“যথেষ্ট হয়েছে”- গত বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে UK তে ঘটে চলা ধর্মঘটে এই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে। ‘অসন্তোষের গ্রীষ্ম ' নামে ভূষিত এই বিশালাকার আন্দোলন মনে করিয়ে দিচ্ছে ১৯৭৯ এর অসন্তোষের শীত’কে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই আন্দোলনে রেলওয়ে থেকে শুরু করে ভূগর্ভস্হ শ্রমিক, বৃটিশ টেলিকম, ফেলিক্সো ( দক্ষিণ পূর্ব বৃটেনের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর) এর বন্দর কর্মীরা, বরখাস্ত শ্রমিক, বাসচালক, এ্যামাজন কর্মী যোগদান করেছে। এই আন্দোলনের গতি যানবাহন থেকে স্বাস্থ্যকর্মী শিক্ষক সর্বত্র ঝড়ের গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। সমস্ত সাংবাদিক ও ভাষ্যকাররা একে শতাব্দীর সবচেয়ে বড়ো আন্দোলন আখ্যা দিয়েছে। এর আগে শুধুমাত্র ১৯৭৯ এর ধর্মঘটগুলি এর থেকে বড়ো এবং বিস্তৃত আকার ধারণ করতে পেরেছিল। এই ব্যাপক মাত্রার আন্দোলন বৃটেনের মতো দেশে শুধু মাত্র স্হানীয় ভাবে গুরুত্বপূর্ণ তা নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এবং গোটা পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তের শোষিত শ্রমিকশ্রেণীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
' শ্রেণীসংগ্রাম ই হল শোষিত শ্রেণীর জীবনযাত্রার ওপর নেমে আসা বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে একমাত্র উত্তর '
অন্যান্য সমস্ত উন্নত দেশগুলির মত বৃটিশ সরকারও ধারাবাহিক ও নিরলস ভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শ্রমিক শ্রেণীর জীবন ও কর্মক্ষেত্রের ওপর আক্রমণ চালিয়ে গেছে। বিশ্ব পুঁজিবাদের প্রতিযোগিতার আসরে টিঁকে থাকা এবং আরো বেশি মুনাফা আত্মসাতের নেশায় শ্রমিকশ্রেণীর জীবনকে নিরাপত্তাহীন ও অনিশ্চিত করে তুলেছে। এই আক্রমণগুলির অন্যতম ফল স্বরূপ বৃটেনে শিশু মৃত্যুর হার ২০১৪ সাল থেকে নজিরবিহীন ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে (medical journal BJM Open[1]).। বর্তমানে মূল্যবৃদ্ধি সুনামির আকার ধারণ করেছে। মূল্য বৃদ্ধির হার জুলাই মাসে ছিল ১০. ১ শতাংশ, অনুমান করা হচ্ছে অক্টোবর মাসে তা ১৩ শতাংশ এবং জানুয়ারি মাসে ১৮ শতাংশে পৌছবে, যার ফল হবে ভয়ংকর রকমের ধ্বংসাত্মক। N H S ইতিমধ্যেই সতর্কবার্তা দিয়েছে অনেক মানুষই তাদের খাদ্যতালিকা কাটছাট করতে বাধ্য হবে, অথবা বাধ্য হবে ঘর উষ্ণ করার পদ্ধতি বন্ধ রাখতে। যার ফলে বহু মানুষকে স্যাঁতসেতে অবস্থা এবং প্রবল শীতের মধ্যে দিন অতিবাহিত করতে হবে। এপ্রিলের প্রথমেই গ্যাস এবং ইলেক্ট্রিসিটির ৭৪ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধি এবং অক্টোবরের শুরুতে ৭৮ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধি পরিস্থিতিকে আরো অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। থ্যাচারের শাসনকালে বৃটিশ শ্রমিকদের ওপর প্রবল বিপর্যয় নেমে আসে যার ফল স্বরূপ তাদের প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষমতাটুকু ও নিঃশেষ হয়ে যায়। আজকের বৃটিশ শ্রমিকদের আন্দোলন সেই ধারাবাহিক নিস্ক্রিয়তার সমাপ্তি সূচনা করে আজকের বৃটিশ শ্রমিকের জীবনে নেমে বিপর্যয়ের বিপক্ষে একটি যোগ্য জবাব হয়ে উঠতে পেরেছে।
অতীতে বৃটিশ শ্রমিকরা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে সংগ্রামশীল বলে পরিচিত ছিল। ধর্মঘটের দিনের সংখ্যার ভিত্তিতে ১৯৭৯ এর ' অসন্তোষের শীতকাল' কে মে ১৯৬৮ এর ফ্রান্সের যে আন্দোলন তার পরবর্তী কালের সবচেয়ে বৃহদাকার আন্দোলন বলা চলে, যার আকার এমন কি ১৯৬৯ এর ইটালির ‘উষ্ণ শরত’ এর থেকেও বড়ো ছিল। শ্রমিকদের ওপর একের পর এক তিক্ত পরাজয় নামিয়ে এনে থ্যাচার সরকার সক্ষম হয়েছিল এই বিশাল আন্দোলনকে দমন করতে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ১৯৮৫ এর খনি শ্রমিকদের আন্দোলন। এই পরাজয়ের সাথে সাথে যুক্তরাজ্যে এমনকি গোটা বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণির লড়াকু চরিত্রের দ্রুত অবনমন হতে শুরু করে। পাঁচ বছর পর ১ ৯৯০ সালে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে প্রচারিত USSR এর পতনের সঙ্গে সঙ্গে ‘কমিউনিজমের মৃত্যু’ 'এবং 'পুঁজিবাদের নিশ্চিত বিজয় ' এই দুটি প্রচার শ্রমিকশ্রেণির জীবনে বিপর্যয় হয়ে নেমে আসে। তারপর থেকে পরিপ্রেক্ষিতের অভাব শ্রমিকশ্রেণির আত্মবিশ্বাস ও শ্রেণীচেতনাকে ক্ষয় থেকে আরো ক্ষয়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে, যার ফল পৃথিবীর সমস্ত জায়গার থেকে বেশি ভোগ করে বৃটেনের শ্রমিকরা। লড়াই করার অক্ষমতা তাদেরকে ধারাবাহিক ভাবে সরকারের আক্রমণের সহজ শিকারে পরিণত করে।
কিন্তু আজকে শ্রমিকশ্রেণীর আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে ক্ষোভ দিনে দিনে ঘনীভূত হচ্ছে। বৃটেনের শ্রমিকশ্রেনী বারংবার প্রমাণ করছে যে সে লড়াই করতে প্রস্তুত এবং পুঁজিবাদের দাবি অনুসরণ করে ত্যাগ স্বীকার করতে সে একেবারেই প্রস্তুত নয়। এই পরিবর্তন অত্যন্ত অর্থবহ এবং শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের আন্তর্জাতিক গতিশীলতার ইঙ্গিত বহন করে। গত বছর থেকে পৃথিবী একের পর এক ধর্মঘটের সাক্ষী থেকেছে।, যার মধ্যে অন্যতম শীতের স্পেন ও আমেরিকায় ঘটে যাওয়া ধর্মঘট গুলি। এবারে গরমে জার্মানি ও বেলজিয়ামে শ্রমিকদের কর্ম ত্যাগ এবং ইতিমধ্যেই অনুমান করা হয়েছে যে ফ্রান্স ও ইতালি একটি বিস্ফোরক সামাজিক পরিস্থিতির সাক্ষী হতে চলেছে। অদূর ভবিষ্যতে কখন এবং কোথায় শ্রমিক আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করবে তার ভবিষ্যদ্বানী না দেওয়া হলেও এটা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে বর্তমানের বৃটেনের শ্রমিক শ্রেণীর সংঘবদ্ধতা শ্রমিকশ্রেণীর ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। নিষ্ক্রিয়তা এবং নতিস্বীকারের দিনের সমাপ্তি ঘটেছে এবং নতুন প্রজন্মের শ্রমিকরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে।
সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের সমকালে শ্রেণীসংগ্রাম
শুধুমাত্র দীর্ঘ সময়ের নিষ্ক্রিয়তার অবসান ঘটানোই এই আন্দোলনের গুরুত্ব নয়, এই আন্দোলনগুলি এমন এক সময়ে বিকশিত হচ্ছে যখন বিশ্ব আরো একটি সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের মুখোমুখি, যে যুদ্ধ রাশিয়াকে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে এবং ন্যাটো অন্তর্ভুক্ত দেশগুলি কে একত্রিত করেছে এবং যার প্রভাব বিশ্ববাসীকে নাজেহাল করে তুলেছে। এর প্রভাব শুধুমাত্র অস্ত্রের বাজারে নয়, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক এবং আদর্শগত সমস্ত ক্ষেত্রেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। পশ্চিমের দেশ গুলির সরকার জনগণকে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার্থে ত্যাগ স্বীকারের জন্য আহ্বান করছে। আরো পরিষ্কার পরিভাষায় বলা যায় এই সমস্ত দেশের শ্রমিক শ্রেণীর এই মুহূর্তে কর্তব্য হল, আরো শক্ত ভাবে ইউক্রেনের শ্রমিক শ্রেণির প্রতি সংহতি প্রদর্শন ও আরো পাশে এসে দাঁড়ানো।
বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে নেমে আসা বিপর্যয়, শক্তি এবং খাদ্যের ঘাটতির ঝুঁকিকে ( জাতি সংহের মহাসচিবের মতে এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে খারাপ খাদ্য সংকট) অজুহাত করে বিভিন্ন দেশের সরকার নির্লজ্জ ভাবে শ্রমিক শ্রেণীর ওপর তাদের অর্থনৈতিক আক্রমণকে ন্যায্যতা দিচ্ছে। শাসকশ্রেণী একই সঙ্গে শান্তির ও ডাক দেয় আবার প্রাচুর্যের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করে। একই সময়ে তার যুদ্ধের অর্থনীতিকে আরো শক্তিশালীও করে তুলেছে। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী সামরিক ব্যয় ২,১১৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ১৯৪৫ সালের পর এই প্রথম সামরিক ব্যয়ের শীর্ষে থাকা ৫ রাষ্ট্রের মধ্যে অন্যতম UK সমেত জার্মানি এবং বিশ্বের প্রতিটি দেশ তাদের অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে ত্বরান্বিত করে চলেছে।
এটি একটি রসিকতার মতই শোনায় যে, যে সময়ে শাসক দেশ গুলি যুদ্ধে তাদের ব্যয় বাড়িয়ে পরিস্থিতিকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে চলেছে, সেই সময়ে তারাই আবার মুদ্রাস্ফিতির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে আত্মত্যাগের আহ্বান জানাচ্ছে। এই ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে পুঁজিবাদ এবং তার প্রতিযোগী জাতীয় বুর্জুয়াদের আরো যুদ্ধ, আরো ধ্বংস, আরো শোষণ, আরো দুর্দশা ছাড়া কিছুই দেবার নেই।
শ্রমিকশ্রেণী সম্পূর্ণভাবে সচেতন না হলেও বৃটেনের আন্দোলনের গুরুত্ব এখানেই যে শাসকশ্রেণীর স্বার্থের জন্য আরো বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে অস্বীকার, জাতীয় অর্থনীতি এবং মানবতাকে বিপর্যয়ের শেষপ্রান্তে এনে দাঁড় করানো যুদ্ধ প্রচেষ্টার জন্য আত্মত্যাগ করতে অস্বীকার। এর বিকল্প গুলিও অত্যন্ত পরিষ্কার, সেটা হলো- সমাজতন্ত্র অথবা মানবতার ধ্বংস ।
পুঁজিবাদের পাতা ফাঁদ এড়িয়ে চলা প্রয়োজন
দীর্ঘ দিন ধরে বৃটেনের এর উগ্র জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ সমগ্র অত্যাচারিত শ্রমিকশ্রেণীকে বিদেশী-স্বদেশী, সাদা-কালো, নারী-পুরুষ, এমন অনেক গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। এমন কি সেখানকার শ্রমিকশ্রেণী ও বিশ্বাস করেছিল যে ব্রেক্সিটে UK এর পশ্চাদপসরণ ই তাদের সমস্ত সমস্যার সমাধান করবে। এমতাবস্থায় শ্রমিকশ্রেণীর বর্তমান অবস্থান গ্রহণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। শুধু তা নয়, বুর্জোয়ারা আরো কঠিন ক্ষতিকর এবং ভয়ংকর ফাঁদ পেতে রেখেছে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের পথে। বর্তমান ধর্মঘটগুলোর অধিকাংশই ডাক দিয়েছে ট্রেড ইউনিয়নগুলি যারা নিজেদেরকে শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থরক্ষা এবং সংগ্রাম সংঘটিত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর সংস্থা হিসাবে দাবি করে। তারা কার্যকর তো বটেই, তবে বুর্জুয়াদের স্বার্থ রক্ষার্থে এবং শ্রমিকশ্রেণীর পরাজয় সংঘটিত করতে। এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, ইউনিয়নগুলির নাশকতা ছাড়া থ্যাচারের বিজয় কখনোই সম্ভব হোতো না। ১৯৮৪ সালের মার্চ মাসে যখন কুড়ি হাজার ( ২০, ০০০) চাকরি ছাঁটাই ঘোষণা হয় তখন কয়লাখনি শ্রমিকদের প্রতিক্রিয়া ছিল তাৎক্ষণিক,- ধর্মঘটের প্রথম দিনই ১৮৪ টি কূপের মধ্যে ১০০ টি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বেশ কিছু ট্রেডইউনিয়ন ধর্মঘটকারিদের দ্রুত বেষ্টন করে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। রেলওয়ে শ্রমিক এবং নাবিক ইউনিয়ন ধর্মঘটে তাদের প্রতীকী সমর্থন জানিয়েছিল। শক্তিশালি বন্দর কর্মী ইউনিয়ন অনেক দেরি করে এই ধর্মঘটকে তাদের সমর্থন জানায়। ট্রেডইউনিয়নের জাতীয়-কংগ্রেস এই ধর্মঘটকে সমর্থন জানাতে অস্বীকার করে। স্টিল শ্রমিক ও ইলেক্ট্রিসিয়ানদের ইউনিয়নগুলি এই ধর্মঘটের বিরোধিতা করে। সংক্ষেপে বলা যায় যে ইউনিয়ন গুলি অত্যন্ত সক্রিয় ভাবে একটি সর্বজনীন সংগ্রামের সম্ভাবনাকে সমূলে বিনষ্ট করেছিল। সর্বোপরি খনি শ্রমিকদের ইউনিয়ন NUM ( National Union of mine workers) কোকিং ডিপো থেকে কয়লা চলাচল রোধ করার প্রয়াসকে কেন্দ্র করে খনি শ্রমিকদের পুলিশের সঙ্গে নিরর্থক এবং পূর্বপরিকল্পিত একটি লড়াই এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে এই জঘন্য কাজটি সম্পন্ন করে ( এটি এক বছরের ও বেশি স্থায়ী হয়েছিল।) ইউনিয়নের এই নাশকতার সাহায্য নিয়েই পুলিশের সাথে এক দীর্ঘ নিষ্ফল এবং অবিরাম সংঘর্ষের মাধ্যমে তীব্র সহিংসতার সাথে এই ধর্মঘটের দমন সম্পন্ন হয়েছিল। এই পরাজয় ছিল সমগ্র শ্রমিকশ্রেণির পরাজয়। আজ যদিও UK তে এই একই ইউনিয়নগুলি বিভিন্ন সেক্টরগুলির মধ্যে শ্রমিকশ্রেণির প্রতি সংহতি প্রদর্শনের ডাক দিচ্ছে এবং একটি সর্বজনীন ধর্মঘট সংঘটনের আস্ফালন ও করছে। কিন্তু তার কারণ হল , একদিকে যেমন তাদের অস্তিত্ব টিকেই আছে শ্রমিক শ্রেণির রাগ, তাদের সংগ্রাম এবং তাদের এই অনুভূতি যে আমাদের একসাথে লড়াই করতে হবে এ সবের ওপর, অন্য দিকে শ্রমিক শ্রেণির এই লড়াই কে যতো তারা নিজেদের কব্জায় করতে পারবে ততো তারা তাদের দমণ করতে সক্ষম হবে। বাস্তবে তারা এই ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে তাদের পরিকল্পনা সাজাচ্ছে অন্যভাবে ; ' সবার জন্য উচ্চ মজুরি 'র শ্লোগান সামনে রেখে বিভিন্ন সেক্টরগুলিকে কর্পোরেটবাদী আলোচনায় আটক ও বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। তার থেকেও বড়ো কথা, তারা অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে শ্রমিকদের বিভিন্ন সেক্টরের মধ্যে আলোচনার পরিধিকে বাধা দিয়ে চলেছে। এ এমতাবস্থায় কোথাও কোনো Cross industry এর সাধারণ সভা হচ্ছে না। এ রকম পরিস্থিতিতে যখন বরিস জনসনের স্থলাভিষিক্ত করার লড়াই এর সামনের সারিতে থাকা Liz trass ঘোষণা করে যে, সে প্রধানমন্ত্রী হলে কখনোই সে বৃটেনকে জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়নগুলির মুক্তি পণে আটকে থাকতে দেবেন না, তখন তার দ্বারা বোকা না বনাই ভালো। সে কেবল তার রোল মডেল মার্গারেট থ্যাচারের পদাঙ্ক অনুসরণ করছে। ইউনিয়নগুলিকে শ্রমিকদের সবচেয়ে সংগ্রামী এবং বিশ্বাসযোগ্য প্রতিনিধি হিসাবে উপস্থাপিত করে শ্রমিকশ্রেণিকে একটি একত্রিত পরাজয়ের দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
২০১৯ সালে ফ্রান্সে লড়াই এর উত্থান এবং বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যেকার সংহতির বিস্ফোরণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ইউনিয়ন গুলি একই কৌশল অবলম্বন করে। সেখানে তারা একক আন্দোলনের বিকল্প হিসাবে আন্দোলনকারিদের বিভিন্ন সেক্টর এবং কোম্পানির ভিত্তিতে গোষ্ঠী ভুক্ত করে।
আমাদের জীবনযাত্রার ওপর নেমে আসা নিরলস আক্রমণ যা আগামীতে আরও বেশি তীব্র হতে চলেছে, তাকে প্রতিহত করতে UK এবং পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তে এই মুহূর্তে প্রয়োজন হল অসংখ্য বিতর্ক সভার আয়োজন এবং তারই মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের পদ্ধতি গুলিকে আরও বেশি শক্তিশালী করে তোলা, যা কিনা ইতিহাসের বিভিন্ন মুহূর্তে বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে নাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল ;
- আমাদের ‘কারখানা,' আমাদের‘কোম্পানি’, 'আমাদের ‘শহর’, আমাদের ‘অঞ্চল’, আমাদের ‘দেশ’, এই সমস্তকিছু কে ছাড়িয়ে পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তে সংহতি এবং সমর্থনের সন্ধান করা।
- শ্রমিক ইউনিয়নগুলির এবং তথাকথিত সবজান্তাদের ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে প্রয়োজন শ্রমিকদের নিজস্ব স্বায়ত্তশাসিত সংগঠণ এবং general assemblies .
- সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা এবং অতীতের ঘটে যাওয়া সংগ্রাম এবং পরাজয় থেকে ইতিবাচক শিক্ষা গ্রহণকে কেন্দ্র করে আলোচনার পরিধিকে আরও বিস্তৃত করে তুলতে হবে। কারণ পরাজয় হল অবশ্যম্ভাবি কিন্তু সব চেয়ে বড়ো পরাজয় হল প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে পরাজয় সহ্য করে যাওয়া। সংগ্রামে প্রবেশই হল শোষিতের প্রথম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিজয়।
UK তে প্রবলভাবে ছড়িয়ে পরা ধর্মঘটের প্রত্যাবর্তন যেমন সর্বহারা শ্রেণির লড়াই এর প্রত্যাবর্তন কে চিহ্নিত করে, তার সঙ্গে এটাও মনে করিয়ে দেয় যে ১৯৮৫ র পরাজয়ের সংকেত বহনকারী দুর্বলতা গুলিকে অবশেষে অতিক্রম করা সম্ভব হয়েছে, যেমন কর্পোরেটিজম এবং ট্রেডইউনিয়নের বিভ্রম । সংগ্রামের স্বায়ত্তশাসন ঐক্য এবং সংহতি ই হল আগামীর সংগ্রামের প্রস্তুতির অপরিহার্য মাপকাঠি।
এর জন্য প্রয়োজন হল নিজেদেরকে একই শ্রেণীর সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করা, সেই শ্রেণীর নাম হল শ্রমিক শ্রেণী, যার সংগ্রাম সংহতির দ্বারাই ঐক্যবদ্ধ। আজকের লড়াই শুধু মাত্র এই কারণেই গুরুত্বপূর্ণ নয় যে শ্রমিকশ্রণী অবশেষে তার বিরুদ্ধে নেমে আসা আক্রমণের বিরোধিতা করতে সক্ষম হচ্ছে, বরং এই কারণেও যে এই লড়াই তার বিশ্বব্যাপী শ্রেণী পরিচয় পুনরুদ্ধারের পথকে নির্দেশ করে, আমাদের সমস্ত দারিদ্র্য ও বিপর্যয়ের কারণ এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে উৎখাতের একটি ধাপ হয়ে উঠতে সক্ষম হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর ধ্বংস, যুদ্ধ, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, অনিশ্চয়তা এ সবের কোনো সমাধানই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে লুকিয়ে নেই। সমস্ত শোষিত এবং অত্যাচারিতকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্ব শ্রমিক শ্রেণীর লড়াই-ই একমাত্র বিকল্প পথের সন্ধান দিতে পারে।
বৃটেনের ব্যাপক ধর্মঘট পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের শ্রমিকশ্রেণী কে লড়াই এ যোগাদানের আহ্বান জানায়।