(নিম্নলিখিত প্রবন্ধটি (World Revolution) ওয়ার্ল্ড রিভলিউসন পত্রিকার৩৫৬ নং সংখ্যার বঙ্গানুবাদ।)
গত ৩০শে জুন ২০১২-য় প্যারিসে আইসিসির একটা পাবলিক মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনাটা শুরু করতে এবং তা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুবিধার্থে আমরা একটি লিখিত প্রেজেনটেসন্ রাখি। বর্তমান প্রবন্ধটা তার ওপর ভিত্তি ক’রে লিখিত।
অতি দক্ষিণপন্থীদের নির্বাচনী সাফল্য কিছুসময় ধ’রে ফ্যাসিজমের উত্থানের আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। সত্যি বলতে কি, প্ররোচনামূলক, অন্য দেশের প্রতি তীব্র ঘৃণা(Xenophobic) ছড়ানো এবং উগ্র জাতিবিদ্বেষী(racist) বক্তব্য দিয়ে এই রাজনৈতিক দলকে আলাদাভাবে চেনা যায়।
এবং এটাও সত্যি যে তাদের বক্তব্য সেই জঘন্য ফ্যাসিস্ট পার্টিগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয় ১৯৩০-এ বিশেষতঃ জার্মান এবং ইতালিতে যারা ক্ষমতায় এসেছিল।
কিন্তু ১৯৩০এর সেই ফ্যাসিবাদী শক্তির বক্তব্যের সঙ্গে মিল আছে বলেই কি একইভাবে বর্তমানে ফ্যাসিবাদের বিপদ মাথাচাড়া দেবে এমনটা ধ’রে নেওয়া যায়?
এবিষয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী এবং তার ওপর আলোচনা আজকের পাবলিক মিটিঙ-এর বিষয়।
কতকগুলো জিনিস দেখে আমারা ভাবতে পারি যে হ্যাঁ, বিপদটা সত্যই আছে। যেমন:
· ১৯৩০-র মত এখন অর্থনৈতিক সংকট বেশিরভাগ মানুষের জীবনে দারুণভাবে আঘাত করছে।
· ১৯৩০-এ যেমন ইহুদিদেরকে আর্ন্তজাতিক পুঁজির প্রতিনিধি হিসাবে উপস্থিত ক’রে তাদেরকে বলির পাঁঠা বানানোহয়, বলসেভিজমের বিপদের বিপরীতে রেখে ফ্যাসিবাদকে জাস্টিফাই করা হয় সেভাবে আজকে মুসলিমদের অথবা ‘আরব’কে নয়তো অভিবাসী(ইমিগ্র্যান্টস্)দেরকেই দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছে যারা নাকি ‘আমাদের কাজ কেড়ে নিচ্ছে’ যারাই নাকি আজকের পৃথিবীর সমস্ত ‘কষ্টের মূলে’।
· ১৯৩০-র মত এখনও এই অতি-দক্ষিণপন্থী চিন্তা ভাবনার প্রতি প্রায়শই সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যতা দেখা যায় ক্ষুদ্রশিল্পের সঙ্গে যুক্ত কারিগর হস্তশিল্পী বা ব্যবসাদারদের যে অংশটা অর্থনৈতিক সংকটের ফলে বিধ্বস্ত এবং শ্রমিকশ্রেণির একটা অংশের মধ্যেও এটা দেখা যাচ্ছে।
· বর্তমানে বিশ্বের নানা প্রান্তে এমনকি ১৯৩০-র চাইতেও বেশি ক’রে এই অতি দক্ষিণপন্থী শক্তির বিকাশ ঘটছে এবং তাদের রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ানোর প্রবণতাই বেড়ে চলেছে। যেমন:
- হল্যান্ডে ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন বিরোধী (ইউরোসেপটিক), ইসলাম বিদ্বেষী ফ্রীডম পার্টি সেখানকার লিব্যারাল এবং ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সঙ্গে মিলিজুলি সরকার গঠন করেছে যেটা ২০১০ থেকে এই বছর অব্দি টিকে আছে।
- ২০১০-এর বিধানসভা নির্বাচনের পর হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভি. ওরবান প্রতিষ্ঠা করেন এক কর্তৃত্বপ্রধান (অ্যথেরিটিরিয়ান) সরকার যেটা গনতান্ত্রিক বিরোধী পক্ষের মতে ‘গনতন্ত্রকে রসাতলে’ পাঠিয়েছে। এটা সত্যিই যে সেই সরকার শুধু যে শ্রমজীবি মানুষের ওপর কঠোর আক্রমণ নামিয়েছে তাই নয়, গনতান্ত্রিক পদ্ধতির অন্তর্গত অনেককিছুকেই অবদমিত করেছে।
- অস্ট্রিয়ায় ২০০৮-র নির্বাচন সেদেশের দুই প্রধান অতি দক্ষিণপন্থী দল যথা মুভমেন্ট ফর অস্ট্রিয়াজ ফিউচার এবং ফ্রিডম পার্টিকে ২৯ শতাংশ ভোট এনে দিয়েছে।
- সংকটের দ্বারা সাংঘাতিকভাবে পর্যুদস্ত গ্রীসে গত জুনের ইলেকসনে ঘোষিত ফ্যাসিস্ট গোল্ডেন ডন মোট ভোটের ৭ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৮ টা সীট দখল করেছে। এই দল অভিবাসীদের ভয় দেখানোতে লিপ্ত;এরা লাইভ টিভি প্রোগ্রামে অন্য একজন রাজনীতিককে চড় মেরে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
- ইউ.এস.এ.তে টি পার্টি দক্ষিণপন্থীদের একটা প্রভাবশালী শক্তি। এরা অত্যন্ত পশ্চাদপদ চিন্তাভাবনা প্রচার করে; যেমন এদের দাবী বিদ্যালয়ে ওল্ড টেস্টামেন্টের মতানুসারী সৃষ্টি তত্ত্ব (Creationism)পড়াতে হবে; অর্থাৎ সোজা কথায় বিবর্তনের তত্ত্বকে খারিজ করতে হবে।
এমনকি যেসব দল নিজেদেরকে অতি দক্ষিণপন্থী বলে দাবী করে না তারাও কম যায় না। সুইজারল্যান্ডে পপুলিস্ট ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন অফ দ্য সেন্টারের একটা বিজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে একটা সাদা ভেড়া একটা কালো ভেড়াকে তাড়া করছে। এখানে কালো ভেড়া হল আরবী এবং রোমানিয়দের প্রতীক। এদেরকে এদেশে সবকিছুতেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
এই সমস্ত উদাহরণ এবং ব্যাখ্যা থেকে বর্তমানে ফ্যাসীবাদের বিপদকেই যুক্তিসিদ্ধ বলে মনে হতে পারে।
তবে এইটুকু আলোচনাতেই আমরা সন্তুষ্ট থাকবো না। ১৯৩০ এবং বর্তমান পর্যায়ের মধ্যে তুলনা বা বিভিন্ন উপাদান যেমন সংকট বা জেনোফোভিক এবং রেসিস্টদের কিছুটা সাফল্য, অতি দক্ষিণপন্থীদের অগ্রগতি ইত্যাদি যত গুরুত্বপূর্ণই হোক না কেন আমাদের কাজ হবে এইসব উপাদানগুলোকে সমাজ-গতির পরিপ্রেক্ষিতে এবং তারও মধ্যে আবার বুরজোয়া এবং প্রলেতারিয়েতের মধ্যেকার ক্ষমতার ভারসাম্যের মধ্যে রেখে বিচার করা।
১৯৩০-র সময়কালে ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থানের পিছনে কী ছিল?
আমরা আগেই পুঁজিবাদের সংকটের বিষয়টা বলেছি। তবে কয়েকটা দেশে পুঁজিবাদী আধিপত্যের একটা বিশেষ রূপ হিসাবে ফ্যাসিবাদের এই দ্রুত উত্থানের কারণ খুঁজতে গেলে সংকট ছাড়াও একটা মৌলিক উপাদানকে বিবেচনায় আনতেই হবে:
এটা হল ১৯১৭-২৩ এই সময়কালে সংঘটিত প্রলেতারিয় বিপ্লবের পরাজয়। শ্রমিকশ্রেণির এত গভীর পরাজয় আগে কখনই হয়নি। কেননা প্রতিবিপ্লবী শক্তি শ্রমিকশ্রেণির কাছ থেকে কেড়ে নিতে পেরেছিল শ্রমিকশ্রেণির দুই প্রধান হাতিয়ার: তাদের সংগঠন এবং প্রলেতারিয় সচেতনতা।এই পরাজয়ের প্রকাশ ঘটে রুশ বিপ্লবের ক্রমঅধঃপতনের ভেতর দিয়ে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উৎখাত করার প্রয়াসে বিপ্লবী সংগ্রাম যে দেশে যত বেশি বিকশিত হয়েছে সেখানে এই পরাজয় তত বেশি সুস্পষ্ট ছাপ রেখেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নে যেমন দেখেছি, সেই ধরণের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের একটা বিশেষরূপের মধ্যে দিয়ে পুঁজিবাদকে টিকিয়ে রাখার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টিগুলো।
এই পরাজয় ইতিহাসের দীর্ঘতম এবং গভীরতম প্রতিবিপ্লবের জন্ম দেয়। এই প্রতিবিপ্লবের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এই যে এটা বিশ্বজুড়ে শ্রমিকশ্রেণিকে তাদের কথামত চলতে প্রোচিত করতে পেরেছিল। দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধে প্রলেতারিয়েতকে কোন না কোন পক্ষে সামিল করতে পারাটা এরই চূড়ান্ত প্রকাশ।
২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে যুদ্ধে লিপ্ত দেশগুলোতে আমরা তিনধরণের আর্থসামাজিক-সংগঠনের মডেল দেখতে পাই। তিনটি মডেলই পুঁজিবাদী এবং প্রতিক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদকে শক্তিশালী করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদকে শক্তিশালী করাটা সেসময় সারা বিশ্বেই পুঁজিবাদের একটা সাধারণ প্রবণতা ছিল। এই তিনটে মডেল হল:
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ
স্টালিনিস্ট রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ
ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ।
প্রথমটার সঙ্গে অন্য দুটোর তফাৎ পরিষ্কার। এখন এটা বলাই যায় যে উৎপাদন ব্যবস্থার পরিচালনা এবং শ্রমিকশ্রেণির ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখার জন্য প্রথম ধরণের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ অন্য দুটোর চাইতে বেশি কার্যকর।
কেন সেসময় কিছু পুঁজিবাদী দেশ ফ্যাসিস্ট ছিল?
ঠিক স্ট্যালিনিস্ট স্টেট (সোভিয়েত ইউনিয়ন)-র মতই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র (জার্মানি, ইতালি)ও শ্রমিকশ্রেণিকে বিভ্রান্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় গনতান্ত্রিক কলাকৌশল খারিজ করে দিয়েছিল এবং এটা বুরজোয়াদের কাছে কোন সমস্যাই ছিল না।
প্রকৃতপক্ষে (বিশেষত: USSR এবং জার্মানে) বিপ্লবের পরাজয়ের সাথে সাথে সাংগঠনিক ও চেতনাগত দিক থেকে নিঃশেষিত শ্রমিকশ্রেণিকে আলাদাভাবে বিভ্রান্তির বেড়াজালে মোহগ্রস্ত করার কোন প্রয়াস আর দরকার ছিল না। দরকার ছিল খোলাখুলি হিংস্র একনায়কতান্ত্রিক পদক্ষেপের সাহায্যে এই পরাজয়কে দীর্ঘায়িত করা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া অবস্থা এবং অর্থনৈতিক সংকটে মুখ থুবরে পড়া জাতীয় পুঁজির স্বার্থ সুরক্ষিত করার জন্য জার্মান এবং ইতালিতে ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের রাজনীতিকে গ্রহণ করে। এসব দেশে বুরজোয়াদের আরেকটা নতুন যুদ্ধ সংগঠিত করা দরকার হয়ে পড়েছিল।প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ এবং/ অথবা যে তাচ্ছিল্য তাদের সে সময় সহ্য করতে হয় তারই শোধ নেবার নাম ক’রে এই যুদ্ধের প্রস্তুতি তারা করে। ১৯২০-র শুরু থেকেই ফ্যাসিস্টরা এই মতামত প্রচারের শীর্ষে ছিল।
এই দুই দেশে বৃহৎ পুঁজির সমর্থন পুষ্ট হয়ে, গনতান্ত্রিক উপায়েই গনতন্ত্র থেকেই ফ্যাসিবাদের উত্থান হয়েছিল।
আমরা বলেছি শ্রমিকশ্রেণির গভীর পরাজয় উক্ত দেশগুলোয় ফ্যাসিবাদের ক্ষমতায় আসার অন্যতম শর্ত। বুরজোয়ারা একটা কথা প্রচার করে যে ফ্যাসিবাদী শক্তিই ১৯২০-৩০-এ শ্রমিকশ্রেণিকে পরাজিত করে। এটা ডাঁহা মিথ্যা। বুরজোয়া রাজনীতির বাম অংশ (বামপন্থীরা) যে পরাজয়ের প্রক্রিয়ার সূচনা করে, ফ্যাসিস্টরা সেই পরাজয়ের প্রক্রিয়াকেই সুসম্পূর্ণ করে। বিপ্লবের পর্বে বুরজোয়াদের প্রতিনিধি হয়েছিল সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিগুলো যারা শ্রমিকশ্রেণি এবং তার আন্তর্জাতিকতার নীতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এরা শ্রমিকশ্রেণিকে বুরজোয়াদের স্বার্থে যুদ্ধে সামিল হওয়ার আহ্বান জানায় এবং এভাবেই শ্রমিকশ্রেণির আন্তর্জাতিকতার মৌলিক নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ায়।
সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিগুলো এরকম ভূমিকা পালন করল কেন? তাদের এমনটা করা কি খুব দরকার ছিল? সেসময় শ্রমিকশ্রেণি শুধুমাত্র অপরাজিত তাই নয়, পরন্তু তাদের বিপ্লবী সংগ্রাম উত্তরোত্তর বিকশিত হচ্ছে; ফলতঃ বুরজোয়াদের অবদমনের কিছু পদ্ধতি সে সংগ্রামের সামনে অকেজো হয়ে পড়ছে। ঠিক এমন একটা পরিস্থিতিতে শ্রমিকশ্রেণির অগ্রগতি প্রতিহত করতে প্রথমেই বর্বর নিপীড়ণ চালানোটা বুরজোয়াদের কাছে আত্মহত্যার সামিল হত। পাশব শক্তির প্রয়োগ তখনই কার্যকর যখন তা প্রলেতারিয়েতকে বিভ্রান্ত করার কৌশলগুলোর একটা অংশ হিসাবে শ্রেণির কোন দুর্বলতাকে ব্যবহার ক’রে তার সংগ্রামকে নিষ্ফল করে দেওয়া যায়, শ্রেণিকে বুরজোয়ার পাতা ফাঁদে এনে ফেলা যায়। আর এই জঘন্য কাজটা সেই রাজনৈতিক পার্টিগুলো করতে পারে যারা প্রলেতারিয়েতের সঙ্গে বেইমানি করা সত্ত্বেও যাদের প্রতি শ্রেণির বিপুল অংশটার তখনও অব্দি ভরসা আছে।
সুতরাং, ১৯১৯-এর জার্মান বিপ্লবের সময়কালে পুঁজির রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখার প্রয়াসী শেষ রাজনৈতিক প্রতিনিধি জার্মান SPD পার্টি বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণিকে শেষ করার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেয়। একাজে সেনাবাহিনীর অবশিষ্ট অংশ যারা রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বস্ত ছিল তাদের সমর্থন মেলে এবং নাৎসি ‘সক ট্রুপ (Shock Troop)’-র পূর্ববর্তী সংস্করণ নিপীড়নমূলক Freikorps (ঝটিকাবাহিনী) নামানো হয়।
এই কারণে, শ্রমিকশ্রেণির যত শত্রু আছে যথা ডান বা বামপন্থী গনত্ন্ত্রী, অতিবাম তা গনতন্ত্রী হোক বা না হোক, পপুলিস্ট তা ফ্যাসিস্ট হোক বা না হোক, সবথেকে বিপজ্জনক শত্রু হল তারাই যারা শ্রেণিকে সুকৌশলে টুপি পরিয়ে বিপ্লবী লক্ষ্যের পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারে। আর এই কাজ প্রাথমিক ভাবে পুঁজির বাম এবং অতিবাম অংশের; সুতরাং এদের মুখোশ খোলা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমান পর্যায়ে পরিস্থিতিটা কী?
১৯৩০-র থেকে একটা বড় পার্থক্য সূচিত হয়েছে ১৯৬৮ থেকে ফ্রান্স এবং বিশ্ব শ্রমিকশ্রেণীর নতুনভাবে সংগ্রামের পথে আসার ভেতর দিয়ে। সেইসময় থেকে শ্রেণীসংগ্রামে এক নতুন গতিমুখ খুলে গেছে। সে পথ শ্রমিকশ্রেণীর পূর্বতন পরাজয়ের পর্ব পেরিয়ে পুনরায় শ্রেণি সংগ্রামের বিকাশ ঘটানোর অভিমুখে। এটা ঠিকই যে সেসময় থেকে শ্রেণি প্রচুর বাধার সামনে পড়েছে তবু বিশ্বজুড়ে শ্রেণি গভীর এবং মৌলিক কোন পরাজয়ের সম্মুখীন হয়নি যাতে ১৯৩০-র মত আবার একটা প্রতিবিপ্লব রাজত্ব করতে পারে।
এই অর্থেই আমরা বলতে পারি ফ্যাসিজম্ কায়েম করার অপরিহার্য শর্তসমূহ যথা আন্তর্জাতিকভাবে নিশ্চিতভাবে পরাজিত শ্রমিকশ্রেণি, পুঁজিবাদীদের কয়েকটা প্রধান দেশে শ্রেণির সাংগঠনিক এবং মতাদর্শগতভাবে সম্পূণভাবে চূর্ণ হয়ে যাওয়া অবস্থা বর্তমানে নেই।
বর্তমানে ফ্যাসিবাদ সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতায় চলে আসবার মত বিপদের ভয় শ্রমিশ্রেণির নেই; তার প্রধান বিপদ গণতন্ত্রের মায়াজাল যারা ছড়ায় তাদের নিয়ে এবং পুরোণো শ্রমিক পার্টিগুলোকে নিয়ে যারা পুরোপুরি বুর্জোয়াদের ক্যাম্পে চলে গেছে। শ্রমিকশ্রেণির পুঁজি বিরোধী সংগ্রাম এবং শ্রেণীর বিপ্লবী চরিত্রকে তুলে ধরার যেকোন প্রয়াসকে সুপরিকল্পিতভাবে শেষ করাই এইসব পার্টিগুলোর কাজ। আর লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই দলগুলোই ফ্যাসিবাদের বিপদ নিয়ে সব চেয়ে বেশি গলা ফাটাচ্ছে যাতে ক’রে শ্রমিকশ্রেণিকে গণতন্ত্র আর বামপন্থার গাড্ডায় আটকে রাখা যায়।
১৯৩০-র ফ্যাসিস্ট দের মত একই বিষয় নিয়ে বর্তমান পপুলিস্ট পার্টিগুলোর মাথা চাড়া দেওয়ার কারণ কী?
দেউলিয়া হয়ে যাওয়া পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার একমাত্র বিকল্প বিশ্ব প্রলেতারিয় বিপ্লব। কিন্তু প্রলেতারিয়েত সেই বিপ্লবের পথে যেতে প্রচুর বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। এর ফলেই এই সব পার্টিগুলো মাথা চারা দিতে পারছে।
সুতরাং যদিও বুরজোয়ারাও এই পরিস্থিতিতে তাদের সংকট মেটানোর জন্য সর্বব্যাপী বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত করতে পারছে না, সমাজটা বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের চাপে সবদিক থেকে পচনশীল অবস্থায় চলে যাচ্ছে। এই পচনশীলতা থেকেই জন্ম হচ্ছে এইধরণের দিশাহীন, জাতপাতবাদী, অন্য দেশের মানুষের প্রতি ঘৃণাপূর্ণ মতবাদের; এসবের ভিত্তিমূলে আছে তীব্র প্রতিযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গী; আছে অপরকে প্রতিযোগী বা শত্রু ভাবা। শ্রমিকশ্রেণীসহ সমাজের একটা লক্ষণীয় অংশই এসব ভাবধারা দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে।
এর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাদের কাজ নয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আলাদা ক’রে কোন সংগ্রাম সংগঠিত করা বা ডিমোক্র্যাসি রক্ষার জন্য কোন বিশেষ আন্দোলন গড়ে তোলা; আমাদের কাজ এইসমস্ত কিছুর জন্য দায়ী যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তার বিরুদ্ধেই শ্রমিকশ্রেণির সর্বব্যাপী স্বাধীন স্বতন্ত্র আন্দোলন গড়ে তোলা।
আই. সি.সি. ৩০ ০৬ ২০১২