশিয়ার সর্বহারাদের পিতৃভূমির নামে তাদের জীবন উৎসর্গ করা, পতাকা ও জাতীয় স্বার্থের জন্য অস্ত্র তুলে নেওয়া এবং একে অপরকে হত্যা করতে প্রস্তুত থাকা, যা মোটেও আজকের বাস্তবতা নয়।   কিন্তু যেখানে ইতিমধ্যেই এই ধ্বংস প্রক্রিয়া চলছে সেখানে নতুন করে জনগণের আর সামিল হওয়ার প্রয়োজন নেই। ২০০০ এর দশকের গোড়ার দিকে, পৃথিবীর বিস্তৃত অংশ সহিংসতা এবং বিশৃঙ্খলায় নিমজ্জিত হয়েছে: আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, লেবানন, ইউক্রেন, ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন... এই গ্যাংগ্রিন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে, দেশে দেশে

অঞ্চলে অঞ্চলে। শোষণের এই ক্ষয়িষ্ণু ও পচনশীল ব্যবস্থাই হলো পুঁজিবাদের একমাত্র সম্ভাব্য ভবিষ্যত।

যুদ্ধের অবসান ঘটাতে হলে পুঁজিবাদকে উৎখাত করতে হবে

সম্ভাব্য শান্তি, "আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়", জাতিসংঘ বা অন্য কোনও চোরের আস্তানা থেকে কোনও সমাধান সম্পর্কে শ্রমিকদের কোনও বিভ্রান্তি থাকা উচিত নয়। পুঁজিবাদ হচ্ছে যুদ্ধ। 1914 সাল থেকে, এটি কার্যত কখনও থামেনি। সর্বদাই  বিশ্বের এক অংশ  অন্য অংশকে প্রভাবিত করে চলেছে। আমাদের সামনের ঐতিহাসিক সময়কালে এই প্রাণঘাতী গতিশীলতা ক্রমবর্ধমান অপরিমেয় বর্বরতার সাথে ছড়িয়ে পড়বে এবং প্রসারিত হবে।

সুতরাং প্রতিটি দেশের শ্রমিকদের অবশ্যই এই দায়ভার বহন করতে অস্বীকার করতে হবে।  তাদের অবশ্যই প্রাচ্যে, মধ্যপ্রাচ্যে এবং সর্বত্র এক বা অন্য বুর্জোয়া শিবিরের পক্ষ নিতে অস্বীকার করতে হবে। তাদের অবশ্যই "আক্রমণের মুখে ইউক্রেনীয় জনগণ", "রাশিয়া হুমকির মুখে",  "শহীদ ফিলিস্তিনি জনগণের" সাথে এবং "আতঙ্কিত ইসরায়েলিদের" সাথে "সংহতি" দেখানোর জন্য বলা বাগাড়ম্বর দ্বারা বোকা হতে অস্বীকার করতে হবে।  সমস্ত যুদ্ধে, সীমান্তের উভয় পাশের রাষ্ট্র সর্বদা মানুষকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে যে, ভাল এবং মন্দের মধ্যে, বর্বরতা এবং সভ্যতার মধ্যে লড়াই রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে, এই সমস্ত যুদ্ধ সবসময় প্রতিদ্বন্দ্বী জাতিগুলির মধ্যে, প্রতিদ্বন্দ্বী বুর্জোয়াদের মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব। এই সমস্ত দ্বন্দ্বে সবসময় শোষিতরা তাদের শোষকদের সুবিধার জন্য মারা যায়।

শ্রমিকদের সংহতি তাই "ফিলিস্তিনিদের" প্রতি নয়, একইভাবে এটি  "ইস্রায়েলি", "ইউক্রেনীয়" বা "রাশিয়ানদের" প্রতিও নয়, কারণ এই সমস্ত জাতীয়তার মধ্যে শোষক এবং শোষিত নামে দুটি পৃথক স্বার্থের শ্রেণি রয়েছে।  শ্রমিকদের সংহতি  ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, রাশিয়া,  ইউক্রেনের শ্রমিক এবং বেকারদের প্রতি, ঠিক একইভাবে শ্রমিকদের সংহতি   বিশ্বের অন্যান্য দেশের শ্রমিকদের প্রতিও। "শান্তির জন্য" মিছিল করে নয়,  যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত কোন এক পক্ষের প্রতি সহমর্মিতা নয়। আসলে উভয়পক্ষের সাধারণ মানুষ, সৈন্য, উর্দিধারী সর্বহারা, এবং প্ররোচিত ধর্মান্ধ শিশুসৈন্য সকলেই কামানের খাবার।

 সর্বহারার একমাত্র সংহতি হল সমস্ত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের নিন্দা করা।  যে সমস্ত দল আমাদের বিভিন্ন জাতীয় পতাকা, যুদ্ধের নানাবিধ কারণের পিছনে একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানায় কিম্বা  যারা শান্তি এবং মানুষের মধ্যে "সুসম্পর্কের" বিভ্রম দিয়ে আমাদের প্রতারিত  করে তাদের সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখান করা।   

শ্রমিক সংহতির অর্থ সর্বোপরি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইকে বিকশিত করা যা সমস্ত যুদ্ধের জন্য দায়ী। শ্রমিক শ্রেণির লড়াই  জাতীয় বুর্জোয়া এবং তাদের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে।

ইতিহাস দেখিয়েছে যে শষিতশ্রেণি হলো একমাত্র শক্তি যে পুঁজিবাদী যুদ্ধের অবসান ঘটাতে পারে।  সর্বহারা শ্রেণী হলো বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রত্যক্ষ শত্রু। ১৯১৭ সালের অক্টোবরে রাশিয়ার  শ্রমিকরা বুর্জোয়া রাষ্ট্রকে উৎখাত করে এবং ১৯১৮ সালের নভেম্বরে জার্মানির শ্রমিক ও সৈন্যরা বিদ্রোহ করে।  সর্বহারা শ্রেণীর সংগ্রামের এই মহান আন্দোলনগুলি সরকারকে যুদ্ধবিরতিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছিল।  বিপ্লবী সর্বহারাশ্রেণীর শক্তিই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটায়।  শ্রমিক শ্রেণীকে বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদকে উৎখাত করে সর্বত্র প্রকৃত ও সুনির্দিষ্ট শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

এক দীর্ঘ পথ আমাদের সামনে।  একটি অপ্রতিরোধ্য সংকটের মধ্যে নিমজ্জিত একটি ব্যবস্থা যা  আমাদের উপর ক্রমবর্ধমান কঠোর অর্থনৈতিক আক্রমণ নামিয়ে এনেছে তার  বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণিকে তার নিজস্ব শ্রেণিগন্ডীর মধ্যেই সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে।  আমাদের জীবনযাত্রা ও কর্মপরিবেশের অবনতিকে প্রত্যাখ্যান করে, বাজেটের ভারসাম্য বজায় রাখার  নামে, জাতীয় অর্থনীতির প্রতিযোগিতা বা যুদ্ধপ্রচেষ্টার নামে করা চিরন্তন ত্যাগকে প্রত্যাখ্যান করে আমরা পুঁজিবাদের কেন্দ্রভূমিতে দাঁড়িয়ে মানুষের দ্বারা মানুষের শোষনকে অস্বীকার করতে শুরু করেছি।  

এইসব সংগ্রামে, আমরা যখন ঐকবদ্ধ এবং সংগঠিত হই, আমরা একসাথে দাঁড়াই, আমরা আমাদের সংহতি গড়ে তুলি, আমরা বিতর্ক  করি এবং তখন আমাদের শক্তি সম্পর্কে সচেতন হই ।  শ্রেণিসংগ্রামে সর্বহারা শ্রেণি তার মধ্যে এমন একটি বিশ্বে সম্ভাবনা বহন করে যা পুঁজিবাদের ঠিক  বিপরীত। একদিকে অর্থনৈতিক ও যুদ্ধের মতো প্রতিযোগিতায় নিয়োজিত জাতিসমূহ বিভাজিত এবং ধ্বংসের পর্যায়ে; অন্যদিকে, বিশ্বের সমস্ত শোষিতদের একটি সম্ভাব্য ঐক্য। সর্বহারা শ্রেণী  এই দীর্ঘ পথে হাঁটতে শুরু করেছে। তার মধ্যে ২০২২ সালে যুক্তরাজ্যে "অসন্তোষের গ্রীষ্ম" , ২০২৩ সালের গোড়ার দিকে ফ্রান্সে  পেনশন সংস্কারের  বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও অটোমোবাইল খাতে ঐতিহাসিক ধর্মঘট হলো কতগুলি গুরুত্ত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই আন্তর্জাতিক  গতিশীলতা শ্রমিকদের লড়াইয়ের ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তনকে চিহ্নিত করে, সেইসাথে জীবনযাত্রা ও কাজের অবস্থার স্থায়ী অবনতি মেনে নিতে অস্বীকার করা  এবং সংগ্রামে শ্রমিক হিসাবে বিভিন্ন সেক্টর এবং প্রজন্মের মধ্যে সংহতি প্রদর্শনের প্রবণতাকে চিহ্নিত করে। ভবিষ্যতে আন্দোলনকে অর্থনৈতিক সংকট ও যুদ্ধের মধ্যে যোগসূত্র চিনতে হবে,এছাড়াও রাষ্ট্রের দাবি করা ত্যাগের সাথে  অস্ত্র বাজেট ও নীতির বিকাশের মধ্যে সম্পর্ক আবিষ্কার করতে হবে।  অচল বিশ্ব পুঁজিবাদ যে সব অর্থনৈতিকসংকট, যুদ্ধ এবং জলবায়ু সংকটের মতো  আন্তঃসম্পর্কযুক্ত এবং পারস্পরিক পুষ্টিপ্রদানকারী অভিশাপগুলিকে বয়ে আনছে সেগুলিকে চিনতে হবে।   

জাতীয়তাবাদের স্বপক্ষে, আমাদের শোষকরা যে সব যুদ্ধে আমাদের টেনে আনতে চায়, সেক্ষেত্রে ১৮৪৮ সালের কমিউনিস্ট ইশতেহারে প্রকাশিত শ্রমিক আন্দোলনের পুরোনো প্রহরীশব্দগুলো  আজ আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক:

 

শ্রমিকদের কোনো স্বদেশ নেই!

দুনিয়ার মজদুর এক হোক!

আন্তর্জাতিক সর্বহারা শ্রেণির শ্রেণিসংগ্রামের বিকাশের জন্য!

 

আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট কারেন্ট, ৭ নভেম্বর ২০২৩

 

কিভাবে আমরা একটি বিশাল ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে একসাথে লড়াই করতে পারি?

গত জুনমাস থেকে অদ্যাবধি বৃটেনের প্রতিটি আন্দোলনে একই আর্তি প্রতিধ্বনিত হয়েছে –

‘অনেক হয়েছে, অনেক !’

আমরা দেখলাম,’ক্রোধের গ্রীষ্ম ' নামে পরিচিত এই বৃহদাকার আন্দোলন ক্রমেই 'ক্রোধের শরত' ও পরবর্তীতে 'ক্রোধের শীতে ' রূপান্তরিত হয়েছে।

ইউকে তে একের পর এক আন্দোলনের ঢেউ বিশ্ব জোড়া শ্রমিক শ্রেণির  সংগ্রামী শক্তির ক্রমাগত বৃদ্ধিকেই চিহ্নিত করেছেঃ

- স্পেনে, মাদ্রিদ সংলগ্ন অঞ্চলে ডাক্তার ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা ধর্মঘট শুরু করে নভেম্বরের শেষের দিকে, একই সঙ্গে ডিসেম্বরে বিমান পরিষেবা ও রেল কর্মীদের ধর্মঘট পরিলক্ষিত হয়। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন অঞ্চলের স্বাস্থ্য বিভাগগুলিতে জানুয়ারি থেকে ধর্মঘট শুরু করার পরিকল্পনা সম্পন্ন হয়েছে। 

- জার্মানিতে ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি এবং তার ফলস্বরূপ ঘটতে চলা এক অভূতপূর্ব শক্তির সঙ্কট শ্রমিকশ্রেণির ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছে। এসব কারণে এ দেশের বড় বড় ধাতু ও বিদ্যুত কারখানা গুলি নভেম্বরেই স্লো-ডাউনের মুখে পড়ে।  

- ইতালিতে অক্টোবরের মাঝামাঝি ইজি জেট এর বিমানচালক দের তালিকায় বিমান যানজট নিয়ন্ত্রক দের দ্বারা পরিচালিত আরও একটি ধর্মঘট এর সাথে যুক্ত হয়। সরকার বাধ্য হয় সরকারি ছুটির দিনগুলিতে ধর্মঘট নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করতে । 

- বেলজিয়ামে নয় এবং ষোল ডিসেম্বর দেশ জোড়া ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয় । 

- গ্রীসের এথেন্সে বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত হাজার হাজার কর্মী জড়ো হয়ে গর্জে ওঠে  'জীবনযাত্রার অসহনীয় খরচের' বিরুদ্ধে। 

- ফ্রান্স গত কয়েক মাসে সরকারি হসপিটাল ও যানবাহন কর্মীদের একের পর এক ডাকা ধর্মঘটের সাক্ষী থেকেছে ।

- পর্তুগালে শ্রমিকরা বর্তমান সর্বনিম্ন বেতন ৭০৫ এর পরিবর্তে ৮০০ ইউরোর দাবি জানিয়েছে । ১৮ নভেম্বর বেসামরিক কর্মীরা ধর্মঘটে নেমেছে। ডিসেম্বরে যানবাহন পরিষেবায় অনেক গুলি ধর্মঘট দেখা যায়। 

- আমেরিকায় ঘটতে চলা মালবাহী রেলকর্মীদের একটি ধর্মঘটকে বন্ধ করতে হাউস অফ রিপ্রেজে নটেটিভরা তৎপর হয়ে ওঠে। জানুয়ারিতে নিউ ইয়র্ক শহরে হাজার হাজার নার্স প্রহৃত হয়। 

এই তালিকা আসলে আরও অনেক লম্বা, কারণ বাস্তবে প্রায় সমস্ত জায়গাই সাক্ষী থেকেছে ছোট বড়, একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন, অসংখ্য ব্যবসা ক্ষেত্র, সরকারি সংস্থায় ঘটতে থাকা অসংখ্য ধর্মঘটের।সমস্ত জায়গায়, সমস্ত দেশে, সমস্ত কর্মক্ষেত্রের ক্রমশ অধোগামী জীবন ও জীবিকা, প্রতিনিয়ত মূল্যবৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য, জীবনের অনিশচয়তা, শ্রমিকের অভাব এবং তার ফলস্বরুপ জমতে থাকা কাজের পাহাড় এবং বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের জন্যে ক্রমাগত কমতে থাকা বাসস্থানের মান, -  এসবকিছুকেই এই পরিস্থিতির জন্যে দায়ী করা যেতে পারে। 

কোভিড ১৯ এর সময় থেকেই প্রায় সমস্ত শ্রমিকের কাছে হসপিটালগুলি হয়ে উঠেছে এক নিষ্ঠুর বাস্তবতার প্রতীক; কর্মী সংখ্যার অপ্রতুলতা এবং তার ফলে ক্লান্তির সীমানা ছাড়ানো ভয়ঙ্কর শোষণ এবং দিনের শেষে অপর্যাপ্ত বেতন যা কোনো ভাবেই জীবন ধারণের জন্যে যথেষ্ট নয়। 

যে দেশে থ্যাচার এর সময়কাল থেকে  মনে করা হত শ্রমিক শ্রেণি নিজের ভবিষ্যতচিন্তা কে ভাগ্যের হাতেই সমর্পণ করেছে, সেই  ইউ কে তে জুন থেকে  চলতে থাকা এই প্রলম্বিত ধর্মঘটের ঢেউ শুধু ইউ কে তেই নয়, বরং গোটা বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণির চেতনার এক বড়সড় পরিবর্তন কে সূচিত করে। ক্রমশ আরও জটিল হতে থাকা অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই লড়াইগুলি প্রমাণ করে যে শ্রমিক শ্রেণি আর কোনও ভাবেই পিছু হটতে প্রস্তুত নয়। 

  ১১ শতাংশেরও বেশি মুদ্রাস্ফীতি আর তারই সঙ্গে সুনক সরকারের কঠোর বাজেট প্রায় প্রতিটি সেক্টরের শ্রমিকদেরকে পথে নামতে বাধ্য করেছে। যানবাহন(ট্রেন,বাস,টিউব,এয়ারপোর্ট),স্বাস্থ্য, রয়্যাল মেল পোস্টাল সার্ভিস এর কর্মীরা, ডেফ্রার বেসামরিককর্মীগণ, আমাজনে কর্মরত শ্রমিক, স্কটল্যান্ডের স্কুল কর্মীরা, উত্তর সাগরে কর্মরত তেল কর্মী সকলেই নেমে এসেছে পথে। স্বাস্থ্য কর্মীদের মধ্যে  এই পরিমাণ সংহতি এদেশে গত কয়েক শতাব্দীতে দেখা যায় নি। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে শিক্ষকদেরও ধর্মঘটে বসার কথা শোনা যাচ্ছে। 

ফ্রান্সের সরকার অবসর গ্রহণের বয়সকে বাড়িয়ে দিতে আইনী ‘সংস্কার’ আনতে তৎপর হয়ে উঠেছে। উদ্দেশ্য খুব সহজ,  মৃত্যু পর্যন্ত শ্রমিককে  লেবুর মত নিংড়ে শুষে নিয়ে নিজেদের খরচ বাঁচানো। আরও স্পষ্ট  করে বললে, এর অর্থ, বিধ্বস্ত হয়ে বৃদ্ধ বয়েস অব্ধি কাজ করে যাওয়া, অথবা আরও কম এবং অপ্রতুল পেনসনের ভরসায় কর্মক্ষেত্র ত্যাগ করা। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে ভুগতে ভুগতেই একজন শ্রমিকের জীবন অতিবাহিত হয়ে যাবে। 

আমাদের জীবন-জীবিকার উপর আক্রমণ থামবে না। বিশ্ব অর্থনীতি দিনে দিনে আরও খারাপের দিকে এগোবে। বিশ্ববাজার দখলের লড়ায়ে টিঁকে থাকতে প্রতিটি দেশের প্রতিটি শাসক গোষ্ঠীই কখনো বা 'ইউক্রেনের প্রতি সহানুভুতি' কখনো বা 'জাতীয় অর্থনীতির ভবিষ্যৎ' এর দোহাই দিয়ে শ্রমিকশ্রেণির জীবন এবং জীবিকা কে আরও বেশি অসহনীয় করে তুলবে। 

 

যুদ্ধ অর্থনীতির ক্রমবিকাশের সাথে সাথে এই সত্য গুলি আরও বেশি করে প্রকট হয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত যুদ্ধ-অর্থনীতির খাতে  শ্রম এবং অন্যান্য সম্পদের আনুপাতিক ব্যয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু ইউক্রেনেই নয়, যুদ্ধ-অর্থনীতির এই বিকাশের ফলে ইথিওপিয়া, ইয়েমেন, সিরিয়া, মালী, নিগার, কঙ্গো এসব জায়গাতেও বিস্ফোরণ,বুলেট এবং মৃত্যু সহজাত হয়ে উঠেছে।   এরই ফলে অন্যান্য সব জায়গাতেই আতঙ্ক, মুদ্রাস্ফীতি এবং শ্রমিকের ঘাড়ে আরও কাজের চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে।এখন প্রতিটি সরকারের সর্বজনীন স্লোগান হয়ে উঠেছে 'দেশের জন্যে ত্যাগ স্বীকার' । 

মানব সভ্যতাকে আরও বেশি দুর্দশা, যুদ্ধ,  প্রতিযোগিতা, ভাগাভাগির দিকে এগিয়ে নিয়ে চলা এই পুঁজিবাদী ব্যাবস্থার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিশ্ব শ্রমিক শ্রেণির(প্রতিটি সেক্টর, প্রতিটি দেশের বেতন ভোগী, বেকার অথবা কর্মরত, প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত অথবা অপ্রশিক্ষন প্রাপ্ত, অবসর প্রাপ্ত বা কর্মরত…)  এই মুহূর্তের কর্তব্য হল অন্য আরেক  পরিপ্রেক্ষিত কে সামনে তুলে ধরা। 'দেশের হয়ে ত্যাগ স্বীকার' কে প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে এবং ঐকবদ্ধ বৃহত্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই অন্য এক পৃথিবীর রূপায়ণের সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করা সম্ভব।  

বিভক্ত অবস্থায় আমরা দুর্বল

বিভক্ত অবস্থায় আমরা পরাজিত

মাসাধিক কাল ধরে সমস্ত দেশের প্রায় সমস্ত সেকটরের কর্মীরা ধর্মঘট করে চলেছে। কিন্তু এই ধর্মঘটগুলি একে অপরের থেকে বিছিন্ন। এই ধর্মঘট গুলির সাথে যুক্ত প্রতিটি মানুষ যেন নিজেদের ধর্মঘট, নিজেদের কর্মক্ষেত্র, নিজেদের কারখানা, সরকারি অফিস এসবের বাইরে বেরোতে পারছে  না। এমনকি যখন একই রাস্তার দু পাশে, একদিকে হাসপাতাল কর্মীরা, অন্য দিকে স্কুল শিক্ষক ও সুপারমার্কেটে কর্মরত শ্রমিকরা নিজেদের দাবি আদায়ে সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছে, কিন্তু নিজেদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয় নি। কখনো কখনো এই বিছিন্নতা আরও বেশি হাস্যকর দেখায়  যখন একই বিভাগে কর্মরত শ্রমিকেরা নিজেদের টিম, নিজেদের ইউনিট এইসবের নামে বিভক্ত হয়ে আলাদা আলাদা করে ধর্মঘট চালিয়ে যায়।  উদাহরণ স্বরূপ দেখা গেছে, একই অফিসে অফিস-কর্মী আর প্রযুক্তি-কর্মীরা আলাদা আলাদা সময়ে আলাদা আলাদা ভাবে একত্রিত হচ্ছে, অথবা একই অফিসের এক তলা এবং দুতলায় আলাদা আলাদা ভাবে কর্মীরা ধর্মঘট ডাকছে।কিছুক্ষেত্রে সত্যিই এটা ঘটে!

নিজেদেরকে একটি ছোট্ট গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ রেখে আন্দোলন করার বিষয়টি শাসকশ্রেণির অনুকূলে যায় এবং আমাদেরকে আরও বেশি দুর্বল করে, আমাদের গুরুত্ব আরও বেশি কমিয়ে দেয়, বিধ্বস্ত করে এবং অবশেষে পরাজয়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।  

এই কারণেই বুর্জোয়ারা এই বিছিন্নতাকে কায়েম  রাখতে আরও বেশি মাথা ঘামায়। প্রতিটি দেশে এই একই পরিচিত কৌশলঃ সরকারের দ্বারা  আমাদের বিভাজন। তারা একটা ক্ষেত্রকে  সাহায্যের নামে অন্য ক্ষেত্রের ওপর আক্রমণ নামিয়ে আনে। কোন এক জায়গায় কোন ঘনীভূত  আন্দোলন কে দমন করতে তারা অন্য কোনও একটি বিশেষ সেক্টর  বা বিশেষ কোম্পানি কে সাহায্য করার মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেয়।  তারা  কোনও একটি গ্রুপকে যৎকিঞ্চিত সাহায্যের মাধ্যমে অন্যান্য গ্রুপগুলির সমস্ত অধিকার  কেড়ে  নেয় এবং বিভাজন ত্বরান্বিত করে। এক কোম্পানি  কে অন্য কোম্পানির থেকে বিছিন্ন করার অথবা এক বিভাগকে অন্য বিভাগের থেকে বিছিন্ন করার এই পদ্ধতি সব জায়গায় সাধারণ ফন্দীতে পরিণত  হয়েছে। 

ফ্রান্সে নতুন  পেনসন আইন সংস্কারের ঘোষণা  প্রসঙ্গে, বধির মিডিয়া মেতে উঠেছে এক অর্থহীন তর্কে।এই নতুন আইন কোন কোন সেক্টরের বেশি ক্ষতি করবে তাই নিয়েই বিতর্ক চলছে বেশি,   যখন কিনা এটা খুব পরিষ্কার যে এই আইন সমগ্র শ্রমিক শ্রেণির জীবনেই বিপর্যয় ডেকে আনবে।

শিক্ষানবিশ, কায়িক শ্রমিক, মহিলা প্রভৃতিদের যোগ্যতার নিরিখে পেনশন সংস্কারের ধারণাও এক ধরণের ফাঁদ!  

শ্রমিকদের সংগ্রাম নিজেদের হাতে নিতে হবে

কেন এই বিভাজন? এটা কি শুধুমাত্র সরকারী প্রচার এবং  কৌশল যা শ্রমিক শ্রেণীর ধর্মঘট ও সংগ্রামকে একে অপরের থেকে আলাদা রেখে আমাদের এভাবে বিভক্ত করতে সফল হয়?

আমরা সবাই একই নৌকার মাঝি এমন অনুভূতি বাড়ছে। ব্যাপক সংহতির সাথে একটি বিশাল ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম শ্রেণীগুলির মধ্যে শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তন করতে পারে, এই ধারণাটি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তাহলে কেন এখনো আমরা প্রতিটি দেশে এবং প্রতিটি সেক্টরে বহু মাস ধরে শ্রমিকদের মধ্যে বিভাজন দেখতে পাচ্ছি?

যুক্তরাজ্যে ধর্মঘটরত শ্রমিকরা ঐতিহ্যগতভাবে তাদের কর্মস্থলের বাইরে পিকেটিং করেন। বেশ কয়েক মাস ধরে, সংগঠিত পিকেটগুলি খুব বেশি দূরে ছিল না, কখনও কখনও কেবল একদিনের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত হয়েছে, কখনও কখনও একই সময়ে হয়েছে,  তবু  পিকেটগুলি কয়েকশ মিটার দূরত্বে আলাদা হয়ে গেছে,  সেখানে একসাথে সংযোগ স্থাপনের কোনও প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় নি। সবাই ধর্মঘটে আছে, কিন্তু পিকেট লাইনে আটকা পড়ে গেছে। এই বিভাজনের বিরুদ্ধে লড়াই না করলে, সংগ্রামে সত্যিকারের একতা গড়ে না  তুললে,  এটি আমাদের লড়াইয়ের চেতনাকে ক্লান্ত করে দিতে পারে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে এই পরিস্থিতি যে অচলাবস্থা এবং বিপদ   তৈরি করেছে তাতে তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যে সব শ্রমিক গত ছয় মাস ধরে 'রোলিং ধর্মঘটে' এ রয়েছেন তারা এখন ক্লান্ত এবং শক্তিহীন বোধ করতে পারেন।  

যাইহোক, আমরা বেশ কয়েকটি পিকেট লাইন পরিদর্শন করেছি, শ্রমিকরা কেবল তাদের নিয়োগকর্তা, তাদের বিভাগ, তাদের সেক্টরের চেয়ে আরও বিস্তৃত সংগ্রামে যুক্ত হওয়ার অনুভূতি আমাদের কাছে প্রকাশ করেছে। একসাথে লড়াই করার প্রয়োজনীয়তার একটি  ক্রমবর্ধমান অনুভূতি রয়েছে।

কিন্তু কয়েক মাস ধরে, সমস্ত দেশে, সমস্ত সেক্টরে, ইউনিয়নগুলিই এই সমস্ত খণ্ডিত সংগ্রাম সংগঠিত করে আসছে। ইউনিয়নগুলি মূলত যে  কৌশল নেয় তা শ্রমিকশ্রেণিকে বিভক্ত এবং বিচ্ছিন্ন করে, এবং তারা এই পরামর্শ দেয় যে তাদের দাবিগুলি শাখা থেকে শাখা, সেক্টর থেকে সেক্টরের মধ্যেই আপসে মীমাংসা সম্ভব হবে। ইউনিয়নগুলি সুনির্দিষ্ট দাবি নির্ধারণ করতে পছন্দ করে এবং ইউনিয়নগুলি সর্বোপরি সতর্ক করে দেয় যে "আমরা যদি সাধারণ দাবি করি তবে আমরা আমাদের নিজস্ব সংগ্রামকে দুর্বল করব"।   

ইতিমধ্যেই ইউনিয়নগুলি সচেতন হয়ে উঠেছে যে শ্রমিকশ্রেণির ক্ষোভ বাড়ছে।  তারা  বেসরকারী ক্ষেত্র এবং সরকারী ক্ষেত্রের  অভ্যন্তরে এবং পরস্পরের মধ্যে   যে বিভাজন তৈরি করেছে তা  ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। তারা বুঝতে পারছে যে "একটি সাধারণ সংগ্রাম" এর ধারণাটি  শ্রেণীর অভ্যন্তরে পরিপক্ক হচ্ছে।    

উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে ইতিমধ্যেই ইউকের ইউনিয়নগুলি বিভিন্ন সেক্টরে যৌথ পদক্ষেপ সম্পর্কে কথা বলতে শুরু করেছে,  যা তারা এখন পর্যন্ত এড়ানোর জন্য খুব সতর্ক ছিল। তাদের বক্তৃতায়  "ঐক্য" এবং "সংহতি" শব্দগুলি শোনা যেতে শুরু করেছে। তারা  কখনোই শ্রমিকদের বিভক্ত করার রাস্তা থেকে সরবে না,  আর সেটা করার জন্যই তারা শ্রমিকশ্রেণির  চিন্তাধারালগুলি কাজে লাগাচ্ছে। এইভাবে তারা সংগ্রামের দিকনির্দেশের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখছে।

ফ্রান্সে, পেনশন সংস্কারের ঘোষণার সাথে সাথে শ্রমিকশ্রেণীর উপর নেমে আসা আক্রমণের সময়ে  ইউনিয়নগুলি তাদের ঐক্য ও সংহতি  জ্ঞাপন করেছিলো । তারা বৃহৎ পথ-বিক্ষোভের সময়  সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলার  আহ্বান জানিয়েছিল । তারা দাবি করেছিল এই সংস্কার যেন পাস না হয়।  লক্ষ লক্ষ মানুষকে অবশ্যই এটি প্রত্যাখ্যান করতে হবে।

বাগাড়ম্বর এবং প্রতিশ্রুতির জন্য এত কিছু।  কিন্তু বাস্তবতা কী? এটি ব্যাখ্যা করার জন্য, আমাদের কেবল সেই আন্দোলনের  কথা স্মরণ করতে হবে যা ম্যাক্রোঁর ২০১৯-২০২০ সালের পেনশন সংস্কার বিলের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়েছিল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শ্রমিকশ্রেণির লড়াইয়ের  উত্থান এবং সংহতি বৃদ্ধির সম্মুখীন হয়ে ইউনিয়নগুলি সর্বদা এই একই কৌশল ব্যবহার করে ।  সেদিনও "সংগ্রামের সম্মিলন" তারা সমর্থন করেছিল এবং একটি ভ্রান্ত-ঐকবদ্ধ আন্দোলন তৈরি করেছিল।  সেখানে বিক্ষোভকারীরা সেক্টর এবং সংস্থা দ্বারা আহূত  হয়েছিল কিন্তু তারা একে অপরের পিছনে ছিল, সবাই একসাথে মিলিত হতে পারে নি।  ট্রেড ইউনিয়নের ব্যানার এবং ইউনিয়ন স্টুয়ার্ডরা  আন্দোলনকারীদের সেক্টর, কোম্পানি এবং প্ল্যান্ট দ্বারা বিভক্ত করেছিল। সর্বোপরি, কোনও আলোচনা বা কোনও সভা সেখানে ছিল না। সর্বশেষ বার্তাটি সেখানে ছিলো: "আপনার স্বাভাবিক সহকর্মীদের মধ্যে  ছড়িয়ে দিন এবং  বাড়ি যান যতদিন না পর্যন্ত পরবর্তী সময় আসছে"। শ্রমিকরা যাতে একে অপরের কথা শুনতে  না পায় তা নিশ্চিত করার জন্য সাউন্ড  সিস্টেমটি পুরোপুরি বিস্ফোরিত করা হয়েছিল। বুর্জোয়াদের মধ্যে কাঁপুনি ধরে যায় তখনই যখন শ্রমিকশ্রেণি  নিজের আন্দোলনের রাশ নিজের হাতে নেয়, যখন নিজেদেরকে সংঘঠিত করে, যখন পস্পরের সাথে মিলিত হতে শুরু করে, বিতর্ক করে…একটা শ্রেণিসংগ্রাম হয়ে ওঠে। 

ইউকে এবং ফ্রান্সের মতই অন্যান্য জায়গায়  শক্তির ভারসাম্যকে প্রভাবিত করার ফলে  আমাদের জীবনযাত্রা এবং কাজের অবস্থার উপর নেমে আসা ক্রমাগত আক্রমণ প্রতিরোধ করতে শ্রমিকশ্রেণি সক্ষম হবে। এই আন্দোলন ভবিষ্যতে আরও সহিংস হয়ে উঠবে, তাই  অবশ্যই আমরা যেখানেই পারি না কেন একত্রিত হতে হবে  এবং সংগ্রামের সেই পদ্ধতিগুলি নিয়ে আলোচনা করতে হবে যা শ্রমিকশ্রেণীকে আরো  শক্তিশালী করে তুলবে।  বুর্জোয়া সিস্টেমে কাঁপন লাগিয়ে দেওয়ার মত ঐতিহাসিক মুহূর্ত তৈরি করবেঃ  

- নির্দিষ্ট কর্মক্ষেত্র, কোম্পানী, সংস্থা, সেক্টর,  প্রকৃতপক্ষে শহর, অঞ্চল এবং দেশের বাইরে শ্রমিকশ্রেণির প্রতি সমর্থন এবং সংহতি বিস্তৃত করার অনুসন্ধান 

- বিশেষত সাধারণ সমাবেশের মাধ্যমে সংগ্রামে শ্রমিকদের স্ব-সংগঠন গড়ে তোলা । পাশাপাশি  সংগ্রামের  তথাকথিত "বিশেষজ্ঞ", ইউনিয়ন এবং তাদের সংগঠনের কাছে নিয়ন্ত্রণ সমর্পণ না করা;  

- অতীতের সংগ্রাম এবং তার পরাজয় থেকে উঠে আসা শিক্ষার আলোকে বর্তমান সংগ্রামের দাবিকে বুঝতে যতদূর সম্ভব বিস্তৃত আলোচনা করতে হবে। কারণ আগামীর পরাজয় হতে পারে, কিন্তু এই আক্রমণের বিরুদ্ধে কোন প্রতিক্রিয়া না জানানো সব চাইতে বর পরাজয়। সংগ্রাম শুরু করাটাই শোষিতদের প্রথম বিজয়। 

১৯৮৫ সালে, থ্যাচারের সময়ে, ব্রিটিশ খনি-শ্রমিকরা অসীম সাহস এবং সংকল্পের সাথে পুরো এক বছর ধরে লড়াই করেছিল ।  কিন্তু রাষ্ট্রশক্তি এবং  ইউনিয়নগুলি তাদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল এবং তারা শক্তিহীন হয়ে একটি নির্দিষ্ট সেক্টরে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল।  এই পরাজয় শুধুমাত্র তাদের পরাজয় চিল না, এটা চিল সমগ্র শ্রমিক শ্রেণির পরাজয়।  আমাদের অবশ্যই ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। যে দুর্বলতাগুলো কয়েক দশক ধরে শ্রমিকশ্রেণীকে দুর্বল করে রেখেছে এবং যা ধারাবাহিকভাবে পরাজয়ের কারণ হয়ে থেকেছে, সেগুলো এখন অতিক্রম করা অত্যাবশ্যক, বিশেষ করে কর্পোরেটবাদের ফাঁদ এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলো শ্রমিক শ্রেণীর অঙ্গ হয়ে ওঠা । সংগ্রামের জন্য শ্রমিকশ্রেণির নিজস্ব সংগঠণ এবং এর বিস্তৃত ঐক্য ও সংহতি আগামীকালের সংগ্রামের প্রস্তুতির অপরিহার্য উপাদান!

এরজন্য আমাদের অবশ্যই নিজেদেরকে সেই শ্রেণীর সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে যা সংগ্রামে সংহতির মাধ্যমে  গড়ে ওঠা ঐক্যবদ্ধ একটি শ্রেণি, তা হলো  শ্রমিক শ্রেণি। আজকের সংগ্রাম শুধু আক্রমণের বিরুদ্ধে নিজেদের রক্ষা করার জন্য নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের  শ্রেণী-পরিচয় পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রেও অপরিহার্য। সব ধরণের বঞ্চনা এবং দুর্যোগের সমার্থক  এই দেউলিয়া ব্যবস্থাকে চূড়ান্তভাবে উৎখাত করার প্রস্তুতির জন্য অপরিহার্য।  

পুঁজিবাদ কোন সমাধান দিতে পারে না। পুঁজিবাদ যা দিতে পারে তা হলো,-হয় পৃথিবীর ধ্বংস, না হয় ক্রমাগত যুদ্ধ, না হয় বেকারত্ব, না হলে কাজের নাজেহাল অবস্থা, বা সীমাহীন দারিদ্র্য। বিশ্বের সকল নিপীড়িত ও শোষিতদের সমর্থণ নিয়ে একমাত্র  আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামই কেবল কমিউনিজমের বিকল্পের পথ খুলে দিতে পারে।  

আজকের ইউকের ধর্মঘট এবং ফ্রান্সের বিক্ষোভ, বিশ্বজুড়ে সর্বহারাদের সংগ্রামের আহ্বান জানাচ্ছে ।

আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট কারেন্ট, 12 জানুয়ারী 2023

 

গণহত্যার নিরিখে কোন সাম্রাজ্যবাদী শিবিরকে সমর্থন নয়! শান্তিবাদী বিভ্রমকে সমর্থণ নয়! চাই সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদ!

সেই ১৯১৪ সাল থেকে ঘটে আসা বিশ্ব-পুঁজিবাদের  শতাব্দীব্যাপী স্থায়ী যুদ্ধের সর্বশেষ নিদর্শন মধ্যপ্রাচ্যে চলমান রক্তস্নাত সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ!

লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের গণহত্যা, এমনকি পুরো দেশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা্র ঘটনা আগামী দিনগুলিতে আরও ভয়াবহ নৃশংসতার প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছুই বয়ে আনছে না।  

বর্তমান পরিস্থিতিতে পৃথিবীর ছোট-বড় বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদীশক্তি যে যৌক্তিক সমাধানের কথা বলছে সেটা আসলে  বিভিন্ন দেশের  জাতীয় প্রতিপক্ষীয় বুর্জোয়াশ্রেণীর  ভ্রাতৃঘাতী হত্যায়  শ্রমিকশ্রেণিকে বিভক্ত করা ও পক্ষাবলম্বনের জন্য প্রস্তুত করার বিশাল প্রতারণার শামিল।  

আজ ইসরায়েল ও গাজায় বসবাসরত মানুষের ওপর অবিরত গোলাগুলির অগ্নিবর্ষণ হচ্ছে। একদিকে রয়েছে হামাস, অন্যদিকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। মাঝখানে শ্রমিকদের ওপর চলছে বোমাবর্ষণ,  কার্যকর করা হচ্ছে মৃত্যুদন্ড এবং অগণিত মানুষকে জিম্মি করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে মারা গেছে  হাজার হাজার মানুষ।

সারা বিশ্বে বুর্জোয়ারা আমাদের কোন একটি পক্ষ বেছে নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। ইসরায়েলি নিপীড়নের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের জন্য, অথবা ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি প্রতিক্রিয়ার পক্ষ নেওয়ার জন্য। প্রত্যেকেই যুদ্ধকে ন্যায়সঙ্গত করার জন্য একে অপরের বর্বরতার নিন্দা করে চলেছে। আমরা দেখেছি,  ইসরায়েলি রাষ্ট্র কয়েক দশক ধরে অবরোধ, হয়রানি, চেকপয়েন্ট এবং  অপমানের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি জনগণের উপর নিপীড়ন চালিয়ে আসছে, অন্যদিকে  ফিলিস্তিনি সংগঠনগুলো  ছুরি হামলা ও বোমা হামলা চালিয়ে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করছে। একে অপরের রক্ত ঝরানোর আহ্বান জানাচ্ছে।

এই প্রাণঘাতী কর্মকান্ডের যুক্তিই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের যুক্তি! শোষক এবং তাদের রাষ্ট্রই সবসময় নিজেদের স্বার্থরক্ষায় এই নির্দয় যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। আর আমরা, সেই শ্রমিক শ্রেণী, ও শোষিত,মানুষ যারা সবসময় আমাদের জীবন দিয়ে মূল্য পরিশোধ করে থাকি।  

আমাদের জন্য, সর্বহারাদের জন্য, বেছে নেওয়ার মতো কোনও পক্ষ নেই, আমাদের কোনও স্বদেশ নেই, রক্ষা করার মতো কোনও জাতি নেই! সীমান্তের দু'পাশে, আমরা একই শ্রেণীর! না ইসরায়েল, না ফিলিস্তিন!

কেবলমাত্র ঐক্যবদ্ধ আন্তর্জাতিক সর্বহারা শ্রেণীই এই ক্রমবর্ধমান গণহত্যা এবং তাদের পিছনে থাকা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের অবসান ঘটাতে পারে। আমরা দেখেছি, ১৯১৭ সালে জিমারওয়াল্ডে মুষ্টিমেয় কমিউনিস্ট বামপন্থীরা যে অনন্য সমাধানের পথের বার্তা দিয়েছিল সেইপথেই  রাশিয়ার বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণি  অক্টোবর মাসে  পুঁজিবাদী শাসনকে উৎখাত করেছিল এবং তার নিজস্ব রাজনৈতিক শ্রেণি শক্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই দৃষ্টান্তই একটি বিস্তৃত আন্তর্জাতিক বিপ্লবী আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছিল যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটাতে বাধ্য করেছিল। 

সেই বিপ্লবীস্রোতের পরাজয় থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে বর্তমানে যে একমাত্র রাজনৈতিক ধারা  আন্তর্জাতিকতাবাদী নীতিকে কঠোরভাবে বজায় রেখেছে তারা হলো কমিউনিস্ট লেফট ধারা। আমরা দেখেছি,  ত্রিশের দশকে,  স্প্যানিশ যুদ্ধ এবং চীন-জাপান যুদ্ধের সময়   শ্রমিকশ্রেণির মৌলিক লাইনটি  রক্ষা  করেছিল কমিউনিস্ট লেফট ধারা। সেইসময় স্ট্যালিনবাদী, ট্রটস্কিবাদী বা নৈরাজ্যবাদীদের মতো   অন্যান্য রাজনৈতিক স্রোতগুলি তাদের সাম্রাজ্যবাদী শিবিরকে বেছে নিয়েছিল যা এই দ্বন্দ্বগুলিকে উস্কে  দিয়েছিল। কমিউনিস্ট বামপন্থীরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার আন্তর্জাতিকতাবাদ বজায় রেখেছিল এবং এই অন্যান্য স্রোতগুলি সাম্রাজ্যবাদী হত্যাযজ্ঞে অংশ নিয়েছিল যা 'ফ্যাসিবাদ এবং ফ্যাসিবাদ বিরোধী' এবং এটাকে  'সোভিয়েত' ইউনিয়নকে রক্ষার করার মধ্যে লড়াই হিসাবে সাজানো হয়েছিল।

আজও কমিউনিস্ট বামপন্থীদের ক্ষুদ্-সংগঠিত শক্তিগুলো সেই আন্তর্জাতিকতাবাদের নীতিকে মেনে চলে, কিন্তু তাদের শক্তি কিছুটা  দুর্বল হয়ে পড়েছে কারন তারা নিজেরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে এবং পারস্পরিক বৈরীতা সৃষ্টি করে নিজেদের দুর্বল করেছে।

একারণেই সাম্রাজ্যবাদী বর্বরতার ক্রমবর্ধমান পতনের মুখে এই আপাত বিচ্ছিন্ন শক্তিকে অবশ্যই সকল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে, শোষকদের পিছনে জাতীয় প্রতিরক্ষার আহ্বানের বিরুদ্ধে, 'শান্তির' জন্য ভণ্ডামিমূলক আবেদনের বিরুদ্ধে এবং কমিউনিস্ট বিপ্লবের দিকে পরিচালিত সর্বহারা শ্রেণি সংগ্রামের জন্য একত্রে আহ্বান রাখতে হবে।  

দুনিয়ার মজদুর এক হোন!

 

ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিস্ট কারেন্ট

(International Communist Current)

 

ইন্টারন্যাশনালিস্ট ভয়েস

(Internationalist Voice) 

 

17.10.2023