২০১০-র ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে আইসিসি তার এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অবস্থিত সেকসনগুলোকে নিয়ে একটি সম্মেলন করে। সম্মেলনে ফিলিপাইন্স, তুর্কি এবং ভারতের সেকসনগুলোর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আইসিসির প্রতি সহমর্মী ছাত্র, যুব এবং শ্রমিকেরা উপস্থিত ছিলেন; ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার একটি আন্তর্জাতিকতাবাদী গ্রুপের প্রতিনিধিও। কোরিয়ার দুটি ইন্টারন্যাশানালিস্ট গ্রুপ যাঁরা আইসিসির কংগ্রেসে উপস্থিত ছিলেন তাঁরাও আমন্ত্রিত ছিলেন কিন্তু তাঁরা শেষপর্যন্ত উপস্থিত হতে পারেননি, তবে সম্মেলনের প্রতি তাঁদের সংহতি ও শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন তাঁরা। পাঠিয়েছেন কোরিয়ার শ্রেণিসংগ্রামের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে একটি বিবৃতি।
এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য আইসিসির অষ্টাদশ কংগ্রেসে নির্ধারিতকর্তব্যগুলো সমাধা করার কাজটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী যে আন্তর্জাতিকতাবাহিনীর উদ্ভব ঘটছে তার ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যুক্ত হওয়া এবং সেই ক্রিয়াকলাপের আরো বিকাশ ঘটানোও এই সম্মেলনের একটি লক্ষ্য। আইসিসির ১৮তম কংগ্রেসে আন্তর্জাতিকতাবাদী গ্রুপ এবং মিল্যুর(milieu) মধ্যে সহযোগিতার বিকাশ ঘটানো বর্তমানে আমাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে স্থির হয়েছিল। এই সম্মেলনেও তাই এটা একটা মুখ্য ফোকাস হিসাবে কাজ করেছে।
একটা গভীর দুঃখের খবর দিয়ে সম্মেলন শুরু হয়। আমরা জানতে পারি মাত্র দুদিন আগে আমাদের ইউএস(USA) সেকসনের কমরেড জেরি মারা গেছেন। তিনি ছিলেন আমেরিকান সেকসনের একটি স্তম্ভস্বরূপ, বহু বছর ধরে তিনি আইসিসির কাজ করে গেছেন। সম্মেলন তাঁর পরিবার এবং সেকসনের প্রতি সৌভ্রাতৃত্ব জ্ঞাপন করে।
কনফারেন্সে প্রদত্ত রিপোর্ট (Reports to the Pan Asian Conference):
কনফারেন্সে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নানা বিষয়ে রিপোর্ট পেশ করা হয়। যেমন, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট,এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী বিরোধ, আইসিসির কর্মকান্ড। এছাড়া প্রলেতারীয় বিতর্কের অনুশীলন ও অভ্যাস এবং তত্ত্বের প্রতি আগ্রহ, ভারত এবং ফিলিপাইন্সের জাতীয় অবস্থা এবং শ্রেণি সংগ্রাম, এশিয়ার বিভিন্ন সেকশনের কাজকর্ম ইত্যাদি বিষয়ে রিপোর্ট পেশ করা হয়।
তিনদিন ধ’রে এই সমস্ত রিপোর্ট এবং সেসব থেকে উ্ঠে আসা প্রশ্নগুলো নিয়ে গভীর আগ্রহ ও আন্তরিকতাসহ আলোচনা ও ডিবেট চলে। তবুও আলোচ্য সমস্ত প্রশ্নে যথেষ্ট গভীরতায় ও স্বচ্ছতায় পৌঁছনো যায়নি। এখানে সমস্ত আলোচনার বিশদে যাওয়া যাবে না তবে তুলনামূলকভাবে গুরুত্ত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে আমরা আমাদের রিপোর্ট পেশ করবো।
এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী বিরোধ(Imperialist Rivalries in Asia)
বিশদ রিপোর্ট আমাদের ইংরাজী সাইট (en.internationalism.org)-এ পাওয়া যাবে। এবিষয়ে পেশ করা রিপোর্ট আমাদের ১৮তম কংগ্রেসে “সাম্রাজ্যবাদী টেনসন” বিষয়ে প্রদত্ত রিপোর্টের মূল দৃষ্টিভঙ্গীর ওপরে ভিত্তি করেই রচিত এবং আলোচিত।
ইউএসের(USA) ক্ষমতা ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়ছে অন্যদিকে চীন আন্তর্জাতিকস্তরে একটা গুরুত্ত্বপূর্ণ পাওয়ার হয়ে উঠছে। এই বিষয়টা আলোচনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। পাশাপাশি এশিয়াতে সাম্রাজ্যবাদী আঁতাত এবং দ্বন্দ্ব-বিরোধে এর প্রভাব কী হতে পারে তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করা হয় এই আলোচনায়।
সম্মেলনে এবিষয়ে কারো কোন সন্দেহই ছিল না যে আমেরিকা ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়া সত্ত্বেও এখনও সেটা বিশ্বে এক নম্বর মহাশক্তিধর দেশ এবং চীনের এই মুহূর্তে আমেরিকাকে সম্মুখসমরে মোকাবিলা করার সামর্থ বা ইচ্ছা কোনটাই নেই। চীন কতটা দ্রুতগতিতে মহাশক্তি হিসাবে উথ্থানের পথে এগিয়ে চলেছে এবং এখনই বা অদূর ভবিষ্যতে সে আমেরিকাকে চ্যালেন্জ করতে পারবে কিনা এই বিষয়টার ওপর কয়েকজন দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
কনফারেন্সে এ্শিয়ায় ক্রমবর্দ্ধমান সমরসজ্জা ও সামরিকীকরণের ওপর গুরুত্ত্বপূর্ণ বিতর্ক হয়। পৃথিবীর মধ্যে এশিয়া এখন অস্ত্র-শস্ত্রের অন্যতম প্রধান বাজার হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীন যুদ্ধাস্ত্রে বিনিয়োগের ব্যাপারে এক নম্বরে এটা ঠিকই, তবে, ভারত, সৌদি আরব, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশগুলোও এব্যাপারে পিছিয়ে নেই। চীন এবং ভারতের বর্তমান অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও গুরুত্ব এবং ক্রমবর্ধিত সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্খাই তাদের এই বেশি বেশি সমরাস্ত্রসজ্জিত হওয়ার মূল কারণ। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার ক্রমবর্ধমান মিলিটারাইজেসনের পিছনে আমেরিকার পতনোন্মুখ অবস্থা এবং চীন দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা একটা বড় কারণ।
বর্তমানে ইউএসএ আফগান-পাক যুদ্ধের প্রতিই বেশি নজর দিচ্ছে। এটা ঠিকই যে আমেরিকা আফগানিস্তানের পরিস্থিতিকে অস্থিরতামুক্ত ও সুনিয়ন্ত্রিত করতে চাইছে কিন্তু আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানই এখন আমেরিকার বেশি দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কনফারেন্সের কাছে এটাও পরিষ্কার যে আমেরিকা এখনই আফগানিস্তান পাকিস্তানের রণাঙ্গণ ছেড়ে যাচ্ছে না এবং ভবিষ্যতে সেনা সংখ্যা কমালেও আফগানিস্তানে তাদের নিয়ন্ত্রণকারী ভূমিকা বজায় রেখেই চলবে।
আলোচনায় দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদীজোটের ভাঙা গড়ার প্রক্রিয়াটির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। ভারত ও পাকিস্তানের পারস্পরিক তিক্ত ও মারাত্মক রেষারেষি শুধু আজকের নয়, সবসময়ের। এটা এখন আফগানিস্তানে দুজনের মধ্যেকার পরোক্ষযুদ্ধে প্রসারলাভ করেছে।এই্ দুই দেশ পরস্পরের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হতে না চাইলেও তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের(volatile) চরিত্রটা মাথায় রেখে বলা যায় যেকোন সময় হঠাতই সামরিক সংঘাত বেধে যাওয়ার বিপদ সম্পর্কে আমাদের সতর্ক থাকা দরকার যেমন ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে আক্রমণের পর দুদেশের মধ্যে সামরিক সংঘাতের সম্ভাবনা এক লাফে অনেকখানি বেড়ে গিয়েছিল।
গত কয়েক বছর ধরে চীন ও ভারতের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ সংঘাত বেড়ে চলেছে। ফলে ভারত, আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কটা আরো গভীর ও বিস্তৃত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বর্তমান ঐতিহাসিক যুগে “চাচা আপন প্রাণ বাঁচা”র প্রবণতা দারুণভাবে জোরদার হওয়ার ফলে এই সম্পর্কেও ভাটার টান দেখা দিয়েছে। ভারত এখন রাশিয়ার মত পুরোণো মিত্রদের দিকে ঝুঁকতে চাইছে।
আলোচনায় অন্যান্য যেসব বিষয় উঠে আসে তার মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোও আছে:
-জাতীয়তাবাদ এবং জাতীয় দ্বন্দ্ব কে শ্রমিকশ্রেণির বিরুদ্ধে ব্যবহার করা
-সংকট এবং সাম্রাজ্যবাদী টানাপোড়েনের মধ্যে সম্পর্ক।
-পুঁজিবাদের পচন এবং(Post war imperialist block)ব্লক ভেঙে যাওয়ার পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা এবং “চাচা আপন প্রাণ বাঁচা” এই প্রবণতাবৃদ্ধি।
শ্রেণি-সংগ্রাম (Class Struggle )
কনফারেন্সের অংশগ্রহণকারীরা এই বিষয় নিয়ে অত্যন্ত উজ্জীবিত ছিলেন। উপস্থাপনায় আন্তর্জাতিকভাবে আজকের শ্রেণি সংগ্রামের পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়।
২০০৩ সালে শ্রমিকশ্রেণি শ্রেণি-সংগ্রামের একটি নতুন বাঁকে(turning point) উপস্থিত হয়েছে। এসময় শ্রেণি নতুন ক’রে বুরজোয়ার বিরুদ্ধে তার প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করে। কিন্তু ২০০৮-এ আকস্মিক প্লাবনের মত সংকট আছড়ে পড়ল। এর ফলে এক লহমায় শ্রমিকশ্রেণির ওপর নেমে আসা তীব্র আক্রমণগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে শ্রমিকশ্রেণি কিছুটা যেন হতচকিত, আতঙ্কিত, দ্বিধাগ্রস্ত বা কিছুটা যেন অবশ(paralized) হয়ে পড়ল। এখন প্রশ্ন শ্রেণি কি এই অবস্থাটা অতিক্রম করতে পেরেছে? ইউএস এবং ইউরোপে যে নেতিবাচক প্রভাব শ্রমিকশ্রেণির ওপর পড়েছে, এশিয়ার শ্রমিকশ্রেণির ওপর কি তার প্রভাব একইরকম? বর্তমান পরিস্থিতি কি ভয় এবং থমকে থাকা অবস্থা থেকে বাইরে আসার ইঙ্গিত দিচ্ছে? এসবের সুনির্দিষ্ট উত্তর যদিও আসে নি তবে সাধারণভাবে আলোচনায় একথা উঠে এসেছে যে বর্তমান সংগ্রাম তার সাময়িক ছত্রভঙ্গ অবস্থা থেকে মুক্ত হবার প্রয়াসকেই সূচিত করছে। তাছাড়া আজকের সংগ্রামগুলো আন্তর্জাতিকস্তরে বিকশিত হবার দিকেই প্রসারিত এবং এই সংগ্রাম একটা বা দুটো দেশের ব্যাপার নয় সারা পৃথিবীতেই তা গড়ে উঠছে।
পাশাপাশি আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে সংগ্রামের ধীরগতি বিকাশের প্রশ্নটা। ১৯৬৮ এবং তার পরবর্তী সময়ের তুলনায় আজকের সংগ্রামে শ্রেণির আত্মবিশ্বাসের ধীরগতি বিকাশের দিকটাও আলোচনায় উঠে আসে। ২০০৩ –এ শ্রেণির পুনরায় (historical)মঞ্চে আসার সময় থেকেই ধীরে ধীরে পরিণত হয়ে ওঠার ব্যাপারটা একটা বৈশিষ্ট হিসাবেই পরিলক্ষ্যিত হচ্ছে।আজ অব্দি এইধারা বজায় আছে। এর কারণ আজকের দিনে সংগ্রামের বর্শামুখের প্রকৃতি: সাধারণভাবে এই সঠিক বিশ্বাস আছে যে এই অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির কোন সম্ভাবনা আর নেই; আর তাই এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শ্রেণিকে এই সংকটের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে এবং তার থেকে উঠে আসা শিক্ষাগুলো সারসংকলন করতে হচ্ছে।
আলোচনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে সংকটের গভীরতার সঙ্গে শ্রেণির প্রতিক্রিয়ার কোন যান্ত্রিক সম্পর্ক নেই; তাই এটা ভাবা ঠিক নয় যে সংকট গভীর হলেই শ্রমিকশ্রেণির প্রতিক্রিয়াও তৎক্ষণাৎ বিশাল বিস্ফোরণের আকারে ফেটে পড়বে। তাসত্ত্বেও ইউরোপসহ বিশ্বের অন্যান্য অংশের সাথে সাথে ভারতেও কিছুকিছু সংগ্রামে শ্রেণি-সংহতির সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটছে। পরপর ঘটতে থাকা সংগ্রামগুলো থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্র (sector)-র মধ্যে সংগ্রাম বিস্তারের সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে।
তুরকি, ফিলিপাইন্স এবং ভারতের শ্রেণিসংগ্রাম বিষয়েও কিছু বিশেষ আলোচনা হয়। ভারতে বিশেষতঃ গুরগাঁও-এ অটো কোম্পানীর শ্রমিকের আন্দোলন, গুজরাটের হীরা শ্রমিকদের আন্দোলন আলোচিত হয়। তবে সবার মধ্যে একটা অনুভূতি ছিল যে আলোচনাটা আরো গভীরে যাওয়ার দরকার ছিল। বিশেষতঃ শ্রেণির মধ্যে সচেতনতা বিকাশের ব্যাপক প্রয়াস কিভাবে সম্ভব হয় এবং কিভাবেই বা শ্রেণি মাস-স্ট্রাইকের স্তরে পৌঁছবে এইদিকগুলো আলোচিত হওয়া এবং বোঝা দরকার। এইদিকটাকে সামনে রেখে রিজলিউসন(resolution) নেওয়া হয় যে কনফারেন্সের পরে এনিয়ে আলোচনা এবং বিতর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।
ভারত এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর বিশেষত্ব নিয়েও আলোচনা হয়:
ভারত, চীন এবং অন্যান্য এশিয়ান দেশগুলোয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি (boom ) নিয়ে বুর্জোয়া প্রচারের প্রভাব;
জাতীয়তাবাদ এবং জাতিগত বিভাজন এবং তার দরুন লেগে থাকা দ্বন্দ্ব;
নানবিধ ধর্ম, জাতপাত এবং বহুবিধ ভাষার প্রভাব;
বিশাল সংখ্যক জনগন কৃষক;
কিভাবে শ্রেণির কাছে আমাদের বক্তব্য নি্য়ে যাওয়া হবে এই প্রশ্ন গুরুত্ব পায়; আইসিসির এবং এশিয়ার অন্তর্গত তার বিভিন্ন সেকশনের কাজকর্ম সংক্রান্ত আলোচনায় এই প্রশ্ন আরো বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়।
আইসিসির জীবনধারা (Life of the ICC)
ল্যাটিন আমেরিকায় আন্তর্জাতিকতাবাদী কিছু গ্রুপ এবং ব্যক্তির সঙ্গে চলা কাজের উল্লেখসহ প্রসঙ্গটি উপস্থাপিত হয়। এ প্রসঙ্গে কালচার অফ ডিবেট, টেস্ট ফর থিয়োরি, ট্রান্সমিসন অফ এক্সপেরিয়েন্স, মানবিক দৃষ্টিকোণ এবং বস্তুগত পরিস্থিতির ভিত্তিতে একজন সদস্যের কার্যকলাপের মূল্যায়ন ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হয়।
আন্তর্জাতিক বিপ্লবী সংগঠনের ধারার মধ্যে শুধু আইসিসি নেই; এর মধ্যে নানাবিধ ধারাবাহিকতার ভেতর দিয়ে উঠে আসা অন্যান্য আন্তর্জাতিকতাবাদী গ্রুপ আছে। আইসিসি সামগ্রিকভাবে এই শক্তিটাকে আরো শক্তিশালী ক’রে তোলার চেষ্টা করছে, এর ভেতরে থাকা বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করতে চাইছে । ভবিষ্যতেও এই একসাথে কাজ করার ব্যাপারটাকে বাড়িয়ে তোলার জন্য সক্রিয় হওয়া অবশ্যই দরকার। সামগ্রিকভাবে আন্তর্জাতিকতাবাদী এই শক্তিটার আরো শক্তিশালী হওয়া মানে আমাদেরও শক্তিশালী হয়ে ওঠা।
বিতর্কের অনুশীলন ও অভ্যাস, তত্ত্বের প্রতি আগ্রহ এবং অভিজ্ঞতার সঞ্চালন ও আদান প্রদান(Culture of Debate, Taste for Theory and Transmission of Experience)
এই আলোচনায় একথা মনে করা হয় যে শ্রমিক শ্রেণি সচেতনতা অর্জনে সক্ষম শ্রেণি। শ্রেণি সচেতনতার ক্রমাগত বিকাশ না ঘটিয়ে এবং দুনিয়াজোড়া ঐতিহাসিক শ্রেণি-সংগ্রামের অভিজ্ঞতার সারসংকলন না ক’রে শ্রমিক শ্রেণি তার সংগ্রামকে পূর্ণ বিকশিত করতে এবং পুঁজিবাদ উচ্ছেদের কাজ সফল করতে পারে না।
ঐতিহাসিক এই অভিজ্ঞতার প্রাসঙ্গিকতাকে সামনে রেখে এবং বর্তমানে বিপ্লবী দিশার খোঁজে থাকা মানুষজনের সংখ্যা বাড়তে থাকার বাস্তবতাকে লক্ষ্য ক’রে শ্রমিক-শ্রেণির সংগ্রাম,সংগঠন এবং সচেতনতার অভিজ্ঞতা এই নতুন প্রজন্মে সঞ্চালিত করার কাজে আইসিসির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে ব’লে আইসিসি মনে করে। সর্বত্রই এই ট্রান্সমিসনের কাজ গুরুত্বপূর্ণ; এশিয়ায় যেখানে কোনদিনই কোন কম্যুনিস্ট সংগঠন ছিল না, যেখানে বামপন্থী এবং জাতীয়তাবাদী শক্তি সর্বদাই নিজেদেরকে কম্যুনিস্ট হিসাবে উপস্থিত করেছে সেখানে এই কাজ আরো বিশেষভাবে জরুরী।
কিন্তু এই কাজটা ইস্কুল-মাস্টারী করার মত একমুখী বিষয় নয় যে শিক্ষক শুধু শিক্ষা দিয়ে যাবেন আর স্টুডেন্টরা তা গ্রহণ করবে। বিপরীতে এ হ’ল একটা বিপ্লবী কাজ। এই প্রক্রিয়া সর্বদাই দ্বিমুখী। একাজ করতে গেলে নতুন প্রজন্ম কী বলতে চাইছে তা গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করতে হবে এবং গুরুত্ব দিতে হবে। যেসব নতুন প্রশ্ন উঠে আসছে সেগুলোর প্রতি চিন্তার জগৎ খোলা রাখতে হবে, খোলা মনে ভাবতে হবে এবং তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে,যেসব নতুন সমস্যা দেখা দিচ্ছে সেগুলো নতুনভাবে খোলামনে বোঝার চেষ্টা করতে হবে, ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার সঞ্চালনের উদ্দেশ্যে আইসিসির অভ্যন্তরে এবং চারপাশের অনিসন্ধিৎসু মানুষজনের মধ্যে বিতর্কের পরিমন্ডল গড়ে তুলতে হবে। তত্ত্বের প্রতি আগ্রহ সৃজনও এই প্রক্রিয়ার একটা অংশ। উপস্থিতদের একটা বড় অংশই এর প্রাসঙ্গিকতাকে তুলে ধরেন।
এক্ষেত্রে উনবিংশ শতকের শেষভাগের এবং বিংশ শতকের শুরুর দিককার বিপ্লবী সংগ্রামের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করা হয়। এই সময়ে বিপ্লবীরা শুধু শ্রেণির ও শ্রেণি সংগ্রামের বস্তুগত অবস্থাই স্টাডি করেছেন তা নয়, সমসাময়িক বিজ্ঞানের বিকাশ সম্পর্কেও যথেষ্ট অধ্যয়ন করেছেন, বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গীতে সেসব পর্যালোচনা করেছেন, সার সংকলন করেছেন, শ্রেণির তাত্ত্বিক সচেতনতা বিকাশে কাজে লাগিয়েছেন। এই সময়টায় গভীর তাত্ত্বিক আগ্রহ এবং অনুশীলন হয়ে উঠেছিল বিপ্লবী কর্মকান্ডের গুরুত্ত্বপূর্ণ অংশ।
আজ, দীর্ঘ প্রতিবিপ্লবী পর্যায় পার করার পর এই কাজ কঠিন ব’লেই মনে হয়। তবে শ্রমিকশ্রেণিকে যদি তার ঐতিহাসিক লক্ষ্যে পৌঁছোতে হয় তাহলে তাকে অবশ্যই এই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতেই হবে।
বিতর্কের পরিমন্ডল গড়ে তোলা বা তত্ত্বের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে তোলার পথে বাধাগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। কতকগুলো ইম্পর্ট্যান্ট বাধা হল:
· বুরজোয়া মতাদর্শের প্রভাব;
· পুঁজির পচনশীলতার পর্যায়ের প্রভাব যা সুসংহত চিন্তাধারা গড়ে তোলাকে অবদমিত করে।
· ভারতের মত দেশে সামন্ততান্ত্রিক এবং জাতপাতগত ঐতিহ্য ‘গুরুজনদের’ মেনে চলা, ‘গুরু’কে অনুসরণ করা ইত্যাদি ধ্যান-ধারণাকে জোরদার করে, বিপরীতে নিজের স্বাধীনভাবে চিন্তাকরা ও সবকিছুকে প্রশ্ন করার প্রবণতাকে অবদমিত করে।
· মাওবাদের প্রভাব: একটি বুরজোয়া ধারা হিসাবে এটি ‘নেতাকে মান্য ক’রে চল” এই নীতিকেই প্রতিষ্ঠা করে, শ্রমিক শ্রেণির ইতিহাস ও তত্ত্বের প্রতি আগ্রহটাকে খুবই সন্দেহজনক চোখে দেখে।
মাওবাদী অভিজ্ঞতা যাদের আছে সেইসব কমরেডরা মনে করিয়ে দেন মাওবাদী ‘থিসিস’টার কথা যাতে বলা হয়েছে: “ যত পড়বে তত বোকা বনবে”
সচেতনভাবে ডিবেটের কালচার গড়ে তোলা এবং তত্ত্বের প্রতি আগ্রহ বিকশিত করার প্রয়োজনীয়তার প্রতি আলোকপাত করা হয়। বলা হয় নতুন প্রজন্মে অভিজ্ঞতার সঞ্চালন এবং তাদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন করার কাজে উপরোক্ত কাজের গুরুত্ত্ব অনস্বীকার্য।
বিপ্লবীদের কাজের গভীর মানবিক চরিত্র (The profoundly human character of militant activity)
আইসিসির জীবনছন্দের অন্তর্গত অপর একটি প্রশ্ন আলোচনায় জায়গা করে নেয়: এটা হল একটা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তার বাহিনীর কাজকে দেখার প্রশ্ন। আমাদের রাজনৈতিক অনুশীলন এবং সামাজিক জীবনযাপন এই দুয়ের মধ্যে যেকোন রকম বিভেদ রেখা টানার প্রয়াসকে আলোচনায় বেঠিক ব’লে চিহ্নিত করা হয়। একইসঙ্গে পুঁজিবাদের অভ্যন্তরে কম্যুনিজমের কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ বানানোর আইডিয়াকেও যৌক্তিকভাবে পরিত্যাগ করা হয়। পাশাপাশি এটাও বলা হয় যে আমাদের জীবনযাপন প্রণালী কম্যুনিজমের মূলদিকগুলোর একদম বিপরীতও হতে পারে না।
নারীদের প্রসঙ্গও একট বিশেষ জায়গা করে নেয়। এক্ষেত্রে সাধারণভাবে সকল নারীর এবং বিশেষভাবে যাঁরা বিপ্লবী কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত মানুষজনের অংশ সেইসব নারীদের প্রতি কম্যুনিস্টদের দৃষ্টিভঙ্গী কী হওয়া উচিত সেবিষয়ে আলোকপাত করা হয়। বিপ্লবীদের এই কনফারেন্সে এই বিষয়টা অনেক সুদূর ভবিষ্যতের ব্যাপারে বিতর্কের বিষয় ব’লে মনে হলেও এটা ঠিক যে ভারত, তুর্কি এবং ফিলিপাইন্সে মেয়েদের প্রতি সামন্ততান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর একটা বিষময় প্রভাব আছে এবং সেদিক থেকেই বিষয়টার প্রাসঙ্গিকতা আছে। প্রকৃতপক্ষে আইসিসির প্রতি সহমর্মী একজন মহিলা সাথী প্রশ্নটাকে সজোরে সামনে আনেন। তিনি দেখান পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব ভারতে আইসিসির সহমর্মী মানুষজনের মধ্যেও বিদ্যমান।
সময়াভাবে এই্ আলোচনা বেশিদূর এগোয়নি তবে সেকসনগুলোকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয় যাতে তারা এ বিষয়ে সেকসনে আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যায়।
ইন্টারভেনসন (Intervention):
ফিলিপাইন্সে সদ্যজাত সেকসন দ্বারা যে বিপুল কাজ ইতোমধ্যেই করা হয়েছে তাকে কনফারেন্স স্যালুট জানায়। বিশেষত, যে পরিস্থিতির মধ্যে সেকসনকে এই কাজ করতে হয়: আধা বে-আইনি অবস্থার মধ্যে, রাষ্ট্রীয় এবং বাম ডান নানা দলের নিজস্ব সেনাবাহিনীর দ্বারা নিপীড়ণের থ্রেটকে মাথায় রেখে এবং খুবই কষ্টকর অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে সংগ্রাম ক’রেই এইসব কাজ করে চলতে হয়।
ইন্টারভেনসনের প্রশ্নে দীর্ঘ, প্রাণবন্ত বিতর্ক চলে। এই আলোচনা অনেকগুলো প্রশ্নে স্বচ্ছতা এনে দেয়:
ইন্টারভেনসনের নানা হাতিয়ার এবং রূপ যথা পামফ্লেট(pamphlet), পত্র-পত্রিকা, লিফলেট, আলোচনা চক্র, কনট্যাক্ট মিটিং, পাবলিক মিটিং ইত্যাদি।
তাত্ত্বিক দিক থেকে স্বচ্ছতা এবং গভীরতা অর্জন ইন্টারভেনসনের অপরিহার্য অঙ্গ এবং রূপ।
থিয়োরি এবং প্র্যাকটিসের মধ্যে ঐক্য।
এই আলোচনার একটি সুনির্দিষ্ট প্রসঙ্গ ছিল ভারতে থাকা সেকসনের কাজকর্মের একটি ব্যালান্স সীট উপস্থাপন। এই মূল্যায়ণে উল্লেখ করা হয় যে:
গত কয়েকটা বছর সেকসন সংখ্যার দিক থেকে বেড়ে ওঠা এবং ভারতের বিভিন্ন জায়গায় সংগঠন গড়ে তোলার ওপরই বিশেষ জোর দেয়।
ভারতের বিভিন্ন জায়গায় উদীয়মান নতুন অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিদের সঙ্গে ফলপ্রসূ এবং গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা আলাপ আলোচনা চালানো গেছে। এতে ক’রে ভারতে কম্যুনিস্ট চিন্তাভাবনার প্রভাব ছড়ানোর কাজই করা হয়েছে এবং তা আইসিসির আন্তর্জাতিক কর্মকান্ডকেই প্রসারিত করেছে।
পাশাপাশি মূল্যায়নের খাতায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ দুর্বলতা চিহ্নিত হয়েছে, যেমন:
এখনও অব্দি ভারতে রেগুলার প্রকাশনার কাজ শুরু করতে না পারা।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহে আমাদের ইন্টারভেনসন অনিয়মিতই থেকে গেছে। ভারতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু শ্রমিক আন্দোলনে আমাদের কোন ইন্টারভেনসনই হয়নি।
শেষোক্ত ব্যাপারটা নিয়ে আইসিসিরই কিছু সহমর্মীও প্রশ্ন তোলেন; এতে আলোচনাটা আরো গভীরতা পায়।
এই ডিসকাসন্টা আমাদের সহমর্মী এবং সেকসন উভয়ের পক্ষেই খুবই উৎসাহব্যঞ্জক হয়ে ওঠে। সহমর্মী কমরেডরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আইসিসির জন্য লিখতে, আইসিসির নানা টেক্সট অনুবাদ করতে, পত্রিকা বিলানোর কাজে সাহায্য করতে এবং শ্রেণি-সংগ্রামে ইন্টারভেইন করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
উপসংহার (Conclusion)
সংগঠনের জীবনে প্যান এশিয়ান কনফারেন্স একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত এবং এশিয়ায় কম্যুনিস্ট ভাবধারা এবং সংগঠন বিস্তারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পথপ্রদর্শক হয়ে রইল। যদিও সংখ্যাগতভাবে বিশাল কিছু নয়, তবুও সম্ভবত এশিয়ায় এখনও অব্দি এটাই কমিউনিস্ট এবং আন্তর্জাতিকতাবাদীদের সবচেয়ে বড় জমায়েত। আইসিসির অনেক সহযোদ্ধা ও সহমর্মীদের কাছে আইসিসির আন্তর্জাতিক সভায় থাকার এটাই প্রথম অভিজ্ঞতা। কমরেডদের মনে হয়েছে এটা যেন আইসিসির কংগ্রেসের ছোট সংস্করণ।
অস্ট্রেলিয়া থেকে আগত প্রতিনিধি এবং অন্যান্য সহমর্মীদের কাছে এই সম্মেলন এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। তাদের মতে এই সম্মেলন তাদের কাছে এমন একটা সংগঠন সম্বন্ধে বাস্তব অভিজ্ঞতা যেটা শুধু আন্তর্জাতকতাবাদীই নয়, তাদের কর্মক্ষেত্রে তারা সত্যিসত্যিই আন্তর্জাতিক। অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা তরুণ কমরেডের ভাষায় এই কনফারেন্সের অভিজ্ঞতা তার জীবনের দিশাটাকেই বদলে দিয়েছে এবং কমিউনিস্ট হিসাবে কাজ করার প্রশ্নটা নতুনভাবে হাজির করেছে।
সম্মেলনের শেষে ভারতের একজন সহমর্মী সাথী সম্মেলন সম্বন্ধে তার মনোভাব ব্যক্ত করেছেন এইভাবে: “ সম্মেলন চলাকালীন আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমি আমার দেশে আছি। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বিপ্লবী সাথীদের সঙ্গে কাজ ও আলোচনা করতে করতে অনুভব করছিলাম আমি আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণির জীবন এবং সংগ্রামেরই অংশ”
এই অনুভবটা আসলে সকলের মধ্যেই ব্যপ্ত ছিল। এই প্যান এশিয়ান কনফারেন্স সকলের মধ্যে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সংগ্রাম গড়ে তোলার লক্ষ্যে স্বচ্ছতা এবং উদ্দীপনা জুগিয়েছে।
সাকি, ৪ই এপ্রিল, ২০১o