বামপন্থা, অতিবামপন্থা এবং কম্যুনিজম্ তারিখ: ২৭শে এপ্রিল, ২০০৮ বিষয় উপস্থাপনা
প্রিয় সাথী,
সকলকে আইসিসি'র পক্ষ থেকে স্বাগত জানাই। আপনাদের মধ্যে অনেকেই জানেন আইসিসি, মানে ইন্টারন্যাশানাল কম্যুনিস্ট কারেন্ট ধারাবাহিকভাবে সারা পৃথিবী জুড়েই শ্রমিকশ্রেণির সচেতনতা বিকাশে সাহায্য করতে সচেষ্ট। বর্তমান সময়কালে শ্রমিকশ্রেণির সচেতনতার অর্থ কী হবে, তার বর্তমান সংগ্রামের গতিপ্রকৃতি কী হবে, কম্যুনিজমের পথে এগোনোর জন্য শ্রেণির আজকের কর্তব্য কী ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন, খোলামেলা আলোচনা এবং স্বচ্ছতা অর্জনের নিরলস প্রয়াস আজকের দিনে আমাদের কর্তব্য ব'লে আইসিসি মনে করে এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে তা পালন করার চেষ্টা করে। ভারতে আজকের এই আলোচনা সভা সেই স্বচ্ছতা অর্জনেরই একটা প্রয়াস হিসেবে দেখতে হবে এবং আইসিসি তার রাজনৈতিক কর্তব্য হিসেবেই এই আলোচনা সভা আয়োজন করেছে।
প্রথমতঃ এই বিষয়টা কেন আমরা রেখেছি তা নিয়ে অবশ্যই দুকথা বলার দরকার আছে। ভারতীয় প্রেক্ষাপটেই শুধু নয়,সারা পৃথিবীতেই বামপন্থা এবং অতিবামপন্থার নানান ভ্যারাইটি আমরা দেখতে পাই এবং চলতি ধারণা মোতাবেক এদের কমর্কান্ডের সঙ্গে কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রামকে এক ক'রে দেখানো হয়। যখন মেলে না তখন এক বিরাট শূণ্যতার বোধ আমাদেরকে গ্রাস করে। সত্যিকারের কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রাম আর এদের সংগ্রামের মঝে এক বিরাট ফাঁক আজ যেকোন মানুষের চোখে পড়ে। কিন্তু বোঝা যায় না কিভাবে এটা ব্যাখ্যা করা যায় এবং কিভাবেই বা শ্রমিক শ্রেণির কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রাম সম্ভব বা আদৌ তার আর কোন তাৎপর্য আছে কিনা। এর ফলে অনেক মানুষ যাঁরা তাঁদের জীবনের অনেকটা সময় শ্রমিকশ্রেণির মুক্তির জন্য ব্যয় করতে চেয়ে অত্যন্ত সততার সংগে হয় কোন না কোন গ্রূপ বা দলের হয়ে কাজ করেছেন বা করছেন, অর্ন্তদন্দ্বে ভুগছেন অথবা সঠিক বিকল্প অনুসন্ধান করছেন অথচ কোন পথের দিশা বা আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে সঠিক এবং সুসংহত একটা ফ্রেমওয়ার্ক পাচ্ছেন না তাঁদের কাছে আজকের দিনে এই বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব'লে মনে হয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ, শ্রমিকশ্রেণির প্রধান হাতিয়ার তার সচেতনতা এবং তার সংগঠন। সত্যিকারের শ্রেণিসংগঠনের রূপরেখা কী হতে পারে, আদৌ এইসমস্ত ধরণের বামপন্থার সাথে তার বিন্দুমাত্র কোন যোগ আছে কিনা, তা বুঝতে না পারলে শ্রেণি তার আজকের সংগ্রামের দিকদিশা ঠিক করতে পারেনা। এক্ষেত্রে তার সামনে সবচেয়ে বড় বাধা তার সনাতনভাবে লালিত এই ধারণা যে বামপন্থা তা সে যেমনই হৌক, পারলিয়ামেনটারি অথবা বিপরীত তা শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থের সংগে সংস্লিষ্ট।
তৃতীয়তঃ, সারা বিশ্বজুড়ে শ্রমিকশ্রেণি আবার সংগ্রামের মন্চে হাজির হচ্ছে। সারা পৃথিবী জুড়েই সচেতনতা অর্জনের প্রয়াসে নতুন জোয়ার এসেছে। আজ পুঁজিবাদী বর্বরতার পর্যায়ে মানব অস্তিত্ব বিপন্ন। এঅবস্থায় সচেতনতার মূর্ত নির্দিষ্ট অর্থ হ'ল কম্যুনিজমের অপরিহার্যতার উপলব্ধি, কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রামকে বিকশিত করা; আর এই লক্ষ্যেই আমাদের প্রথম দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় সংগ্রামের সামনে বাধাগুলো সম্বন্ধে স্বচ্ছতা অর্জন। যে রাজনীতি কম্যুনিজমের নামে কম্যুনিজমের ঠিক বিপরীত ধারাকে শ্রমিকশ্রেণির ওপর চাপিয়ে দিয়েছে এবং আজো তাইই ক'রে চলেছে, তার স্বরূপ উন্মোচন করা আমাদের দায়িত্ব।
বিষয়ে আসা যাক।
আমরা জানি পুঁজিবাদী সমাজের বিবর্তনের পথে তার বস্তুগত পরিস্থিতির বদলের সঙ্গে শ্রেণিসংগ্রামের গতিপ্রকৃতি ও দিকদিশা বদলায়। প্রকৃতপক্ষে এই দুইয়ের একটিকে অন্যটির সাথে বিচ্ছিন্ন ক'রে দেখা যায় না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা সামন্ততন্ত্রের গর্ভ থেকে জন্মলাভ ক'রে দীর্ঘ বুরজোয়া বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে গেছে এবং নিজেকে সমৃদ্ধতর করতে থেকেছে। তারপর নিজ নিয়মেই সেটা বিকাশের চূড়ান্ত পর্যায় অতিক্রম ক'রে ক্ষয়ের পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। আর এই দীর্ঘ কাল পর্বে শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রামেরও বিবর্তন ঘটেছে। বিকাশের পর্ব থেকে ক্ষয়ের পর্বে যেমন পুঁজিবাদ পৌঁছেছে তেমনই শ্রেণিসংগ্রামও সংস্কারমূলক কর্মসূচির কালপর্ব থেকে প্রলেতারীয় বিশ্ব বিপ্লবের কর্মসূচির কাল পর্বে পৌঁছেছে। ফলতঃ বিপ্লবী লক্ষ্যের সাপেক্ষেই তার সংগ্রামের প্রকৃতি, উপায় ইত্যাদিরও বদল ঘটেছে।
পুঁজিবাদের বিকাশের দশা বা Ascendant phase-র প্রধান বৈশিষ্ট হ'ল এই পর্যায়ে পুঁজির সম্প্রারণের পথে কোন মৌলিক বাধা নেই, সমগ্র উৎপাদন সম্পর্ক উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যে একটা তালমেল আছে, শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রামগুলোর প্রধান লক্ষ্য আশু দাবীদাওয়া ভিত্তিক যা মূলতঃ তার জীবনযাপনের মানকে আরো উন্নত করবে, সুনিশ্চিত করবে, রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্রীয় কাজে আর প্রত্যক্ষ যোগ থাকবে(পার্লামেনটে অংশ নেওয়া)। এককথায় এই পর্যায়ের রাজনীতি চালিত হয়েছে সংগ্রাম এবং সহাবস্থান এই ভিত্তিতে। অবশ্য এই পর্যায়েই শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রামের ঐতিহাসিক লক্ষ্য স্থিরীকৃত হয়ে গেছে: কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টোয় মার্কস তারই ঘোষণা করেছেন সুস্পষ্ট ভাষায়। বোঝা গেছে কম্যুনিজম কোন ইউটোপিয়া নয়, কোন ভাবাদর্শ নয়, এ হ'ল বাস্তবে অর্জনযোগ্য শ্রেণিহীন শোষনহীন রাষ্ট্রীয় সীমানাহীন একটা বিশ্বব্যবস্থা, সমাজ গতির মধ্যেকার ক্রিয়াশীল দন্দ্বগুলোর পরিণতিতে এটা হয়ে ওঠে সম্ভবপর এবং অপরিহার্য। আর এর জন্য সংগ্রাম করতে, তাকে সফল ক'রে তুলতে পারে একমাত্র শ্রমিকশ্রেণি। তবে পুঁজির বিকাশের সেই পর্বে কম্যুনিজম আশু কর্মসূচি হয়ে ওঠে নি।
পুঁজিবাদের ক্ষয়ের পর্যায়ের (decadence) প্রধান বৈশিষ্ট হ'ল বাধাহীনভাবে পুঁজির সম্প্রসারণে স্থায়ী সংকট। বিশ্বজুড়ে বৃহৎ পুঁজির মধ্যে বিশ্ববাজারটা একবার দখল হয়ে যাবার পর তার বাজারের সংকট স্থায়ী রূপ লাভ করতে থাকে।। এর ফলে অনিবার্য হয়ে ওঠে বাজার পুণর্দখলের লড়াই: দুদুটো বিশ্বযুদ্ধ তারই সুস্পষ্ট প্রতিফলন। বিংশশতাব্দীর প্রারম্ভ থেকেই মোটামুটিভাবে সুস্পষ্ট হতে থাকা এই পর্যায়কে সাম্রাজ্যবাদের যুগ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন লেনিন এবং বলেছেন এ হ'ল "মূমূর্ষ পুঁজিবাদ" (সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়"-লেনিন, ১৯১৬)। শ্রমিকশ্রেণির দিক থেকে তাই এই যুগ আর কোন দাবী দাওয়া আদায়ের সংগ্রামের যুগ নয়: এ হ'ল প্রলেতারীয় বিশ্ববিপ্লবের যুগ। এই পর্যায়ে তাই তার কাছে কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রামটা নিছক শ্লোগান থাকতে পারেনা, বরং তার সংগ্রামের গতিপ্রকৃতি হয়ে ওঠে কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রামের অভিমুখী। বর্তমান পর্যায় সেই কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রামের পর্যায়। সহাবস্থান বজায় রেখে সংগ্রাম নয়,এ হ'ল পুঁজিবাদের উচ্ছেদের জন্য সংগ্রামের পর্যায়।
দুই পর্যায়ের রাজনীতি তাই শ্রমিকশ্রেণির কাছে একইরকম হতে পারেনা।
আমরা দেখি পুঁজির বিকাশের দশায় সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিগুলোর প্রধান কাজ ছিল দাবীদাওয়াভিত্তিক সংগ্রামগুলো সংগঠিত করা, তাকে নেতৃত্ব দেওয়া। তখনও অব্দি বুর্জোয়াদের মধ্যে থেকে প্রগতিশীল বুর্জোয়া অংশ খুঁজে পাওয়া যেত যাদের কে প্রলেতারিয়েত কোন কোন প্রশ্ন সমর্থন করত পারত এবং তা শ্রমিকশ্রেণির তৎকালীন স্বার্থের পক্ষে সহায়কই হত। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মধ্যে বহুরকম "গণসংগঠন" গড়ে তোলার প্রোগ্রাম ছিল, ছিল পার্লামেন্টে অংশগ্রহনের কর্মসূচি। কম্যুনিজম ছিল সর্বদাই একটা দূরের বস্তু, শেষ লক্ষ্য। এরই অধীনে যেসব পার্টিগুলো কাজ করত তাদেরকেই বলা হত বামপন্থী দল এবং তারা ছিল মূলতঃ সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি হিসেবে পরিচিত। কম্যুনিজম তাদের কাছে আশু লক্ষ্য ছিল না আর তাই সংস্কারমূলক কাজ কর্মের মধ্যে নিয়োজিত থাকাটা ছিল শ্রমিকশ্রেণির রাজনীতিরই অংগ।
কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ইতিহাসের সেই পর্যায়কে চিহ্নিত করল এই ব'লে যে পৃথিবী এক নূতন যুগে প্রবেশ করেছে- সাম্রাজ্যবাদী বর্বরতা অথবা সমাজতন্ত্র এই হ'ল এযুগের দুই বিকল্প। সুতরাং শ্রমিকশ্রেণির রাজনীতিতে এক মৌলিক পরিবর্তন ঘটল: তার আশু এবং চূড়ান্ত সংগ্রাম সমার্থক হয়ে দাঁড়াল, বিপ্লবই হয়ে দাঁড়াল তার একমাত্র কর্মসূচি। সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিকযুগের সংস্কারমূলক সংগ্রাম সেকেলে হয়ে পড়ল, শ্রমিকশ্রেণি ট্রেডইউনিয়নের সংগ্রাম ছেড়ে "মাস-স্ট্রাইক"-র রাস্তা দেখাল। লেনিনসহ রোজা লুক্সেমবার্গ, কার্ল লিবনেখ্ট, পানেকোয়েক ইত্যাদি অগ্রণী কমরেডরা নতুন যুগের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি অনুযায়ী শ্রেণির সংগ্রামের পথ নির্দেশিকা হাজির করলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে এরই পরিণত প্রতিফলন ঘটল এই বিখ্যাত অবস্থানের মধ্য দিয়ে: সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের সবকটা পক্ষই সমান প্রতিক্রিয়াশীল এবং সাম্রাজ্যবাদী; এর মধ্যে কোন পক্ষই শ্রমিকশ্রেণি গ্রহণ করতে পারেনা। তার কাজ সাম্রাজ্যবাদী এই যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধে পরিণত করা। সোজা বাংলায় যার মানে হ'ল বিশ্বজুড়ে প্রলেতারীয় বিপ্লব সংগঠিত করা। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মধ্যে বেশিরভাগ অংশই এই লাইনকে মেনে নেয়নি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিকশ্রেণিকে এক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অপর সাম্রাজ্যবাদী পক্ষ অবলম্বন করতে আহ্বান জানাল। জাতীয়তাবাদের ধারণাকে উস্কে দিয়ে এভাবেই এক অংশের শ্রমিকশ্রেণিকে অন্য অংশের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিল; ফলে শ্রমিকশ্রেণির আন্তর্জাতিকতার কোন প্রশ্নই দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মধ্যে রইল না। স্পষ্টতই লেনিনসহ মাইনরিটি অংশ দ্বিতীব আন্তর্জাতিকের রাজনীতি পরিত্যাগ করলেন। ঘোষণা করলেন দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক মৃত। এভাবে ইতিহাসের বিপ্লবী যুগের সূচনাতেই আমরা দেখলাম শ্রমিকশ্রেণির রাজনীতিতে দুটি সুষ্পষ্ট ধারা: একটি অধঃপতিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের, অন্যটি লেনিন, রোজা ইত্যাদিদের মাইনরিটি ধারা। ইতিহাস দেখিয়ে দিয়েছে কোন্ ধারাটি প্রকৃত বিপ্লবী লাইনের প্রতিনিধিত্ব করেছে। লেনিনেরা সংখ্যায় অল্প ছিলেন কিন্তু প্রলেতারীয় অবস্থান নেওয়ার প্রশ্নে তাঁরাই প্রকৃত বিপ্লবী ধারার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। বিপরীতে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের রাজনীতি শ্রমিকশ্রেনীর প্রতি বেইমানিই করেছে, কারণ শ্রমিকশ্রেণি সারা পৃথিবী জুড়ে সাম্রাজ্যবাদী নিধনযজ্ঞের শিকারই হয়েছে। মুখে-আন্তর্জাতিকতার বিপরীতে লেনিনেরা বাস্তবে আন্তর্জাতিক শ্রেণিলাইনটি আঁকড়ে ছিলেন যারই ধারাবাহিকতায় পৃথিবীতে প্রথম সফল প্রলেতারীয় বিপ্লব সংঘটিত হ'ল রাশিয়ায়। তার ঢেউ আছড়ে পড়ল সারা ইউরোপে- জার্মানি হয়ে উঠল বিশ্ব প্রলেতারীব বিপ্লবের সাফল্যের নির্ধারক শক্তি। আর সেই জার্মানেই আমরা বিপ্লবকে পরাজিত হতে দেখলাম দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের অন্তর্গত সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিগুলোর বেইমানির কারণেই। সেই সময় থেকেই বাস্তবতঃ বামপন্থী সোস্যাল ডেমোক্র্যাসির সঙ্গে কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রামের সম্পর্ক রইল না। যদিও তারা টিকে রইল কিন্তু তাদের অস্তিত্ব শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রামকে বেপথু করা ছাড়া শেষ বিচারে কিছুই করে নি। জার্মানিতে প্রতিবিপ্লবের বিজয় তারই সুনিশ্চিত প্রমাণ।
১৯১৭-র রুশ বিপ্লব দিয়ে শুরু হল শ্রমিক শ্রেণির প্রথম বিশ্বজোড়া বিপ্লবের ঢেউ। সেই ঢেউ শেষঅব্দি পরাজিত হ'ল। শ্রমিকশ্রেণির এই পরাজয় তার শ্রেণি সচেতনতার ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব বিস্তার করল। তার হেরে যাওয়ার ওপর ভিত্তি করেই ক্রমাগত সেই ধারার বিকাশ এবং বিস্তার ঘটতে থাকল যা লেনিনেরা পরিত্যাগ করেছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালেই। বিজয়ী রুশ বিপ্লবের ওপর ভিত্তি করেই যে বিপ্লবী শিক্ষা দুনিয়ার শ্রমিক শ্রেণি অর্জন করছিল, তারই ওপর ভিত্তি ক'রে তৃতীয় আন্তর্জাতিক গঠিত হয়েছিল। তার মূল লক্ষ্যই ছিল বিশ্ব বিপ্লবকে জয়ী করা। কিন্তু সেই বিপ্লবী তরংগে যখন ভাটা এল, তখন সেই ভাটার হাত ধরেই তার মধ্যে ফিরে আসতে থাকল সেই রাজনৈতিক অবস্থানের কথা যা লেনিনেরা পরিত্যাগ করেছিলেন দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সময়কালেই। এল বুরজোয়াদের সংগে ইউনাইটেড ফ্রন্ট গঠনের রাজনীতি, ফিরে এল সংস্কারমূলক কর্মসূচির জন্য লড়াই, ট্রেডইউনিয়নিজম, ফিরে এল পার্লামেন্টে অংশ গ্রহণের রাজনীতি, ফিরে এল বাণর্স্টাইনের শান্তিপূর্ণ সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব, ফিরে এল সেকেলে হয়ে যাওয়া এবং বাস্তবতই ভিত্তিহীন হয়ে পড়া বুরজোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তত্ত্ব অর্থাৎ এককথায় সেইসবকিছু যা পুঁজির বিকাশের যুগের শ্রমিকশ্রেণির রাজনীতির সঙ্গে খাপ খায়। আন্তর্জাতিকতার প্রশ্নটি একটি বাগাড়ম্বরে পরিণত হল। রাশিয়ার সফল বিপ্লব শেষ অবধি অধঃপতিত হতে হতে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদে রূপলাভ করল। আর এরই ধারাবাহিকতায় এল ইতিহাসের ভয়ংকরতম শ্রমিকশ্রেণি বিরোধী লাইন যা এর আগে কোন কম্যুনিস্ট কোনদিন কল্পনাও করতে পারেননি: ঘোষিত হ'ল: একদেশে সমাজতন্ত্র সম্ভব! যদি একদেশে সমাজতন্ত্র সম্ভব হয় তাহলে আন্তর্জাতিকের দরকার থাকে না। সেটা আর দুনিয়ার শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী সংগ্রামকে নেতৃত্ব দিতে পারেনা।
ইতিহাসের সেই পর্বে তৃতীয় আন্তর্জাতিকের মধ্যে কি তবে কোন ডিবেট ছিল না? কোন অংশই কি সেদিন ছিল না যারা দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মধ্যে লেনিনেরা যা ভূমিকা পালন করেছিলেন সেই একই ভূমিকায় কমিনর্টানের মধ্যে প্রলেতারীয় লাইনকে তুলে ধরেছেন, আন্তর্জাতিক শ্রেণি লাইনকে প্রাণপণে রক্ষা করার লড়াই করেছেন? আমরা কি কখনও তাদের ইতিহাস ঘেঁটে দেখেছি? আসলে আবারো আমরা দেখব দুটি ধারার বিভাজন: একটি ধারা যা শ্রমিক শ্রেণির নামে বুরজোয়াদেরই স্বার্থরক্ষাকারী ধারা যাদেরকে আজ আমরা বামপন্থী হিসেবে চিনি এবং এদের সাথে কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রামের কোন সম্পর্ক নেই। অপর ধারা যেটা কমিনটার্ণের মূল মার্কসীয় ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে, প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাকে একমূহুর্তের জন্যও পরিত্যাগ করেনি। বরং যাদেরকে ইন্টারন্যাসনাল থেকে বের ক'রে দেওয়া হয়েছিল বা যারা অধঃপতিত হতে থাকা ইন্টান্যাশনাল থেকে নিজেরাই বেরিয়ে এসেছিল শ্রমিকশ্রেণির অবস্থানকে রক্ষা করতে।এদের মধ্যে ইটালিয়ান লেফ্ট্, জার্মান লেফ্ট্ ইত্যাদি অংশের ঐতিহাসিক ভূমিকা অপরিসীম। ইতিহাসে এরা কম্যুনিস্ট লেফ্ট্ নামে পরিচিত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই দুই ধারার মৌলিক অবস্থানই আমাদের নিশ্চিতভাবে চিনতে সাহায্য করে কোন্ ধারাটি প্রলেতারিয়েতের বিপ্লবী অংশের প্রতিনিধিত্ব করেছে। আমরা জানি তৃতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেসে সকলেই " সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে কোন পক্ষ নেওয়া নয়, আসল কাজ তাকে গৃহযুদ্ধে পরিণত করা" এই অবস্থান গ্রহণ করেছিল কারণ মার্কসের ভাষায় প্রলেতারিয়েতের কোন ‘পিতৃভূমি" নেই, থাকতে পারেনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই অবস্থানকে আঁকড়ে ধরার আহ্বান রেখেছিল কারা? সেই মাইনরিটি অংশ যারা লেনিন রোজা ইত্যাদিদের যোগ্য উত্তরসূরি। এই মাইনরিটি ধারার নাম কী? ইতিহাসে এদের নামকরণ হয়েছে কম্যুনিস্ট লেফ্ট্। বিপরীতে স্ট্যালিনের আহ্বান কী ছিল? পিতৃভূমি রক্ষার লড়াই। এ পিতৃভূমি কার? নিশ্চয়ই বুরজোয়ার রাশিয়া যার একটি অংশ।, নিশ্চয়ই সারা পৃথিবী জুড়ে শ্রমিকশ্রেণির মানুষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়ার চক্রান্ত বুরজোয়া রাজনীতিরই অঙ্গ। এই রাজনীতিই কম্যুনিস্ট লেফ্টদের সংগ্রামের ইতিহাস মুছে দেওয়ার চেষ্টা করেছৈ। মার্কসবাদের নামে একটি ধারা সারা পৃথিবীতে লালন করেছে বামপন্থী দলগুলো, যাদের ভিত্তি হল অধঃপতিত হতে থাকা কম্যুনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের রাজনৈতিক অবস্থানগুলো।
একদিন দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক থেকে লেনিনদের একটি ছোট্ট অংশ বেরিয়ে এসেছিলেন শ্রমিকশ্রেণির প্রকৃত অবস্থানকে আঁকড়ে ধ'রে, ঠিক তেমনই সেই বিপ্লবীদের প্রকৃত মার্কসীয় ধারাকে অব্যাহত রাখার জন্য অধঃপতিত তৃতীয় আন্তর্জাতিকের রাজনীতিকে পরিত্যাগ ক'রে শ্রমিকশ্রেণির প্রকৃত আন্তর্জাতিকতার অবস্থানকে গ্রহণ ক'রে এবং তাকে বিকশিত ক'রে তোলার কাজে যাঁরা হাত লাগিয়েছিলেন তাঁরাই ‘কম্যুনিস্ট লেফ্ট্ কারেন্ট"। এঁরা বামপন্থী নন, এঁদের গ্রূপ বা কারেন্ট কোন শ্ট্যালিনীয় বা মাওবাদী বা ট্রটস্কিবাদী অফিসিয়াল ধারাকে প্রতিনিধিত্ব করে না, এরা হ'ল কম্যুনিস্ট লীগ থেকে শুরু ক'রে, তিনটি আন্তর্জাতিকের যা কিছু বিপ্লবী ঐতিহ্য তারই ধারাবাহিকতার ফসল, তারই প্রকৃত উত্তরাধিকারী: এখানেই বামপন্থার সঙ্গে কম্যুনিস্ট লেফ্টের মৌলিক তফাৎ। বিপ্লববিরোধী রাজনীতির বিপুল ঢেউয়ের তলায় চাপা দিয়ে দেওয়া হয়েছে এদের সমস্ত প্রয়াসকে। ইন্টারন্যাশানাল কম্যুনিস্ট কারেন্ট সেই কম্যুনিস্ট লেফ্টের অংশ, তাদেরই আরধ্য কাজেরই ধারাবাহিকতায় আইসিসি তার আজকের কর্মকান্ড পরিচালনা করছে। লেনিন যে কম্যুনিস্ট লেফ্টদের ছেলেমানুষ বলেছিলেন ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে তাদের অবস্থানই আজ আরো সুসংহত এবং সত্যরূপে প্রকাশিত হয়েছে। স্পষ্টতই, বামপন্থার হাজার ভ্যারাইটির মধ্যে এবং তাদের থেকে ভেঙে বেরিয়ে আসা হাজারটা দল উপদল থেকে বা আপাত রাডিক্যাল অতিবামপন্থা, তৃতীয় ধারা, চতুর্থ ধারা ইত্যাদির মধ্যে আমাদের কম্যুনিজমের জন্য সংগ্রামের একটি কণাও খুঁজে পাওয়া যাবে না, কেননা তাদের প্রতিটি অবস্থানই আজকের যুগে সেকেলে হয়ে পড়েছে তা সে যতই মার্কসবাদের নাম দিয়ে বিশুদ্ধ করে তোলার চেষ্টা হোক। বিপরীতে কম্যুনিস্ট লেফ্টরাই প্রকৃতঅর্থে কম্যুনিজমের সংগ্রাম বিকাশের ধারার প্রতিনিধিত্ব করেছে এবং করছে। এইসব বামপন্থী দলের অস্তিত্ব আজ কোন না কোনভাবে বুরজোয়াদেরই স্বার্থ সুরক্ষিত করতে বাধ্য। যদিও এইসব বামপন্থী দলে যুক্ত মানুষের মধ্যে অনেক মানুষ আছেন যাঁরা অকৃত্রিম সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গেই কমিউনজিমের জন্য সংগ্রাম করতে চান।
সুতরাং আজ কমিউনিজমের জন্য সংগ্রামে রত মানুষের কাছে ইতিহাসের একটি সত্য উপলব্ধি করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে যে বামপন্থার সঙ্গে কমিউনিজমের জন্য সংগ্রামের কোন সম্পর্ক নেই। যাঁরা দীর্ঘ সময় ধ'রে কোন না কোনভাবে এই কাজে রত আছেন বা থাকতে চান তাঁদের প্রয়াসের সততায় কোন সন্দেহই থাকতে পারেনা। তাই তাঁদের যুক্তিবোধ, মার্কসীয় আলোকে সবকিছুকে বারাবার ফিরে দেখার যে প্রয়াস তাকে স্বাগত জানিয়ে আশা করব আসুন আমরা খোলামেলা আলোচনার ভেতর দিয়ে স্বচ্ছতর হবার চেষ্টা করি। আমরা কেউই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর নিয়ে বসে নেই, কিন্তু প্রলেতারিয়েতের কাছে যৌথ আলোচনার ভেতর দিয়ে সঠিকতায় পৌঁছোনোর প্রয়াস সর্বদাই ছিল, আছে, থাকবে।
উপস্থাপনার পর্ব শেষ। আমরা আশা করব সকলের সম্মিলিত আলোচনায় আজকের সভা প্রাণবন্ত, ফলপ্রসূ হয়ে উঠবে এবং ভারতবর্ষে প্রলেতারীয় রাজনৈতিক চর্চার ক্ষেত্রে তা একটি সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে। এখানে আপনাদের মতামত, প্রশ্ন, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, বিরোধ যা আছে তা নির্দ্বিধায় রাখার অনুরোধ করছি।
অভিনন্দনসহ,
ইন্টারন্যাশনাল কম্যুনিস্ট কারেন্ট
২৭ ০৪ ০৮