Communist Internationalist - 2021

আমাদের কমরেড কিষণের প্রতি শ্রদ্ধা

২০২০ সালের ২৬ শে মার্চ সারা বিশ্ব যখন কোভিড ১৯ এ আক্রান্ত  তখনই কমরেড কিষণের মৃত্যুতে  আই. সি. সি  র সঙ্গে যুক্ত  সকলেই এক বেদনাঘন অবস্থার সম্মুখীন হলাম। তাঁর মৃত্যু 'আই সি সি ' র কাছে যেমন বিশাল ক্ষতি,  তেমনি ' আই. সি. সি' র ভারতীয় অংশের কাছেও সমান ক্ষতি । কিষণের অভাব আমরা  সবাই গভীর ভাবে অনুভব করব। আই সি সি র কর্মকান্ডে কিষণের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত  কিষণ ছিলেন একজন লড়াকু  যোদ্ধা ।

ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের এক গন্ডগ্রামে   ১৯৩৯ সালে কিষণ জন্মগ্রহণ করেন ।   ঊনিশ শতকের  ষাটের দশকে  কিষণ যখন  স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের জন্য উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করছে  ঠিক সেই সময়  দীর্ঘ বিরতির পর  শ্রমিক শ্রেণীর পুনরাবির্ভাব  হচ্ছে ১৯৬৮  সালে ফ্রান্সের নয় লক্ষ  শ্রমিকের  স্ট্রাইকে   অংশ গ্রহণের মাধ্যমে।    পরের বছর ১৯৬৯ সালের ঊষ্ণ শরতে ইটালীর শ্রমিকদের স্ট্রাইকে অংশ গ্রহণ এবং ১৯৭০সালে  পোলিস শ্রমিকদের স্ট্রাইকে অংশ গ্রহণের মধ্যে দিয়ে তা আরও তীব্রতর হচ্ছে ।এর অর্থই হচ্ছে প্রতিবিপ্লবী পর্বের  অন্তিম লগ্নের ঘোষণা মুখরিত হয়ে উঠছে। ঊনিশ শতকের ষাটের দশক সারা পৃথিবীর সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়  ছাত্রছাত্রী দের কাছে  প্রতিবাদের দশক। বিশেষ করে ভিয়েতনাম যুদ্ধ  ও জাতিবৈষম্যের বিরুদ্ধে তারা তৎপর হয়ে ওঠে। তাদের কাঙ্খিত বিপ্লবী পরিবর্তনের কাজ  যথেষ্ট   আন্তরিক ছিল  কিন্তু  'তৎক্ষণাৎ সমাজ পরিবর্তনের গোলকধাঁধায় তারা  মূলত পেটিবুর্জূয়া  শিবিরের হয়ে ই কাজ করেছিল। ১৯৬৮ সালের আগে বা পরে সারা পৃথিবীতে যে সব তথাকথিত 'বামপন্থী সংগঠণ’' অর্থাৎ বুর্জোয়া সংগঠণগুলি ছিল তারা যুব সম্প্রদায়কে শ্রমিকশ্রেণীর  স্বার্থরক্ষকের ভূমিকার  পরিবর্তে নিজেদের  স্বার্থ রক্ষার কাজে নিযুক্ত করতে  তৈরি ছিল। পৃথিবীব্যাপি এই অবস্থার মধ্যে কিষণও বিভ্রান্তির শিকার হয়  এবং নকশাল আন্দোলনে  ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৬৩-৬৫ সেশনে কিষণ উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্সের এম. এস সি র  ছাত্র ছিল।  মাস্টার্স  ডিগ্রিতে কিষণ ফিজিক্সে  ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয় ।  গবেষণার কাজে লিপ্ত থাকার সময়ই কিষণ   যুব সম্প্রদায়ের অংশ হিসেবে  নকশাল আন্দোলনের প্রতি  আকৃষ্ট হয়। ধীরে ধীরে নকশাল আন্দোলন আর  মাওবাদ সমার্থ হয়ে ওঠে। গবেষণার কাজ অসমাপ্ত রেখেই কিষণ   নকশাল আন্দোলনের ঘুর্নাবর্তে নিজেকে নিক্ষেপ করে। আর এর ফল হিসেবে   তাকে জেলে যেতে  হয়। দীর্ঘ আট বছর  পূর্ন মেয়াদের জেল খাটার পর ১৯৭৮ সালে কিষণ জেল থেকে  ছাড়া পায়।  জেলের অকথ্য অত্যাচারের ক্ষত তাকে জীবনের  শেষ দিন পর্যন্ত বয়ে বেড়াতে হয়েছে। জেলের  অপ্রশস্থ ও অস্বাস্থ্যকর     কুঠুরী  এবং  অপর্যাপ্ত ও কখনো কখনো অখাদ্য খাবারের কারণে তার টি. বি  হয়।  ফুসফুসের   এই সংক্রমণের   ক্ষত জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত  তার সর্বক্ষণের  সাথী  হয়ে থেকে গিয়েছিল। জেলে বসেই কিষণ কার্ল মার্ক্সের বিশেষ কিছু লেখা পড়েন।  পরবর্তী কালে   কম্যুনিস্ট  লেফট এর  সংস্পর্শে এলে এসব পড়াশোনাই তাকে  খোলামেলা  আলোচনায় অংশগ্রহণে সাহায্য করে। 

খুব কম সংখ্যক মানুষের মধ্যে কিষণ একজন ব্যক্তি, বামপন্থী বুর্জোয়া আদর্শেরই ব্যাধিপূর্ণ  উত্তরাধিকারি মাওবাদ  যাকে শুঁষে  নিলেও  সেখান থেকে যিনি নিজেকে  সম্পূর্ণ মুক্ত করে  কম্যুনিস্ট লেফট ধারার সংগে নিজেকে যুক্ত করে শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থে নিজের জীবন উৎসর্গ করে। এই উত্তরণের  জন্য   অনিবার্য রূপে তার সোপান  ছিল আশি ও নব্বইয়ের দশক জুড়ে গভীর ধৈর্য সহকারে  আই সি সি র  সঙ্গে  দীর্ঘ আলোচনার  মাধ্যমে   স্বচ্ছ ধারনা অর্জনের প্রক্রিয়া। এই  স্বচ্ছ ধারণা লাভের চলমান প্রক্রিয়া ই হয়ে ওঠে  ১৯৮৯ সালে  ভারতবর্ষের বুকে  প্রথম'  আই সি সি' র ভ্রূণ তৈরির   প্রধান  হাতিয়ার।    আই সি সি র সংগে যুক্ত হওয়ার পরই  কম্যুনিস্ট লেফট এর  আসল ইতিহাস কিষণ জানতে পারে। আই সি সি র সংগে দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে  কিষণ যখন বুঝতে পারে মাওবাদ হল বুর্জোয়া আদর্শেরই অন্য রূপ,    প্রতিবিপ্লবী  রাজনীতির  স্রোত , তখন সে চমকে  উঠেছিল। “মাওবাদ কোনভাবেই শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামের সাথে যুক্ত নয়, না তার  সচেতনতা না তার বৈপ্লবিক প্রতিষ্ঠানের সাথেমার্কসীয় ধারার সাথে এর কোনো সংযোগ নেই:  এটা না কোনো অভ্যন্তরীণ প্রবণতা, না সর্বহারার বৈপ্লবিক তত্ত্বের কোন অগ্রগমনপক্ষান্তরে বলা যায়, মাওবাদ মার্কসীয় ভাবধারার একটি স্থূল মিথ্যাকরনের প্রয়াস; এর এক   একমাত্র  লক্ষ্য হল প্রত্যেক বৈপ্লবিক নীতিকে সমূলে কবর দেওয়া, সর্বহারার শ্রেণিসচেতনতাকে বিভ্রান্ত করা এবং নিকৃষ্টতম নির্বুদ্ধিতা সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করা। ‘তত্ত্ব’ হিসাবে  মাওবাদ প্রতিবিপ্লব   সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের কালে ক্ষয়িষ্ণু বুর্জোয়া সম্প্রদায় দ্বারা  গৃহীত এক দুষ্ট অবলম্বন স্বরূপ”(১)। মাওবাদ সম্পর্কে আই সি সি র এই ব্যাখ্যা কমরেড কিষণের উপর দারুণ প্রভাব ফেলেছিল। কিষণের অতীত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার পূর্ণ সমালোচনা করার এই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তার একটি সত্যিকারের  বিপ্লবী সংগঠণের সহযোদ্ধা হয়ে উঠার পক্ষে জরুরি ছিল।

 ১৯২৫ সালে  কম্যুনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল  যখন ইতিমধ্যেই ক্ষয়িষ্ণু হতে শুরু করেছে , বিপ্লবী সংগঠন গুলির  গুরুত্বপূর্ণ   আন্দোলনগুলি পরাজিত হচ্ছে, বিশেষ করে রাশিয়ান ও জার্মান বিপ্লব পরাজিত হয়েছে , তখনই  ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম হল। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম  থেকেই লক্ষ্য ছিল অন্যান্য জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে উপনিবেশিক শক্তির বিরোধীতা বা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা।  ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টির ওপর জাতীয়তাবাদ  ও দেশাত্মবোধের প্রভাব খুব বেশী ছিল। ভারতের শ্রমিক শ্রেণী কম্যুনিস্ট লেফট এর পরম্পরা ও ধারাবাহিকতা থেকে  বঞ্চিত থেকেছে এবং তাকে  ভুগতে হয়েছে। এই রকম  রাজনৈতিক  পরিস্থিতিতে  ভারতবর্ষের কাছে কম্যুনিস্ট লেফট এর প্রকৃত ঐতিহাসিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরার  ক্ষেত্রে আই সি সি র এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থেকে গেছে।

গভীর অধ্যয়ণ এবং ধারাবাহিক আলোচনার পথেই কিষণ ধীরে ধীরে আই সি সি’র ভারতীয় অংশের সহযোদ্ধা হয়ে উঠেছিল। আই সি সি  এবং আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামের প্রতি  কিষণের  আনুগত্যই  তাকে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী  রূপে চিহ্নিত করেছে। অপরিমেয় নিষ্ঠার সঙ্গে কিষণ  সব সময় আই সি সি র  অবস্থানকে সমর্থন করেছে। আই সি সি র সঙ্গে  বিতর্কে  তার ছিল গভীর নিষ্ঠা, সে বিতর্ক আন্তর্জাতিক স্তরের  হোক বা আই সি সি র আমাদের ভারতীয় অংশের  মধ্যেই হোক  । আই সি সি র কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন স্তরে  কিষণের অবদান  গুরুত্বপূর্ণ। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে  আই. সি সি র বই বিক্রি করার উপযুক্ত দোকান খুঁজে বের করেছে। যেখানে যতটা সম্ভব হয়েছে কমরেড কিষণ  বিভিন্ন আলোচনা চক্র এবং পাবলিক মিটিং  এ অংশ গ্রহণ করেছে। আই সি সি র পত্র পত্রিকার গ্রাহকসংখ্যা বাড়ানোর ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা ছিল দৃষ্টান্ত  মূলক। তিনি আই সি সি’র নানাবিধ আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে অংশগ্রহণ এবং সক্রিয় ভূমিকা পালনের পাশাপাশি আমাদের ভারতীয় অংশেও সমান ভূমিকা রেখেছেন। তার মূল্যবান এবং সুচিন্তিত মতামত রাজনৈতিক স্বচ্ছ্বতা অর্জনের প্রক্রিয়াকে আরো ধারালো করে তুলেছিল। তার সবচেয়ে বড় শক্তি  হল সংগঠনের ওপর সমস্তরকমের আক্রমণ ও কুৎসা রটনার রিরুদ্ধে  প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

জীবনের অসংখ্য উত্থান পতন কাটিয়ে ওঠার ক্ষমতা কমরেড কিষণের ছিল। সবচেয়ে কঠিন রাজনৈতিক  অবস্থাতেও  আই সি সি র রাজনীতির প্রতি তার  দৃঢ় বিশ্বাস   ও  আশাবাদী ভূমিকাই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত  তাকে আই. সি সি র পাশে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করেছে। শ্রমিক শ্রেণীর শৃঙ্খল মোচনের জন্য কমরেড কিষণের যে রাজনৈতিক সংগ্রাম তার সঠিক মূল্যায়ণের জন্য এই  ছোট্ট একটি লেখা  যথেষ্ট নয়।  কিষণ সম্পর্কে আরো বলা যায় সে ছিল অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ এবং মাটির মানুষ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ  অথবা ভারতবর্ষের অন্যান্য অংশের আই সি সি র  কমরেডদের  প্রতি   কমরেড কিষণের ছিল উদার  আতিথ্য। আতিথিদেরও সে অভিজ্ঞতা  বার বার  ই হয়েছে। তার পরিবারের প্রতি আমরা সংগ্রামী  শ্রদ্ধা ও  দায়বদ্ধতা জ্ঞাপন করছি ।

 আই সি সি   সবরকম সহানুভূতি ও দায়বদ্ধতা নিয়ে তার স্ত্রী  ও কন্যার পাশে আছে ।

 

আই সি সি, অক্টোবর ২০২০.

(১) আমাদের ওয়েবসাইটে ‘Maoism, a monstrous offspring of decadent capitalism’ নামক প্রতিবেদন দেখুন. 

https://en.internationalism.org/ir/094_china_part3.html#_ftnref4

কোভিডের মোকাবিলায় এক বছরের অবহেলা: পুঁজিবাদই হন্তারক!

এপ্রিল মাসের শুরু থেকেই পৃথিবীর চারিদিকে কোভিড-১৯ দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়েছে। দু হাজার কুড়ির নভেম্বর মাস থেকে সারা বিশ্বে কোভিড এর আরো ভয়ংকর হয়ে ওঠার যাত্রা অব্যাহত রয়েছে। ইউরোপের অবস্থার কিছুটা উন্নতি এবং আমেরিকা তার ভয়ংকর অবস্থা কিছুটা কাটিয়ে উঠলে ও ল্যাটিন আমেরিকা এবং ভারতীয় উপমহাদেশ এই মুহূর্তে সংক্রমণের শীর্ষে।  চাইনার মতো দেশগুলিতে বৃহৎ সংখ্যক জনগণকে ভ্যাকসিন(1) দেওয়া সত্ত্বেও  সংক্রমণ পিছু হঠে নি । পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর যে চীনা কর্তৃপক্ষের মধ্যেও কিছু কণ্ঠস্বর ভ্যাকসিনের "অপর্যাপ্ত" কার্যকারিতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। চীন এবং অন্যান্য বেশ কিছু দেশের মিথ্যা তথ্য সত্ত্বেও সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকারি নথি অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ৩২ লক্ষ।

বিগত এক বছরের গবেষণায় হয়ত ভাইরাস সম্পর্কে আরও বেশি কিছু জানা যেত, এটি কীভাবে ছড়ায়  এবং এর বিরুদ্ধে কীভাবে লড়াই করা যায় সে সম্পর্কে আরও ভাল ধারণা গড়ে তোলা যেত, কিন্তু আন্তর্জাতিক স্তরের সমস্ত রাষ্ট্রের ক্রমাগত অবহেলা এবং বুর্জোয়া শ্রেণীর দায়িত্বহীনতা মূলত সুসঙ্গত এবং কার্যকর ব্যবস্থা বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে কাজ করেছে।  প্রতিযোগিতার দর্শনে জর্জরিত রাষ্ট্রগুলি টিকা নীতির ক্ষেত্রে পারষ্পরিক ন্যূনতম সমন্বয় রক্ষা করতে সক্ষম হয়নি।

এই রকম অসহযোগিতা মূলক পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে প্রতিটি রাষ্ট্রই  আশ্রয় নিয়েছে স্বল্প মেয়াদি স্বাস্থ্য পরিকল্পনায়, তারা কখনো লক ডাউন করে, কখনো লকডাউন প্রত্যাহার করে নিয়ে বা আবার তা চালু করে বা কখনো আংশিক লকডাউন ঘোষণা করার মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে। দীর্ঘকালীন আর্থিক সংকটে জর্জরিত এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লড়াইইয়ে মত্ত প্রতিটি রাষ্ট্রই  চিকিৎসা ক্ষেত্রে চরম  অবহেলা  এবং  আর্থিক  বরাদ্দ কাছাঁট করার পথে এগিয়ে চলেছে যার ফল স্বরূপ এই মুহূর্তে প্রতি দিনকার ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর কাছে মাথা নত করা এবং হাসপাতাল মর্গ ও শ্মশানগুলিতে  চরম  বিশৃঙ্খলাকে  সামাল দেওয়া ছাড়া  তাদের আর কিছু ই করার নেই। একেই শাসক শ্রেণী  '‘ভাইরাসের সঙ্গে সহাবস্থানের শিক্ষা' নামে চিহ্নিত করেছে। ফলস্বরূপ যদিবা কিছু রাষ্ট্র দ্রুত ভ্যাকসিন দিতে সক্ষম হচ্ছে কিন্তু অন্যদিকে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে ভাইরাস রূপ বদল করে আরো সংক্রামক চেহেরায় দ্রুত চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে।

 ভারতবর্ষ এবং  ব্রাজিল - - - - ভাবি চিত্র

এই ভূতের নাচের  সব চেয়ে ভয়ংকর চিত্রের দর্শক এই মুহূর্তে ভারত এবং ব্রাজিল। একজন  ব্রাজিলিয়ান বিঞ্জানীর মতে এই অতিমারির অবস্থা বর্তমানে আয়ত্তের বাইরে : চারিদিকে নতুন নতুন সমাধি ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে, বাসে করে মৃত দেহ স্থানান্তরিত করা হচ্ছে এবং হাজারে হাজারে সংক্রমণ  এখানের প্রাত্যহিক চিত্র। খুব তাড়াতাড়ি  মৃত্যু সংখ্যা পাঁচ লাখের কোঠায় পৌঁছে যাবে এবং রেকর্ড অনুযায়ী ইউনাইটেড স্টেট কে ছাপিয়ে যাবে। হাসপাতাল গুলি কোভিড রোগীতে ভর্তি, শয্যার অভাবে মানুষ স্ট্রেচারের ওপরে শুয়েই মৃত্যু বরণ করছে, আর এ সবই ঘটছে আ্যমাজোনাস স্টেটের শহর থেকে আসা একটি নতুন প্রজাতির ভাইরাসের কারণে যেখানে ২০২০ র শেষের দিকে হার্ড ইমিউনিটির  গুজব ফেরি করা হয়েছিল,  একই সঙ্গে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ব্রাজিল কে টালমাটাল করে তুলেছে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বলসোনারো, যিনি পূর্বে ভাইরাসটি কে তুচ্ছ জ্বর হিসাবে উল্লেখ করে ছিলেন, তিনি বার বার বলে চলেছেন ‘কাজে ফিরে যাওয়া এবং অভিযোগ বন্ধ করা অত্যন্ত জরুরি’। একই সঙ্গে এমন একটি  বিপর্যয়ময় পরিস্থিতিতে তিনি তাঁর মন্ত্রীদের পোশাক পরিবর্তনের মতো পরিবর্তন করে চলেছেন।

এদিকে লোকচক্ষুর অন্তরালে ব্রাজিলের আ্যমাজোনে পশু পাচারের ঘটনা  এবং একইসঙ্গে মারাত্মক রূপে অরণ্য নিধনের বিষয়টি  মানুষকে আরো বেশি করে ভাইরাসের সামনে বেআব্রু করে তুলেছে। মানাউসের একজন জীব বিজ্ঞানী  নুকাস ফেরান্ডের মতে, আমরা উহানে(2) যা প্রত্যক্ষ করেছি তার থেকে ভয়ংকর এবং নতুন ভাইরাসের সম্ভাবনা অপেক্ষা করে আছে অ্যামাজনের জঙ্গলে। গত কয়েক বছরে এই জঙ্গল নিধন এক ভয়ংকর পর্যায়ে পৌঁছলেও বুর্জোয়া শ্রেণীর যে অংশটি  এরই লভ্যাংশ এর ওপর নির্ভর করে টিকে আছে তারা এই জঙ্গল নিধন বন্ধ  করতে একে বারেই রাজি নয়।

 গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারত বর্ষের পরিস্থিতিও তাকে সংবাদ পত্রের শিরোনামে এনে দিয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটির  ভয়ংকর স্বাস্থ্য বিপর্যয় কে তুলে ধরার জন্য কোনো শব্দই বোধহয় যথেষ্ট নয়। ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক উন্নতি এবং প্যানডেমিকের শুরুতে  স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল অবস্থা গভীর এক বৈপরীত্যকে চিহ্নিত করে। স্বাস্থ্য এখানে সামান্যতমও অগ্রাধিকার পায় নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, যিনি কি না বলসেনারোর একেবারে দোসর স্বরূপ, তিনি ফেব্রুয়ারি মাসে গর্বের সঙ্গে প্রচার করেন যে ভারতবর্ষ ইতিমধ্যেই কোভিড ভাইরাসকে বধ করে বিশ্বে নজির সৃষ্টি করেছে। সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষ,  চায়না এবং অন্যান্য প্রভাবশালী  দেশ গুলিকেও প্রতিষেধক টিকা সরবরাহ করেছে। যদিও এই মুহূর্তে ভ্যাকসিন সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।

এটা দেখা গেছে যে, হিন্দু মৌলবাদের প্রতিনিধিত্ব  করা ভারতের সরকার জানুয়ারির শুরু থেকেই সেদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় কুম্ভমেলার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা তীর্থ যাত্রীদের ইচ্ছাকৃত ভাবে উৎসাহিত করতে থাকে।  এপ্রিলের প্রথম দুই সপ্তাহে দেখা যায় আঠাশ লক্ষ হিন্দুর এক বিশাল জনস্রোত মাস্ক, দূরত্ববিধি, করোনা পরীক্ষা ছাড়াই  গঙ্গারজলে  নিজেদেরকে নিমজ্জিত করেছে, যে জল নিজেই বর্জ্য  পদার্থ নিক্ষেপের মাধ্যমে তথা গঙ্গা বক্ষে সংক্রামিত মৃত দেহের উদ্দেশ্যে  পালিত ধর্মিয় আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কলুষিত, দূষিত। এরই পাশাপাশি ভোট প্রচারের উদ্দেশ্যে জমায়িত  বিশাল জনস্রোত ভাইরাসের বিস্ফোরকের কাজ করেছে। এই সমস্ত উন্নাসিকতা ও অজ্ঞতার ফল অদূরেই ওঁত্ পেতে ছিল। সংক্রমণ  এবং মৃত্যুর হার লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। দৈনিক চার লাখ সংক্রমন এবং মৃত্যুর পরিমান চার হাজারে গিয়ে পৌঁছয়, যদিও সংবাদ মাধ্যমের সরকার প্রদত্ত পরিসংখ্যান বাস্তব পরিসংখ্যানের সঙ্গে  একেবারেই সাযুজ্যহীন। হাসপাতালের সামনে রোগীর লম্বা লাইন, লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় রোগীর মৃত্যু, অপ্রতুল অক্সিজেন, শয্যার অভাব, একই শয্যায় একাধিক রোগী, মোটরবাইকের ওপর রোগীর মৃত্যু, অনাদরে রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহ গুলি  সংবাদ মাধ্যমের দাবি কে আরো শক্ত ভাবে প্রতিষ্ঠা করছে। এ সব দৃশ্য এমন একটি দেশের মধ্যে দেখা যাচ্ছে যে দেশ ব্রাজিলের মতোই নিজেকে বিশ্বের মধ্যে বৃহদাকার অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিযোগিতায় মত্ত।  কিন্তু এ সবের পরিবর্তে আমাদের  চোখে পড়ছে সেই সব অসহায় পরিবার গুলি যারা প্রিয় জনের অন্ত্যেষ্টির উদ্দেশ্যে এক টুকরো জায়গার খোঁজে দিশেহারা । অসংখ্য জমে থাকা মৃতদেহের অন্ত্যেষ্টির জন্য শত শত মিটার জুড়ে অন্ত্যেষ্টির চিতা ক্রমাগত  প্রজ্জ্বলিত, অসংখ্য জমে থাকা মৃতদেহের  শেষ   প্রাপ্য সম্মানটুকুও পায় নি। ব্রাজিল   এবং অন্যান্য জায়গার মতো এখানেও সমাজের সব চেয়ে বঞ্চিত অংশ, শ্রমিকশ্রেণী এবং মানব সমাজের অন্যান্য শোষিত অংশকেই এই গাফিলতি ও অসাবধানতার চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। যদিও হাস্যকর ভাবেই এখনো এই দুটি রাষ্ট্র এবং দক্ষিণ আফ্রিকা (3)  কে চীনের সমকক্ষীয় উন্নতির সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ এবং পুঁজিবাদের চির স্থায়িত্ব ও চলমানতার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

পচনশীলতায় ডুবন্ত পুঁজিবাদ

করোনা শুধুমাত্র পুঁজির পচনশীলতার উৎপাদনই নয় বরং এই পচনকে ত্বরান্বিত করার শক্তিশালী অনুঘটক স্বরূপও। অর্থহীন আর অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের জন্যে বিখ্যাত, প্রবল জনপ্রিয় সরকারের দ্বারা পরিচালিত মোদীর ভারতবর্ষ এবং বলসেনারোর ব্রাজিল হলো পুঁজিবাদের বর্তমান অচলাবস্থার চূড়ান্ত প্রকাশ।

  এ ক্ষেত্রে ভুল হওয়ার নয যে মোদী, বলসেনারো, ট্রাম্প এবং অন্যান্য প্রবল জনপ্রিয় প্রতিনিধিরা তাদের  নিজেদের খামখেয়ালি ও সংকীর্ণমনা পরিচালনপন্থা  এবং আভিজাত্যহীন বক্তৃতা সত্ত্বেও নিজেদেরকে  রাষ্ট্রীয় এবং বৈশ্বিক পুঁজিবাদের শক্তিশালী ধারক এবং উপযুক্ত বাহক  প্রতিপন্ন করতে চেয়েছে।  সয়া রপ্তানিকারি দেশ গুলির স্বার্থে  আমাজনের জঙ্গল নিধন এবং মারাত্মক পরিমানে খনিজ পদার্থের উত্তোলনের মধ্যে দিয়েই তাদের চরিত্রের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এদিকে মোদীর ভারতবর্ষের এমন  "সুরক্ষিত" কৃষি-আইন প্রণয়ন করা হয়েছে যাতে পুঁজির (4) প্রয়োজনে আরও গ্রামীণক্ষেত্রগুলোকে উন্মুক্ত করা যায়।

কোভিড ১৯ মহামারী সম্পর্কিত ২০২০ এর জুলাই মাসের রিপোর্ট অনুযায়ী বলা যায়, এই অতিমারি  পুঁজির পতনশিলতার বিভিন্ন উপাদান গুলিকে এক জায়গায় টেনে এনে নিজেকে ইতিমধ্যেই পুঁজিবাদের পচনশীলতার দ্যোতক  হিসাবে তুলে ধরেছে।

এই উপাদান গুলির অন্তর্গত বিষয়: -  

- উনিশ শো সাতষট্টি থেকে চলতে থাকা অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং তারই সাপেক্ষে নেওয়া কঠোর ব্যবস্থাপনা একদিকে যেমন এই অতিমারির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বুর্জোয়া শ্রেণীর অপ্রতুল এবং বিশৃঙ্খল  প্রতিক্রিয়ার জন্য দায়ী অন্যদিকে দীর্ঘ সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে থাকা উত্পাদন এই অর্থনৈতিক সংকটকে  আরো ত্বরান্বিত করে তুলেছে।

-খুব পরিষ্কার ভাবেই এই অতিমারির উত্স হল পুঁজিবাদের দীর্ঘকালীন সংকট, অতি উত্পাদনের কারণে উত্তরোত্তর বর্ধিত পরিবেশের ধ্বংসসাধন।

- সাম্রাজ্যবাদী বিশেষ করে পূর্বে মিত্রতার চুক্তিতে আবদ্ধ শক্তি গুলির বিশৃঙ্খল শত্রুতা এই অতিমারির বিরুদ্ধে নেওয়া বিশ্ব পুঁজিবাদের পদক্ষেপ গুলিকে একটি বিশ্ব বিপর্যয়ে পরিণত করেছে।

-  এই স্বাস্থ্য সংকটের সম্মুখে দাড়িয়ে শাসক শ্রেণীর বুদ্ধিহীনতা  তার  রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণহীনতা  এবং সামাজিক জীবনের ওপর রাষ্ট্রের প্রবল নিয়ন্ত্রণকেই সূচিত করে। শক্তিশালী পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলিতে নিজেদের ব্যর্থতা কে ঢাকতে রাষ্ট্র নেতাদের হাস্যকর মিথ্যাচার এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন অর্থহীন বক্তৃতা শাসক শ্রেণীর রাজনৈতিক এবং সামাজিক কর্ম ক্ষমতা হ্রাস এবং মতাদর্শগত পচনকে  আরো স্পষ্ট করে তুলেছে।

সাম্রাজ্যবাদি, অর্থনৈতিক, ভাবাদর্শগত প্রতিটি ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী সমাজের যে অবক্ষয়তা এবং পচনশীলতা তাকে কোভিড-১৯ আরো পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরেছে। বর্তমান স্বাস্থ্য সংকট পুঁজিবাদী শ্রেণীর নিজস্ব গঠণ তন্ত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণহীনতাকে এবং মনুষ্য সমাজকে  ভবিষ্যতের পথ দেখানোর পরিপ্রেক্ষিতহীনতাকে বেআব্রু করে দিয়েছে। পুঁজিবাদের অবক্ষয়ের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত আত্ম নিধনের যে প্রবণতা তা পচনশীলতার যুগে পৌঁছে নিজের স্বরূপ পরিবর্তন করে বিশ্বযুদ্ধের অনুঘটক থেকে নিজেকে রূপান্তরিত করে হয়ে উঠেছে বিশ্-বিশৃঙ্খলার অনুঘটকস্বরূপ, যা মানব প্রজাতিকে ধ্বংসের কিনারায় এনে দাঁড়  করিয়েছে।

এই অতিমারী শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামের পথে সাময়িক বিরতির সূচনা করলেও তা পুঁজিবাদী সমাজের বিশৃঙ্খল চরিত্রটিকে পরিবর্তন করে দিতে পারেনি। বরং এই অতিমারি শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবের অপরিহার্যতা কেই আরো বেশি করে চিহ্নিত করেছে। এই ঐতিহাসিক ফলাফল সম্পূর্ন ভাবে নির্ভর করবে এই সময়ের একমাত্র বৈপ্লবিক শক্তি শ্রমিক শ্রেণীর নিজের শ্রেণীগত অস্তিত্বকে নতুন করে আবিষ্কার করার সচেতনতা ও বৈপ্লবিক কর্ম ক্ষমতার ওপর। কারণ শ্রেণীগত স্বায়ত্বশাসন এবং প্রতিরক্ষার স্বার্থে পরিচালিত এবং সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণীই একমাত্র সক্ষম এই পুঁজিবাদী শাসনের বিনাশ ঘটিয়ে একটি শোষনহীন এবং শ্রেণীহীন সমাজের সূচনা করতে।

Inigo, May 6, 2021

 


[1] China and Russia have taken advantage of the situation in order to flood African and Latin American countries with vaccines for their own imperialist ends.

[2] "Amazon: point of departure of a new pandemic?", France Culture (April 19, 2021).

[3] For Africa and particularly South Africa see https://en.internationalism.org/content/16990/covid-19-africa-vain-hopes...

[4] https://en.internationalism.org/content/16997/lessons-indian-famers-move...