ইউক্রেন-যুদ্ধ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট লেফট গ্রুপগুলির যৌথ বিবৃতি
শ্রমিক শ্রেণীর কোন দেশ নেই !
সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নিপাত যাক !
পুঁজিবাদী বর্বরতার পরিবর্তে সমাজতন্ত্র !
ইউক্রেনের যুদ্ধের হচ্ছে ছোট-বড় বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি গুলির পারস্পরিক স্বার্থ সংঘাতের জন্য, এর সাথে কোনো ভাবেই আন্তর্জাতিক ঐক্যের প্রতীক শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থের কোনো রূপ কোনো সম্পর্ক নেই । প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সামরিক এবং অর্থনৈতিক প্রভুত্ব কায়েমের জন্য এটি আমেরিকা,রাশিয়া পশ্চিম-ইউরোপীয় রাষ্ট্রযন্ত্রগুলির দায়িত্বে থাকা যুদ্ধবাজদের একটি ভূ-আঞ্চলিক কৌশলগত লড়াই। এই লড়াইয়ে ইউক্রেনের শাসক শ্রেণীকে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী দাবার মঞ্চে একটি বোড়ে হিসেবে কাজে লাগানো হচ্ছে।
ইউক্রেনীয় রাষ্ট্র নয়, এই যুদ্ধের আসল বলি হচ্ছে সমগ্র শ্রমিক শ্রেণী, যেখানে নারী ও শিশুরা অসহায়ভাবে নিহত হচ্ছে, ক্ষুধার্ত উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে, উভয় সেনাবাহিনীর কামানের খোরাক হিসেবে তারা ব্যবহৃত হতে বাধ্য হচ্ছে। এই যুদ্ধের প্রভাবে নেমে আসা ক্রমবর্ধমান রিক্ততা থেকে পৃথিবীর কোনো অংশের শ্রমিক শ্রেণিই রেহাই পাবে না।
পুঁজিবাদী শ্রেণি এবং তাদের বুর্জোয়া উৎপাদন পদ্ধতি কখনোই দেশভিত্তিক প্রতিযোগিতাকে অতিক্রম করতে শেখায় নি। এই প্রতিযোগিতারই ফল হলো এই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ। কোনোভাবেই এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তার গভীরতর বর্বরতায় ডুবে যাওয়া থেকে নিজেকে আটকাতে পারবে না ।
ক্রমশ অধোগামী মজুরি এবং জীবনযাত্রার নিম্ন মানের মুখে দাঁড়িয়ে বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণি এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামকে কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারে না। এই যুদ্ধ যেটাকে বলা যেতে পারে 1945 সালের পরে ইউরোপের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ, সেটা এই মুহূর্তে সারা বিশ্বকে আরো একবার পুঁজিবাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে এই সতর্ক বার্তা দিচ্ছে যে এই ধ্বংস এক মাত্র এড়ানো সম্ভব যদি শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রাম বুর্জোয়াদের উৎখাত করে শ্রমিকশ্রেণির এক-নায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
যুদ্ধের উদ্দেশ্য এবং বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মিথ্যাচার
রাশিয়ান সাম্রাজ্যবাদ তাদের 1989 সালের নিদারুণ পশ্চাদাপসরণের ধাক্কাকে কাটিয়ে উঠে আবার বিশ্বশক্তিতে পরিণত হতে চাইছে । অন্য দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সুপার পাওয়ার মর্যাদা এবং বিশ্বনেতৃত্বের পদকে অটুট রাখতে চাইছে। ইউরোপীয় শক্তিগুলি একাধারে যেমন রাশিয়ার শক্তিবৃদ্ধিকে ভয় পায় তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যকেও ভয় পায়। ইউক্রেন চায় নিজেকে সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের মিত্র হিসেবে দেখতে ।
আসুন দেখি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা শক্তিগুলি আসলে কী প্রতিপন্ন করতে চায়? তাদের কাছে থাকা সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মিথ্যাচার এবং তাকে প্রচার করার জন্য বৃহত্তম মিডিয়াগুলি এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন রাশিয়া একটা ছোট্ট সার্বভৌম রাষ্ট্রকে আক্রমণ করছে আর তারা ক্রেমলিন এর স্বৈরাচার আর পুতিনের নৃশংসতার মুখ থেকে গণতন্ত্রকে রক্ষা করার ধ্বজা ধরে আছে।
সাধারণত সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী গুন্ডাদের কাছেই সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য যুদ্ধ-প্রোপাগান্ডা মজুত থাকে। তারা তাদের কার্যকর রণকৌশল কে কাজে লাগিয়ে শত্রুদেরকে প্রথমে গুলি চালাতে উসকানি দিতে পারে। মনে রাখবেন, সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে, সিরিয়ায়, ইরাকে এবং আফগানিস্তানে এইসব শক্তির শান্তির ললিত বাণী প্রচারের ন্যাকামোপণা। ইদানিং আমেরিকা কীভাবে মসুল শহরকে চিড়েচ্যাপ্টা করে দিয়েছে, কীভাবে মিত্রশক্তি সাদ্দাম হোসেনের কাছে মানব-নিধনকারী অস্ত্র থাকার মিথ্যা অভিযোগে ইরাকের জনগণকে তরবারির ডগায় রেখেছে। আরো একটু পিছিয়ে যান, মনে করুন গত শতাব্দীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অগুনতি অপরাধ, যেগুলো এইসব তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশগুলি আপামর নিরীহ জনগণের উপর নামিয়ে এনেছিল। হতে পারে সেটা ১৯৬০ সালের ভিয়তনাম, হতে পারে ১৯৫০ এর কোরিয়া, কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন হিরোসীমা, ড্রেসডেন বা হামবুর্গ। ইউক্রেণের সাধারণ মানুষের উপর রাশিয়ার এই অত্যাচার সেই সাম্রাজ্যবাদী প্লেবুক থেকেই নেওয়া ।
পুঁজিবাদ মানবতাকে স্থায়ী সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের যুগে নিয়ে গেছে, যে যুগে দাঁড়িয়ে যুদ্ধকে ‘বন্ধ’ করতে বলাটাও একটা বিভ্রম। পুঁজিবাদের এই পর্যায়ে 'শান্তি' শুধু একটি সাময়িক বিরতি ছাড়া কিছুই না ।
পুঁজিবাদ যতই অমীমাংসিত সংকটে ডুবে যাবে, তার দূষণ এবং আঘাতের ক্রমবর্ধমান বিপর্যয়ের পাশাপাশি সামরিক ধ্বংসও ততই ত্বরান্বিত হবে। পুঁজিবাদের পচন যত বাড়বে বিপ্লবী পরিবর্তনের সম্ভবনা ততটাই অপরিহার্য হয়ে উঠবে।
শ্রমিক শ্রেণিই হলো সেই ঘুমন্ত দৈত্য
সর্বৈবভাবে যুদ্ধের এবং ভয়াবহতার ব্যবস্থাতে পরিণত হওয়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, যার শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বর্তমানে এমন কোনও উল্লেখযোগ্য শ্রেণি-বিরোধিতা খুঁজে পাওয়া যায় না, যার ফলস্বরূপ সর্বহারা শ্রেণি একদিকে যেমন পুঁজিবাদের ক্রমবর্ধমান শোষণের শিকার হয়, অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদের ডাকে যুদ্ধক্ষেত্রে চূড়ান্ত বলিদান দিতে বাধ্য হচ্ছে।
শ্রমিকশ্রেণির শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার লড়াইয়ের বিকাশ এবং সেইসাথে বিপ্লবী ভ্যানগার্ডের অপরিহার্য ভূমিকা দ্বারা উদ্দীপিত শ্রেণি-চেতনা অনেক বড় সম্ভাবনাকে লুকিয়ে রাখে। সেই সম্ভবনা হলো শ্রেণি হিসাবে একত্রিত হওয়ার এবং রাজনৈতিক শোষণযন্ত্রকে উৎখাত করার ক্ষমতা যা তারা ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় করেছিলো এবং সেই সময়ের জার্মানি এবং অন্যান্য কিছু স্থানেও করে ফেলার সম্ভাবনা তৈরি করেছিলো। এটাই সেই সম্ভাবনা যা নিরন্তর যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাওয়া ব্যবস্থাকে ছুঁড়ে ফেলতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, অক্টোবর বিপ্লব শুধু যুদ্ধের বিরোধিতাই নয়, বুর্জোয়া রাষ্ট্রশক্তির উপর আক্রমণেরও একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।
আজ আমরা সেরকম একটি বিপ্লবী পরিস্থিতি থেকে অনেক দূরে। একইভাবে, প্রথম সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের সময় প্রলেতারিয়াতদের লড়াইয়ের যে অবস্থা ছিলো তার থেকে আজকের পরিস্থিতি অনেক আলাদা। অন্যদিকে, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের মোকাবিলায় যা এখনও একই রয়ে গেছে, তা হল সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদ। এখন বিপ্লবী সংগঠনগুলির আশু কর্তব্য হলো চলতি স্রোতের বিরুদ্ধে এই মূল নীতিগুলিকে অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে সমর্থন করা আর প্রলেতারিয়েতের সামনে তুলে ধরা ।
এই রাজনৈতিক ঐতিহ্য একাধারে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং আন্তর্জাতিকতাবাদের পক্ষে লড়াই করেছে ও করে চলেছে।
সুইজারল্যান্ডের জিমারওয়াল্ড এবং কিয়েনথাল - এই গ্রামগুলি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে উভয় পক্ষের সমাজতন্ত্রীদের মিলনস্থল হিসেবে বিখ্যাত হয়েছিলো। আবার এই স্থানটিই দেশপ্রেমের ধ্বজাধারী সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিগুলির সমালোচনা এর মাধ্যমে একটি আন্তর্জাতিক সংগ্রাম শুরুর উৎস স্থল হিসাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এই স্থানের সেই বৈঠকেই ব্রেমেন লেফট ও ডাচ লেফট দ্বারা সমর্থিত বলশেভিকরা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রয়োজনীয় নীতিগুলিকে সামনে নিয়ে আসে যা আজও সমানভাবে বৈধ এবং প্রাসঙ্গিক:
কোনো সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের প্রতিই কোনো প্রকার সমর্থন নয়; সমস্ত শান্তিবাদী বিভ্রম প্রত্যাখ্যান; এবং এই স্বীকৃতি দেওয়া যে একমাত্র শ্রমিকশ্রেণি এবং তার বিপ্লবী সংগ্রামই শ্রমশোষণভিত্তিক এবং স্থায়ী সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের জন্মদাতা এই ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে পারে।
1930 এবং 1940-এর দশকে শুধুমাত্র সেই পলিটিক্যাল কারেন্ট বর্তমানে যাকে আমরা কমিউনিস্ট লেফট বলি সেই সংগঠনগুলিই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে বলশেভিকদের দ্বারা বিকশিত আন্তর্জাতিকতাবাদী নীতিগুলিকে দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইতালীয়ান লেফট এবং ডাচ লেফট খুব সক্রিয়ভাবে মানব-নিধনের ফ্যাসিস্ট এবং অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট উভয়পক্ষের সাফাইকে নাকচ করেছিলো, উল্টোদিকে ট্রটস্কিবাদী সহ অন্যান্য ধারাগুলি এটাকে প্রলেতাড়িয়-বিপ্লব হিসেবে দাবী করেছিলো। সেইসময় এইভাবেই কমিউনিস্ট লেফটরা স্তালিনবাদী-রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদের প্রতি যে কোনো প্রকার সমর্থনকে প্রত্যাখ্যান করেছিল।
আজ, ইউরোপে সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব ত্বরান্বিত হওয়ার মুখে, কমিউনিস্ট লেফটদের ঐতিহ্য বহনকারী রাজনৈতিক সংগঠনগুলি সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদের পতাকাকে তুলে ধরেছে এবং যারা বিশ্ব প্রলেতারিয়েতের মূল নীতিগুলিকে সমর্থন করতে চায় তাদের জন্য একটি মাপকাঠি পয়েন্ট প্রদান করছে।
এই কারণেই আজ কমিউনিস্ট লেফট সংগঠন ও গোষ্ঠীগুলি, সংখ্যায় অল্প এবং প্রায় নগন্য হওয়া সত্ত্বেও একটা যৌথ বিবৃতিটি রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং যতটা সম্ভব ব্যাপকভাবে আন্তর্জাতিকতাবাদের নীতিসমূহকে সম্প্রচার করতে চাইছে যেটা দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধের বর্বরতার বিরুদ্ধে অনুশীলিত হয়েছিলো।
ইউক্রেনে সাম্রাজ্যবাদী হত্যাকাণ্ডে কোনো পক্ষের সমর্থণ নয় ।
শান্তিবাদের কোন বিভ্রম নয় : পুঁজিবাদ কেবল অবিরাম যুদ্ধের মাধ্যমেই বাঁচতে পারে।
শুধুমাত্র শ্রমিকশ্রেণিই তার শোষণের বিরুদ্ধে শ্রেণি-সংগ্রামের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের অবসান ঘটাতে পারে।
দুনিয়ার মজদুর এক হও!
International Communist Current (en.internationalism.org)
Istituto Onorato Damen http://www.istitutoonoratodamen.it
Internationalist Voice (en.internationalistvoice.org)
Internationalist Communist Perspective (Korea) fully supports the joint statement (국제코뮤니스트전망 - International Communist Perspective (jinbo.net)