The first revolutionary wave of the world proletariat
পুঁজির পচনশীল অবস্থার শুরুর সূচক হিসেবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এটাও প্রমাণ করে দিল যে শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় বস্তুগত অবস্থা (Objective conditions) পরিপক্ক হয়ে উঠেছে । সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী অভ্যুথ্থানের জোয়ারের বজ্রনিনাদে কেঁপে উঠল রাশিয়া ও ইউরোপ , সেই দুনিয়া কাঁপানো আওয়াজে বেশ ভালোভাবেই প্রভাবিত হল উভয় আমেরিকাও , চীনেও প্রতিধ্বনিত হল সে আওয়াজ আর এইভাবে এই বিপ্লবী অভ্যুথ্থানের ঢেউ পুঁজিবাদ উচ্ছেদের ঐতিহাসিক কর্তব্য পালনের পথে বিশ্ব শ্রমিকশ্রেণীর প্রথম প্রচেষ্টায় পরিণত হল ।
১৯১৭ থেকে ১৯২৩ ব্যাপী এই বিপ্লবী সংগ্রামের উচ্চতম পযার্য়ে রাশিয়ায় রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে নিল শ্রমিকশ্রেণি , ক্ষমতা দখলের শ্রমিকগণঅভ্যুথ্থানে লিপ্ত হল জামার্নিতে এবং পুঁজিব্যবস্থার ভিতকেই সজোরে কাঁপিয়ে দিল ইতালি ,অস্ট্রিয়া এবং হাঙ্গেরীতে । স্পেন , গ্রেট ব্রিটেন , উত্তর ও দক্ষিন আমেরিকা এবং অন্যান্য জায়গায় তীব্র ও তিক্ত শ্রেণী সংগ্রামের রূপে আত্মপ্রকাশ করল এই বিপ্লবী ঢেউ যদিও তার জোর ছিল কিছুটা কম । আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একের পর এক দেশে হেরে যাওয়ার পর ১৯২৭ সালে চীনের সাংহাই ও ক্যান্টনে শ্রমিক অভ্যুথ্থান পরযুদস্ত ও চূর্ণ -বিচূর্ণ হয়ে গেল আর এই ভাবে চূড়ান্তরূপে সূচিত হল এই বিশ্ব বিপ্লবী জোয়ারের শোচনীয় পরাজয় ও ব্যর্থতা । এইজন্যই রাশিয়ার ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবকে ‘বুজোর্য়া', ‘রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী'(State Capitalism) , ‘দ্বৈত'(dual) , অথবা ‘স্থায়ী'(permanent)বিপ্লব হিসেবে নয় , এই বিশাল বিশ্বজোড়া শ্রেণী সংগ্রামের উচ্চতম রূপ ও সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশ হিসেবেই শুধু সঠিক ভাবে অনুধাবন করা যায় । বুজোর্য়ারা নিজেরা ‘বুজোর্য়া গণতান্ত্রিক' কর্তব্যগুলো সম্পন্ন করতে আপারগ হয়ে পড়ায়, প্রথমোক্তভাবে এই বিপ্লবকে বোঝার বা প্রতিষ্ঠিত করার অর্থই হল শ্রমিকশ্রেণীকে কোন না কোন ভাবে এইসব করতে বাধ্য করা ।
১৯১৯ সালে তৃতীয় আন্তর্জাতিক বা কমিউনিয্ট আন্তর্জাতিকের সৃষ্টি একই ভাবে এই বিপ্লবী জোয়ারের অংশ হিসাবেই হয়েছিল । কমিউনিষ্ট আন্তজার্তিক দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের পার্টিগুলো থেকে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক পার্টিগুলো বিচ্ছিন্নতা ঘোষণা করল । সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে অংশগ্রহণ, এইসব পার্টির বুজোর্য়া শিবিরে যো্দানের ব্যাপারটাকে একদম স্পষ্ট করে দিল । ‘সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে গৃহযদ্ধে পরিণত করুন', ‘পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে ফেলুন' এবং ‘সোভিয়াতের হাতে সমস্ত ক্ষমতা' এইসমস্ত স্লোগানের মাধ্যমে প্রতিফলিত সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ ও তৃতীয় আন্তর্জাতিক সংগঠিত করার প্রক্রিয়ায় নির্ণায়ক ভূমিকা পালন ক'রে বলশেভিক পার্টি এই বিপ্লবী কর্মকান্ডে মৌলিক অবদানই শুধু রাখল না , সেই বৈপ্লবিক কালে সারা দুনিয়ার শ্রমিকশ্রেণীর সত্যিকার অগ্রগামী বাহিনীতে পরিণত হল। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ছেড়ে বেরিয়ে আসা বিপ্লবী বামের(revolutionary Left) অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই এই অগ্রগামী ভূমিকা পালন করল বলশেভিক পার্টি ।
রাশিয়ার বিপ্লব ও তৃতীয় আন্তর্জাতিক উভয়েরই আধঃপতনের মূলে যদিও ছিল আসলে অন্যান্য দেশে বিপ্লবী অভ্যুথ্থানের শোচনীয় পরাজয় এবং বিপ্লবী জোয়ারের স্তিমিত ও নিঃশেষিত হয়ে পড়ার ঘটনা , এই আধঃপতনের প্রক্রিয়ায় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শ্রমিকশ্রেণীর পরাজয়ে বলশেভিক পার্টির ভূমিকাকে অনুধাবন করাও সমানভাবে জরুরি কারণ অন্যান্য সব পার্টির আপেক্ষিক দুবর্লতার জন্য তৃতীয় আন্তর্জাতিকে বলশেভিক পার্টিই হয়ে উঠেছিল নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দু । উদাহরণ হিসাবে ক্রন্সটাড্ট্ বিদ্রোহের (Kronstadt uprising) দমন এবং ( তৃতীয় আন্তর্জাতিকের বাম অংশের বিরোধিতা সত্ত্বেও ) ‘ইউনিয়ন গুলিকে জয় করা' (conquering the unions) , সংদীয় ব্যবস্থাকে বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপের উদ্দেশ্যে ব্যবহার' (Revolutionary Parliamentarism) এবং ‘সংযুক্ত মোর্চা'র (United Front) অবস্থানের সপক্ষে দাঁড়ানোর ফলে এই বিপ্লবী জোয়ারের পরিসমাপ্তিতে বলশেভিকের প্রভাব ও দায়িত্ব , এই জোয়ারের বিকাশের পরযায়ে তাদের অবদানের থেকে কোন অংশেই কম ছিল না ।
‘বাইরে থেকেই' শুধু নয় , ‘ভিতর থেকে'ও এবং বিশেষ ক'রে বলশেভিক পার্টি যে রাষ্ট্র কাঠামো গ'ড়ে তুলেছিল এবং যার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল , খোদ রাশিয়াতেই প্রতিবিপ্লব তার ভিতর থেকেই এগিয়ে এসেছে। ১৯১৭ সালের অক্টোবরে যেগুলো ছিল সাংঘাতিক ভুলমাত্র এবং নতুন ঐতিহাসিক যুগে রাশিয়ার শ্রমিকশ্রেণীর এবং সারা দুনিয়ার শ্রমিক আন্দোলনের সচেতনতার অপরিপক্কতার আলোকে স্বাভাবিক ব'লে ব্যাখ্যা করা যেত , তখন থেকে সেগুলোই হয়ে উঠল প্রতিবিপ্লবের আবরণ ও মতাদর্শগত যৌক্তিকতা (ideological justification) এবং প্রতিবিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করল। যাই হোক রাশিয়ার বিপ্লবী অভ্যুথ্থানসহ এই বিশ্ব বিপ্লবী তরঙ্গপ্রবাহ এবং তৃতীয় আন্তর্জাতিক কে শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনের প্রকৃত ও যথাযথ অভিব্যক্তি রূপে বিবেচনা করেই কেবল যুদ্ধ পরবর্তী বিপ্লবী জোয়ার ও রুশ বিপ্লবের নিম্নমুখী গতি , তৃতীয় আন্তর্জাতিক ও বলশেভিক পার্টির অধঃপতন এবং একটা পরযায়ে প্রতিবিপ্লবী ভূমিকা পালনের বিষয়টিকে সঠিক ভাবে অনুধাবন করা যায় । অন্য যেকোন ব্যাখ্যা শুধু বিভ্রান্তির জন্মই দিতে পারে আর এই বিভ্রান্তি কর্তব্য সম্পাদনের পথে বাধা সৃষ্টিই শুধু করবে । এইসব বিভ্রান্তির পক্ষধর সমস্ত রাজনৈতিক ধারার ক্ষেত্রেই এটা ঘটবে ।
শ্রেণীর এই বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে জীবনযাত্রার মানের বস্তুগত কোন উন্নতি না হলেও এগুলোর প্রকৃতির(nature) গভীর অধ্যয়ন ও অনুধাবন থেকে শুরু করেই কেবল প্রকৃত ও গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক অগ্রগতি ও স্পষ্টতা অজর্ন করা সম্ভব । বিশেষ শ্রমিকশ্রেণী কতৃর্ক ক্ষমতা দখলের একমাত্র উদাহরণ (১৮৭১ সালের প্যারী কমিউনের স্বল্পকালস্থায়ী এবং ১৯১৯ সালের বাভেরিয়া ও হাঙ্গেরীয় ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা ছাড়া ) হিসেবে , বিপ্লবী সংগ্রামের দুটো নির্ণায়ক বিষয় অনুধাবনের ক্ষেত্রে দারুন মূল্যবান অনেক শিক্ষা দিয়ে গেছে অক্টোবর বিপ্লব । সেই বিষয় দুটো হল : বিপ্লবের সারবস্তু (content of the revolution) এবং বিপ্লবীদের সংগঠনের প্রকৃতি (nature of the organization of revolutionaries) ।