State Capitalism
সমস্ত ব্যবস্থার পতনশীলতার পযায়ে সমাজব্যবস্থার দ্বন্দ্বগুলো বিস্ফোরনমুখী হয়ে উঠলে, নির্ধারক (dominant) উৎপাদন সম্পর্ক বজায় রাখার উদ্দেশ্যে সমাজসত্তার সংহতি রক্ষার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে হয় রাষ্ট্রকে । নিজেকে ক্রমাগত জোরদার করে তোলার প্রবণতা দেখা যায় রাষ্ট্রের মধ্যে যাতে করে শেষ পযন্ত সমাজজীবনের সব কিছুকে স্ফীতকায় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলোর ভিতরে সমাহিত (incorporate) ক'রে নেওয়া যায় । রোমান সাম্রাজ্যের প্রশাসন ব্যবস্থা এবং সাবর্ভৌম রাজতন্ত্রের স্ফীতকায় বৃদ্ধি যথাক্রমে রোমান দাস সমাজ ও সামন্ত সমাজের পতনশীলতার যুগে এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যেরই অভিব্যক্তি ছিল । পুঁজির পতনশীলতার যুগে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী হয়ে ওঠার সাধারণ একটা প্রবণতা সমাজ জীবনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে । অব্যাহত বিকাশ ও বিস্তৃতি অসম্ভব হয়ে পড়ায় , সাম্রাজ্যবাদী প্রতিদ্বন্দ্বিতার তীব্রতা বৃদ্ধির পরিস্থিতিতে,অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা এবং আভ্যন্তরীন ক্ষেত্রে সামাজিক দ্বন্দ্বগুলোর বেড়ে ওঠা ও বিস্ফোরনের মোকাবিলার উদ্দেশ্যে প্রত্যেকটি রাষ্ট্রীয় পুঁজিই যতটা সম্ভব সুদক্ষভাবে নিজেকে সংগঠিত করতে বাধ্য হয়। এই সব কাজ করতে সক্ষম সমাজের একমাত্র শক্তিই হচ্ছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রই কেবল পারে :
- বিশ্ববাজারের প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়ানোর ক্ষমতাকে জোরদার করার উদ্দেশ্যে,অর্থব্যবস্থার দূর্বলতার জন্য দায়ী আভ্যন্তরীন প্রতিযোগিতাকে প্রশমিত করতে এবং সামগ্রিক এক কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির দায়িত্ব নিতে ।
- ক্রমবর্ধমান আর্ন্তজাতিক বিরোধ ও সংঘর্ষের পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সামরিক শক্তির বিকাশ ঘটাতে।
- সবশেষে,বেশি বেশি পীড়নমূলক ও আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্রের বলে বলীয়ান হয়ে,অর্থনৈতিক ভিত্তির ক্রমবর্ধমান পচনশীলতার ফলে বিচ্ছিন্নতায় আক্রান্ত সামাজিক সংহতিকে রক্ষা ও জোরদার করতে । মানবিক সম্পর্কগুলোকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিয়ন্ত্রনের অক্ষমতা বেড়ে চলে যে সমাজব্যবস্থায়,যে ব্যবস্থা সমাজের অস্তিত্বের পক্ষেই ক্রমাগত বেশি বিপজ্জনক ,অযৌক্তিক হয়ে ওঠার সাথে সাথে বেশি বেশি প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয় ,তাকে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা রাষ্ট্র কেবল করতে পারে সর্বব্যাপক হিংসা ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে ।
রাষ্ট্র কর্তৃক উৎপাদনের চরম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোর অধিগ্রহণের মাধ্যমেই প্রতিফলিত হয় অর্থনৈতিক স্তরে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের প্রবণতা । যদিও তা কখনোই সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয় না । এর মানে এই নয় যে , মূল্যের নিয়ম(Law of value) প্রতিযোগিতা অথবা উৎপাদনের নৈরাজ্যের মত পুঁজিবাদী অর্থনীতির মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো আর ক্রিয়াশীল থাকেনা । বাজারের নিয়ম গুলো তখনো সব জায়গাতেই বহাল তবিয়তেই থেকে যায় এবং যতই রাষ্ট্রীয়কৃত (Statified) বা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন হোক না কেন,প্রতিটি জাতীয়অর্থনীতির উৎপাদনের অবস্থার নির্ণায়ক অবস্থানে থাকে বলে , সারা দুনিয়ার পটভূমিতেএই বৈশিষ্ট্যগুলো বাস্তবায়িত হতে থাকে । মূল্য ও প্রতিযোগিতার নিয়মগুলো কোথাও অকেজো করে দেওয়া হয়েছে বা উল্লঙ্ঘন করা হয়েছে মনে হলে এটাই ধ'রে নিতে হবে যে , বিশ্বপটভূমিতে ওগুলোর প্রভাব আরো জোরদার হয়ে উঠবে । রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার দরুন কোথাও খানিকটা প্রশমিত মনে হলেও বিশ্বপটভূমিতে উৎপাদনের নৈরাজ্য আরো মারাত্মক রূপে ফিরে আসে, বিশেষ করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার তীব্র সংকট কালে, যাকে নিবৃত্ত করার কোন ক্ষমতা নেই রাষ্ট্রীয়পুঁজিবাদের। বিজ্ঞানসম্মত ভাবে পুনর্গঠনের (rationalization) প্রক্রিয়ার সূচক হওয়া তো দূরের কথা, রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ পুঁজির অবক্ষয়ের অভিব্যক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়।
পুঁজির রাষ্ট্রীয়করনের প্রক্রিয়া দুইভাবে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে । সব থেকে উন্নত দেশগুলোতে এটা ঘটে সাধারনত ‘ব্যক্তিগত' এবং রাষ্ট্রীয় পুঁজির ক্রমাগত (gradual) মিলনের মাধ্যমে ।
অন্যদিকে সাধারণভাবে সব থেকে দূবর্ল ব্যক্তিগত পুঁজির দেশগুলোতে হঠাৎ একলাফেই বিশালাকার ও সম্পূর্ণ জাতীয়করণের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয় এই প্রক্রিয়া ।
বাস্তব ক্ষেত্রে যদিও পৃথিবীর সবর্ত্রই রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের প্রবনতার প্রকাশ ঘটে ,কোনো দেশ পতনশীলতার ফলে মারাত্মক ভাবে বির্পযস্ত হয়ে পড়ার সময়ে এটা বেশি দ্রুত ও স্পষ্ট হয়ে ওঠে । ঐতিহাসিকভাবে প্রকাশ্য সংকট (Open crisis) অথবা যুদ্ধের সময় এবং ভৌগোলিকভাবে দূবর্লতম আর্থিকব্যবস্থার দেশ গুলোতে এটা ঘটে থাকে । কিন্তু রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ শুধুমাত্র পিছিয়ে পড়া দেশগুলোরই নির্দিষ্ট বৈশিষ্টসূচক কোনো ব্যাপার নয় । বিপরীতে বরং বেশি বিকশিত দেশগুলোতে পুঁজিরকেন্দ্রীভবন (concentration) - এর উচ্চমাত্রার ফলে অর্থনেতিক জীবনের উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রন সাধারনভাবে অনেকবেশি কাযর্কর হয় যদিও পশ্চাদপদ পুঁজির ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক (formal) রাষ্ট্রীয়করণ বা জাতীয়করনের মাত্রা প্রায়ই বেশি হয়ে থাকে । সমাজ জীবনের সবর্ত্র সবকিছুর উপর রাষ্ট্রযন্ত্রের বিশেষ করে আমলাতান্ত্রিক-প্রশাসনিক কাঠামোর বেশি
বেশি সুব্যবস্থিত ও জোরালো নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে, কোথাও বা এটা ফ্যাসিবাদ বা স্তালিনবাদের মত চূড়ান্ত,সবর্গ্রাসী একচ্ছত্র আধিপত্যকামি রূপে ঘটে থাকে আবার অন্য কোথাও ঘটে গণতন্ত্রের মুখোশের আড়ালে।রোমের বা সামন্ততন্ত্রের পতনশীলতার যুগের তুলনায় অনেক অনেক বেশি পরিমানে বিকটাকার,দানবীয়,আবেগহীন ,নৈব্যর্ক্তিক যন্ত্রবিশেষ হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকের রাষ্ট্র আর গ্রাস করে নিয়েছে নাগরিক জীবনের সারবস্তুকেই।