গত ৭ ই জুলাই’০৫ তারিখে লন্ডনে সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমনের প্রথম শিকার কারা?
২০০১ এ নিউইয়ক এবং ২০০৪ এ মাদ্রিদের মতই লন্ডনেও বিস্ফোরণের সুপরিকল্পিত লক্ষ্য ছিল শ্রমিকেরা। তার কারণ সেসময় টিউবে আর বাসে তাদেরই কমর্স্থলে যাবার ভীড় উপচে পড়েছিল। এই গণহত্যা ঘটানোর দায় স্বীকার করেছে আল-কায়দা, এরা বলছে “ইরাকে ব্রিটিশ সেনারা যে হত্যালীলা চালিয়েছে তার ” বদলা নিতেই তারা এ কাজ করেছে।কিন্তু ভেবে দেখুন, ইরাকি জনগণের উপর যে সীমাহীন নিধন চলছে তার জন্য নিশ্চয় ব্রিটেনের শ্রমজীবী মানুষেরা দায়ী নয়।এর জন্য দায়ী ব্রিটেনের এবং আমেরিকার শাসকশ্রেণী এবং তথাকথিত প্রতিবাদী সন্ত্রাসবাদীরা যারা প্রতিদিন ইরাকি জনগণের উপর হত্যালীলা চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিরোধের নাম করেই।কিন্তু ইরাক যুদ্ধের হোতারা মানে ওই বুশ আর ব্লেয়াররা বহাল তবিয়তেই থেকে যাচ্ছে, বরং সন্ত্রাসবাদীদের নতুন নতুন হত্যালীলা ওদের নতুন কোনো যুদ্ধে নামার অজুহাত তৈরীতে সাহায্য করছে যেমন ১১ ই সেপ্টেম্বরের ঘটনা আফগানিস্তান এবং ইরাক আক্রমনের যুক্তি যুগিয়ে ছিল।
এই সব যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদীদের প্রয়োজনে, পৃথিবীর উপর তাদের নিজ নিজ আধিপত্য বজায় রাখার এবং এর মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদী শ্রেণীস্বাথ সুরক্ষিত করার জন্যই সংঘটিত হচ্ছে।আর এই যুদ্ধে বলী হচ্ছে অগণিত অত্যাচারিত,শোষিত, পুঁজির মজুরীদাসেরা। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ নিজেকে যৌক্তিক প্রমাণ করতে গিয়ে উসকে দিচ্ছে জাতীয়তাবাদ, জাতিবৈষম্যবাদের মত বিষাক্ত ধারণা এবং শ্র্রেণী নিবির্শেষে সমগ্র জনগণকে পরিণত করছে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে। আপামর সাধারণ মানুষ অপমানিত,ধিকৃত,নিহত হচ্ছে প্রতিদিন। যুদ্ধের এই যুক্তি শ্রমিককে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে শ্রমিককেরই বিরুদ্ধে,তার নিজ শ্রেণীর স্বাথে ঐক্যবদ্ধ লড়াই করাটাকে দুঃসাধ্য করে তুলছে এই যুদ্ধ। তার চেয়েও ভয়ংকর হলো যে যুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর কোন স্বার্থ নেই, শোষক শ্রেণীর স্বাথে সেই যুদ্ধেই শ্রমিক শ্রেণীকে জাতীয়রাষ্ট্র ও জাতীয় পতাকাতলে স্বেচ্ছায় সম্মিলিত হতে আহ্বান জানাচ্ছে আর এভাবেই তার আন্তজার্তিক বিপ্লবী সংহতি ও বিপ্লবী যুদ্ধের পথ থেকে তাকে বিচ্যুত করতে চাইছে ।
গ্রুপ-৮শীষ বৈঠকে ধনী আর ক্ষমতাশালীদের সভায় লন্ডনে বোমা বিস্ফোরণ প্রসঙ্গে ব্লেয়ারের বক্তব্য:“ সন্ত্রাসবাদী কাযকলাপের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বোঝে যে তাদের নিষ্পাপ নিরীহ জনগনকে হত্যা করার প্রতিজ্ঞার তুলনায় আমাদের জীবনধারা এবং মূল্যবোধ রক্ষার সংকল্প অনেক বেশী শক্তিশালী ” ।
সত্যি কথাটা হল ব্লেয়ার এবং বিন লাদেনের মূল্যবোধ সম্পূণ একই । তাদের জঘন্য লক্ষ্যপূরণের জন্য উভয়েই একইভাবে নিরীহ ,নিরপরাধ মানুষকে মারছে , চালাচ্ছে ধ্বংসলীলা । তফাত্ এই যে ব্লেয়ার বড় সাম্রাজ্যবাদী মস্তান আর লাদেন তুলনায় ছোট । সুতরাং আমাদের কতব্য এদের কোন পক্ষে না যাওয়া ,আমাদের উচিত এই দুই পক্ষের কোন একটাতে যারা আমাদের সামিল করতে চায় তাদের সকলকে ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করা । যারা লন্ডন বিস্ফোরণের শিকার তাদের পাশে থাকার ঘোষনা করেছে আজকের ‘বিশ্বনেতারা’ –এটা তাদের ভন্ডামি ও দ্বিচারিতা ছাড়া কিছু নয় ,এরা সেই সমাজব্যবস্থার নেতা যা গত শতাব্দীতে দু –দুটো বিশ্বযুদ্ধ এবং কোরিয়া থেকে উপসাগর ,ভিয়েতনাম থেকে প্যালেস্টাইন –সবত্র চলতে থাকা যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে মেরেছে । গেলডফ, বোনো এবং অন্যান্যদের ছড়ানো বিভ্রান্তির বিপরীতে এরা সেই সমাজের নেতা যে সমাজ তার নিজ প্রকৃতিগত কারণেই ‘দারিদ্রকে অতীতের বিষয়’ করে তুলতে পারেনা বরং লক্ষ লক্ষ মানুষকে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর অবস্থার দিকে নিয়ে যায়,প্রকৃতিকে তার মুনাফার স্বাথে দূষিত করে অহরহ । এরা চায় বিভিন্ন শ্রেনীর মধ্যে জাতীয় সংহতি,ভবিষ্যতের কোনো সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বাধানোর জন্য যা ওদের দরকার ---শ্রমিক শ্রেণীর কাছে এ সংহতি, আসলে বিশ্বশ্রমিকের শ্রেণিগত সংহতির সম্পূণ পরিপন্থি । এই সংহতি তাই একটা ভাঁওতা ছাড়া কিছু নয় ।
প্রকৃত ঐক্য হল দুনিয়াজোড়া শ্রমিকের সাধারন স্বাথের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক ঐক্য ,এই একতাই সমস্ত জাতিগত ,ধমর্গত বিভেদকে নস্যাত্ করতে পারে – পারে পুঁজিবাদের সামরিকতন্ত্র আর যুদ্ধসবর্স্বতার যৌক্তিকতাকে প্রতিহত করতে । শ্রমিক শ্রেণীর এই ঐক্য এবং সৌভ্রাতৃত্বের শক্তি কতটা তা ইতিহাস থেকেই পাওয়া যায় :
১৯১৪-১৮–র সেনা বিদ্রোহ এবং রাশিয়া ও জামার্নির বিপ্লব প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থামাতে পুঁজিবাদকে বাধ্য করেছিল ; ইতিহাস আরো দেখায যে এই শ্রমিক শ্রেণীই যখন তার এই শ্রেণিগত ঐক্য ছেড়ে জাতীয়তাবাদী ঘৃণা এবং শাসকশ্রেণির প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ে ২য় বিশ্বযুদ্ধে সামিল হল তার জন্য সাড়া পৃথিবী জুড়ে কি ভয়ংকর মূল্যই তাকে দিতে হয়েছিল !
আজ পুঁজিবাদ আবার সারা পৃথিবীতে যুদ্ধজাল বিস্তার করছে, তাকে ঠেলে দিচ্ছে সবব্যাপি ক্যাওস আর ধ্বংসের দিকে, যদি আমরা একে থামাতে চাই তাহলে অতি অবশ্যই
শাসকশ্রেণির সমস্ত দেশাত্মবোধক আহ্বানকে ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করতে হবে,
শ্রমিক হিসাবে আমাদের শ্রেণিস্বাথ রক্ষার লড়াই করতে হবে,
এবং এই মৃত্যুপথযাত্রি সমাজ যা ক্রমবধর্মান আতঙ্ক আর মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না তার বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে ।
ইন্টারন্যাশনাল কম্যুনিস্ট কারেন্ট ,৭ ই জুলাই ২০০৫.