কিভাবে আমরা একটি বিশাল ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে একসাথে লড়াই করতে পারি?

গত জুনমাস থেকে অদ্যাবধি বৃটেনের প্রতিটি আন্দোলনে একই আর্তি প্রতিধ্বনিত হয়েছে –

‘অনেক হয়েছে, অনেক !’

আমরা দেখলাম,’ক্রোধের গ্রীষ্ম ' নামে পরিচিত এই বৃহদাকার আন্দোলন ক্রমেই 'ক্রোধের শরত' ও পরবর্তীতে 'ক্রোধের শীতে ' রূপান্তরিত হয়েছে।

ইউকে তে একের পর এক আন্দোলনের ঢেউ বিশ্ব জোড়া শ্রমিক শ্রেণির  সংগ্রামী শক্তির ক্রমাগত বৃদ্ধিকেই চিহ্নিত করেছেঃ

- স্পেনে, মাদ্রিদ সংলগ্ন অঞ্চলে ডাক্তার ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা ধর্মঘট শুরু করে নভেম্বরের শেষের দিকে, একই সঙ্গে ডিসেম্বরে বিমান পরিষেবা ও রেল কর্মীদের ধর্মঘট পরিলক্ষিত হয়। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন অঞ্চলের স্বাস্থ্য বিভাগগুলিতে জানুয়ারি থেকে ধর্মঘট শুরু করার পরিকল্পনা সম্পন্ন হয়েছে। 

- জার্মানিতে ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি এবং তার ফলস্বরূপ ঘটতে চলা এক অভূতপূর্ব শক্তির সঙ্কট শ্রমিকশ্রেণির ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছে। এসব কারণে এ দেশের বড় বড় ধাতু ও বিদ্যুত কারখানা গুলি নভেম্বরেই স্লো-ডাউনের মুখে পড়ে।  

- ইতালিতে অক্টোবরের মাঝামাঝি ইজি জেট এর বিমানচালক দের তালিকায় বিমান যানজট নিয়ন্ত্রক দের দ্বারা পরিচালিত আরও একটি ধর্মঘট এর সাথে যুক্ত হয়। সরকার বাধ্য হয় সরকারি ছুটির দিনগুলিতে ধর্মঘট নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করতে । 

- বেলজিয়ামে নয় এবং ষোল ডিসেম্বর দেশ জোড়া ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয় । 

- গ্রীসের এথেন্সে বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত হাজার হাজার কর্মী জড়ো হয়ে গর্জে ওঠে  'জীবনযাত্রার অসহনীয় খরচের' বিরুদ্ধে। 

- ফ্রান্স গত কয়েক মাসে সরকারি হসপিটাল ও যানবাহন কর্মীদের একের পর এক ডাকা ধর্মঘটের সাক্ষী থেকেছে ।

- পর্তুগালে শ্রমিকরা বর্তমান সর্বনিম্ন বেতন ৭০৫ এর পরিবর্তে ৮০০ ইউরোর দাবি জানিয়েছে । ১৮ নভেম্বর বেসামরিক কর্মীরা ধর্মঘটে নেমেছে। ডিসেম্বরে যানবাহন পরিষেবায় অনেক গুলি ধর্মঘট দেখা যায়। 

- আমেরিকায় ঘটতে চলা মালবাহী রেলকর্মীদের একটি ধর্মঘটকে বন্ধ করতে হাউস অফ রিপ্রেজে নটেটিভরা তৎপর হয়ে ওঠে। জানুয়ারিতে নিউ ইয়র্ক শহরে হাজার হাজার নার্স প্রহৃত হয়। 

এই তালিকা আসলে আরও অনেক লম্বা, কারণ বাস্তবে প্রায় সমস্ত জায়গাই সাক্ষী থেকেছে ছোট বড়, একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন, অসংখ্য ব্যবসা ক্ষেত্র, সরকারি সংস্থায় ঘটতে থাকা অসংখ্য ধর্মঘটের।সমস্ত জায়গায়, সমস্ত দেশে, সমস্ত কর্মক্ষেত্রের ক্রমশ অধোগামী জীবন ও জীবিকা, প্রতিনিয়ত মূল্যবৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য, জীবনের অনিশচয়তা, শ্রমিকের অভাব এবং তার ফলস্বরুপ জমতে থাকা কাজের পাহাড় এবং বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের জন্যে ক্রমাগত কমতে থাকা বাসস্থানের মান, -  এসবকিছুকেই এই পরিস্থিতির জন্যে দায়ী করা যেতে পারে। 

কোভিড ১৯ এর সময় থেকেই প্রায় সমস্ত শ্রমিকের কাছে হসপিটালগুলি হয়ে উঠেছে এক নিষ্ঠুর বাস্তবতার প্রতীক; কর্মী সংখ্যার অপ্রতুলতা এবং তার ফলে ক্লান্তির সীমানা ছাড়ানো ভয়ঙ্কর শোষণ এবং দিনের শেষে অপর্যাপ্ত বেতন যা কোনো ভাবেই জীবন ধারণের জন্যে যথেষ্ট নয়। 

যে দেশে থ্যাচার এর সময়কাল থেকে  মনে করা হত শ্রমিক শ্রেণি নিজের ভবিষ্যতচিন্তা কে ভাগ্যের হাতেই সমর্পণ করেছে, সেই  ইউ কে তে জুন থেকে  চলতে থাকা এই প্রলম্বিত ধর্মঘটের ঢেউ শুধু ইউ কে তেই নয়, বরং গোটা বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণির চেতনার এক বড়সড় পরিবর্তন কে সূচিত করে। ক্রমশ আরও জটিল হতে থাকা অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই লড়াইগুলি প্রমাণ করে যে শ্রমিক শ্রেণি আর কোনও ভাবেই পিছু হটতে প্রস্তুত নয়। 

  ১১ শতাংশেরও বেশি মুদ্রাস্ফীতি আর তারই সঙ্গে সুনক সরকারের কঠোর বাজেট প্রায় প্রতিটি সেক্টরের শ্রমিকদেরকে পথে নামতে বাধ্য করেছে। যানবাহন(ট্রেন,বাস,টিউব,এয়ারপোর্ট),স্বাস্থ্য, রয়্যাল মেল পোস্টাল সার্ভিস এর কর্মীরা, ডেফ্রার বেসামরিককর্মীগণ, আমাজনে কর্মরত শ্রমিক, স্কটল্যান্ডের স্কুল কর্মীরা, উত্তর সাগরে কর্মরত তেল কর্মী সকলেই নেমে এসেছে পথে। স্বাস্থ্য কর্মীদের মধ্যে  এই পরিমাণ সংহতি এদেশে গত কয়েক শতাব্দীতে দেখা যায় নি। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে শিক্ষকদেরও ধর্মঘটে বসার কথা শোনা যাচ্ছে। 

ফ্রান্সের সরকার অবসর গ্রহণের বয়সকে বাড়িয়ে দিতে আইনী ‘সংস্কার’ আনতে তৎপর হয়ে উঠেছে। উদ্দেশ্য খুব সহজ,  মৃত্যু পর্যন্ত শ্রমিককে  লেবুর মত নিংড়ে শুষে নিয়ে নিজেদের খরচ বাঁচানো। আরও স্পষ্ট  করে বললে, এর অর্থ, বিধ্বস্ত হয়ে বৃদ্ধ বয়েস অব্ধি কাজ করে যাওয়া, অথবা আরও কম এবং অপ্রতুল পেনসনের ভরসায় কর্মক্ষেত্র ত্যাগ করা। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে ভুগতে ভুগতেই একজন শ্রমিকের জীবন অতিবাহিত হয়ে যাবে। 

আমাদের জীবন-জীবিকার উপর আক্রমণ থামবে না। বিশ্ব অর্থনীতি দিনে দিনে আরও খারাপের দিকে এগোবে। বিশ্ববাজার দখলের লড়ায়ে টিঁকে থাকতে প্রতিটি দেশের প্রতিটি শাসক গোষ্ঠীই কখনো বা 'ইউক্রেনের প্রতি সহানুভুতি' কখনো বা 'জাতীয় অর্থনীতির ভবিষ্যৎ' এর দোহাই দিয়ে শ্রমিকশ্রেণির জীবন এবং জীবিকা কে আরও বেশি অসহনীয় করে তুলবে। 

 

যুদ্ধ অর্থনীতির ক্রমবিকাশের সাথে সাথে এই সত্য গুলি আরও বেশি করে প্রকট হয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত যুদ্ধ-অর্থনীতির খাতে  শ্রম এবং অন্যান্য সম্পদের আনুপাতিক ব্যয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু ইউক্রেনেই নয়, যুদ্ধ-অর্থনীতির এই বিকাশের ফলে ইথিওপিয়া, ইয়েমেন, সিরিয়া, মালী, নিগার, কঙ্গো এসব জায়গাতেও বিস্ফোরণ,বুলেট এবং মৃত্যু সহজাত হয়ে উঠেছে।   এরই ফলে অন্যান্য সব জায়গাতেই আতঙ্ক, মুদ্রাস্ফীতি এবং শ্রমিকের ঘাড়ে আরও কাজের চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে।এখন প্রতিটি সরকারের সর্বজনীন স্লোগান হয়ে উঠেছে 'দেশের জন্যে ত্যাগ স্বীকার' । 

মানব সভ্যতাকে আরও বেশি দুর্দশা, যুদ্ধ,  প্রতিযোগিতা, ভাগাভাগির দিকে এগিয়ে নিয়ে চলা এই পুঁজিবাদী ব্যাবস্থার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিশ্ব শ্রমিক শ্রেণির(প্রতিটি সেক্টর, প্রতিটি দেশের বেতন ভোগী, বেকার অথবা কর্মরত, প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত অথবা অপ্রশিক্ষন প্রাপ্ত, অবসর প্রাপ্ত বা কর্মরত…)  এই মুহূর্তের কর্তব্য হল অন্য আরেক  পরিপ্রেক্ষিত কে সামনে তুলে ধরা। 'দেশের হয়ে ত্যাগ স্বীকার' কে প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে এবং ঐকবদ্ধ বৃহত্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই অন্য এক পৃথিবীর রূপায়ণের সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করা সম্ভব।  

বিভক্ত অবস্থায় আমরা দুর্বল

বিভক্ত অবস্থায় আমরা পরাজিত

মাসাধিক কাল ধরে সমস্ত দেশের প্রায় সমস্ত সেকটরের কর্মীরা ধর্মঘট করে চলেছে। কিন্তু এই ধর্মঘটগুলি একে অপরের থেকে বিছিন্ন। এই ধর্মঘট গুলির সাথে যুক্ত প্রতিটি মানুষ যেন নিজেদের ধর্মঘট, নিজেদের কর্মক্ষেত্র, নিজেদের কারখানা, সরকারি অফিস এসবের বাইরে বেরোতে পারছে  না। এমনকি যখন একই রাস্তার দু পাশে, একদিকে হাসপাতাল কর্মীরা, অন্য দিকে স্কুল শিক্ষক ও সুপারমার্কেটে কর্মরত শ্রমিকরা নিজেদের দাবি আদায়ে সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছে, কিন্তু নিজেদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয় নি। কখনো কখনো এই বিছিন্নতা আরও বেশি হাস্যকর দেখায়  যখন একই বিভাগে কর্মরত শ্রমিকেরা নিজেদের টিম, নিজেদের ইউনিট এইসবের নামে বিভক্ত হয়ে আলাদা আলাদা করে ধর্মঘট চালিয়ে যায়।  উদাহরণ স্বরূপ দেখা গেছে, একই অফিসে অফিস-কর্মী আর প্রযুক্তি-কর্মীরা আলাদা আলাদা সময়ে আলাদা আলাদা ভাবে একত্রিত হচ্ছে, অথবা একই অফিসের এক তলা এবং দুতলায় আলাদা আলাদা ভাবে কর্মীরা ধর্মঘট ডাকছে।কিছুক্ষেত্রে সত্যিই এটা ঘটে!

নিজেদেরকে একটি ছোট্ট গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ রেখে আন্দোলন করার বিষয়টি শাসকশ্রেণির অনুকূলে যায় এবং আমাদেরকে আরও বেশি দুর্বল করে, আমাদের গুরুত্ব আরও বেশি কমিয়ে দেয়, বিধ্বস্ত করে এবং অবশেষে পরাজয়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।  

এই কারণেই বুর্জোয়ারা এই বিছিন্নতাকে কায়েম  রাখতে আরও বেশি মাথা ঘামায়। প্রতিটি দেশে এই একই পরিচিত কৌশলঃ সরকারের দ্বারা  আমাদের বিভাজন। তারা একটা ক্ষেত্রকে  সাহায্যের নামে অন্য ক্ষেত্রের ওপর আক্রমণ নামিয়ে আনে। কোন এক জায়গায় কোন ঘনীভূত  আন্দোলন কে দমন করতে তারা অন্য কোনও একটি বিশেষ সেক্টর  বা বিশেষ কোম্পানি কে সাহায্য করার মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেয়।  তারা  কোনও একটি গ্রুপকে যৎকিঞ্চিত সাহায্যের মাধ্যমে অন্যান্য গ্রুপগুলির সমস্ত অধিকার  কেড়ে  নেয় এবং বিভাজন ত্বরান্বিত করে। এক কোম্পানি  কে অন্য কোম্পানির থেকে বিছিন্ন করার অথবা এক বিভাগকে অন্য বিভাগের থেকে বিছিন্ন করার এই পদ্ধতি সব জায়গায় সাধারণ ফন্দীতে পরিণত  হয়েছে। 

ফ্রান্সে নতুন  পেনসন আইন সংস্কারের ঘোষণা  প্রসঙ্গে, বধির মিডিয়া মেতে উঠেছে এক অর্থহীন তর্কে।এই নতুন আইন কোন কোন সেক্টরের বেশি ক্ষতি করবে তাই নিয়েই বিতর্ক চলছে বেশি,   যখন কিনা এটা খুব পরিষ্কার যে এই আইন সমগ্র শ্রমিক শ্রেণির জীবনেই বিপর্যয় ডেকে আনবে।

শিক্ষানবিশ, কায়িক শ্রমিক, মহিলা প্রভৃতিদের যোগ্যতার নিরিখে পেনশন সংস্কারের ধারণাও এক ধরণের ফাঁদ!  

শ্রমিকদের সংগ্রাম নিজেদের হাতে নিতে হবে

কেন এই বিভাজন? এটা কি শুধুমাত্র সরকারী প্রচার এবং  কৌশল যা শ্রমিক শ্রেণীর ধর্মঘট ও সংগ্রামকে একে অপরের থেকে আলাদা রেখে আমাদের এভাবে বিভক্ত করতে সফল হয়?

আমরা সবাই একই নৌকার মাঝি এমন অনুভূতি বাড়ছে। ব্যাপক সংহতির সাথে একটি বিশাল ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম শ্রেণীগুলির মধ্যে শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তন করতে পারে, এই ধারণাটি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তাহলে কেন এখনো আমরা প্রতিটি দেশে এবং প্রতিটি সেক্টরে বহু মাস ধরে শ্রমিকদের মধ্যে বিভাজন দেখতে পাচ্ছি?

যুক্তরাজ্যে ধর্মঘটরত শ্রমিকরা ঐতিহ্যগতভাবে তাদের কর্মস্থলের বাইরে পিকেটিং করেন। বেশ কয়েক মাস ধরে, সংগঠিত পিকেটগুলি খুব বেশি দূরে ছিল না, কখনও কখনও কেবল একদিনের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত হয়েছে, কখনও কখনও একই সময়ে হয়েছে,  তবু  পিকেটগুলি কয়েকশ মিটার দূরত্বে আলাদা হয়ে গেছে,  সেখানে একসাথে সংযোগ স্থাপনের কোনও প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় নি। সবাই ধর্মঘটে আছে, কিন্তু পিকেট লাইনে আটকা পড়ে গেছে। এই বিভাজনের বিরুদ্ধে লড়াই না করলে, সংগ্রামে সত্যিকারের একতা গড়ে না  তুললে,  এটি আমাদের লড়াইয়ের চেতনাকে ক্লান্ত করে দিতে পারে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে এই পরিস্থিতি যে অচলাবস্থা এবং বিপদ   তৈরি করেছে তাতে তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যে সব শ্রমিক গত ছয় মাস ধরে 'রোলিং ধর্মঘটে' এ রয়েছেন তারা এখন ক্লান্ত এবং শক্তিহীন বোধ করতে পারেন।  

যাইহোক, আমরা বেশ কয়েকটি পিকেট লাইন পরিদর্শন করেছি, শ্রমিকরা কেবল তাদের নিয়োগকর্তা, তাদের বিভাগ, তাদের সেক্টরের চেয়ে আরও বিস্তৃত সংগ্রামে যুক্ত হওয়ার অনুভূতি আমাদের কাছে প্রকাশ করেছে। একসাথে লড়াই করার প্রয়োজনীয়তার একটি  ক্রমবর্ধমান অনুভূতি রয়েছে।

কিন্তু কয়েক মাস ধরে, সমস্ত দেশে, সমস্ত সেক্টরে, ইউনিয়নগুলিই এই সমস্ত খণ্ডিত সংগ্রাম সংগঠিত করে আসছে। ইউনিয়নগুলি মূলত যে  কৌশল নেয় তা শ্রমিকশ্রেণিকে বিভক্ত এবং বিচ্ছিন্ন করে, এবং তারা এই পরামর্শ দেয় যে তাদের দাবিগুলি শাখা থেকে শাখা, সেক্টর থেকে সেক্টরের মধ্যেই আপসে মীমাংসা সম্ভব হবে। ইউনিয়নগুলি সুনির্দিষ্ট দাবি নির্ধারণ করতে পছন্দ করে এবং ইউনিয়নগুলি সর্বোপরি সতর্ক করে দেয় যে "আমরা যদি সাধারণ দাবি করি তবে আমরা আমাদের নিজস্ব সংগ্রামকে দুর্বল করব"।   

ইতিমধ্যেই ইউনিয়নগুলি সচেতন হয়ে উঠেছে যে শ্রমিকশ্রেণির ক্ষোভ বাড়ছে।  তারা  বেসরকারী ক্ষেত্র এবং সরকারী ক্ষেত্রের  অভ্যন্তরে এবং পরস্পরের মধ্যে   যে বিভাজন তৈরি করেছে তা  ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। তারা বুঝতে পারছে যে "একটি সাধারণ সংগ্রাম" এর ধারণাটি  শ্রেণীর অভ্যন্তরে পরিপক্ক হচ্ছে।    

উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে ইতিমধ্যেই ইউকের ইউনিয়নগুলি বিভিন্ন সেক্টরে যৌথ পদক্ষেপ সম্পর্কে কথা বলতে শুরু করেছে,  যা তারা এখন পর্যন্ত এড়ানোর জন্য খুব সতর্ক ছিল। তাদের বক্তৃতায়  "ঐক্য" এবং "সংহতি" শব্দগুলি শোনা যেতে শুরু করেছে। তারা  কখনোই শ্রমিকদের বিভক্ত করার রাস্তা থেকে সরবে না,  আর সেটা করার জন্যই তারা শ্রমিকশ্রেণির  চিন্তাধারালগুলি কাজে লাগাচ্ছে। এইভাবে তারা সংগ্রামের দিকনির্দেশের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখছে।

ফ্রান্সে, পেনশন সংস্কারের ঘোষণার সাথে সাথে শ্রমিকশ্রেণীর উপর নেমে আসা আক্রমণের সময়ে  ইউনিয়নগুলি তাদের ঐক্য ও সংহতি  জ্ঞাপন করেছিলো । তারা বৃহৎ পথ-বিক্ষোভের সময়  সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলার  আহ্বান জানিয়েছিল । তারা দাবি করেছিল এই সংস্কার যেন পাস না হয়।  লক্ষ লক্ষ মানুষকে অবশ্যই এটি প্রত্যাখ্যান করতে হবে।

বাগাড়ম্বর এবং প্রতিশ্রুতির জন্য এত কিছু।  কিন্তু বাস্তবতা কী? এটি ব্যাখ্যা করার জন্য, আমাদের কেবল সেই আন্দোলনের  কথা স্মরণ করতে হবে যা ম্যাক্রোঁর ২০১৯-২০২০ সালের পেনশন সংস্কার বিলের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়েছিল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শ্রমিকশ্রেণির লড়াইয়ের  উত্থান এবং সংহতি বৃদ্ধির সম্মুখীন হয়ে ইউনিয়নগুলি সর্বদা এই একই কৌশল ব্যবহার করে ।  সেদিনও "সংগ্রামের সম্মিলন" তারা সমর্থন করেছিল এবং একটি ভ্রান্ত-ঐকবদ্ধ আন্দোলন তৈরি করেছিল।  সেখানে বিক্ষোভকারীরা সেক্টর এবং সংস্থা দ্বারা আহূত  হয়েছিল কিন্তু তারা একে অপরের পিছনে ছিল, সবাই একসাথে মিলিত হতে পারে নি।  ট্রেড ইউনিয়নের ব্যানার এবং ইউনিয়ন স্টুয়ার্ডরা  আন্দোলনকারীদের সেক্টর, কোম্পানি এবং প্ল্যান্ট দ্বারা বিভক্ত করেছিল। সর্বোপরি, কোনও আলোচনা বা কোনও সভা সেখানে ছিল না। সর্বশেষ বার্তাটি সেখানে ছিলো: "আপনার স্বাভাবিক সহকর্মীদের মধ্যে  ছড়িয়ে দিন এবং  বাড়ি যান যতদিন না পর্যন্ত পরবর্তী সময় আসছে"। শ্রমিকরা যাতে একে অপরের কথা শুনতে  না পায় তা নিশ্চিত করার জন্য সাউন্ড  সিস্টেমটি পুরোপুরি বিস্ফোরিত করা হয়েছিল। বুর্জোয়াদের মধ্যে কাঁপুনি ধরে যায় তখনই যখন শ্রমিকশ্রেণি  নিজের আন্দোলনের রাশ নিজের হাতে নেয়, যখন নিজেদেরকে সংঘঠিত করে, যখন পস্পরের সাথে মিলিত হতে শুরু করে, বিতর্ক করে…একটা শ্রেণিসংগ্রাম হয়ে ওঠে। 

ইউকে এবং ফ্রান্সের মতই অন্যান্য জায়গায়  শক্তির ভারসাম্যকে প্রভাবিত করার ফলে  আমাদের জীবনযাত্রা এবং কাজের অবস্থার উপর নেমে আসা ক্রমাগত আক্রমণ প্রতিরোধ করতে শ্রমিকশ্রেণি সক্ষম হবে। এই আন্দোলন ভবিষ্যতে আরও সহিংস হয়ে উঠবে, তাই  অবশ্যই আমরা যেখানেই পারি না কেন একত্রিত হতে হবে  এবং সংগ্রামের সেই পদ্ধতিগুলি নিয়ে আলোচনা করতে হবে যা শ্রমিকশ্রেণীকে আরো  শক্তিশালী করে তুলবে।  বুর্জোয়া সিস্টেমে কাঁপন লাগিয়ে দেওয়ার মত ঐতিহাসিক মুহূর্ত তৈরি করবেঃ  

- নির্দিষ্ট কর্মক্ষেত্র, কোম্পানী, সংস্থা, সেক্টর,  প্রকৃতপক্ষে শহর, অঞ্চল এবং দেশের বাইরে শ্রমিকশ্রেণির প্রতি সমর্থন এবং সংহতি বিস্তৃত করার অনুসন্ধান 

- বিশেষত সাধারণ সমাবেশের মাধ্যমে সংগ্রামে শ্রমিকদের স্ব-সংগঠন গড়ে তোলা । পাশাপাশি  সংগ্রামের  তথাকথিত "বিশেষজ্ঞ", ইউনিয়ন এবং তাদের সংগঠনের কাছে নিয়ন্ত্রণ সমর্পণ না করা;  

- অতীতের সংগ্রাম এবং তার পরাজয় থেকে উঠে আসা শিক্ষার আলোকে বর্তমান সংগ্রামের দাবিকে বুঝতে যতদূর সম্ভব বিস্তৃত আলোচনা করতে হবে। কারণ আগামীর পরাজয় হতে পারে, কিন্তু এই আক্রমণের বিরুদ্ধে কোন প্রতিক্রিয়া না জানানো সব চাইতে বর পরাজয়। সংগ্রাম শুরু করাটাই শোষিতদের প্রথম বিজয়। 

১৯৮৫ সালে, থ্যাচারের সময়ে, ব্রিটিশ খনি-শ্রমিকরা অসীম সাহস এবং সংকল্পের সাথে পুরো এক বছর ধরে লড়াই করেছিল ।  কিন্তু রাষ্ট্রশক্তি এবং  ইউনিয়নগুলি তাদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল এবং তারা শক্তিহীন হয়ে একটি নির্দিষ্ট সেক্টরে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল।  এই পরাজয় শুধুমাত্র তাদের পরাজয় চিল না, এটা চিল সমগ্র শ্রমিক শ্রেণির পরাজয়।  আমাদের অবশ্যই ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। যে দুর্বলতাগুলো কয়েক দশক ধরে শ্রমিকশ্রেণীকে দুর্বল করে রেখেছে এবং যা ধারাবাহিকভাবে পরাজয়ের কারণ হয়ে থেকেছে, সেগুলো এখন অতিক্রম করা অত্যাবশ্যক, বিশেষ করে কর্পোরেটবাদের ফাঁদ এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলো শ্রমিক শ্রেণীর অঙ্গ হয়ে ওঠা । সংগ্রামের জন্য শ্রমিকশ্রেণির নিজস্ব সংগঠণ এবং এর বিস্তৃত ঐক্য ও সংহতি আগামীকালের সংগ্রামের প্রস্তুতির অপরিহার্য উপাদান!

এরজন্য আমাদের অবশ্যই নিজেদেরকে সেই শ্রেণীর সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে যা সংগ্রামে সংহতির মাধ্যমে  গড়ে ওঠা ঐক্যবদ্ধ একটি শ্রেণি, তা হলো  শ্রমিক শ্রেণি। আজকের সংগ্রাম শুধু আক্রমণের বিরুদ্ধে নিজেদের রক্ষা করার জন্য নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের  শ্রেণী-পরিচয় পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রেও অপরিহার্য। সব ধরণের বঞ্চনা এবং দুর্যোগের সমার্থক  এই দেউলিয়া ব্যবস্থাকে চূড়ান্তভাবে উৎখাত করার প্রস্তুতির জন্য অপরিহার্য।  

পুঁজিবাদ কোন সমাধান দিতে পারে না। পুঁজিবাদ যা দিতে পারে তা হলো,-হয় পৃথিবীর ধ্বংস, না হয় ক্রমাগত যুদ্ধ, না হয় বেকারত্ব, না হলে কাজের নাজেহাল অবস্থা, বা সীমাহীন দারিদ্র্য। বিশ্বের সকল নিপীড়িত ও শোষিতদের সমর্থণ নিয়ে একমাত্র  আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামই কেবল কমিউনিজমের বিকল্পের পথ খুলে দিতে পারে।  

আজকের ইউকের ধর্মঘট এবং ফ্রান্সের বিক্ষোভ, বিশ্বজুড়ে সর্বহারাদের সংগ্রামের আহ্বান জানাচ্ছে ।

আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট কারেন্ট, 12 জানুয়ারী 2023