Communist Internationalist - 2023

না ইসরাইল না ফিলিস্তিন ! শ্রমিকদের পিতৃভূমি নেই !

গত শনিবার থেকে ইসরায়েল ও গাজায় বসবাসরত সাধারণ মানুষের উপর আগুনের অবিরাম ধারা বর্ষিত হচ্ছে। একদিকে হামাস, অন্যদিকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী, এরই মাঝখানে অবস্থানরত বেসামরিক নাগরিকদের গুলি ছোড়া হচ্ছে, কার্যকর করা হচ্ছে মৃত্যুদন্ড এবং বহু মানুষকে  গৃহবন্দী করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে সহস্রাধিক মানুষ মারা গেছে।    

এই দুই পক্ষের একটিকে বেছে নেওয়ার জন্য সারা বিশ্বের বুর্জোয়ারা আমাদের আহ্বান জানাচ্ছে। ইসরায়েলি নিপীড়নের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের জন্য অথবা ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি প্রতিক্রিয়াকে সমর্থণের জন্য এই আহ্বান । প্রত্যেকেই যুদ্ধকে ন্যায়সঙ্গত করার জন্য একে অপরের বর্বরতার নিন্দা করে চলে। ইসরায়েলি রাষ্ট্র কয়েক দশক  ধরে অবরোধ, হয়রানি, চেকপয়েন্ট এবং অপমান দিয়ে ফিলিস্তিনি জনগণের উপর নিপীড়ন চালিয়ে আসছে, তাই তাদের প্রতিশোধ বৈধ হবে এইরকম যুক্তি দিয়ে  ফিলিস্তিনি সংগঠনগুলো ছুরিকাঘাত ও বোমাহামলা চালিয়ে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করতে শুরু করেছে। একে অপরের রক্ত ঝরানোর যুক্তিকে  সামনে আনছে।   

হনন-জীঘাংসার এই ভয়ঙ্কর যুক্তিই আসলে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের যুক্তি। আমাদের শোষকশ্রেণি তথা রাষ্ট্রশক্তি সবসময় নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় নির্দয় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে যুক্তির আমদানি করে।  আর আমরা শ্রমিকশ্রেণি, যারা শোষিত, তারা সবসময় আমাদের জীবন দিয়ে এর মূল্য পরিশোধ করি।  

আমাদের জন্য, সর্বহারাদের জন্য, বেছে নেওয়ার মতো কোনও পক্ষ নেই, আমাদের কোনও স্বদেশ নেই, রক্ষা করার মতো কোনও জাতি নেই! সীমান্তের দু'পাশে, আমরা একই শ্রেণিসম্পর্কের সহোদর! আমরা না ইসরায়েল, না ফিলিস্তিন!

মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের কোন শেষ নেই সমগ্র বিংশ শতাব্দী ছিল যুদ্ধের এক শতাব্দী মানব ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস যুদ্ধগুলি সংঘঠিত হয়েছে এই শতাব্দীতে, এবং এই যুদ্ধগুলির কোনটিও  শ্রমিকদের স্বার্থে সংগঠিত হয় নিআমরা দেখেছি কখনো সেটা  "পিতৃভূমি", কখনো "সভ্যতা", কখনো "গণতন্ত্র", এমনকি কখনো "সমাজতান্ত্রিক পিতৃভূমি" (যেমন কেউ কেউ স্ট্যালিন এবং গুলাগের সোভিয়েত ) রক্ষার নামে তাদের শোষকদের স্বার্থে  লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করার জন্য সর্বদা আহ্বান জানিয়ে ছিলো

আজ মধ্যপ্রাচ্যে আবার এক নতুন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। উভয় পক্ষের শাসকশক্তি  ইহুদি বা ফিলিস্তিনি নির্বিশেষে শোষিতদের "স্বদেশ রক্ষার" আহ্বান জানাচ্ছে। অথচ ইসরায়েলে ইহুদি শ্রমিকরা ইহুদি  পুঁজিপতিদের দ্বারা শোষিত হয় এবং  ফিলিস্তিনির শ্রমিকরা একই সাথে ইহুদি পুঁজিপতিদের ও  আরব পুঁজিপতিদের দ্বারা শোষিত হয় (এবং প্রায়শই ইহুদি পুঁজিপতিদের  তুলনায় আরব পুঁজিপতিরা অনেক বেশি হিংস্র, যেহেতু ফিলিস্তিনি সংস্থাগুলিতে শ্রমআইন এখনও প্রাক্তন উসমানীয় সাম্রাজ্যের মতো)।

ইহুদি শ্রমিকরা  ১৯৪৮ সাল থেকে  পাঁচটি যুদ্ধের শিকার হয়েছে।  বুর্জোয়াদের যুদ্ধ উন্মাদনার জন্য ইতিমধ্যে তাদের ভারী মূল্য দিতে হয়েছে। বিশ্বযুদ্ধে বিপর্যস্ত  ইউরোপের  কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প এবং ঘেটোর ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা থেকে বেরিয়ে আসা  শ্রমজীবী মানুষের উত্তরসূরীরা পরে  ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধে সাহালের (ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী) ইউনিফর্ম পরছেন। আমরা দেখেছি,  '৬৭, '৭৩ ও '৮২ সালের যুদ্ধে তাদের বাবা-মা রক্তের মূল্য   পরিশোধ করেছেন। এই সৈন্যরা সত্যিই কি এতটা জঘন্য নৃশংস হতে চায়, যাদের একমাত্র চিন্তা হবে ফিলিস্তিনি শিশুদের হত্যা করা ?  তারা সবাই তরুণ সৈন্য, যাদের অধিকাংশই শ্রমিক, তারা পুলিশ হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে এবং তাদের মাথা আরবদের "বর্বরতা" সম্পর্কে প্রচারণায় ভরে গেছে।      

ফিলিস্তিনি শ্রমিকরাও এরই মধ্যে রক্তের ভয়াবহ মূল্য পরিশোধ করেছে। ১৯৪৮ সালে তাদের নেতাদের দ্বারা পরিচালিত যুদ্ধের দ্বারা তাদের বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত হয়ে, তারা তাদের জীবনের বেশিরভাগ সময় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে কাটিয়েছে, ফাতাহ, পিএফএলপি বা হামাস মিলিশিয়াদের সাথে কিশোর বয়সে যুক্ত হয়েছে।

ফিলিস্তিনিদের উপর সবচেয়ে বড় গণহত্যা ইসরাইলের সেনাবাহিনী দ্বারা সংঘটিত হয়নি, বরং জর্ডান এবং লেবাননের মতো যেসব দেশে তাদের পার্ক করা হয়েছিল: ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বরে ("ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর") "লিটল কিং" হুসেইন তাদের গণহারে হত্যা করেছিলেন, এমন পর্যায়ে যেখানে তাদের কেউ কেউ মৃত্যু থেকে বাঁচতে ইসরায়েলে আশ্রয় নিয়েছিল। ১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বরে, আরব মিলিশিয়ারা (স্বীকৃতভাবে খ্রিস্টান এবং ইসরায়েলের মিত্র) বেইরুটের সাবরা এবং শাতিলা শিবিরে তাদের গণহত্যা করেছিল।  

জাতীয়তাবাদ এবং ধর্ম, শোষিতদের জন্য বিষ  আজ, "ফিলিস্তিনি মাতৃভূমি" এর নামে, আরব শ্রমিকদের আবারও ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে একত্রিত করা হচ্ছে, যাদের বেশিরভাগই হচ্ছে ইসরায়েলি শ্রমিক, সেই তাদেরকেই  "প্রতিশ্রুত ভূমি" রক্ষায় আত্মাহূতি দিতে বলা হচ্ছে।

জাতীয়তাবাদী প্রোপাগান্ডা উভয় দিক থেকে ঘৃণ্যভাবে প্রবাহিত হয়, মনকে অসাড় করে তোলে ।  মানুষকে হিংস্র পশুতে পরিণত করার জন্য এই প্রোপাগান্ডা ডিজাইন করা হয়। ইসরায়েলি এবং আরব বুর্জোয়ারা অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এটিকে উত্তেজিত করে চলেছে। ইসরায়েলি এবং আরব শ্রমিকদের ক্রমাগত বলা হয়েছে যে তাদের অবশ্যই  পূর্বপুরুষদের ভূমি রক্ষা করতে হবে। সমাজব্যবস্থার মধ্যেই একটা নিয়মতান্ত্রিক সামরিকীকরণের পদ্ধতি  "ভাল সৈন্যে" নির্মাণের একটি সাইকোসিস তৈরি করেছে।  নিজের  বাসস্থান খুঁজে নেওয়ার জন্য ইস্রায়েলের সাথে যুদ্ধ করার আকাঙ্ক্ষাকে  জাগ্রত করা হয়েছে । সেইসব দেশের নেতারাই এই আকাঙ্খাকে জাগ্রত করছে যে সব দেশের নেতারা তাদের নাগরিকদের অনেককেই  কয়েক দশক ধরে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে রেখেছিলেন।

বুর্জোয়াদের উদ্ভাবিত সবচেয়ে খারাপ মতাদর্শগুলির মধ্যে একটি জাতীয়তাবাদ।  এটা সেই মতাদর্শ যা শোষক ও শোষিতদের মধ্যে শত্রুতা ঢাকতে দেয়, তাদের সবাইকে একই পতাকার আড়ালে একত্রিত করতে দেয়, যার জন্য শোষকদের সেবায়, শাসক শ্রেণীর স্বার্থ ও সুযোগ-সুবিধা রক্ষায় শোষিতদের হত্যা করা হয়।

সবকিছুর মুকুট পরানোর জন্য, এই যুদ্ধে ধর্মীয় প্রচারণার বিষ যুক্ত করা হয়েছে, যা এই পরিস্থিতে আরো  নিষ্ঠুর ধর্মান্ধতা তৈরি করেছে। ইহুদির আহ্বান জানানো হচ্ছে  তাদের রক্ত দিয়ে  সলোমনের মন্দিরের  প্রাচীর রক্ষা করতে। মুসলমানদের আহ্বান জানানো হচ্ছে  ওমর মসজিদ এবং  ইসলামের পবিত্র স্থানগুলির জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করতে ।  ঊনিশ শতকের বিপ্লবীরা ধর্ম সম্পর্কে যেটা বলেছিলেন, ‘জনগণের আফিম’ সেটা ইসরাজিল ও ফিলিস্তিনে এখন বেশি করে প্রমাণিত হচ্ছে। ধর্মের উদ্দেশ্য হচ্ছে শোষিত ও নিপীড়িতদের সান্ত্বনা দেওয়া। যাদের জন্য পৃথিবীতে জীবন জাহান্নাম, তাদের বলা হয় যে তারা তাদের মৃত্যুর পরে সুখী হবে যদি তারা জানে কিভাবে তাদের পরিত্রাণ অর্জন করতে হয়। এবং এই পরিত্রাণ ত্যাগ, আত্মসমর্পণ, এমনকি "পবিত্র যুদ্ধের" সেবায় তাদের জীবন উৎসর্গ করার বিনিময়ে বিনিময় করা হয়।

একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে, প্রাচীনকাল বা মধ্যযুগের মতাদর্শ এবং কুসংস্কারগুলি এখনও মানুষকে তাদের জীবন উৎসর্গ করার জন্য পরিচালিত করার জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।   মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশ্বের অন্যান্য অনেক অংশের মানুষেরা এখনো এর মধ্যে গভীরভাবে নিমজ্জমান।

পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিগুলো এই যুদ্ধের জন্য দায়ী বৃহৎ শক্তির নেতারাই এমন এক  নারকীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন, যেখানে এই অঞ্চলের হাজার হাজার শোষিত মানুষ মারা যাচ্ছে। ইউরোপীয় বুর্জোয়ারা, বিশেষত ব্রিটিশ বুর্জোয়ারা ১৯১৭ সালের "বালফোর" ডিক্লিয়ারেশনের মধ্য দিয়ে তাদের তাদের ‘বিভক্ত ও জয়’ করার নীতিকে চরিতার্থ করার জন্য  ফিলিস্তিনে একটি "ইহুদি আবাস" তৈরির অনুমতি দিয়েছিল।  এই ভাবে জায়োনিজমের আধিপত্যবাদী ইউটোপিয়াগুলিকে উৎসাহিত করা হয়েছিল। এই একই  বুর্জোয়ারা যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জিতেছিল, তারা মধ্য ইউরোপীয় ইহুদিদের শিবির ছেড়ে  তাদের মূল অঞ্চল থেকে দূরে বিতারিত করার পর ফিলিস্তিনে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। এর অর্থ হ'ল তাদের নিজেদের বাসভূমিতে নিয়ে যেতে হবে না।  

এই একই বুর্জোয়ারা, প্রথমে ব্রিটিশ এবং ফরাসি, তারপর আমেরিকান বুর্জোয়ারা, যারা স্নায়ুযুদ্ধের সময় এই অঞ্চলে পশ্চিমা ব্লকের নেতৃত্বের ভূমিকা দেওয়ার জন্য ইস্রায়েল রাষ্ট্রকে দাঁত পর্যন্ত সশস্ত্র করেছিল, যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন তার পক্ষে তার আরব মিত্রদের যতটা সম্ভব সশস্ত্র করেছিল। এই মহান "পৃষ্ঠপোষক" ছাড়া, 1956, 67, 73 এবং 82 এর যুদ্ধগুলি ঘটতে পারত না।

আজ লেবানন, ইরান এবং সম্ভবত রাশিয়ার বুর্জোয়ারা হামাসকে অস্ত্র দিয়ে সমৃদ্ধ করছে। যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ভূমধ্যসাগরে তাদের বৃহত্তম বিমানবাহী রণতরী পাঠিয়েছে এবং ইসরায়েলে নতুন অস্ত্র সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, সমস্ত বৃহৎ শক্তি এই যুদ্ধ এবং এই গণহত্যায় কমবেশি প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিচ্ছে! 

এই নতুন যুদ্ধ পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দিচ্ছে! বিশ্বের এই প্রান্তকে শুধু শোকের মধ্যে নিমজ্জিত করার জন্য  রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এটা নয়, সংগঠিত হত্যাকাণ্ডের মাত্রা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে বর্বরতা একটি নতুন স্তরে পৌঁছেছে: তরুণরা মেশিনগান নিয়ে একটি উত্সবে নাচছে, প্রকাশ্য রাস্তায় পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে নারী ও শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে।  অন্ধ  প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা ছাড়া আর কোনও উদ্দেশ্য নেই, পুরো জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করার জন্য বোমার কার্পেট বেছানো হয়েছে।  গাজার ২০ লাখ মানুষ জল, বিদ্যুৎ, গ্যাস, খাদ্যসহ সবকিছু থেকে বঞ্চিত। এই সমস্ত নৃশংসতার, এই সমস্ত অপরাধের কোনও সামরিক যুক্তি নেই! দু'পক্ষই সবচেয়ে ভয়ংকর ও অযৌক্তিক প্রাণঘাতী ক্রোধে জর্জরিত!

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে: এই প্যান্ডোরার বাক্সটি আর কখনও বন্ধ হবে না। ইরাকের মতো  আফগানিস্তান, সিরিয়া ও লিবিয়াতেও আর কখনো  'শান্তিতে ফিরে আসবে না'। পুঁজিবাদ মানবতার বৃহত্তর অংশকে যুদ্ধ, মৃত্যু এবং সমাজের পতনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেনে যুদ্ধ ইতিমধ্যে প্রায় দুই বছর ধরে চলছে এবং অন্তহীন হত্যাযজ্ঞে নিমজ্জিত। নাগোর্নো-কারাবাখেও গণহত্যা চলছে। ইতিমধ্যে প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়ার দেশগুলির মধ্যে একটি নতুন যুদ্ধের হুমকি রয়েছে। পুঁজিবাদ হচ্ছে যুদ্ধ!

যুদ্ধের অবসান ঘটাতে হলে পুঁজিবাদকে উৎখাত করতে হবে।

সকল দেশের শ্রমিকদের অবশ্যই যে কোন বুর্জোয়া শিবিরের পক্ষ নিতে অস্বীকার করতে হবে। বিশেষ করে যেসব বাম ও চরম বামপন্থি দলগুলো, নিজেদের শ্রমিকশ্রেণির দল বলে  দাবি করে, অথচ 'মাতৃভূমির' অধিকারের জন্য 'ফিলিস্তিনি জনগণের সঙ্গে সংহতি' দেখানোর  আহ্বান জানায়, তাদের বাগাড়ম্বরকে অস্বীকার করতে হবে। বোকা বনানোর কৌশলকে অস্বীকার করতে হবে। মনে রাখতে হবে,  ফিলিস্তিনি মাতৃভূমি কখনোই শোষকশ্রেণির সেবায় নিয়োজিত বুর্জোয়া রাষ্ট্র  ছাড়া আর কিছুই হবে না, তারাও  পুলিশ ও কারাগার দিয়ে এই একই  জনগণকে নিপীড়ন করবে। সবচেয়ে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির শ্রমিকদের সংহতি "ফিলিস্তিনি ও "ইসরায়েলিদের" সেই সমস্ত শ্রমিকদের কাছে পৌঁছায় না যাদের নিজেদের মধ্যে শোষক এবং শোষিতের বিভাজন রয়েছে। এটি ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের সেইসব শ্রমিক ও বেকারদের কাছে  যায় ( যারা তাদের সমস্ত মগজধোলাই সত্ত্বেও ইতিমধ্যে তাদের শোষকদের বিরুদ্ধে  সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে ), ঠিক যেমনটি বিশ্বের অন্যান্য সমস্ত দেশের শ্রমিকদের ক্ষেত্রে যায়। সেটাই হবে শ্রমিকদের সর্বোত্তম সংহতি, যা  তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী বিভ্রমকে উৎসাহিত করবে না।

এই সংহতির অর্থ সর্বোপরি সমস্ত যুদ্ধের জন্য দায়ী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের লড়াই, তাদের নিজস্ব বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তোলা।

বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদকে উৎখাত করে শ্রমিক শ্রেণীকে শান্তি অর্জন করতে হবে, এবং আজ এর অর্থ হল শ্রেণিসচেতন লাইনেই নিজেদের সংগ্রামকে বিকশিত করতে হবে। অপ্রতিরোধ্য  অর্থনৈতিক আক্রমণের বিরুদ্ধে শ্রেণিসংগ্রামকে বিকশিত করাটাই কাজ।

জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে, যে শোষকরা শোষিতকে যুদ্ধে সামিল করতে চায় তার বিরুদ্ধে:
সকল দেশের শ্রমিকেরা, ঐক্যবদ্ধ হও!  

ICC, 9 October 2023

ইসরায়েল, গাজা, ইউক্রেন, আজারবাইজানে গণহত্যা ও যুদ্ধ... পুঁজিবাদ মৃত্যুর বীজ বপন করে! আমরা কিভাবে এটা থামাতে পারি?

"ভয়াবহতা", "গণহত্যা", "সন্ত্রাসবাদ", "সন্ত্রাস", "যুদ্ধাপরাধ", "মানবিক বিপর্যয়", "গণহত্যা"... আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রথম পাতায় ছড়িয়ে পড়া শব্দগুলো গাজায় বর্বরতার মাত্রা সম্পর্কে অনেক কিছু বলে।

৭ ই অক্টোবর হামাস ১,৪০০ ইসরায়েলিকে হত্যা করে। বাড়িতে থাকা অবস্থাতেই  তারা বৃদ্ধ পুরুষ, মহিলা এবং শিশুদের হত্যা করে। এই ঘটনার পর থেকে ইসরাইল এর প্রতিশোধ নিতে শুরু করে এবং এখনো ব্যাপকভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। গাজায় দিন-রাত বোমা বর্ষণের ফলে ইতিমধ্যে ৪,৮০০ শিশুসহ ১০,০০০ এরও বেশি ফিলিস্তিনি মারা গেছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িতে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা জল, বিদ্যুৎ, খাদ্য এবং ওষুধ সহ সবকিছু থেকে বঞ্চিত। ঠিক  এই মুহুর্তে, আড়াই মিলিয়ন গাজাবাসী অনাহার এবং মহামারীর আতঙ্কে রয়েছে।  তাদের মধ্যে ৪০০,০০০ গাজা শহরে বন্দী রয়েছে।   প্রতিদিন শত শত লোক ক্ষেপণাস্ত্র  এবং বুলেটের সম্মুখীন হচ্ছে, তারা  ছিন্নভিন্ন হয়ে নিহত হচ্ছে, এবং ট্যাংক দ্বারা পিষ্ট হচ্ছে।  

ইউক্রেনের মতো গাজার সর্বত্রই মৃত্যু। রাশিয়ান সেনাবাহিনী কর্তৃক  মারিওপোলের ধ্বংস, মানুষের পলায়ন, কিম্বা ট্রেঞ্চযুদ্ধ যা জ্যান্ত মানুষকে কবর দেয় তা ভুলে যাবেন না। এখনও পর্যন্ত প্রায় ৫ ০০,০০০ মানুষ মারা গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নিহতের সংখ্যা উভয় পাশেই প্রায় সমান সমান। রুশ ও ইউক্রেনীয়দের একটি পুরো প্রজন্মকে এখন মাতৃভূমি রক্ষার নামে জাতীয় স্বার্থের বেদীতে উৎসর্গ করা হচ্ছে।  এছারাও আরো কিছু ঘটনা ঘটেছে : সেপ্টেম্বরের শেষে, নাগোর্নো-কারাবাখে, আজারবাইজানি সেনাবাহিনী এবং গণহত্যার হুমকির মুখে 100,000 মানুষ পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। ইয়েমেনে যে সংঘাতের কথা কেউ বলে না, তাতে দুই লাখেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এবং ২৩ লাখ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। ইথিওপিয়া, মিয়ানমার, হাইতি, সিরিয়া, আফগানিস্তান, মালি, নাইজার, বুরকিনা ফাসো, সোমালিয়া, কঙ্গো, মোজাম্বিকে একই ধরনের যুদ্ধ চলছে। সার্বিয়া ও কসোভোর মধ্যে সংঘাত চলছে।

এই বর্বরতার জন্য কে দায়ী? যুদ্ধ কতদূর যেতে পারে? এবং সর্বোপরি, কোন শক্তি এর বিরোধিতা করতে পারে?

সব দেশই যুদ্ধাপরাধী

এই লেখার সময়, সমস্ত দেশ ইসরায়েলকে তার আক্রমণ "পরিমিত" বা "স্থগিত" করার আহ্বান জানিয়েছে  । দেড় বছর আগে ইউক্রেনে একই নৃশংসতার সঙ্গে হামলা চালানো এবং ১৯৯৯ সালে একই 'সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের' নামে চেচনিয়ায় তিন লাখ বেসামরিক  নাগরিককে হত্যা করে রাশিয়া।একদিকে  চিন বলছে, তারা শান্তি চায়, কিন্তু অন্যদিকে তারা উইঘুর  জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করছে এবং তাইওয়ানের অধিবাসীদের আরও বেশি দাবানলের হুমকি দিচ্ছে। সৌদি আরব ও তার আরবমিত্ররা একদিকে ইয়েমেনের জনগণকে ধ্বংস করে এবং একই সাথে ইসরায়েলি আক্রমণের অবসান চায়। এদিকে তুরস্ক কুর্দিদের নির্মূল করার স্বপ্ন দেখে কিন্তু গাজায় হামলার বিরোধিতা করে। "ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার"কে  সমর্থন করার  সাথে সাথে প্রধান  গণতান্ত্রিক দেশগুলি,  এখন "মানবিক যুদ্ধবিরতি" এবং "আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা"র  আহ্বান জানাচ্ছে। বলা বাহুল্য, এই সমস্ত গণতান্ত্রিক দেশগুলি সেই ১৯১৪ সাল থেকে উল্লেখযোগ্য এবং ধারাবাহিকভাবে গণহত্যায় তাদের দক্ষতা প্রদর্শন করে চলেছে।    

বর্তমানে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রাথমিক যুক্তি: "গাজার ধ্বংস বৈধ", যেভাবে একসময় হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে ফেলা পারমাণবিক বোমা এবং ড্রেসডেন এবং হামবুর্গে কার্পেট-বোমা হামলার বিষয়েও যে কথা বলা হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ও ইরাকে একই  যুক্তি এবং একই পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালিয়েছিল যা আজ ইসরায়েল চালাচ্ছে।  সব দেশই যুদ্ধাপরাধী! বড় বা ছোট, আধিপত্যবাদী বা শক্তিশালী, আপাতদৃষ্টিতে যুদ্ধবাজ বা মধ্যপন্থী, তারা সকলেই বাস্তবে বিশ্ব-অঙ্গনে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে এবং তারা সবাই শ্রমিক শ্রেণীকে  কামানের খাদ্য হিসাবে বিবেচনা করছে।

এই ভণ্ডামি এবং প্রতারণামূলক কণ্ঠস্বরই এখন আমাদেরকে শান্তির জন্য তাদের অভিযানে সামিল করবে এবং তাদের সমাধানে বিশ্বাস করতে বাধ্য করবে, যেটা হলো, ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনকে দুটি স্বাধীন এবং স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া। ফিলিস্তিনি  যদি স্বায়ত্বশাসিত রাষ্ট্র হয়, তবু  সেই রাষ্ট্রটি কেমন হবে সেটা  হামাস এবং ফাতাহ ইতিমধ্যেই  তার পূর্বাভাস দিচ্ছে।  অন্য সবার মতো এটিও শ্রমিকদের শোষণ করবে; অন্য সকলের মতো, এটি জনগণকে দমন করবে; অন্য সবার মতো এটিও যুদ্ধে যাবে। পৃথিবীতে ইতিমধ্যে 195 টি  "স্বাধীন এবং স্বায়ত্তশাসিত" রাষ্ট্র রয়েছে। তারা সম্মিলিতভাবে "প্রতিরক্ষার জন্য বছরে 2,000 বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ব্যয় করে! আর ২০২৪ সালের মধ্যে এইখাতের খরচ  বিস্ফোরিত হতে চলেছে।

বর্তমান যুদ্ধ: পৃথিবীকে পুড়িয়ে ফেলার নীতি

তাহলে জাতিসংঘ হঠাৎ কেন ঘোষণা করেছে: "আমাদের অবিলম্বে মানবিক  কারণে যুদ্ধবিরতি প্রয়োজন। ত্রিশ দিন হয়ে গেছে। যথেষ্ট হয়েছে। এটা  এখনই বন্ধ করতে হবে"”। স্পষ্টতই, ফিলিস্তিনের মিত্ররা ইসরায়েলি আক্রমণের অবসান চায়। ইসরায়েলের মিত্রদের কথা বলতে গেলে অর্থাৎ যে "মহান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি" "আন্তর্জাতিক আইন"  কে সম্মান করে বলে দাবি করে, তারা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে কিছু না বলে যা খুশি করতে চায় তা করতে দিতে পারে না। আইডিএফ-এর গণহত্যা দিনের আলোর মতো দৃশ্যমান।  গণতান্ত্রিক দেশগুলি  ইউক্রেনকে "রাশিয়ান আগ্রাসন"  এবং  "যুদ্ধাপরাধের" বিরুদ্ধে সামরিক  সহায়তা প্রদান করছে এবং এখন তারা মনে করছে দুটি "আগ্রাসনের" বর্বরতা খুব বেশি অনুরূপ হতে দেওয়া উচিত নয়।  

কিন্তু এর চেয়েও গভীর কারণ আছে: সবাই বিশৃঙ্খলার সীমা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে।  কারণ এর ফলে সবাই প্রভাবিত হতে পারে।  যদি এই সংঘাত খুব বেশি দূরে ছড়িয়ে পড়ে তবে প্রত্যেকেরই হারানোর কিছু না কিছু আছে। হামাসের হামলা এবং ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে একটি মিল রয়েছে: পৃথিবীকে পুড়িয়ে ফেলার নীতি। গতকালের সন্ত্রাসী গণহত্যা এবং আজকের কার্পেট বোমা হামলা কোনও সত্যিকারের এবং স্থায়ী বিজয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে না। এই যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীলতা ও সংঘাতের যুগে নিমজ্জিত করছে।

ইসরায়েল যদি গাজাকে ধ্বংস করে ধ্বংসস্তূপের নিচে পুঁতে ফেলতে থাকে, তাহলে পশ্চিম তীরেও আগুন লাগার আশঙ্কা রয়েছে।  হিজবুল্লাহ লেবাননকে যুদ্ধের দিকে টেনে নিয়ে যাবে এবং ইরানও এতে জড়িয়ে পড়বে। পুরো অঞ্চলজুড়ে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়া কেবল আমেরিকান প্রভাবের জন্য নয়, চিনের বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্যও আঘাত হবে। কারণ চিনের মূল্যবান সিল্করোড এই অঞ্চলের মধ্য দিয়েই গেছে। 

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের হুমকি সবার মুখে মুখে। সাংবাদিকরা প্রকাশ্যে টেলিভিশনে এ নিয়ে বিতর্ক করছেন। বাস্তবে বর্তমান পরিস্থিতি অনেক বেশি বিপজ্জনক। ১৯১৪-১৮ এবং ১৯৩৯-৪৫ সালের মতো বা স্নায়ুযুদ্ধের পুরো সময়জুড়ে একে অপরের মুখোমুখি হয়ে সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো এবং সুনির্দিষ্ট  দুটি ব্লক নেই। যদিও চিন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের  প্রতিযোগিতা ক্রমবর্ধমান নৃশংস এবং নিপীড়নমূলক।  অন্য দেশগুলি এই দুটি বৃহৎ গোষ্ঠীর মধ্যে একটি বা অন্যটির আদেশের কাছে মাথা নত করছে না।  তারা বিশৃঙ্খলা, অনিশ্চয়তা এবং ডামাডোলের মধ্যে তাদের নিজস্ব খেলা খেলছে।  চিনের পরামর্শের  বিরুদ্ধে ইউক্রেন আক্রমণ করেছে রাশিয়া। ইসরাইল আমেরিকার পরামর্শের বিরুদ্ধে গাজাকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। এই দুটি সংঘাত সেই বিপদের প্রতীক যা সমগ্র মানবজাতিকে ধ্বংসের হুমকি দেয়। এটি যুদ্ধের বহুগুণ যার একমাত্র লক্ষ্য প্রতিপক্ষকে অস্থির করে তোলা বা ধ্বংস করা। এটি হলো সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং ধ্বংসাত্মক বহিষ্কারের  একটি অন্তহীন শৃঙ্খল। এখন প্রতিটি মানুষ নিজের জন্য, যে দর্শন আসলে অনিয়ন্ত্রিত বিশৃঙ্খলার সমার্থক ছাড়া অন্য কিছুই নয়।  

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং পূর্ব এশিয়ার সর্বহারাদের পিতৃভূমির নামে তাদের জীবন উৎসর্গ করা, পতাকা ও জাতীয় স্বার্থের জন্য অস্ত্র তুলে নেওয়া এবং একে অপরকে হত্যা করতে প্রস্তুত থাকা, যা মোটেও আজকের বাস্তবতা নয়।   কিন্তু যেখানে ইতিমধ্যেই এই ধ্বংস প্রক্রিয়া চলছে সেখানে নতুন করে জনগণের আর সামিল হওয়ার প্রয়োজন নেই। ২০০০ এর দশকের গোড়ার দিকে, পৃথিবীর বিস্তৃত অংশ সহিংসতা এবং বিশৃঙ্খলায় নিমজ্জিত হয়েছে: আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, লেবানন, ইউক্রেন, ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন... এই গ্যাংগ্রিন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে, দেশে দেশে

অঞ্চলে অঞ্চলে। শোষণের এই ক্ষয়িষ্ণু ও পচনশীল ব্যবস্থাই হলো পুঁজিবাদের একমাত্র সম্ভাব্য ভবিষ্যত।

যুদ্ধের অবসান ঘটাতে হলে পুঁজিবাদকে উৎখাত করতে হবে

সম্ভাব্য শান্তি, "আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়", জাতিসংঘ বা অন্য কোনও চোরের আস্তানা থেকে কোনও সমাধান সম্পর্কে শ্রমিকদের কোনও বিভ্রান্তি থাকা উচিত নয়। পুঁজিবাদ হচ্ছে যুদ্ধ। 1914 সাল থেকে, এটি কার্যত কখনও থামেনি। সর্বদাই  বিশ্বের এক অংশ  অন্য অংশকে প্রভাবিত করে চলেছে। আমাদের সামনের ঐতিহাসিক সময়কালে এই প্রাণঘাতী গতিশীলতা ক্রমবর্ধমান অপরিমেয় বর্বরতার সাথে ছড়িয়ে পড়বে এবং প্রসারিত হবে।

সুতরাং প্রতিটি দেশের শ্রমিকদের অবশ্যই এই দায়ভার বহন করতে অস্বীকার করতে হবে।  তাদের অবশ্যই প্রাচ্যে, মধ্যপ্রাচ্যে এবং সর্বত্র এক বা অন্য বুর্জোয়া শিবিরের পক্ষ নিতে অস্বীকার করতে হবে। তাদের অবশ্যই "আক্রমণের মুখে ইউক্রেনীয় জনগণ", "রাশিয়া হুমকির মুখে",  "শহীদ ফিলিস্তিনি জনগণের" সাথে এবং "আতঙ্কিত ইসরায়েলিদের" সাথে "সংহতি" দেখানোর জন্য বলা বাগাড়ম্বর দ্বারা বোকা হতে অস্বীকার করতে হবে।  সমস্ত যুদ্ধে, সীমান্তের উভয় পাশের রাষ্ট্র সর্বদা মানুষকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে যে, ভাল এবং মন্দের মধ্যে, বর্বরতা এবং সভ্যতার মধ্যে লড়াই রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে, এই সমস্ত যুদ্ধ সবসময় প্রতিদ্বন্দ্বী জাতিগুলির মধ্যে, প্রতিদ্বন্দ্বী বুর্জোয়াদের মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব। এই সমস্ত দ্বন্দ্বে সবসময় শোষিতরা তাদের শোষকদের সুবিধার জন্য মারা যায়।

শ্রমিকদের সংহতি তাই "ফিলিস্তিনিদের" প্রতি নয়, একইভাবে এটি  "ইস্রায়েলি", "ইউক্রেনীয়" বা "রাশিয়ানদের" প্রতিও নয়, কারণ এই সমস্ত জাতীয়তার মধ্যে শোষক এবং শোষিত নামে দুটি পৃথক স্বার্থের শ্রেণি রয়েছে।  শ্রমিকদের সংহতি  ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, রাশিয়া,  ইউক্রেনের শ্রমিক এবং বেকারদের প্রতি, ঠিক একইভাবে শ্রমিকদের সংহতি   বিশ্বের অন্যান্য দেশের শ্রমিকদের প্রতিও। "শান্তির জন্য" মিছিল করে নয়,  যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত কোন এক পক্ষের প্রতি সহমর্মিতা নয়। আসলে উভয়পক্ষের সাধারণ মানুষ, সৈন্য, উর্দিধারী সর্বহারা, এবং প্ররোচিত ধর্মান্ধ শিশুসৈন্য সকলেই কামানের খাবার।

 সর্বহারার একমাত্র সংহতি হল সমস্ত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের নিন্দা করা।  যে সমস্ত দল আমাদের বিভিন্ন জাতীয় পতাকা, যুদ্ধের নানাবিধ কারণের পিছনে একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানায় কিম্বা  যারা শান্তি এবং মানুষের মধ্যে "সুসম্পর্কের" বিভ্রম দিয়ে আমাদের প্রতারিত  করে তাদের সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখান করা।   

শ্রমিক সংহতির অর্থ সর্বোপরি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইকে বিকশিত করা যা সমস্ত যুদ্ধের জন্য দায়ী। শ্রমিক শ্রেণির লড়াই  জাতীয় বুর্জোয়া এবং তাদের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে।

ইতিহাস দেখিয়েছে যে শষিতশ্রেণি হলো একমাত্র শক্তি যে পুঁজিবাদী যুদ্ধের অবসান ঘটাতে পারে।  সর্বহারা শ্রেণী হলো বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রত্যক্ষ শত্রু। ১৯১৭ সালের অক্টোবরে রাশিয়ার  শ্রমিকরা বুর্জোয়া রাষ্ট্রকে উৎখাত করে এবং ১৯১৮ সালের নভেম্বরে জার্মানির শ্রমিক ও সৈন্যরা বিদ্রোহ করে।  সর্বহারা শ্রেণীর সংগ্রামের এই মহান আন্দোলনগুলি সরকারকে যুদ্ধবিরতিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছিল।  বিপ্লবী সর্বহারাশ্রেণীর শক্তিই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটায়।  শ্রমিক শ্রেণীকে বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদকে উৎখাত করে সর্বত্র প্রকৃত ও সুনির্দিষ্ট শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

এক দীর্ঘ পথ আমাদের সামনে।  একটি অপ্রতিরোধ্য সংকটের মধ্যে নিমজ্জিত একটি ব্যবস্থা যা  আমাদের উপর ক্রমবর্ধমান কঠোর অর্থনৈতিক আক্রমণ নামিয়ে এনেছে তার  বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণিকে তার নিজস্ব শ্রেণিগন্ডীর মধ্যেই সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে।  আমাদের জীবনযাত্রা ও কর্মপরিবেশের অবনতিকে প্রত্যাখ্যান করে, বাজেটের ভারসাম্য বজায় রাখার  নামে, জাতীয় অর্থনীতির প্রতিযোগিতা বা যুদ্ধপ্রচেষ্টার নামে করা চিরন্তন ত্যাগকে প্রত্যাখ্যান করে আমরা পুঁজিবাদের কেন্দ্রভূমিতে দাঁড়িয়ে মানুষের দ্বারা মানুষের শোষনকে অস্বীকার করতে শুরু করেছি।  

এইসব সংগ্রামে, আমরা যখন ঐকবদ্ধ এবং সংগঠিত হই, আমরা একসাথে দাঁড়াই, আমরা আমাদের সংহতি গড়ে তুলি, আমরা বিতর্ক  করি এবং তখন আমাদের শক্তি সম্পর্কে সচেতন হই ।  শ্রেণিসংগ্রামে সর্বহারা শ্রেণি তার মধ্যে এমন একটি বিশ্বে সম্ভাবনা বহন করে যা পুঁজিবাদের ঠিক  বিপরীত। একদিকে অর্থনৈতিক ও যুদ্ধের মতো প্রতিযোগিতায় নিয়োজিত জাতিসমূহ বিভাজিত এবং ধ্বংসের পর্যায়ে; অন্যদিকে, বিশ্বের সমস্ত শোষিতদের একটি সম্ভাব্য ঐক্য। সর্বহারা শ্রেণী  এই দীর্ঘ পথে হাঁটতে শুরু করেছে। তার মধ্যে ২০২২ সালে যুক্তরাজ্যে "অসন্তোষের গ্রীষ্ম" , ২০২৩ সালের গোড়ার দিকে ফ্রান্সে  পেনশন সংস্কারের  বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও অটোমোবাইল খাতে ঐতিহাসিক ধর্মঘট হলো কতগুলি গুরুত্ত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই আন্তর্জাতিক  গতিশীলতা শ্রমিকদের লড়াইয়ের ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তনকে চিহ্নিত করে, সেইসাথে জীবনযাত্রা ও কাজের অবস্থার স্থায়ী অবনতি মেনে নিতে অস্বীকার করা  এবং সংগ্রামে শ্রমিক হিসাবে বিভিন্ন সেক্টর এবং প্রজন্মের মধ্যে সংহতি প্রদর্শনের প্রবণতাকে চিহ্নিত করে। ভবিষ্যতে আন্দোলনকে অর্থনৈতিক সংকট ও যুদ্ধের মধ্যে যোগসূত্র চিনতে হবে,এছাড়াও রাষ্ট্রের দাবি করা ত্যাগের সাথে  অস্ত্র বাজেট ও নীতির বিকাশের মধ্যে সম্পর্ক আবিষ্কার করতে হবে।  অচল বিশ্ব পুঁজিবাদ যে সব অর্থনৈতিকসংকট, যুদ্ধ এবং জলবায়ু সংকটের মতো  আন্তঃসম্পর্কযুক্ত এবং পারস্পরিক পুষ্টিপ্রদানকারী অভিশাপগুলিকে বয়ে আনছে সেগুলিকে চিনতে হবে।   

জাতীয়তাবাদের স্বপক্ষে, আমাদের শোষকরা যে সব যুদ্ধে আমাদের টেনে আনতে চায়, সেক্ষেত্রে ১৮৪৮ সালের কমিউনিস্ট ইশতেহারে প্রকাশিত শ্রমিক আন্দোলনের পুরোনো প্রহরীশব্দগুলো  আজ আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক:

 

শ্রমিকদের কোনো স্বদেশ নেই!

দুনিয়ার মজদুর এক হোক!

আন্তর্জাতিক সর্বহারা শ্রেণির শ্রেণিসংগ্রামের বিকাশের জন্য!

 

আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট কারেন্ট, ৭ নভেম্বর ২০২৩

 

কিভাবে আমরা একটি বিশাল ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে একসাথে লড়াই করতে পারি?

গত জুনমাস থেকে অদ্যাবধি বৃটেনের প্রতিটি আন্দোলনে একই আর্তি প্রতিধ্বনিত হয়েছে –

‘অনেক হয়েছে, অনেক !’

আমরা দেখলাম,’ক্রোধের গ্রীষ্ম ' নামে পরিচিত এই বৃহদাকার আন্দোলন ক্রমেই 'ক্রোধের শরত' ও পরবর্তীতে 'ক্রোধের শীতে ' রূপান্তরিত হয়েছে।

ইউকে তে একের পর এক আন্দোলনের ঢেউ বিশ্ব জোড়া শ্রমিক শ্রেণির  সংগ্রামী শক্তির ক্রমাগত বৃদ্ধিকেই চিহ্নিত করেছেঃ

- স্পেনে, মাদ্রিদ সংলগ্ন অঞ্চলে ডাক্তার ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা ধর্মঘট শুরু করে নভেম্বরের শেষের দিকে, একই সঙ্গে ডিসেম্বরে বিমান পরিষেবা ও রেল কর্মীদের ধর্মঘট পরিলক্ষিত হয়। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন অঞ্চলের স্বাস্থ্য বিভাগগুলিতে জানুয়ারি থেকে ধর্মঘট শুরু করার পরিকল্পনা সম্পন্ন হয়েছে। 

- জার্মানিতে ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি এবং তার ফলস্বরূপ ঘটতে চলা এক অভূতপূর্ব শক্তির সঙ্কট শ্রমিকশ্রেণির ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছে। এসব কারণে এ দেশের বড় বড় ধাতু ও বিদ্যুত কারখানা গুলি নভেম্বরেই স্লো-ডাউনের মুখে পড়ে।  

- ইতালিতে অক্টোবরের মাঝামাঝি ইজি জেট এর বিমানচালক দের তালিকায় বিমান যানজট নিয়ন্ত্রক দের দ্বারা পরিচালিত আরও একটি ধর্মঘট এর সাথে যুক্ত হয়। সরকার বাধ্য হয় সরকারি ছুটির দিনগুলিতে ধর্মঘট নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করতে । 

- বেলজিয়ামে নয় এবং ষোল ডিসেম্বর দেশ জোড়া ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয় । 

- গ্রীসের এথেন্সে বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত হাজার হাজার কর্মী জড়ো হয়ে গর্জে ওঠে  'জীবনযাত্রার অসহনীয় খরচের' বিরুদ্ধে। 

- ফ্রান্স গত কয়েক মাসে সরকারি হসপিটাল ও যানবাহন কর্মীদের একের পর এক ডাকা ধর্মঘটের সাক্ষী থেকেছে ।

- পর্তুগালে শ্রমিকরা বর্তমান সর্বনিম্ন বেতন ৭০৫ এর পরিবর্তে ৮০০ ইউরোর দাবি জানিয়েছে । ১৮ নভেম্বর বেসামরিক কর্মীরা ধর্মঘটে নেমেছে। ডিসেম্বরে যানবাহন পরিষেবায় অনেক গুলি ধর্মঘট দেখা যায়। 

- আমেরিকায় ঘটতে চলা মালবাহী রেলকর্মীদের একটি ধর্মঘটকে বন্ধ করতে হাউস অফ রিপ্রেজে নটেটিভরা তৎপর হয়ে ওঠে। জানুয়ারিতে নিউ ইয়র্ক শহরে হাজার হাজার নার্স প্রহৃত হয়। 

এই তালিকা আসলে আরও অনেক লম্বা, কারণ বাস্তবে প্রায় সমস্ত জায়গাই সাক্ষী থেকেছে ছোট বড়, একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন, অসংখ্য ব্যবসা ক্ষেত্র, সরকারি সংস্থায় ঘটতে থাকা অসংখ্য ধর্মঘটের।সমস্ত জায়গায়, সমস্ত দেশে, সমস্ত কর্মক্ষেত্রের ক্রমশ অধোগামী জীবন ও জীবিকা, প্রতিনিয়ত মূল্যবৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য, জীবনের অনিশচয়তা, শ্রমিকের অভাব এবং তার ফলস্বরুপ জমতে থাকা কাজের পাহাড় এবং বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের জন্যে ক্রমাগত কমতে থাকা বাসস্থানের মান, -  এসবকিছুকেই এই পরিস্থিতির জন্যে দায়ী করা যেতে পারে। 

কোভিড ১৯ এর সময় থেকেই প্রায় সমস্ত শ্রমিকের কাছে হসপিটালগুলি হয়ে উঠেছে এক নিষ্ঠুর বাস্তবতার প্রতীক; কর্মী সংখ্যার অপ্রতুলতা এবং তার ফলে ক্লান্তির সীমানা ছাড়ানো ভয়ঙ্কর শোষণ এবং দিনের শেষে অপর্যাপ্ত বেতন যা কোনো ভাবেই জীবন ধারণের জন্যে যথেষ্ট নয়। 

যে দেশে থ্যাচার এর সময়কাল থেকে  মনে করা হত শ্রমিক শ্রেণি নিজের ভবিষ্যতচিন্তা কে ভাগ্যের হাতেই সমর্পণ করেছে, সেই  ইউ কে তে জুন থেকে  চলতে থাকা এই প্রলম্বিত ধর্মঘটের ঢেউ শুধু ইউ কে তেই নয়, বরং গোটা বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণির চেতনার এক বড়সড় পরিবর্তন কে সূচিত করে। ক্রমশ আরও জটিল হতে থাকা অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই লড়াইগুলি প্রমাণ করে যে শ্রমিক শ্রেণি আর কোনও ভাবেই পিছু হটতে প্রস্তুত নয়। 

  ১১ শতাংশেরও বেশি মুদ্রাস্ফীতি আর তারই সঙ্গে সুনক সরকারের কঠোর বাজেট প্রায় প্রতিটি সেক্টরের শ্রমিকদেরকে পথে নামতে বাধ্য করেছে। যানবাহন(ট্রেন,বাস,টিউব,এয়ারপোর্ট),স্বাস্থ্য, রয়্যাল মেল পোস্টাল সার্ভিস এর কর্মীরা, ডেফ্রার বেসামরিককর্মীগণ, আমাজনে কর্মরত শ্রমিক, স্কটল্যান্ডের স্কুল কর্মীরা, উত্তর সাগরে কর্মরত তেল কর্মী সকলেই নেমে এসেছে পথে। স্বাস্থ্য কর্মীদের মধ্যে  এই পরিমাণ সংহতি এদেশে গত কয়েক শতাব্দীতে দেখা যায় নি। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে শিক্ষকদেরও ধর্মঘটে বসার কথা শোনা যাচ্ছে। 

ফ্রান্সের সরকার অবসর গ্রহণের বয়সকে বাড়িয়ে দিতে আইনী ‘সংস্কার’ আনতে তৎপর হয়ে উঠেছে। উদ্দেশ্য খুব সহজ,  মৃত্যু পর্যন্ত শ্রমিককে  লেবুর মত নিংড়ে শুষে নিয়ে নিজেদের খরচ বাঁচানো। আরও স্পষ্ট  করে বললে, এর অর্থ, বিধ্বস্ত হয়ে বৃদ্ধ বয়েস অব্ধি কাজ করে যাওয়া, অথবা আরও কম এবং অপ্রতুল পেনসনের ভরসায় কর্মক্ষেত্র ত্যাগ করা। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে ভুগতে ভুগতেই একজন শ্রমিকের জীবন অতিবাহিত হয়ে যাবে। 

আমাদের জীবন-জীবিকার উপর আক্রমণ থামবে না। বিশ্ব অর্থনীতি দিনে দিনে আরও খারাপের দিকে এগোবে। বিশ্ববাজার দখলের লড়ায়ে টিঁকে থাকতে প্রতিটি দেশের প্রতিটি শাসক গোষ্ঠীই কখনো বা 'ইউক্রেনের প্রতি সহানুভুতি' কখনো বা 'জাতীয় অর্থনীতির ভবিষ্যৎ' এর দোহাই দিয়ে শ্রমিকশ্রেণির জীবন এবং জীবিকা কে আরও বেশি অসহনীয় করে তুলবে। 

 

যুদ্ধ অর্থনীতির ক্রমবিকাশের সাথে সাথে এই সত্য গুলি আরও বেশি করে প্রকট হয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত যুদ্ধ-অর্থনীতির খাতে  শ্রম এবং অন্যান্য সম্পদের আনুপাতিক ব্যয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু ইউক্রেনেই নয়, যুদ্ধ-অর্থনীতির এই বিকাশের ফলে ইথিওপিয়া, ইয়েমেন, সিরিয়া, মালী, নিগার, কঙ্গো এসব জায়গাতেও বিস্ফোরণ,বুলেট এবং মৃত্যু সহজাত হয়ে উঠেছে।   এরই ফলে অন্যান্য সব জায়গাতেই আতঙ্ক, মুদ্রাস্ফীতি এবং শ্রমিকের ঘাড়ে আরও কাজের চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে।এখন প্রতিটি সরকারের সর্বজনীন স্লোগান হয়ে উঠেছে 'দেশের জন্যে ত্যাগ স্বীকার' । 

মানব সভ্যতাকে আরও বেশি দুর্দশা, যুদ্ধ,  প্রতিযোগিতা, ভাগাভাগির দিকে এগিয়ে নিয়ে চলা এই পুঁজিবাদী ব্যাবস্থার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিশ্ব শ্রমিক শ্রেণির(প্রতিটি সেক্টর, প্রতিটি দেশের বেতন ভোগী, বেকার অথবা কর্মরত, প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত অথবা অপ্রশিক্ষন প্রাপ্ত, অবসর প্রাপ্ত বা কর্মরত…)  এই মুহূর্তের কর্তব্য হল অন্য আরেক  পরিপ্রেক্ষিত কে সামনে তুলে ধরা। 'দেশের হয়ে ত্যাগ স্বীকার' কে প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে এবং ঐকবদ্ধ বৃহত্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই অন্য এক পৃথিবীর রূপায়ণের সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করা সম্ভব।  

বিভক্ত অবস্থায় আমরা দুর্বল

বিভক্ত অবস্থায় আমরা পরাজিত

মাসাধিক কাল ধরে সমস্ত দেশের প্রায় সমস্ত সেকটরের কর্মীরা ধর্মঘট করে চলেছে। কিন্তু এই ধর্মঘটগুলি একে অপরের থেকে বিছিন্ন। এই ধর্মঘট গুলির সাথে যুক্ত প্রতিটি মানুষ যেন নিজেদের ধর্মঘট, নিজেদের কর্মক্ষেত্র, নিজেদের কারখানা, সরকারি অফিস এসবের বাইরে বেরোতে পারছে  না। এমনকি যখন একই রাস্তার দু পাশে, একদিকে হাসপাতাল কর্মীরা, অন্য দিকে স্কুল শিক্ষক ও সুপারমার্কেটে কর্মরত শ্রমিকরা নিজেদের দাবি আদায়ে সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছে, কিন্তু নিজেদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয় নি। কখনো কখনো এই বিছিন্নতা আরও বেশি হাস্যকর দেখায়  যখন একই বিভাগে কর্মরত শ্রমিকেরা নিজেদের টিম, নিজেদের ইউনিট এইসবের নামে বিভক্ত হয়ে আলাদা আলাদা করে ধর্মঘট চালিয়ে যায়।  উদাহরণ স্বরূপ দেখা গেছে, একই অফিসে অফিস-কর্মী আর প্রযুক্তি-কর্মীরা আলাদা আলাদা সময়ে আলাদা আলাদা ভাবে একত্রিত হচ্ছে, অথবা একই অফিসের এক তলা এবং দুতলায় আলাদা আলাদা ভাবে কর্মীরা ধর্মঘট ডাকছে।কিছুক্ষেত্রে সত্যিই এটা ঘটে!

নিজেদেরকে একটি ছোট্ট গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ রেখে আন্দোলন করার বিষয়টি শাসকশ্রেণির অনুকূলে যায় এবং আমাদেরকে আরও বেশি দুর্বল করে, আমাদের গুরুত্ব আরও বেশি কমিয়ে দেয়, বিধ্বস্ত করে এবং অবশেষে পরাজয়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।  

এই কারণেই বুর্জোয়ারা এই বিছিন্নতাকে কায়েম  রাখতে আরও বেশি মাথা ঘামায়। প্রতিটি দেশে এই একই পরিচিত কৌশলঃ সরকারের দ্বারা  আমাদের বিভাজন। তারা একটা ক্ষেত্রকে  সাহায্যের নামে অন্য ক্ষেত্রের ওপর আক্রমণ নামিয়ে আনে। কোন এক জায়গায় কোন ঘনীভূত  আন্দোলন কে দমন করতে তারা অন্য কোনও একটি বিশেষ সেক্টর  বা বিশেষ কোম্পানি কে সাহায্য করার মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেয়।  তারা  কোনও একটি গ্রুপকে যৎকিঞ্চিত সাহায্যের মাধ্যমে অন্যান্য গ্রুপগুলির সমস্ত অধিকার  কেড়ে  নেয় এবং বিভাজন ত্বরান্বিত করে। এক কোম্পানি  কে অন্য কোম্পানির থেকে বিছিন্ন করার অথবা এক বিভাগকে অন্য বিভাগের থেকে বিছিন্ন করার এই পদ্ধতি সব জায়গায় সাধারণ ফন্দীতে পরিণত  হয়েছে। 

ফ্রান্সে নতুন  পেনসন আইন সংস্কারের ঘোষণা  প্রসঙ্গে, বধির মিডিয়া মেতে উঠেছে এক অর্থহীন তর্কে।এই নতুন আইন কোন কোন সেক্টরের বেশি ক্ষতি করবে তাই নিয়েই বিতর্ক চলছে বেশি,   যখন কিনা এটা খুব পরিষ্কার যে এই আইন সমগ্র শ্রমিক শ্রেণির জীবনেই বিপর্যয় ডেকে আনবে।

শিক্ষানবিশ, কায়িক শ্রমিক, মহিলা প্রভৃতিদের যোগ্যতার নিরিখে পেনশন সংস্কারের ধারণাও এক ধরণের ফাঁদ!  

শ্রমিকদের সংগ্রাম নিজেদের হাতে নিতে হবে

কেন এই বিভাজন? এটা কি শুধুমাত্র সরকারী প্রচার এবং  কৌশল যা শ্রমিক শ্রেণীর ধর্মঘট ও সংগ্রামকে একে অপরের থেকে আলাদা রেখে আমাদের এভাবে বিভক্ত করতে সফল হয়?

আমরা সবাই একই নৌকার মাঝি এমন অনুভূতি বাড়ছে। ব্যাপক সংহতির সাথে একটি বিশাল ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম শ্রেণীগুলির মধ্যে শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তন করতে পারে, এই ধারণাটি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তাহলে কেন এখনো আমরা প্রতিটি দেশে এবং প্রতিটি সেক্টরে বহু মাস ধরে শ্রমিকদের মধ্যে বিভাজন দেখতে পাচ্ছি?

যুক্তরাজ্যে ধর্মঘটরত শ্রমিকরা ঐতিহ্যগতভাবে তাদের কর্মস্থলের বাইরে পিকেটিং করেন। বেশ কয়েক মাস ধরে, সংগঠিত পিকেটগুলি খুব বেশি দূরে ছিল না, কখনও কখনও কেবল একদিনের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত হয়েছে, কখনও কখনও একই সময়ে হয়েছে,  তবু  পিকেটগুলি কয়েকশ মিটার দূরত্বে আলাদা হয়ে গেছে,  সেখানে একসাথে সংযোগ স্থাপনের কোনও প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় নি। সবাই ধর্মঘটে আছে, কিন্তু পিকেট লাইনে আটকা পড়ে গেছে। এই বিভাজনের বিরুদ্ধে লড়াই না করলে, সংগ্রামে সত্যিকারের একতা গড়ে না  তুললে,  এটি আমাদের লড়াইয়ের চেতনাকে ক্লান্ত করে দিতে পারে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে এই পরিস্থিতি যে অচলাবস্থা এবং বিপদ   তৈরি করেছে তাতে তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যে সব শ্রমিক গত ছয় মাস ধরে 'রোলিং ধর্মঘটে' এ রয়েছেন তারা এখন ক্লান্ত এবং শক্তিহীন বোধ করতে পারেন।  

যাইহোক, আমরা বেশ কয়েকটি পিকেট লাইন পরিদর্শন করেছি, শ্রমিকরা কেবল তাদের নিয়োগকর্তা, তাদের বিভাগ, তাদের সেক্টরের চেয়ে আরও বিস্তৃত সংগ্রামে যুক্ত হওয়ার অনুভূতি আমাদের কাছে প্রকাশ করেছে। একসাথে লড়াই করার প্রয়োজনীয়তার একটি  ক্রমবর্ধমান অনুভূতি রয়েছে।

কিন্তু কয়েক মাস ধরে, সমস্ত দেশে, সমস্ত সেক্টরে, ইউনিয়নগুলিই এই সমস্ত খণ্ডিত সংগ্রাম সংগঠিত করে আসছে। ইউনিয়নগুলি মূলত যে  কৌশল নেয় তা শ্রমিকশ্রেণিকে বিভক্ত এবং বিচ্ছিন্ন করে, এবং তারা এই পরামর্শ দেয় যে তাদের দাবিগুলি শাখা থেকে শাখা, সেক্টর থেকে সেক্টরের মধ্যেই আপসে মীমাংসা সম্ভব হবে। ইউনিয়নগুলি সুনির্দিষ্ট দাবি নির্ধারণ করতে পছন্দ করে এবং ইউনিয়নগুলি সর্বোপরি সতর্ক করে দেয় যে "আমরা যদি সাধারণ দাবি করি তবে আমরা আমাদের নিজস্ব সংগ্রামকে দুর্বল করব"।   

ইতিমধ্যেই ইউনিয়নগুলি সচেতন হয়ে উঠেছে যে শ্রমিকশ্রেণির ক্ষোভ বাড়ছে।  তারা  বেসরকারী ক্ষেত্র এবং সরকারী ক্ষেত্রের  অভ্যন্তরে এবং পরস্পরের মধ্যে   যে বিভাজন তৈরি করেছে তা  ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। তারা বুঝতে পারছে যে "একটি সাধারণ সংগ্রাম" এর ধারণাটি  শ্রেণীর অভ্যন্তরে পরিপক্ক হচ্ছে।    

উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে ইতিমধ্যেই ইউকের ইউনিয়নগুলি বিভিন্ন সেক্টরে যৌথ পদক্ষেপ সম্পর্কে কথা বলতে শুরু করেছে,  যা তারা এখন পর্যন্ত এড়ানোর জন্য খুব সতর্ক ছিল। তাদের বক্তৃতায়  "ঐক্য" এবং "সংহতি" শব্দগুলি শোনা যেতে শুরু করেছে। তারা  কখনোই শ্রমিকদের বিভক্ত করার রাস্তা থেকে সরবে না,  আর সেটা করার জন্যই তারা শ্রমিকশ্রেণির  চিন্তাধারালগুলি কাজে লাগাচ্ছে। এইভাবে তারা সংগ্রামের দিকনির্দেশের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখছে।

ফ্রান্সে, পেনশন সংস্কারের ঘোষণার সাথে সাথে শ্রমিকশ্রেণীর উপর নেমে আসা আক্রমণের সময়ে  ইউনিয়নগুলি তাদের ঐক্য ও সংহতি  জ্ঞাপন করেছিলো । তারা বৃহৎ পথ-বিক্ষোভের সময়  সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলার  আহ্বান জানিয়েছিল । তারা দাবি করেছিল এই সংস্কার যেন পাস না হয়।  লক্ষ লক্ষ মানুষকে অবশ্যই এটি প্রত্যাখ্যান করতে হবে।

বাগাড়ম্বর এবং প্রতিশ্রুতির জন্য এত কিছু।  কিন্তু বাস্তবতা কী? এটি ব্যাখ্যা করার জন্য, আমাদের কেবল সেই আন্দোলনের  কথা স্মরণ করতে হবে যা ম্যাক্রোঁর ২০১৯-২০২০ সালের পেনশন সংস্কার বিলের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়েছিল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শ্রমিকশ্রেণির লড়াইয়ের  উত্থান এবং সংহতি বৃদ্ধির সম্মুখীন হয়ে ইউনিয়নগুলি সর্বদা এই একই কৌশল ব্যবহার করে ।  সেদিনও "সংগ্রামের সম্মিলন" তারা সমর্থন করেছিল এবং একটি ভ্রান্ত-ঐকবদ্ধ আন্দোলন তৈরি করেছিল।  সেখানে বিক্ষোভকারীরা সেক্টর এবং সংস্থা দ্বারা আহূত  হয়েছিল কিন্তু তারা একে অপরের পিছনে ছিল, সবাই একসাথে মিলিত হতে পারে নি।  ট্রেড ইউনিয়নের ব্যানার এবং ইউনিয়ন স্টুয়ার্ডরা  আন্দোলনকারীদের সেক্টর, কোম্পানি এবং প্ল্যান্ট দ্বারা বিভক্ত করেছিল। সর্বোপরি, কোনও আলোচনা বা কোনও সভা সেখানে ছিল না। সর্বশেষ বার্তাটি সেখানে ছিলো: "আপনার স্বাভাবিক সহকর্মীদের মধ্যে  ছড়িয়ে দিন এবং  বাড়ি যান যতদিন না পর্যন্ত পরবর্তী সময় আসছে"। শ্রমিকরা যাতে একে অপরের কথা শুনতে  না পায় তা নিশ্চিত করার জন্য সাউন্ড  সিস্টেমটি পুরোপুরি বিস্ফোরিত করা হয়েছিল। বুর্জোয়াদের মধ্যে কাঁপুনি ধরে যায় তখনই যখন শ্রমিকশ্রেণি  নিজের আন্দোলনের রাশ নিজের হাতে নেয়, যখন নিজেদেরকে সংঘঠিত করে, যখন পস্পরের সাথে মিলিত হতে শুরু করে, বিতর্ক করে…একটা শ্রেণিসংগ্রাম হয়ে ওঠে। 

ইউকে এবং ফ্রান্সের মতই অন্যান্য জায়গায়  শক্তির ভারসাম্যকে প্রভাবিত করার ফলে  আমাদের জীবনযাত্রা এবং কাজের অবস্থার উপর নেমে আসা ক্রমাগত আক্রমণ প্রতিরোধ করতে শ্রমিকশ্রেণি সক্ষম হবে। এই আন্দোলন ভবিষ্যতে আরও সহিংস হয়ে উঠবে, তাই  অবশ্যই আমরা যেখানেই পারি না কেন একত্রিত হতে হবে  এবং সংগ্রামের সেই পদ্ধতিগুলি নিয়ে আলোচনা করতে হবে যা শ্রমিকশ্রেণীকে আরো  শক্তিশালী করে তুলবে।  বুর্জোয়া সিস্টেমে কাঁপন লাগিয়ে দেওয়ার মত ঐতিহাসিক মুহূর্ত তৈরি করবেঃ  

- নির্দিষ্ট কর্মক্ষেত্র, কোম্পানী, সংস্থা, সেক্টর,  প্রকৃতপক্ষে শহর, অঞ্চল এবং দেশের বাইরে শ্রমিকশ্রেণির প্রতি সমর্থন এবং সংহতি বিস্তৃত করার অনুসন্ধান 

- বিশেষত সাধারণ সমাবেশের মাধ্যমে সংগ্রামে শ্রমিকদের স্ব-সংগঠন গড়ে তোলা । পাশাপাশি  সংগ্রামের  তথাকথিত "বিশেষজ্ঞ", ইউনিয়ন এবং তাদের সংগঠনের কাছে নিয়ন্ত্রণ সমর্পণ না করা;  

- অতীতের সংগ্রাম এবং তার পরাজয় থেকে উঠে আসা শিক্ষার আলোকে বর্তমান সংগ্রামের দাবিকে বুঝতে যতদূর সম্ভব বিস্তৃত আলোচনা করতে হবে। কারণ আগামীর পরাজয় হতে পারে, কিন্তু এই আক্রমণের বিরুদ্ধে কোন প্রতিক্রিয়া না জানানো সব চাইতে বর পরাজয়। সংগ্রাম শুরু করাটাই শোষিতদের প্রথম বিজয়। 

১৯৮৫ সালে, থ্যাচারের সময়ে, ব্রিটিশ খনি-শ্রমিকরা অসীম সাহস এবং সংকল্পের সাথে পুরো এক বছর ধরে লড়াই করেছিল ।  কিন্তু রাষ্ট্রশক্তি এবং  ইউনিয়নগুলি তাদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল এবং তারা শক্তিহীন হয়ে একটি নির্দিষ্ট সেক্টরে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল।  এই পরাজয় শুধুমাত্র তাদের পরাজয় চিল না, এটা চিল সমগ্র শ্রমিক শ্রেণির পরাজয়।  আমাদের অবশ্যই ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। যে দুর্বলতাগুলো কয়েক দশক ধরে শ্রমিকশ্রেণীকে দুর্বল করে রেখেছে এবং যা ধারাবাহিকভাবে পরাজয়ের কারণ হয়ে থেকেছে, সেগুলো এখন অতিক্রম করা অত্যাবশ্যক, বিশেষ করে কর্পোরেটবাদের ফাঁদ এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলো শ্রমিক শ্রেণীর অঙ্গ হয়ে ওঠা । সংগ্রামের জন্য শ্রমিকশ্রেণির নিজস্ব সংগঠণ এবং এর বিস্তৃত ঐক্য ও সংহতি আগামীকালের সংগ্রামের প্রস্তুতির অপরিহার্য উপাদান!

এরজন্য আমাদের অবশ্যই নিজেদেরকে সেই শ্রেণীর সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে যা সংগ্রামে সংহতির মাধ্যমে  গড়ে ওঠা ঐক্যবদ্ধ একটি শ্রেণি, তা হলো  শ্রমিক শ্রেণি। আজকের সংগ্রাম শুধু আক্রমণের বিরুদ্ধে নিজেদের রক্ষা করার জন্য নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের  শ্রেণী-পরিচয় পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রেও অপরিহার্য। সব ধরণের বঞ্চনা এবং দুর্যোগের সমার্থক  এই দেউলিয়া ব্যবস্থাকে চূড়ান্তভাবে উৎখাত করার প্রস্তুতির জন্য অপরিহার্য।  

পুঁজিবাদ কোন সমাধান দিতে পারে না। পুঁজিবাদ যা দিতে পারে তা হলো,-হয় পৃথিবীর ধ্বংস, না হয় ক্রমাগত যুদ্ধ, না হয় বেকারত্ব, না হলে কাজের নাজেহাল অবস্থা, বা সীমাহীন দারিদ্র্য। বিশ্বের সকল নিপীড়িত ও শোষিতদের সমর্থণ নিয়ে একমাত্র  আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামই কেবল কমিউনিজমের বিকল্পের পথ খুলে দিতে পারে।  

আজকের ইউকের ধর্মঘট এবং ফ্রান্সের বিক্ষোভ, বিশ্বজুড়ে সর্বহারাদের সংগ্রামের আহ্বান জানাচ্ছে ।

আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট কারেন্ট, 12 জানুয়ারী 2023

 

গণহত্যার নিরিখে কোন সাম্রাজ্যবাদী শিবিরকে সমর্থন নয়! শান্তিবাদী বিভ্রমকে সমর্থণ নয়! চাই সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদ!

সেই ১৯১৪ সাল থেকে ঘটে আসা বিশ্ব-পুঁজিবাদের  শতাব্দীব্যাপী স্থায়ী যুদ্ধের সর্বশেষ নিদর্শন মধ্যপ্রাচ্যে চলমান রক্তস্নাত সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ!

লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের গণহত্যা, এমনকি পুরো দেশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা্র ঘটনা আগামী দিনগুলিতে আরও ভয়াবহ নৃশংসতার প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছুই বয়ে আনছে না।  

বর্তমান পরিস্থিতিতে পৃথিবীর ছোট-বড় বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদীশক্তি যে যৌক্তিক সমাধানের কথা বলছে সেটা আসলে  বিভিন্ন দেশের  জাতীয় প্রতিপক্ষীয় বুর্জোয়াশ্রেণীর  ভ্রাতৃঘাতী হত্যায়  শ্রমিকশ্রেণিকে বিভক্ত করা ও পক্ষাবলম্বনের জন্য প্রস্তুত করার বিশাল প্রতারণার শামিল।  

আজ ইসরায়েল ও গাজায় বসবাসরত মানুষের ওপর অবিরত গোলাগুলির অগ্নিবর্ষণ হচ্ছে। একদিকে রয়েছে হামাস, অন্যদিকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। মাঝখানে শ্রমিকদের ওপর চলছে বোমাবর্ষণ,  কার্যকর করা হচ্ছে মৃত্যুদন্ড এবং অগণিত মানুষকে জিম্মি করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে মারা গেছে  হাজার হাজার মানুষ।

সারা বিশ্বে বুর্জোয়ারা আমাদের কোন একটি পক্ষ বেছে নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। ইসরায়েলি নিপীড়নের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের জন্য, অথবা ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি প্রতিক্রিয়ার পক্ষ নেওয়ার জন্য। প্রত্যেকেই যুদ্ধকে ন্যায়সঙ্গত করার জন্য একে অপরের বর্বরতার নিন্দা করে চলেছে। আমরা দেখেছি,  ইসরায়েলি রাষ্ট্র কয়েক দশক ধরে অবরোধ, হয়রানি, চেকপয়েন্ট এবং  অপমানের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি জনগণের উপর নিপীড়ন চালিয়ে আসছে, অন্যদিকে  ফিলিস্তিনি সংগঠনগুলো  ছুরি হামলা ও বোমা হামলা চালিয়ে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করছে। একে অপরের রক্ত ঝরানোর আহ্বান জানাচ্ছে।

এই প্রাণঘাতী কর্মকান্ডের যুক্তিই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের যুক্তি! শোষক এবং তাদের রাষ্ট্রই সবসময় নিজেদের স্বার্থরক্ষায় এই নির্দয় যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। আর আমরা, সেই শ্রমিক শ্রেণী, ও শোষিত,মানুষ যারা সবসময় আমাদের জীবন দিয়ে মূল্য পরিশোধ করে থাকি।  

আমাদের জন্য, সর্বহারাদের জন্য, বেছে নেওয়ার মতো কোনও পক্ষ নেই, আমাদের কোনও স্বদেশ নেই, রক্ষা করার মতো কোনও জাতি নেই! সীমান্তের দু'পাশে, আমরা একই শ্রেণীর! না ইসরায়েল, না ফিলিস্তিন!

কেবলমাত্র ঐক্যবদ্ধ আন্তর্জাতিক সর্বহারা শ্রেণীই এই ক্রমবর্ধমান গণহত্যা এবং তাদের পিছনে থাকা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের অবসান ঘটাতে পারে। আমরা দেখেছি, ১৯১৭ সালে জিমারওয়াল্ডে মুষ্টিমেয় কমিউনিস্ট বামপন্থীরা যে অনন্য সমাধানের পথের বার্তা দিয়েছিল সেইপথেই  রাশিয়ার বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণি  অক্টোবর মাসে  পুঁজিবাদী শাসনকে উৎখাত করেছিল এবং তার নিজস্ব রাজনৈতিক শ্রেণি শক্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই দৃষ্টান্তই একটি বিস্তৃত আন্তর্জাতিক বিপ্লবী আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছিল যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটাতে বাধ্য করেছিল। 

সেই বিপ্লবীস্রোতের পরাজয় থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে বর্তমানে যে একমাত্র রাজনৈতিক ধারা  আন্তর্জাতিকতাবাদী নীতিকে কঠোরভাবে বজায় রেখেছে তারা হলো কমিউনিস্ট লেফট ধারা। আমরা দেখেছি,  ত্রিশের দশকে,  স্প্যানিশ যুদ্ধ এবং চীন-জাপান যুদ্ধের সময়   শ্রমিকশ্রেণির মৌলিক লাইনটি  রক্ষা  করেছিল কমিউনিস্ট লেফট ধারা। সেইসময় স্ট্যালিনবাদী, ট্রটস্কিবাদী বা নৈরাজ্যবাদীদের মতো   অন্যান্য রাজনৈতিক স্রোতগুলি তাদের সাম্রাজ্যবাদী শিবিরকে বেছে নিয়েছিল যা এই দ্বন্দ্বগুলিকে উস্কে  দিয়েছিল। কমিউনিস্ট বামপন্থীরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার আন্তর্জাতিকতাবাদ বজায় রেখেছিল এবং এই অন্যান্য স্রোতগুলি সাম্রাজ্যবাদী হত্যাযজ্ঞে অংশ নিয়েছিল যা 'ফ্যাসিবাদ এবং ফ্যাসিবাদ বিরোধী' এবং এটাকে  'সোভিয়েত' ইউনিয়নকে রক্ষার করার মধ্যে লড়াই হিসাবে সাজানো হয়েছিল।

আজও কমিউনিস্ট বামপন্থীদের ক্ষুদ্-সংগঠিত শক্তিগুলো সেই আন্তর্জাতিকতাবাদের নীতিকে মেনে চলে, কিন্তু তাদের শক্তি কিছুটা  দুর্বল হয়ে পড়েছে কারন তারা নিজেরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে এবং পারস্পরিক বৈরীতা সৃষ্টি করে নিজেদের দুর্বল করেছে।

একারণেই সাম্রাজ্যবাদী বর্বরতার ক্রমবর্ধমান পতনের মুখে এই আপাত বিচ্ছিন্ন শক্তিকে অবশ্যই সকল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে, শোষকদের পিছনে জাতীয় প্রতিরক্ষার আহ্বানের বিরুদ্ধে, 'শান্তির' জন্য ভণ্ডামিমূলক আবেদনের বিরুদ্ধে এবং কমিউনিস্ট বিপ্লবের দিকে পরিচালিত সর্বহারা শ্রেণি সংগ্রামের জন্য একত্রে আহ্বান রাখতে হবে।  

দুনিয়ার মজদুর এক হোন!

 

ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিস্ট কারেন্ট

(International Communist Current)

 

ইন্টারন্যাশনালিস্ট ভয়েস

(Internationalist Voice) 

 

17.10.2023