এই মুহূর্তে ভীষণ অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে গ্রীসের পরিস্থিতি। যেকোন মুহূর্তে তীব্র ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে শ্রমিক শ্রেণি। গ্রীক রাষ্ট্র শ্রমিক শ্রেণির ওপর অবিরাম আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে—সমস্ত প্রজন্মের, সমস্ত সেক্টরের ওয়ার্কার আজ সেই আক্রমণের শিকার। প্রাইভেট সেক্টর, পাবলিক সেক্টর, বেকার, পেনসনজীবি, আংশিক সময়ের চুক্তিতে কর্মরত ছাত্র-ছাত্রী কেউ বাদ যায়নি। সমগ্র শ্রমিক শ্রেণি নিদারুণ দারিদ্রের মুখোমুখি।রাষ্ট্রের আক্রমণের সামনে দাঁড়িয়ে শ্রমিকশ্রেণি তার পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করেছে। অন্যান্য কান্ট্রিগুলোর মতই গ্রীসেও শ্রমিকশ্রেণি নেমেছে রাস্তায়, করছে ধর্মঘট,জানিয়ে দিচ্ছে:
পুঁজিবাদের সংকটে তারা আর বলির পাঁঠা হতে চায় না; পুঁজিবাদকে টিকিয়ে রাখার জন্য নিদারুণ আত্মত্যাগের আহ্বানে সাড়া দিতে শ্রমিকশ্রেণি বিন্দুমাত্র দায়বদ্ধ নয়।
তবে গ্রীসে এই আন্দোলন এখনও বিশাল আকার ধারণ করেনি। গ্রীসের শ্রমিকেরা এই মুহূর্তে অত্যন্ত কঠিন পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সমস্ত মিডিয়া এবং সমস্ত রাজনীতিকরা শ্রমিকশ্রেণিকে জ্ঞান দিচ্ছে : বাছা করার আর কিছু নেই কোমরে গামছা বাঁধ কষে আর দেউলে অবস্থা থেকে দেশটাকে বাঁচাও; তো তখন শ্রমিকেরা কী করবে? শ্রমিক ভাইয়েরা ভীষণ দানবাকৃতি এই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিভাবে দাঁড়াবে? কিভাবে কোন্ পদ্ধতিতে লড়াই করা দরকার যাতে শক্তিসাম্যটা শোষিত মানুষের পক্ষে আসে?
এই সব প্রশ্ন শুধু গ্রীসের শ্রমিকেরা ফেস করছেন তা নয়, এ প্রশ্ন আজ সমগ্র বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণির। প্রকৃতপক্ষে গ্রীসের এই “ট্র্যাজেডি”সারা বিশ্বে কী ঘটতে চলেছে তার আভাস মাত্র। ইতোমধ্যে গ্রীক স্টাইলে ‘ব্যয়সংকোচের প্যাকেজ’ ঘোষিত হয়েছে পর্তুগাল, রুমানিয়া, জাপান এবং স্পেন (যেখানে সরকার পাবলিক সেক্টরের ওয়ার্কারদের বেতনের শতকরা ৫ ভাগ কেটে নিচ্ছে)। বৃটেনে এই কাটাউতি কিরকম হতে চলেছে তার ছবি নতুন কোয়ালিসন সরকার সবেমাত্র প্রকাশ করতে শুরু করেছে। এইসব আক্রমণ পরপর ঘটে চলেছে। এ থেকে আবারো বোঝা যাচ্ছে শ্রমিকশ্রেণির কোন জাতীয়তা নেই, পৃথিবীজুড়ে তাদের একটাই শ্রেণি পরিচয়, তাদের স্বার্থও একটাই, এই ধরণীতে তাদের শত্রুও একটাই। পুঁজিবাদ প্রলেতারিয়েতকে মজুরি-শ্রমের এই ভারী শেকলটা পরে থাকতে বাধ্য করে, তবে একইসঙ্গে এই শেকলই বিশ্বজুড়ে তাদের যুক্তও করে, একত্র করে সারা বিশ্বের শেকলপরা প্রলেতারিয়েতকে।
গ্রীসে আমাদেরই শ্রেণিভাইবোনেরা আক্রমণের শিকার আর তারাই এই আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়তে নেমেছে তাই তাদের সংগ্রাম আমাদেরই সংগ্রাম।
গ্রীসের শ্রমিকশ্রেণির প্রতি আমাদের সংহতি জানাই! একটাই শ্রেণি আমাদের, লড়াইও আমাদের একটাই!
বুরজোয়ারা আমাদের মধ্যে হাজারোরকমের বিভেদ সৃষ্টির চক্রান্ত অনবরত চালিয়ে যাচ্ছে--—এই সমস্ত চক্রান্ত আমাদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। সেই আদ্যিকাল হতে চলে আসা শাসকশ্রেণির নীতি: ‘ভাগ কর শাসন কর’—এর বিরুদ্ধে আমাদের শ্লোগান আজ একটাই: দুনিয়ার মজদুর এক হও।
ইউরোপে, বিভিন্ন দেশীয় বুরজোয়ারা বলছে আমাদেরকে যদি পেটে গামছা বেঁধে পড়ে থাকতে হয় তো তার দায় গ্রীসের। সেখানে দেশ পরিচালনার দায় যাদের কাঁধে তারা অসততা করেছে—দশকের পর দশক তারা দেশটাকে ঋণের ওপর নির্ভর ক’রে বেঁচে থাকতে দিয়েছে, সরকারী অর্থের অপব্যয়, তছরুপ এবং লুটপাট করেছে আর এরাই ইউরোর প্রতি ‘বিশ্বজোড়া আস্থার যে সংকট’ তার জন্য দায়ী। একটার পর একটা, এইসব ফালতু অজুহাত দেখিয়ে সরকারগুলো কেন ডেফিসিট কমাতে হবে তার ব্যাখ্যা দিচ্ছে আর আমাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে ব্যয় সংকোচের’র কঠোর পদক্ষেপগুলো।
বুরজোয়াদের কোন কোন গোষ্ঠী বলছে ইউএস-এতে স্টক মার্কেটে ধস নামার কারণ হ’ল ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অস্থির অবস্থা। কোম্পানীগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ ইউরো কারেন্সির দুর্বল অবস্থা কেননা, ডলার এবং ইউএসের রপ্তানীর ক্ষেত্রে ইউরো একটা প্রতিবন্ধক।....
সংক্ষেপে, প্রতিটা জাতীয় বুরজোয়া তাদের প্রতিবেশী বুরোজোয়া দেশগুলোকে অভিযুক্ত করছে আর শ্রমিকশ্রেণিকে ব্ল্যাকমেল করছে। এরা বলছে: ব্যয়সংকোচ মেনে নাও নয়তো দেশ দুর্বল হয়ে পড়বে আর এর সুফল ভোগ করবে আমাদের প্রতিযোগী অন্য দেশগুলো”। এভাবে জাতীয়তাবাদের বিষাক্ত ইনজেকসন দিয়ে এরা আমাদের শ্রেণি সংগ্রামের রাস্তা থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছে।
কতকগুলো প্রতিযোগী পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসাবে বিভাজিত ধরণী আমাদের ধরণী নয়। যে বিশেষ রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে বাস করছি সেই রাষ্ট্রীয় পুঁজির স্বার্থে শৃঙ্খলিত থেকে শ্রমিকশ্রেণির কিচ্ছু পাবার নেই। আজ ‘জাতীয় অর্থনীতিকে’ বাঁচাবার স্বার্থে ওদের চাপিয়ে দেওয়া ব্যয়সংকোচের কালা কানুন মেনে নেওয়ার মানে আগামীকাল আরও কঠোরতর আত্মত্যাগ মেনে নিতে প্রস্তুত থাকা।
গ্রীস আজ গভীর খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে। আজ স্পেন, ইতালি এবং পর্তুগাল ঠিক তার পিছনের সারিতে; বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানী, আমেরিকা আজ ভীষণ এক সংকটের মুখোমুখি--- এসবের কারণ পুঁজিবাদ এখন আক্ষরিক অর্থেই মুমূর্ষ ব্যবস্থা। পুঁজিবাদের নৈরাজ্যের অতল তলে ক্রমাগত আরো তলিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত দেশ। গত চল্লিশটা বছর ধরে পুঁজিবাদী বিশ্ব অর্থনীতি সংকটাপন্ন। এক মন্দা থেকে আরেক মন্দার ভেতর দিয়ে চলেছে সে। এ্যাদ্দিন শুধুমাত্র বাঁচার চেষ্টায় মরীয়া পুঁজিবাদ লাগামছাড়াভাবে ঋণের আশ্রয় নিয়েই যেটুকু সম্ভব বিকাশটুকুকে জিইয়ে রাখতে পেরেছে; কিন্তু তার ফলাফল আজ কী? প্রতিটি ব্যক্তি, প্রতিটি পরিবার, কোম্পানী, ব্যাঙ্ক আর রাষ্ট্র সমস্তটাই ঋণভারে জর্জরিত। গ্রীস রাষ্ট্রের দেউলিয়া হয়ে যাওয়াটা এই শোষণভিত্তিক ব্যবস্থাটার সাধারণ এবং ঐতিহাসিকভাবে দেউলে অবস্থারই একটা বিশেষ বিকৃত প্রকাশমাত্র।
শাসকশ্রেণির দরকার আমাদের ঐক্য ভাঙা: আমাদের দরকার শ্রেণি-সংহতি!
শ্রমিকশ্রেণির শক্তি তার ঐক্য!
শাসকশ্রেণি ব্যয়সংকোচের যে প্ল্যান ঘোষণা করেছে তা আসলে আমাদের জীবনযাপনের অবস্থার ওপর সামগ্রিক একটা আক্রমণ। সুতরাং এর বিরুদ্ধে একমাত্র দাওয়াই শ্রমিকশ্রেণির ব্যাপক শ্রেণি-সংগ্রাম। নিজের ছোট্ট চৌহদ্দির ভেতর লড়াই ক’রে একে ঠেকানো অসম্ভব: তা সে নিজ নিজ ফ্যাক্টরি, স্কুল, অফিস যাই হোক; একাএকা এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন থেকে কোন আন্দোলনই আজ আর এই বিপুল আক্রমণকে প্রতিহত করতে পারবে না। সুতরাং সমস্ত ক্ষেত্রের সমস্ত শ্রমিকের ব্যাপক আন্দোলন আজ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। শাসকেরা সেক্টরভিত্তিক লড়াই চূর্ণ করে দেবেই, আর বাধ্য করবে গভীরতর দারিদ্রে নিমজ্জিত হতে। এর বিপরীতে একমাত্র উপায় সমস্ত বিভাজনরেখার ভেঙে চূড়মার ক’রে সমস্ত সেক্টরের শ্রমিকের ঐক্যবদ্ধ এবং সুসংহত লড়াই।
লক্ষ্য করুন অফিসিয়াল সংগ্রাম-বিশেষজ্ঞদের মানে ট্রেডইউনিয়নওয়ালাদের—কী করছে তারা? অসংখ্য কর্মক্ষেত্রে তারা ধর্মঘট সংগঠিত করছে:কিন্তু একটিবারের জন্যও তাদের চেষ্টা নেই এই সমস্ত পৃথক পৃথক আন্দোলনগুলোকে একসূত্রে গাঁথার। বরং সেকসনগত, বিশেতঃ সরকারী এবং বেসরকারী ক্ষেত্রগুলোর শ্রমিকদের মধ্যে বিভাজনটাকে এরা সক্রিয়ভাবে উৎসাহিতই করছে। তারা শ্রমিকদের নিষ্ফল, নিষ্ক্রিয় প্রতিবাদ-কর্মসূচীতে সামিল করছে; সোজা কথায় তারা ওয়ার্কারদের ঐক্য বিনাশ করারই বিশেষজ্ঞ। ইউনিয়নগুলোও একইরকমভাবে জাতীয়তাবাদী মনোভাবকে আরো চাঙ্গা করতে চাইছে। একটা উদাহরণ দিই: মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে ইউনিয়নগুলোর একটা গালভরা কমন্ শ্লোগান হ’ল: “ স্বদেশী জিনিস কেনো”!
ইউনিয়নের রাস্তায় হাঁটা মানে ঐক্যের বিপরীতে হাঁটা, পরাজয়ের পথে হাঁটা। শ্রমিকদের নিজেদের সংগ্রাম নিজেদের হাতেই নিতে হবে; সব শ্রমিকদের সম্মিলিত সাধারণ সভায় নিজেদের সংগঠিত করার মধ্য দিয়ে, সাধারণ সভায় সংগ্রামের দিশামুখ, পদ্ধতি ইত্যাদি সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভেতর দিয়ে, নিজেদের দাবী আর শ্লোগান সম্মিলিতভাবে ঠিক করার মধ্যে দিয়ে, সংগ্রাম পরিচালনার জন্য, যেকোন সময়ে প্রত্যাহারযোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচন ক’রে, সংগ্রাম কমিটি গঠন ক’রে, কাছাকাছি থাকা ফ্যাক্টরি, স্কুল. কলেজ. হাসপাতালইত্যাদি সম্ভাব্য সব জায়গায়কর্মরত শ্রমিকদের সঙ্গে (যাতে তারাও আন্দোলনে সামিল হয় সেই্ লক্ষ্যে) আলোচনা করার জন্য প্রতিনিধি পাঠানোর কাজ সংগঠিত করার মধ্যে দিয়ে শ্রমিকশ্রেণিকে একাজ করতে হবে।
ট্রেডইউনিয়ন চৌহদ্দির বাইরে বেরিয়ে, শ্রেণি তার নিজের সংগ্রামের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবে নিজেই, অন্যান্য সেক্টরের শ্রমিকের কাছে যাবে—এগুলো বেশ কঠিন কাজ মনে হতে পারে। আসলে শ্রমিকশ্রেণির নিজ শ্রেণির প্রতি গভীর আস্থার অভাব আজকের দিনে শ্রেণিসংগ্রাম বিকাশের ক্ষেত্রে একটা বিরাট বাধা। নিজের শ্রেণিটা যে কি বিপুল শক্তি ধরে সেটা সম্বন্ধে তারা নিজেরা পুরোপুরি সচেতন নয়। এই মুহূর্তে একদিকে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট, পুঁজিবাদের হিংস্র আক্রমণ, অন্যদিকে প্রলেতারিয়েতের স্ব-শ্রেণির প্রতি দৃঢ় আস্থার অভাব সব মিলে একটা অচল, অবশ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি যেমনটা দাবী করে এমনকি গ্রীসেও, শ্রমিকের সাড়া, তার তুলনায় অনেকটাই ক্ষীণ। তাসত্বেও ভবিষ্যৎ শ্রেণিসংগ্রামেরই হাতে। পুঁজিবাদের আক্রমণের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণির ক্রমবর্ধমান এবং ব্যাপক আন্দোলনই সামনে এগোনোর একমাত্র রাস্তা।
কিছু মানুষ জিগ্যেস করছেন, “ কেন আন্দোলন করব? এ আন্দোলনের পরিণতিটাই বা কী? পুঁজিবাদ তো দেউলে হয়ে গেছে, কোন সংস্কারই যখন সম্ভব নয়, তখন আর কিইবা রাস্তা থাকে?” সত্যি বলতে কি, এই শোষণভিত্তিক ব্যবস্থার ভেতর আর কোন সমাধান নেই। কিন্তু কুত্তার মত বাঁচতে অস্বীকার ক’রে সম্মিলিতভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর মানে আপন মর্যাদা রাখার দাঁড়ানো। এর মানে এই উপলব্ধি যে এই প্রতিযোগিতা আর শোষণ ভিত্তিক বিশ্বেও সংহতি নিশ্চিতভাবেই আছে আর এই অমূল্যবান মানবিক অনুভবটিকে বিশ্বজুড়ে বাস্তবায়িত করতে শ্রমিকশ্রেণি সক্ষম। আর এখান থেকেই আরেক নতুন ধরণীর অভ্যুদয়ের শুরু: একটা বিশ্ব যেখানে কোন শোষণ নেই, রাষ্ট্রীয় সীমানা নেই, নেই কোন সেনাবাহিনী; সে বিশ্ব লাভের জন্য নয়, মানুষের জন্য। শ্রমিকশ্রেণি নিজের শক্তির ওপর গভীর আস্থা গড়ে তুলতে পারে এবং তা তাকে করতেই হবে। একমাত্র এই আস্থাই সেই মানবিক বিশ্ব গড়ে তুলতে সক্ষম; এই আস্থাই মার্কসের ভাষায় “পরিস্থিতির দাসত্ব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে স্বাধীনতার পরিমন্ডলে উত্তরণের” মধ্যে দিয়ে মানুষের প্রজাতিগত সত্তার প্রকৃত বিকাশ ঘটাতে পারে।
পুঁজিবাদ দেউলিয়া কিন্তু আরেক বিশ্ব সম্ভব, সে হ’ল কমিউনিজ্ম্!
ইন্টারন্যাশানাল কমিউনিস্ট কারেন্ট, ২৪শে মে ২০১০