The counter–revolutionary myth of ‘national liberation’
জাতীয় মুক্তি এবং নতুন জাতির গঠন বা সৃষ্টি কখনোই শ্রমিকশ্রেণীর বিশেষ ভাবে নিদির্ষ্ট কর্তব্য (specific task) হয়ে ওঠে নি। ঊনিশ শতকে কোনও কোনও ক্ষেত্রে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে সমর্থন করা সত্ত্বেও , এসব আন্দোলনের পুরোপুরি বুজোর্য়া চরিত্র সম্বন্ধে বিপ্লবীদের বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। ‘জাতি সমূহের আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকারের' নামেও কিন্তু তাঁরা ঐসব আন্দোলন সমর্থন করেন নি। উথ্থানের যুগে পুঁজির বিকাশের পক্ষে সবথেকে উপযুক্ত কাঠামো ছিল জাতি বা জাতিরাষ্ট্র এবং প্রাক-পুঁজিবাদী সামাজিক সম্পর্কের শ্বাসরোধকারী অস্তিত্বকে শেষ করে নতুন জাতি বা জাতিরাষ্ট্রের গঠন ছিল বিশ্বব্যাপী উৎপাদিকা শক্তির আরো বিকাশ অর্থাৎ সমাজতন্ত্রের জন্য অপরিহারয বাস্তব শর্তাবলীর পরিপক্কতার পথে অগ্রগামী পদক্ষেপ, আর সে জন্যই এইসব আন্দোলন বিপ্লবীরা সমর্থন করেছিলেন ।
পতনশীলতার যুগে প্রবেশের সাথে সাথে পুঁজির উৎপাদন সম্পর্ক সহ জাতিরাষ্ট্রের সামগ্রিক কাঠামোটা এতই সংকীর্ণ হয়ে পড়ল যে উৎপাদিকা শক্তির যথাসম্ভব বিকাশের পক্ষে আর তা সহায়ক নয় । সবচেয়ে পুরনো এবং শক্তিশালী দেশগুলোর আরো বিকাশলাভে অক্ষম হয়ে পড়ার পরিস্থিতিতে, নতুন করে বৈধ জাতিরাষ্ট্রের গঠন(Juridical Constitution of new countries ) আসলে প্রগতির কোন পদক্ষেপই নয় । পরস্পর বিরোধী সাম্রাজ্যবাদী শিবিরে বিভাজিত পৃথিবীতে ‘জাতীয় মুক্তির' সংগ্রাম প্রগতিশীল কোনও পদক্ষেপ তো নয়ই, বরং তা কেবল প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরের মধ্যেকার অনিবারয ,অবিরাম সংঘাতের একটা মুহূর্ত বা ক্ষেত্র হিসেবেই পরিগণিত হতে পারে আর এইসব সংগ্রামে, স্বেচ্ছায় হোক বা বলপ্রয়োগের মাধ্যমেই হোক ,শ্রমিক ও কৃষকেরা সামিল হন শুধু কামানের খোরাক হিসেবেই ।
সাম্রাজ্যবাদের উৎসমূল অর্থাৎ পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের উৎখাতের লক্ষ্যে পরিচালিত নয় ব'লে , এই ধরনের সব সংগ্রাম ‘সাম্রাজ্যবাদকে দুবর্ল' করে না কোনভাবেই। এগুলোর ফলে কোন একটা সাম্রাজ্যবাদী শিবির দুবর্ল হয়ে পড়লে অন্যটা অবশ্যই জোরদার হয়ে ওঠে ; এবং এইসব সংঘাতের ফলে গড়ে ওঠা নতুন সব জাতিরাষ্ট্রকেও সাম্রাজ্যবাদী হতেই হবে , কারণ, পতনশীলতার যুগে ছোট, বড় নিবির্শেষে কোন দেশই সাম্রাজ্যবাদী নীতি অনুসরন না করে টিকে থাকতে পারে না ।
বর্তমান যুগে ‘জাতীয় মুক্তির' সংগ্রামের ‘সাফল্য' বা ‘বিজয়ের' অর্থই হল সংশ্লিষ্ট দেশের সাম্রাজ্যবাদী প্রভুর ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন মাত্র। শ্রমিকদের, বিশেষ করে নতুন ক'রে গজিয়ে ওঠা তথাকথিত ‘সমাজতান্ত্রিক' দেশের শ্রমিকদের কাছে এর অর্থ হল সামরিক ধাঁচে ,সুব্যবস্থিত ও সুপরিকল্পিত পদ্ধতিতে রাষ্ট্রীয়কৃত পুঁজির (Statified Capital) শোষনের তীব্রতা বৃদ্ধি । এই রাষ্ট্রীয়কৃত পুঁজি বুজোর্য়া ব্যবস্থার বরবতারই একটা সুচকরূপে ‘মুক্ত ,স্বাধীন' জাতি-রাষ্ট্রকে বিশাল এক বন্দীশালায় রূপান্তরিত করার পথে এগিয়ে চলে। কিছুলোকের দাবীর সম্পূর্ণ বিপরীতে, তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণীর কাছে এইসব সংগ্রাম শ্রেণীসংগ্রামের পথে বিরাট উল্লম্ফনের সুযোগ এনে দেয় না । ‘দেশপ্রেমের' বিভ্রান্তি ছড়িয়ে জাতীয় পুঁজির স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে শ্রমিকশ্রেণিকে সংগঠিত ক'রে সবসময়ই শ্রেণীসংগ্রামের পথে বিরাট বাধা হবে দাঁড়ায় এই সংগ্রামগুলো। এই শ্রেণীসংগ্রাম প্রায়ই অত্যন্ত বেদনাদায়ক , রক্তক্ষয়ী রূপধারণ করে এইসব দেশে । কমিউনিষ্ট বা তৃতীয় আন্তর্জাতিকের ঘোষণার বিপরীতে , গত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ করে দিয়েছে যে , ‘জাতীয় মুক্তি' যুদ্ধ (National Liberation Struggle), শিল্পোন্নত বা পিছিয়ে পড়া কোন দেশেরই শ্রমিকদের সংগ্রামে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে না । এইসব সংগ্রামে শ্রমিকশ্রেণীর কোন অংশেরই লাভ করার কিছুই নেই এবং সমর্থনের জন্যে কোনো পক্ষকেই তারা বেছে নিতে পারেনা । তথাকথিত ‘জাতীয় মুক্তি' জমকালো আবরনে ‘জাতীয় প্রতিরক্ষার' পরবর্তী কালের সংস্করণ ছাড়া আর কিছুই নয় । এইসব সংঘাত সংঘর্ষে একমাত্র বিপ্লবী শ্লোগান হচ্ছে : বিপ্লবী পরাজয়বাদ (Revolutionary defeatism) অর্থাৎ ‘সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে বিপ্লবী গৃহযুদ্ধে পরিণত করুন'। বিপ্লবীরা শ্রমিকশ্রেণীর কাছে এই আহ্বানই রেখেছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় । ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত যে ভাবেই হোক না কেন , এইসব সংঘর্ষের প্রতি ‘বিনা শর্ত' বা ‘ সমালোচনা মুলক' সমর্থনের যেকোন অবস্থানই প্রথম মহাযুদ্ধের সময়কার ‘ উৎকট স্বদেশভক্ত সমাজ গণতন্ত্রী' দের (সোস্যাল সোভিনিস্ট /Social-chauvinists) অবস্থানের একদম অনুরূপ । সঙ্গতিপূর্ণ ও সুসংহত কমিউনিষ্ট ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে তাই এটা একদম খাপ খায়না ।