শিক্ষা, সরকারী অফিস ও স্থানীয় প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানের প্রায় দশলক্ষ শ্রমিক ৩০শে জুন(২০১১) ধর্মঘটের প্রস্তুতি নিচ্ছে কেন?
সেই একই কারণে যে কারণে ২৬শে মার্চ পাঁচলক্ষ শ্রমিক শ্রমিক লন্ডনের রাজপথে মিছিল করেছিল; সেই একই কারণে যে কারণে গত শরতে ইউনিভার্সিটি এবং স্কুলের দশহাজার ছাত্রছাত্রী মিছিল, জমায়েত ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে আন্দোলনে সামিল হয়ে ছিল। জীবন যাত্রার ওপর সরকারের অন্তহীন আক্রমণে শ্রমিকেরা জেরবার। স্বাস্থ্য-সুরক্ষা ব্যবস্থায় ব্যয় সংকোচ, টিউশন ফিজ বৃদ্ধি, বেকারি বেড়ে যাওয়া, বেতনবৃদ্ধি বন্ধ করা ইত্যাদি নানাভাবে এই আক্রমণ নেমে আসছে। ৩০শে জুনের যেটা একটা মেজর ইস্যু সেই টিচারদের পেনসনের ওপর অ্যাটাকের কথাই ধরা যাক যাতে ক’রে পেনশন পাওয়ার জন্যে জমা রাখতে হবে আগের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণ টাকা, রিটায়ার করতে হবে দেরিতে এবং পেনসন পাবে দেয় টাকার তুলনায় অনেক কম; এই হচ্ছে বাস্তব পরিস্থিতি।
প্রতিটি আক্রমণের পিছনে সরকারের এবং সামান্য তফাৎ রেখে ‘বিরোধী’ লেবার পার্টির যুক্তি: “অর্থনীতিকে পুনরায় সচল করতেই এইসব পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে সুতরাং আসলে প্রতিটি মানুষের স্বার্থ সুরক্ষিত করাই এসবের উদ্দেশ্য।” কিন্তু শ্রমিক, ছাত্র বেকার পেনসনভোগী কেউই এই যুক্তি আর তেমনভাবে সমর্থন করতে পারছে না। দীর্ঘকাল ধরে এই যুক্তি মেনে বহু আত্মত্যাগ মানুষ করেছে। তা সত্ত্বেও অর্থনীতি আর তার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবনযাত্রার মানের ক্রমাবনতি ঘটেই চলেছে।
প্রতিদিন আরো বেশি বেশি সংখ্যায় খেটে খাওয়া মানুষ বুঝতে পারছে যে আমরা সর্বত্র একই আক্রমণের শিকার; আর বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে লড়াই ক’রে শেষপর্যন্ত হারতেই হচ্ছে। ফলে আরো বেশি বেশি ক’রে এই ব্যাপারটা উপলব্ধি করা যাচ্ছে যে ওরকম বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন আন্দোলনের পরিবর্তে সর্বাত্মক, সর্বব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। বুঝতে পারছে আমাদের লড়াই যতদূর এবং যত বেশি বেশি ক্ষেত্র জুড়ে সম্ভব ততদূর তাকে বিস্তৃত করতে হবে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে “একদিনের কর্মসূচী” কে নিয়ে: সরকার-স্বীকৃত ট্রেডইউনিয়নগুলোর এই একদিনের স্ট্রাইক ডাকার পিছনে আসল উদ্দেশ্য কী? সরকারের এইসব আক্রমণের বিরুদ্ধে এরা সত্যি সত্যিই কি কোন কার্যকর সংগঠিত প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চায়? যদি সত্যিই তাই হত তাহলে ২৬শে মার্চ হাজার হাজার মানুষকে লন্ডনে জড়ো করা হল কেন? --- মিছিলে ঘুরিয়ে আর এড মিলিবান্ডের মত লোকেদের দ্বিচারিতায় ভর্তি ভাষণ শুনিয়ে ঘর পাঠানোর জন্যে? কেন ইউনিয়নওয়ালারা আমাদের এই ধাপ্পাটা গেলাতে চাইছে যে ব্যয় সংকোচের বিষয়টা নেহাতই বর্তমান সরকারের ব্যাপার অর্থাৎ কিনা লেবার পার্টি ক্ষমতায় থাকলে এমনটা হত না?
প্রশ্ন থাকছে কেন বিরাট পাবলিক সেক্টরের মাত্র একটা ছোট্ট অংশকেই শুধু ডাকা হল? বাকি সবকে নয় কেন? কেন প্রাইভেট সেক্টরের সমস্ত শ্রমিকদের ডাকা হল না? তারা কি আক্রান্ত নয়? কেনই বা একদিনের কর্মসূচী? সেই ২৬শে মার্চের মত আবারো কি তারা আমাদেরকে দিয়ে লড়াই-লড়াই খেলা করাতে চাইছে যেন বা আমরা সত্যিই সমস্ত আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়ছি? আসলে এভাবেই কি তারা আমাদের বৃথা শক্তিব্যয় করাতে আর আমাদের নিজেদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করতে চাইছে?
শাসকশ্রেণির আমাদেরকে ভয় পাওয়ার কারণ আছে বৈকি
যে পরিমাণ ক্ষোভ বিক্ষোভ সহজে সামাল দেবার ক্ষমতা শাসক-শ্রেণির আছে, সরকার গৃহীত শ্রমিকবিরোধী পদক্ষেপগুলো যে তার চাইতেও অনেক বেশি মাত্রায় অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে এই আশঙ্কা করার যথেষ্ট যুক্তি আছে। গত শরতে বৃটেনে ঘটে যাওয়া ঘটনা বা ২৬শে মার্চের জমায়েতে হাজিরার সংখ্যাই শুধু নয়, শাসক-শ্রেণির সামনে আছে উত্তর আফ্রিকা থেকে সুদূর মধ্য-প্রাচ্য পর্যন্ত বিস্তৃত ক্রমবর্ধমান বিদ্রোহের জোয়ারের টাটকা উদাহরণ যা এখন ইউরোপে এসে আছড়ে পড়ছে যার ফলে স্পেন এবং গ্রীস এখন বিশাল গনআন্দোলনে উত্তাল। ইউরোপের এই দেশগুলোতে লক্ষ লক্ষ সাধারণ জনতা যাদের অধিকাংশই যুবা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সিটি স্কোয়্যারগুলো দখল ক’রে সংগঠিত করছে বিশাল বিশাল সাধারণ-সভা(general assembly)। সভায় মত প্রকাশে কোন বাধা নেই তা সে এই সরকার বা ওই সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েই হোক বা যে ব্যবস্থার অধীনে আমরা বেঁচে আছি সাধারণ ভাবে সেই সমগ্র সামাজিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়েই হোক। এই আন্দোলন এখনও অব্দি কোন ‘বিপ্লব’ নয় কিন্তু এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে এটা এমন এক আবহ তৈরি করেছে যেখানে বিপ্লব সম্পর্কে গভীর এবং বিস্তৃত আলোচনা একটা জায়গা ক’রে নিয়েছে।
স্বভাবতই বৃটেন রাষ্ট্র চাইবেই জনগনের প্রতিরোধে ফেটে পড়াটাকে রাষ্ট্র-স্বীকৃত ঘেরাটোপের মধ্যেই বন্দী ক’রে রাখতে, আর এব্যাপারে ট্রেড ইউনিয়নগুলোর ভূমিকা সবচেয়ে কার্যকর। ট্রেড ইউনিয়নগুলোর কাজই হল ট্রেডইউনিয়ন-অধিকার সংক্রান্ত কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে আমাদের আন্দোলনকে আটকে দেওয়া। এই বিধি-নিষেধ অনুযায়ী গন-সভার সিদ্ধান্ত মেনে কোন ধর্মঘট ডাকা যাবে না। অন্য কোন সেক্টরের ধর্মঘটের সমর্থনে কোন’সংহতি-মূলক ধর্মঘট করা যাবে না। যদি এমনকি কোন সেক্টরের পিকেটিং কর্মসূচী চলে তবে অন্য সেক্টরের ওয়ার্কারদের তাতে যুক্ত হয়ে পড়া চলবে না, অন্যথায় তা বেআইনী ‘ গৌণ কর্মসূচী(Secondary action)’ হিসাবে গণ্য হবে। নিয়মিত সদস্যপদ নবীকরণ করা থাকলে তবেই কোন শ্রমিক কোন ধর্মঘটে সামিল হতে পারবে। এইরকম আরো সব নিয়মবিধি।
আমাদের সংগ্রামের কর্ণধার হতে হবে আমাদেরকেই।
তাহলে ৩০শে জুনের কর্মসূচী কি নেহাতই টাইম নষ্ট?
না, তা হবে না যদি আমরা সেদিনটাকে সবাইমিলে একত্র হবার একটা সুযোগ বলে ভাবতে পারি, যদি সময়টাকে কাজে লাগাই, মানে যদি আমরা সম্মিলিতভাবে আলোচনা করি, সিদ্ধান্ত করি কী উপায়ে আমরা আমাদের প্রতিবাদ প্রতিরোধ আন্দোলনকে সঠিকরূপে এবং সঠিকপথে পরিচালনা করতে পারি, কিভাবে তা আরও ছড়িয়ে দিতে পারি। সেদিনটা বৃথা যাবে না যদি আমরা ভয় কাটিয়ে উঠে আমাদের সংগ্রামের রাশ আমাদের হাতেই তুলে নিতে পারি।
তিউনিসিয়া, ঈজিপ্ট স্পেন অথবা গ্রীসের উদাহরণ আমাদের সামনে আছে: যখন প্রচুর মানুষ কোথাও একত্রিত হচ্ছে, যখন তারা পাবলিক স্পেস দখল ক’রে দাবী তুলছে স্বাধীন মত প্রকাশ করার স্বাধীনতার, দাবী তুলছে সকলে মিলে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার তখনই তারা পুলিশি নির্যাতন কিংবা কতৃপক্ষের শাস্তির ভয় কাটিয়ে উঠতে পারছে।
তারা আমাদের সামনে একটা মডেল হাজির করেছে- মডেলটা অবশ্য নতুন নয়, গত শতাব্দীর সমস্ত বড় বড় শ্রমিক-সংগ্রামে এই মডেল ছিল: উন্মুক্ত সাধারণ-সমাবেশ (যাকে ইংরাজিতে বলা হয় ‘জেনারেল এ্যাসেমব্লি’)। সাধারণ-সমাবেশ বিভিন্ন কাজের পরিচালনার জন্য হাত তুলে সমর্থনের ভিত্তিতে নির্বাচিত করে বিভিন্ন প্রতিনিধি এবং কমিসন। সাধারণ-সমাবেশের হাতে থাকে এই সমস্ত প্রতিনিধি এবং কমিসনের নিয়ন্ত্রণ। নির্বাচিত যেকোন প্রতিনিধি কিংবা কমিসন যেকোন সময় প্রত্যাহারযোগ্য এবং সে সিদ্ধান্ত নেবে বিপুল মানুষের সম্মিলনে তৈরি এই সাধারণ- সমাবেশই।
৩০শে জুনের আগে আমরা নিজ নিজ কর্মস্থলে সাধারণ সভা করতে পারি, কে কোন্ কাজ করে বা কে কোন্ ইউনিয়নের লোক এসব না দেখে সব কর্মচারীরা মিলে সিদ্ধান্ত নিতে পারি কীভাবে আন্দোলন কর্মসূচীকে যতদূর সম্ভব ব্যাপক আকার দেওয়া যায়। স্কুল কলেজগুলোতে শিক্ষক,শিক্ষাকর্মীর মধ্যেকার পেশা এবং পদভিত্তিক বিভেদ এবং তাদের সকলের সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিভেদ কাটিয়ে সকলকে আন্দোলনে সামিল করার লক্ষ্যে কাজ করা একান্ত দরকারী। স্থানীয় পৌরসংস্থা এবং সরকারী দপ্তরগুলোর বেলাতেও একই কথা: একত্রিত হয়ে সভা করা, আলাপ আলোচনা করা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে পেশা এবং পদভিত্তিক বিভেদের ব্যাপারটা অতিক্রম করা সহজ হতে পারে এবং এভাবে সকলেই যাতে আন্দোলনে সামিল হয় তা নিশ্চিত হতে পারে। অফিসিয়ালি যতলোকের থাকার কথা দেখা দরকার সংখ্যাটা যেন তাকে ছাড়িয়ে যায়।
ধর্মঘটের দিন আমাদের নিশ্চিত হতে হবে যে পিকেটিংটা যেন নেহাত প্রতীকী না হয়ে আন্দোলনটাকে যতটা সম্ভব বিস্তৃত এবং গভীর করার কাজে ব্যবহার করা যায়; এজন্য প্রত্যেক শ্রমিক-কর্মচারীকে আমাদের আন্দোলনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে হবে, আন্দোলনে সামিল করার চেষ্টা করতে হবে; আন্দোলনরত অন্যান্য সেক্টরে প্রতিনিধি পাঠিয়ে তাদের আন্দোলনকে সমর্থন জানাতে হবে। চেষ্টা করতে হবে কীভাবে ভবিষ্যতে এই সংগ্রামকে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় এই নিয়ে আলাপ আলোচনার দিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার।
সমাবেশ যেন কোনভাবেই নিষ্ক্রিয় প্রথামাফিক পদযাত্রার কর্মসূচীতে পরিণত না হয়। সমাবেশের ফলে রাস্তায় রাস্তায় যে জমায়েতগুলো হয় সেটা যেন রাজনৈতিক নেতা আর ইউনিয়ন কর্তাদের পূর্ব-পরিকল্পিত ভাষণ দেওয়ার মঞ্চ না হয়ে ওঠে, বরং সেখানে যেন যত বেশি বেশি সম্ভব সাধারণ মানুষেরা তাদের অভিজ্ঞতা বিনীময় করতে পারে, তারা কী ভাবে ভাবছে তা যেন খোলাখুলি রাখতে পারে এটা দেখা ভীষণ জরুরী।
নানাদিকথেকে, বিশেষতঃ বামপন্থীদের মুখ থেকে এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে সরকার এইসব শ্রমিক-স্বার্থ বিরোধী পদক্ষেপগুলো না নিলেও পারত, এগুলো নেহাতই সরকারের ভ্রান্ত আর্থিক-নীতির ফল। কিন্তু প্রকৃত বাস্তব হল সংকটাপন্ন পুঁজিবাদের পক্ষে আমাদের জীবনযাত্রার মানের অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করা একান্ত প্রয়োজনীয় এবং অপরিহার্য। আমাদের অর্থাৎ শোষিত মানুষের কাছে দরকারী বিষয় হল শোষকরা তাদের ব্যবস্থাটাকে কীভাবে আরেকটু বেটার উপায়ে চালাবে সে ব্যাপারে তাদেরকে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা না করা। শাসক-শ্রেণির কিসে ভালো হবে সে সব পরামর্শ দেওয়া শোষিত শ্রেণির কর্মসূচী হতে পারে না। আমাদের কাজ বর্তমান এবং ভবিষ্যতের যাবতীয় পুঁজিবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা আর তা করতে গিয়ে ক্রমাগত আরো বেশি ক’রে আমরা অর্জন করব নিজেদের ক্ষমতার ওপর আস্থা এবং প্রত্যয়,গড়ে তুলতে সক্ষম হবো স্ব-সংগঠন আর বাড়িয়ে তুলতে পারব রাজনৈতিক সচেতনতা। আর এভাবেই বিপ্লব এবং সমগ্র বিশ্বসমাজের আমূল রূপান্তরের অপরিহার্যতার প্রশ্নটা মূর্তরূপ লাভ করবে।
WR/ 04. 06. 2011